যেন লোহার সুড়ঙ্গ পথ। হর্ন বাজিয়ে ট্রেন চলেছে সে পথে। পাকশী রেলস্টেশনে দাঁড়িয়ে দৃশ্যটি দেখলে এমনই মনে হবে। ইতিহাসের সাক্ষী ঈশ্বরদীর পাকশীতে প্রমত্তা পদ্মা নদীর বক্ষে মাথা উঁচু করে দাঁড়িয়ে থাকা হার্ডিঞ্জ ব্রিজের বয়স শতবর্ষ পূর্ণ হওয়ার দ্বারপ্রান্তে। আর দুই বছর পরেই স্টেশনটির বয়স হবে ১০০ বছর। স্টেশনটি আর দশটি স্টেশনের মতো নয়। এ যেন ব্রিটিশ আমলের ইট-সুরকির লাল দালান। চারপাশে সবুজ বৃক্ষরাজি। টিকিট কাউন্টার, ওয়েটিং রুমসহ অন্যান্য কক্ষ সমতলে। আর ট্রেনে উঠতে হয় স্টেশন থেকে প্রায় ৩০ ফুট উপরে গিয়ে। অনেকটাই দার্জিলিংয়ের পাহাড়ি স্টেশনের মতো। আঁকাবাঁকা সিঁড়ি বেয়ে উপরে উঠতে হয়।
পূর্বকথা
একশ’ বছর আগে পরাধীন উপমহাদেশে পূর্ব বাংলার সঙ্গে কলকাতা এবং অন্যান্য স্থানের যোগাযোগের মূল লক্ষ্যই ছিল বাণিজ্যিক সমৃদ্ধি। এশিয়ার বৃহত্তম রেল সেতু হার্ডিঞ্জ ব্রিজ এ দেশের উত্তর ও পশ্চিমাঞ্চলের সাথে রেল যোগাযোগের ক্ষেত্রে বৈপ্লবিক পরিবর্তন এনেছে। এপারে ঈশ্বরদীর সাঁড়াঘাট এবং ওপারে ভেড়ামারার দামুকদিয়া-রাইটা ঘাটের মাঝে সেতুবন্ধের সৃষ্টি করেছে এই হার্ডিঞ্জ ব্রিজ। আর নিচ দিয়ে বয়ে চলেছে প্রমত্তা পদ্মা নদী।
এক সময় অবিভক্ত ভারতের পূর্ববঙ্গের সাথে কলকাতার যোগাযোগ বাহন ছিল কেবল জাহাজ। জাহাজগুলো নারায়ণগঞ্জ বন্দর থেকে ছেড়ে সাঁড়া, দামুকদিয়া ও রাইটা ঘাট হয়ে কলকাতা বন্দরে গিয়ে পৌঁছত। এ অঞ্চলের শাক-সবজি, মাছ, মাংস থেকে শুরু করে বিভিন্ন প্রকার কাঁচামাল কলকাতা যেত। এভাবেই এ অঞ্চলের সাথে কলকাতার আত্মিক সম্পর্ক গড়ে ওঠে। পাকিস্তান-ভারত বিভক্তির পূর্বলগ্ন পর্যন্ত এ অবস্থা বলবত ছিল।
প্রস্তাবনা
একদিকে ব্যবসা-বাণিজ্য, অপরদিকে পর্যটক তথা অবিভক্ত ভারতের পূর্বাঞ্চলীয় রাজ্য আসাম, ত্রিপুরা, নাগাল্যান্ড ও উত্তর পূর্ববঙ্গের সঙ্গে কলকাতা দিল্লির সহজ যোগাযোগের কথা বিবেচনা করে ব্রিটিশ শাসিত ভারত সরকার ১৮৮৯ সালে পদ্মা নদীর উপর দিয়ে সেতু তৈরির প্রস্তাব পেশ করে। ১৯০৮ সালে সেতু নির্মাণের মঞ্জুরি লাভের পর প্রধান প্রকৌশলী হিসেবে ব্রিটিশ প্রকৌশলী স্যার রবার্ট গেইলস হার্ডিঞ্জ ব্রিজ নির্মাণের দায়িত্ব গ্রহণ করেন। ১৯০৯ সালে পদ্মায় সেতু নির্মাণের জন্য সার্ভে করা হয়। ১৯১০-১১ সালে প্রথম কাজের মৌসুম শুরু হলে ভয়াল পদ্মার দুই তীরে সেতু রক্ষা বাঁধ নির্মাণের প্রয়োজনীয়তা দেখা দেয়। ফলে মূল সেতুর কাজ শুরু হয় পরের বছর।

