ইতিহাসসমৃদ্ধ সুপ্রাচীন জনপদ বাংলাদেশ। যুগ যুগ ধরে এখানে বাস করে আসছে জাতি-ধর্মনির্বিশেষে বৈচিত্র্যময় নানা জনগোষ্ঠী। বঙ্গের নাম খুঁজে পাওয়া যায় দুই হাজার বছর আগে রচিত আরব্য সাহিত্যের উপাখ্যানে; পর্তুগিজ সাহিত্যে। আর্য জাতিগোষ্ঠী থেকে শুরু করে বৌদ্ধ ভিক্ষুদের বসতিও ছিল এই বাংলায়। এখানেই একসময় বসত শুরু করে মুসলিম শাসকেরা। এরপর কেটেছে বেশ কয়েক বছর। বঙ্গ তার অঙ্গে অঙ্গে ধারণ করছে ফেলে আসা সব হিরন্ময় ইতিকথা।
উপমহাদেশে ইসলামের আগমন ইখতিয়ার উদ্দিন মোহাম্মদ বিন বখতিয়ার খিলজির বাংলা আক্রমণের সূত্র ধরে। কিন্তু আগমনটা ছিল শুধুই রাজনৈতিক। এর আগ থেকেই এখানে আসত আরব সওদাগরেরা। আরব্য ইতিহাসের বিভিন্ন বইয়ে ‘বরকন্দ ঈ হরিকেল’-এর নাম পাওয়া যায়, যার বর্তমান নাম ‘চট্টগ্রাম সমুদ্রবন্দর’। এখানে ইসলামের আগমনের সঙ্গে সঙ্গে গড়ে উঠতে শুরু করে বিভিন্ন মসজিদ। সে সময় ধর্মপ্রাণ মুসলমানদের সুবিধার্থে রাজা-বাদশাহরা মসজিদ তৈরি করতেন। মসজিদে নামাজ পড়তে আসতেন এলাকার মুসল্লিরা।
কিন্তু বাংলায় মূলত সুন্দর স্থাপত্যকলার মসজিদ স্থাপন শুরু হয় মোগল আমলে। এ অঞ্চল দীর্ঘ সময় শাসন করেছে মোগলরা। আর বাংলায় এসেই মোগলরা বিভিন্ন স্থানে মসজিদ আর দুর্গ গড়তে শুরু করে, যার মাঝে মোগলের পাশাপাশি ইরানি স্থাপত্যরীতির বিশেষ বৈশিষ্ট্য ছিল। বাংলায় এসে মোগল স্থাপত্যকলার রীতিতে পরিবর্তন আসে। বিশেষ করে এই এলাকার মাটি এবং আবহাওয়ার কাছে অনেকটাই নতিস্বীকার করে মোগলরা। ফলে এখানকার অধিবাসীদের মতো করে এখানে স্থাপত্যকলা গড়তে শুরু করে ওরা। যার মধ্যে তিনটি মসজিদের স্থাপত্যশৈলী স্বমহিমায় সমুজ্জ্বল।

তারা মসজিদ
পুরান ঢাকার আরমানিটোলা স্কুলের মাঠের পাশে মাথা তুলে দাঁড়িয়ে আছে ঐতিহ্যবাহী এ মসজিদ। এর সামনেই রয়েছে একটি বিশালাকার তারকা। এই তারকা থেকেই কিংবা মসজিদের গায়ে খচিত তারা থেকে মসজিদটির নাম হয়েছে তারা মসজিদ বা সিতারা মসজিদ।
কথিত আছে মির্জা গোলাম পীর কর্তৃক ১৯ শতকের শুরুতে মসজিদটি নির্মিত। তবে তখন শুধু এটির মূল অংশটিই ছিল। তারপর ধীরে ধীরে যুক্ত হয়েছে এর অন্যান্য অংশ। প্রথমে শুধুই মিনার আর পেঁয়াজ ডোমগুলো থাকলেও ধীরে ধীরে এর গায়ে বসানো হয়েছে অনেক তারা। চীনামাটি দিয়ে মোড়ানো হয়েছে এর শরীর। সামনে সুন্দর করে সজ্জিত করা হয়েছে মাঠ। সেখানে বোনা হয়েছে সুন্দর একটি তারকা আকৃতির ঝরনা। ধীরে ধীরে বেড়েছে এর সৌন্দর্য।