প্রকল্প প্রণয়ন
সেতুটির প্রস্তাবের উপর প্রথম প্রকল্প প্রণয়ন করেন স্যার এসএম রেনডলস। সেতু নকশা প্রণয়ন করেন প্রধান প্রকৌশলী স্যার রবার্ট উইলিয়াম গেইলস। প্রথমে সেতুটির কাজ শুরু হয় বর্তমান স্থান থেকে ১ কিলোমিটার দক্ষিণে। প্রাথমিক কিছু কাজ হওয়ার পর স্থান পরিবর্তন করে বর্তমান স্থানে নিয়ে আসা হয়। সেতুতে রয়েছে মূল পনেরোটি স্প্যান, এর প্রতিটি বিয়ারিংদ্বয়ের মধ্যবর্তী দৈর্ঘ্য ৩শ’ ৪৫ ফুট এবং উচ্চতা ৫২ ফুট। প্রতিটি স্প্যানের ওজন ১ হাজার ২শ’ ৫০ টন, রেললাইনসহ ওজন ১ হাজার ৩শ’ টন। সেতুটিতে পনেরোটি স্প্যান ছাড়াও দু’পাশে রয়েছে ৩টি করে অতিরিক্ত ল্যান্ড স্প্যান। এ ছাড়াও দুটি বিয়ারিংয়ের মধ্যবর্তী দৈর্ঘ্য ৭৫ ফুট। সেতুটির মোট দৈর্ঘ্য ৫ হাজার ৮শ’ ৯৪ ফুট অর্থাৎ ১ মাইলের কিছু বেশি।
নির্মাণ কৌশল
সেতুটি নির্মাণের ঠিকাদার ছিলেন ব্রেইথ ওয়ালটি এন্ড ক্রিক। সেতু নির্মাণের চেয়েও নদীর গতি নিয়ন্ত্রণ করা কম কষ্টসাধ্য ছিল না। প্রকৃতপক্ষে বড় সমস্যা ছিল প্রমত্তা পদ্মার গতিকে নিয়ন্ত্রণ করে স্থায়ীভাবে প্রস্তাবিত সেতুর নিচ দিয়ে নিয়ে যাওয়া। সেতু নির্মাণের ১শ’ বছর পর আজো এ সেতু নির্মাণের কাজ বা রিভার ট্রেনিং ওয়ার্ক পৃথিবীর প্রকৌশলীদের নতুন ধরনের অনুপ্রেরণা যোগায়। ১৯১২ সালে সেতুর গাইড ব্যাঙ্ক নির্মাণ শুরু হয়। এই গাইড ব্যাঙ্ক ৪/৫ মাইল উজান থেকে বেঁধে আসা হয়। সে বছরই সেতুর গার্ডার নির্মাণের জন্য পাঁচটি কূপ খনন করা হয় এবং পরের বছর সাতটি কূপ খনন শুরু হয়। তার পর লোহা ও সিমেন্টের কংক্রিটের বিশাল পায়াগুলো নির্মিত হয়। এই সেতু নির্মাণ করতে পদ্মার উপর স্টিমার বার্জ নিয়ে আসা হয়।
ব্যবহৃত উপকরণ
সে সময় দিন-রাত কাজ করার পর ব্রিজ নির্মাণ ও সেতু রক্ষা বাঁধের জন্য মাটির প্রয়োজন হয় ১.৬ কোটি ঘনফুট এবং নদী নিয়ন্ত্রণে প্রয়োজন হয় ৩ কোটি ৮৬ লাখ ঘনফুট মাটির। মোট পাথর প্রয়োজন হয় ৩ কোটি ৮ লাখ ঘনফুট। মোট ইটের গাঁথুনির কাজ হয় ২ লাখ ৯৯ হাজার টন। মোট ইস্পাত ব্যবহৃত হয় ৩০ লাখ টন। মোট সিমেন্ট ব্যবহৃত হয় ১ লাখ ৭০ হাজার ড্রাম ফিল্ড সিমেন্ট।
নির্মাণ ব্যয়
তৎকালীন হিসেবে সেতু তৈরির ব্যয় হয় মূল স্প্যানের জন্য ১ কোটি ৮০ লাখ ৫৪ হাজার ৭শ’ ৯৬ টাকা। এটি স্থাপনের জন্য ৫ লাখ ১০ হাজার ৮শ’ ৪৯ টাকা, নদী নিয়ন্ত্রণের জন্য ৯৪ লাখ ৮ হাজার ৩শ’ ৪৬ টাকা। দুই পাশের রেললাইনের জন্য ৭১ লাখ ৫৫ হাজার ১শ’ ৭৩ টাকা অর্থাৎ সর্বমোট ৩ কোটি ৫১ লাখ ২৯ হাজার ১শ’ ৬৪ টাকা ব্যয় হয়।
ভিত্তির গভীরতা
হার্ডিঞ্জ সেতুর বিশেষত্ব হচ্ছে এর ভিত্তির গভীরতা। বাংলাদেশের নরম পলি মাটিতে বড় স্প্যানের সেতু গড়তে ভিত্তির গভীরতা চাই প্রচুর। ভিত্তির জন্য দুটো কুয়ো বসানো হয়। একটি পানির সর্বনিম্ন সীমা থেকে ১শ’ ৬০ ফুট নিচে এবং অপরটি বসানো হয় ১শ’ ৫০ ফুট নিচে। ১৫ নম্বর সেতু স্তরের কুয়ো স্থাপিত হয়েছে পানির নিম্নসীমা থেকে ১শ’ ৫০ দশমিক ৬০ ফুট নিচে এবং সর্বোচ্চ সীমা থেকে ১শ’ ৯০ দশমিক ৬০ ফুট অর্থাৎ সমুদ্রের গড় উচ্চতা থেকে ১শ’ ৪০ ফুট নিচে। সেতু তৈরিকালে এ ধরনের ভিত্তির জন্য এটিই ছিল পৃথিবীর গভীরতম।
উদ্বোধন
১৯১২ সালের ফেব্রæয়ারি মাসে প্রকল্পটিতে কর্মী সংখ্যা ছিল ২৪ হাজার ৪শ’। এই ২৪ হাজার ৪শ’ শ্রমিকের দীর্ঘ ৫ বছরের অক্লান্ত পরিশ্রমের পর ১৯১৫ সালে সেতু নির্মাণ কাজ শেষ হয়। ওই সময়ে ইংরেজি নবর্ষের দিনে অর্থাৎ ১ জানুয়ারি ১৯১৫ সালে ১ ডাউন লাইন দিয়ে প্রথম চালু হয় মাল গাড়ি। দুই মাস পরেই ৪ মার্চ ১৯১৫ সালে সেতুর উপর ডবল রেললাইন দিয়ে যাত্রীবাহী গাড়ি চলাচলের উদ্বোধন করেন তৎকালীন ভাইসরয় লর্ড হার্ডিঞ্জ, যার নামে সেতুটির নামকরণ হয়েছে হার্ডিঞ্জ ব্রিজ।
যুদ্ধে ক্ষতিগ্রস্ত
বিজয় অর্জনের মাত্র ৫ দিন আগে, ১৯৭১ সালের ১১ ডিসেম্বর ভারতীয় বিমান বাহিনীর বোমার আঘাতে ১২ নং স্প্যানটি দুমড়ে মুচড়ে ভেঙে পদ্মা নদীতে পড়ে যায়। আঘাতপ্রাপ্ত হয়ে ১৫ নং স্প্যানটির ক্রসগার্ডার ও দুটো স্ট্রিকারও ক্ষতিগ্রস্ত হয়। এ ছাড়া দুই নং সেতু স্তরের উপরের স্প্যানের ট্রাসেলটিও শেলের আঘাতে ক্ষতিগ্রস্ত হয়।
পুনর্নির্মাণ