তারা মসজিদের ভেতরের অংশটি (মূল স্থাপনা) ৩৫ ফুট বাই ১৫ ফুট। চার কোনায় চারটি মিনার বসানো আছে। আর মাঝখানে আছে পাঁচটি বড় ছোট ডোম। ডোমগুলো মোগল ও মোগল-পরবর্তী স্থাপত্যকলাকে নির্দেশ করে। গম্বুজগুলোর শৃঙ্গগুলো পদ্ম ও কলস এই দুই পদ্ধতির মিলিত রূপে নির্মিত।
মধ্যবর্তী বিশালাকার গম্বুজের পাশে ছোট গম্বুজগুলো বর্গক্ষেত্র তৈরি করে বসেছে একের পর এক। এভাবে একটা গম্বুজের সঙ্গে আরেকটা গম্বুজ মিলিত হয়ে পুরোনো অংশের ছাদটি ধরে রেখেছে।
বিংশ শতকের প্রথমার্ধে এসে সামনের সুন্দর অংশটি আলীজান বেপারী নামে একজন ধনকুবের তৈরি করে দেন। এই অংশে আছে চীনা টাইলস এবং চীনামাটির কারুকাজ। পুরো মসজিদ ভবনটি মোট ছয়টি পিলারের ওপর দাঁড়িয়ে আছে। অষ্টভুজাকৃতির পিলারগুলোর কারুকাজ দেখার মতো। পুরো মসজিদটির গা-জুড়ে ছড়িয়ে আছে শত শত তারকা। এই নীল রঙের তারাগুলোর সঙ্গে মোগল স্থাপত্যকলার কারুকাজ যেন পদ্মফুলের মতো সৌন্দর্য ছড়িয়ে চলেছে পুরান ঢাকার ঘিঞ্জি পরিবেশের মধ্যেও।

বাংলাদেশ সরকার এই মসজিদকে বিশেষ ভবন ঘোষণা করেনি এখন অবধি। দ্রুতই এর আশপাশে গড়ে উঠছে বিশাল বিশাল সব স্থাপনা। ফলে মসজিদটি ঢাকা পড়ে যাচ্ছে। আজ থেকে ২০ বছর আগেও যেখানে দূরের বংশাল থেকে দেখা যেত সুন্দর এই মসজিদটি, আজ সেখানে ২০ হাত সামনে থেকেই দেখা যায় না স্থাপনাটির সৌন্দর্য। মসজিদের গা-ঘেঁষে স্থাপনাগুলো জরুরি ভিত্তিতে ভেঙে মসজিদটির পুরোনো সৌন্দর্য ফিরিয়ে আনা উচিত বলেই মনে করছেন পুরাতত্ত¡বিদেরা।
তেঁতুলিয়া জামে মসজিদ
তেঁতুলিয়া জামে মসজিদ বা সালামতউল্লাহ মসজিদ মোগল ও ইউরোপীয় স্থাপত্যকলার সন্নিবেশিত অপূর্ব এক নিদর্শন। মসজিদটি সাতক্ষীরার তালা উপজেলায় অবস্থিত। পুরো তেঁতুলিয়াজুড়ে অবস্থিত ২২টি মসজিদের মধ্যে এটি অন্যতম। খান বাহাদুর মৌলভি কাজী সালামতউল্লাহ এই মসজিদ স্থাপন করেন ১৮৫৮-৫৯ সময়কালে। এখানে মূলত দুটি স্থাপনা ছিল। একটি খান বাহাদুর কাজী সালামতউল্লাহর বাসস্থান ও অন্যটি মসজিদ। কিন্তু এখন নেই সালামতউল্লাহর বাসস্থানটি। তবে কালের প্রবাহে সগৌরবে দাঁড়িয়ে আছে প্রায় ১৫০ বছরের পুরোনো এই স্থাপত্যশৈলীটি।
ছয় গম্বুজ আকৃতির এই মসজিদটি মোগল স্থাপত্যকলাকে মনে করিয়ে দেয়। সম্রাট টিপু সুলতানের আমলে এই স্থাপত্যকলার ব্যবহার শুরু হয় এবং বাংলায় তেঁতুলিয়ায় এসে এটির সৌন্দর্য প্রকাশ পায় পূর্ণমাত্রায়। ‘সালাম মঞ্জিল’ এখন আর না থাকলেও এটিসহ পুরো এ চত্বরটি ছিল মোগল স্থাপত্যকলার অপূর্ব এক নিদর্শন।
আঠারো শতকে দুই পিলারবিশিষ্ট স্থাপনা বাংলায় ছিল না বললেই চলে। মাত্রাতিরিক্ত ওজনবিশিষ্ট ছাদের রিইনফোর্সমেন্টকে মজবুত করে ধরে রাখার জন্য এটার ব্যবহার শুরু হয়। মসজিদটি একটি টেরাসের ওপর অবস্থিত, যার মাথায় আছে সাতটি গম্বুজ। প্রতিটি গম্বুজ প্রায় ২৫ ফুট চওড়া। অষ্টভুজাকৃতির মিনারগুলো মসজিদের চার কোনা থেকে উঠে গেছে চারটি ভাগে বিভক্ত হয়ে। এগুলোর ঠিক মাথায় বাংলার পূর্ববর্তী স্থাপত্যকলার কলস মুন্ড (kalasha finial) ব্যবহৃত হয়েছে। এখানে বলে রাখা ভালো, বাংলার ঐতিহ্যবাহী আলপনা এই মসজিদে বিভিন্ন আঙ্গিকে বিভিন্ন রূপে এসেছে এবং মসজিদের সৌন্দর্য বাড়িয়ে দিয়েছে বহুগুণ।

মসজিদের বিভিন্ন দেয়ালে আছে সুন্দর কিছু দরজা। এই দরজাগুলোতে এসেছে ইউরোপীয় স্থাপত্যকলার আবেশ। আর্চ দরজার ভেতর দিয়ে প্রবেশকালে চোখে পড়ে মোগল স্থাপত্যরীতির বৈশিষ্ট্যপূর্ণ কাচবিশিষ্ট দরজা। ভেতরে প্রবেশ করলেই চোখে পড়বে দুটি বিরাট চারকোনাকৃতির কলাম। কলামগুলো ছাদের ও পেঁয়াজাকৃতির ডোমের পুরো ভর নিজেদের ওপর নিয়ে দাঁড় করিয়ে রেখেছে স্থাপনাটিকে।
এই মসজিদের গায়ের কারুকাজ উন্নত শিল্পগুণসম্পন্ন। এখানে ইউরোপীয় দরজা ও আর্চ ডোমের সফঙ্গ মোগল পেঁয়াজাকৃতির গম্বুজ মিলে মিশে একাকার হয়ে গেছে। মসজিদের উত্তরে একটি পুকুরঘাট থাকলেও এখন পুকুরটি শুকিয়ে মৃতপ্রায়। তবে এখনো কালের সাক্ষী হয়ে দাঁড়িয়ে আছে তেঁতুলিয়া শাহি জামে মসজিদ, যেখানে এখনো মুসল্লিদের আনাগোনা হয় সেই দেড় শ বছর আগের মতো।
সাত গম্বুজ মসজিদ
রাজধানী ঢাকার বুড়িগঙ্গা নদীর তীরঘেঁষে এগিয়েছে মোগল সম্রাজ্য। আর এখানকার জাফরাবাদে (মোহাম্মদপুর) গড়ে উঠেছিল একটি ঐতিহাসিক মসজিদ। নাম সাত গাম্বাদ বা সাত গুম্বাদ মসজিদ, যা এখন সাত গম্বুজ মসজিদ নামে পরিচিত।
বুড়িগঙ্গা নদীর একটি পুরোনো শাখার কাছেই এই মসজিদটির অবস্থান। বর্তমানে সাত মসজিদ সড়ক এই সাত গম্বুজ মসজিদের নামে নামকৃত।

৮৮ ফুট দৈর্ঘ্য বাই ৮৫ ফুট প্রস্থবিশিষ্ট একটি বেইজের ওপর এই মসজিদটি দাঁড়িয়ে আছে। মোট তিনটি গম্বুজ ও চারটি মিনারসমৃদ্ধ এই মসজিদে আছে দুটি সিঁড়ি, যা দিয়ে মসজিদের দোতলায় উঠে নামাজ আদায় করা যায়। পশ্চিম দিক ব্যতীত এই মসজিদের তিনটি দিকই খোলা। তবে মূল দরজা পূর্বদিকে এবং বাকি দুই দিকের দরজা দিয়ে দুই দিকে বেরোনো যায়। দরজাগুলোর খিলানে আছে মোগল ও ইউরোপীয় স্থাপনার আদলে নির্মিত আর্চ।