স্বাধীনতার পর ব্রিটিশ সরকার অতিদ্রুততার সঙ্গে তাদের নিজ খরচে বিশ্ব সংস্থার মাধ্যমে সিঙ্গাপুরের বিখ্যাত জাহাজ উদ্ধারকারী কোম্পানি সেলকোকে দিয়ে উদ্ধার কাজ করে। উল্লেখ্য, হার্ডিঞ্জ ব্রিজ পুনর্নির্মাণের কাজে যারা জড়িত ছিলেন তাদের মধ্যে ভারতের পূর্ব রেলওয়ে মন্ত্রী এইচ কে ব্যানার্জী, চিফ ইঞ্জিনিয়ার আর কে এম কে সিংহ রায়, ডিভিশনাল ইঞ্জিনিয়ার ডিজাইন শ্রী পিসিজি মাঝি উল্লেখযোগ্য। যুদ্ধবিধ্বস্ত তৎকালীন বাংলাদেশে রেলওয়েকে যারা নবজীবন দান করেন তারা হচ্ছেন তৎকালীন বাংলাদেশ রেলওয়ে বোর্ডের চেয়ারম্যান আঃ মুহিত চৌধুরী, মেম্বার এম এ গফুর ইঞ্জিনিয়ার, মেম্বর সৈয়দ মর্তুজা হোসেন প্রমুখ। হার্ডিঞ্জ ব্রিজ পুনর্নির্মাণের কাজে বাংলাদেশ রেলওয়ের আরো যারা জড়িত ছিলেন তাদের মধ্যে চিফ ইঞ্জিনিয়ার আমজাদ আলী, এম রহমান, ডিভিশনাল সুপারিনটেনডেন্ট সৈয়দ হোসেন এবং ব্রিজ ইঞ্জিনিয়ার এম মুনাফ।

রেল পারাপার
বহু ত্যাগ ও পরিশ্রমের ফলে স্বাধীনতা-উত্তর এ দেশে প্রমত্তা পদ্মার উপর দিয়ে আবার রেল পারাপার শুরু হয় ১২ অক্টোবর ১৯৭২ সালে। বর্তমানে বাংলাদেশের দর্শনীয় স্থানগুলোর মধ্যে হার্ডিঞ্জ ব্রিজ অন্যতম। প্রতিদিন দূরদূরান্তের বহু মানুষ এবং বিদেশি পর্যটক হার্ডিঞ্জ ব্রিজ দেখতে আসেন। শীত মৌসুমে এখানে পিকনিক করতে আসেন অনেকে। বর্ষার সময় প্রমত্তা পদ্মা নদীর ভয়াল রূপ মানুষের হৃদয়ে ভয়ের সঞ্চার করে। জেলেদের জালে ধরা পড়ে মাছের রাজা রুপালি ইলিশ। প্রতিদিন হাজার হাজার দর্শনার্থী হার্ডিঞ্জ ব্রিজের নিচে এসে এ দৃশ্য দেখে মুগ্ধ হয়। ঈশ্বরদী উপজেলার পাকশীতে অবস্থিত এশিয়ার বৃহত্তম রেল সেতু হার্ডিঞ্জ ব্রিজ এ দেশের উত্তর ও পশ্চিমাঞ্চলের সাথে রেল যোগাযোগের ক্ষেত্রে বৈপ্লবিক পরিবর্তন এনেছে। এপারে ঈশ্বরদী সাঁড়াঘাট এবং ওপারে ভেড়ামারার দামুকদিয়া-রাইটা ঘাটের মাঝে সেতুবন্ধের সৃষ্টি করেছে এই হার্ডিঞ্জ ব্রিজ। আর নিচ দিয়ে বয়ে চলেছে প্রমত্তা পদ্মা।
এখনকার অবস্থা
পাকশী হার্ডিঞ্জ ব্রিজের নিচ থেকে বালু উত্তোলন ও দেদার মাটি কাটার ফলে ব্রিজটি চরম হুমকির মুখে পড়েছে। অথচ গাইড ব্যাঙ্ক এলাকার দুই হাজার ফুট এবং ব্রিজের স্প্যান থেকে এক কিলোমিটারের মধ্যে বালু উত্তোলন সম্পূর্ণ নিষিদ্ধ করা হয়েছে। পাকশী বিভাগীয় রেল সদর দফতরের সেতু প্রকৌশলী এবং রেলওয়ে কর্মকর্তারা এ নিয়ে উদ্বেগ প্রকাশ করলেও বালু উত্তোলন বন্ধে তারা কোনো ব্যবস্থা নিতে পারছেন না।
মেহেদী হাসান
ই-মেইল :[email protected]
কৃতজ্ঞতা :
স্টেশন ম্যানেজার, কমলাপুর রেলওয়ে স্টেশন, ঢাকা।
প্রকাশকাল: বন্ধন ৩১ তম সংখ্যা, নভেম্বর ২০১২