এই মসজিদের চার কোনায় চারটি মিনারের ওপর স্থাপিত রয়েছে চারটি বিশালাকৃতির গম্বুজ। প্রতিটি গম্বুজ আনুমানিক ১২ ফুট। মাঝখানের গম্বুজটি আরও দুটি মাঝারি আকারের গম্বুজকে সঙ্গে নিয়ে মূল ছাদের ওপর অবস্থিত। প্রতিটি গম্বুজের গায়ে আছে মোগল স্থাপনার চিহ্ন। চারকোনায় চারটি গম্বুজে রয়েছে মোগল স্থাপত্যরীতির প্রচলিত জানালা ও খিলান। এবং গম্বুজগুলো পদ্ম চক্র (Lotus finial) তৈরি করে বসানো আছে ছাদের ওপর। পেঁয়াজাকৃতি গম্বুজগুলো মোগল ও মোগল-পরবর্তী সময়ের স্থাপনাকে নির্দেশ করে। এই মসজিদটি স্থান পেয়েছে বিভিন্ন জার্নালে। এটি মন কেড়েছিল অনেক পর্যটকেরও। ইংরেজদের ‘জ্বালাও-পোড়াও নীতি’র মধ্যেও এটির সৌন্দর্য ছিল অটুট।
ড. জেমস অ্যাটকিনসনকে এই মসজিদটি ভেনিসের কথা স্মরণ করিয়ে দিয়েছিলেন। তিনি এর গঠনের নিপুণতা, স্থাপত্য বৈশিষ্ট্য, আভিজাত্য এবং সহজতায় মুগ্ধ হয়ে বলেছিলেন, সময়, আগ্রাসী জঙ্গল ও বিরুদ্ধ প্রকৃতি যদিও স্থাপনাটির যথেষ্ট ক্ষতিসাধন করেছে, তথাপি একটি আধ্যাত্মিক স্নিগ্ধ গাম্ভীর্য একে ঘিরে রেখেছে।
স্যার চার্লস ডি’ওয়লি তাঁর আঁকা স্কেচে মন্তব্য করেছেন-
“rises immediately from the margin of the river, with an effect at once stately and picturesque. Its neglected domes and arches are now shattered by accidents, and crumbling to decay; yet in the general proportions and character of its architecture, the principles of elegance and simplicity appears to be combined … Time and vegetation, and storms and sunshine, have not only tinted it with rich variety, but so tempered the vividness of its hues, that a cool solemnity, suited to religious musing, still appears to prevail here.”

সাত গম্বুজ মসজিদের উপরিউক্ত ছবিটি The Graphic ম্যাগাজিনের, Page 544) ইলাস্ট্রেশন; মূল টাইটেল ছিল ‘Sketches of Ancient Buildings at Dacca, Bengal’. একই পৃষ্ঠায় চারটি স্কেচ ছিল। আর এই ছবিটির ক্যাপশন ছিল Ruins of Sath Musjid or Seven Dome Tample.
মসজিদটির সৌন্দর্য দিন দিন নিঃশেষ হয়ে যেতে শুরু করেছে মানুষের অবহেলায়। বাংলাদেশ বিল্ডিং কোড অনুসারে কোনো বিশেষ স্থাপনার একটি নির্দিষ্ট দূরত্ব পর্যন্ত কোনো বৃহৎ স্থাপনা নির্মাণের অনুমতি না থাকলেও এ এলাকায় গড়ে উঠেছে বহুতল ভবন। ফলে ধীরে ধীরে তা ধ্বংস হতে চলেছে। মসজিদের নামফলকটি হারিয়ে গেছে ২০ বছর আগেই। ফলে এটি কখন নির্মিত, তার আন্দাজ পাওয়া কষ্টকর। তবে বিশেষজ্ঞদের মতে, শায়েস্তা খাঁ কর্তৃক নির্মিত মসজিদটি ১৭শ শতক থেকে মাথা তুলে দাঁড়িয়ে আছে বাংলার বুকে। এর রূপ অহর্নিশ মুগ্ধ করছে অনেক পর্যটক ও স্থানীয় অধিবাসীদের।
স্থপতি রাজীব চৌধুরী
প্রকাশকাল: বন্ধন ৩৭ তম সংখ্যা, মে ২০১৩