পানাম সুবর্ণ সময়ের এলিজি ৩

শতবর্ষ বা আরও প্রাচীন নগর যদি হঠাৎ করেই আগের মতো হয়ে যেত! যদি হঠাৎ করেই এখানে প্রতিদিনের হাঁকডাক শুরু হতো সূর্য ওঠার সঙ্গে সঙ্গে! যদি ভোরের আলো ফোটার আগেই মসলিনের চরকির ঘটাঘট আওয়াজ আরম্ভ হতো! তবে কেমন হতো? সময়কে কখনো পেছনে ফিরিয়ে নেওয়া যায় না। ফিরিয়ে আনা যায় না মরে যাওয়া বা হারিয়ে যাওয়া শতবর্ষী মানুষদেরও। কিন্তু আমরা ফিরিয়ে আনতেই পারি ঐতিহ্যবাহী সেই স্থাপনাগুলোকে। ফিরিয়ে আনা কিন্তু সম্ভব। ফিরে এসেছে অনেক কিছুই। ফিরিয়ে আনা হয়েছে মিসরের বহু প্রাচীন পিরামিডের ভেতরকার পরিবেশ। ফিরিয়ে আনা হয়েছে প্রাচীনতম উপাসনালয়ের ভেতরের সেই পুরোনো আদল। কিন্তু আমাদের এখানে কি আমরা এমনটা করছি? করতে না পারার এ দায় কার ওপর বর্তায় বলতে পারেন?

দেশের এমন মহামূল্যমান সব সম্পদ আমরা তিলে তিলে ধ্বংস করছি নিজেরাই। আমরাই হত্যা করেছি আমাদের পর্যটনের অন্যতম তীর্থ পানামকেও। এখন চলছে  সীমানা প্রাচীর ঘিরে ইট দিয়ে গেঁথে একে অনাথ বানানোর চেষ্টা। কিন্তু কেন? আমরা কি পারতাম না পুরোনো এ বাড়িকে সুন্দর করে সাজিয়ে-গুছিয়ে চলমান মিউজিয়ামে রূপ দিতে? অবশ্যই পারতাম। কিন্তু দেশের সরকার ও সরকার স্থানীয় লোকজনদের সদিচ্ছা কখনো ছিল না এসব রক্ষা কিংবা সংস্কারে। উল্টো রাতের অন্ধকারে পুরোনো সব স্থাপনা গুঁড়িয়ে দিয়ে সেখানে নতুন করে আমরাই গড়ে তুলেছি নব স্থাপনা। ‘বিনা যুদ্ধে নাহি দেব সুচাগ্র মেদিনী’সুলভ মানসিকতার কারণে প্রায় হারিয়ে যেতে বসেছে সোনার নগর পানাম। পানামের প্রায় হারিয়ে যাওয়া নগরের একেবারে প্রাচীন কিন্তু সুবর্ণ কিছু স্মৃতি শেষ আখ্যানে।

পানামের কয়েকটি স্থাপনার মডেল
পানামের কয়েকটি স্থাপনার মডেল

মনসা মন্দির ও লক্ষ্মীজিউ মন্দির
পানামের পথে-প্রান্তরে ভ্রমণ করলেই চোখে পড়বে মনসা মন্দির। আনন্দ মোহন পোদ্দার হাউসে যাওয়ার পথে হঠাৎই চোখ আটকে গেল মন্দিরের প্রবেশপথে। প্রাচীন এ পথে হেঁটে গেলেই দেখা মিলবে পুরোনো সেই মন্দিরের। প্রাচীনত্ব এর এতটাই যে মন্দিরে নেই কোনো বিগ্রহ। আছে শুধুই স্থাপনার কঙ্কাল। সেই কঙ্কালের ভেতর থেকে বেরিয়ে আসা মন্দিরের পাশেই আছে লক্ষ্মীনারায়ণের মন্দির। আদতে ওখানে দুটো মন্দির পরপর স্থাপিত। এই মন্দির দুটোই দোতলা। দোতলা ভবনের দেয়ালগুলো পুরু। পুরু এ দেয়ালের মধ্যে একটা ফুটো দিয়ে মন্দিরের ভেতরে ঢোকা যায়। ঢুকলেই মনে হয় এখানে এককালে মা মনসার উদ্দেশে বলি হয়েছে শত শত পশু। মা মনসার এই পূজাঘরের পাশেই একেবারেই জীর্ণশীর্ণকায় লক্ষ্মীনারায়ণ মন্দির। মন্দির দুটোর স্ট্রাকচার পুরোটাই ইটের তৈরি। পুরু ২০ ইঞ্চি দেয়ালে সেই আমলের নিপুণ কারুকাজ। একেবারেই দক্ষিণী ও বঙ্গীয় আর্কিটেকচারের বাংলায়ন বলা চলে। ভেতরে গর্ভগৃহ ও কীর্তনালয় জন্য রয়েছে আলাদা কক্ষ। দুটো মন্দিরেরই ভেতর একেবারেই ভগ্ন দশা। কোনো রকমে টিকে আছে কালের সাক্ষী হয়ে।

কোম্পানি কুঠি
কোম্পানি কুঠির অপর নাম নীলকুঠি। বাংলাপিডিয়ার মতে, দালালপুরে অবস্থিত ইংরেজ ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির ফ্যাক্টরি ও অফিস ভবন ছিল এটি। দালালপুর পুলের কয়েক গজ উত্তরে রাস্তার পূর্ব পাশে ভবনটির অবস্থান। ইংরেজ ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি মসলিন বস্ত্র ক্রয়ের জন্য পানামে একটি কুঠি স্থাপন করে এবং এ জন্য প্রথম দিকে একটি বাড়িভাড়া নেয়। পরে বর্তমান ভবনটি নির্মাণ করে কোম্পানি এখানে তাদের দপ্তর ও গুদাম প্রতিষ্ঠা করে। পরবর্তী সময়ে ভবনটি নীল ব্যবসার কেন্দ্র হিসেবে ব্যবহার করা হয়।

মনসা মন্দির, মনসা ও লক্ষ্মীজিউ মন্দির
মনসা মন্দির, মনসা ও লক্ষ্মীজিউ মন্দির

কোম্পানি কুঠি ইটের তৈরি একটি চতুর্ভুজাকৃতির দোতলা ইমারত। এর অভ্যন্তর ভাগে রয়েছে খিলানশ্রেণী শোভিত ও প্রাকার বেষ্টিত অঙ্গন। অট্টালিকার সদর দেয়ালের সমতল বহির্ভাগ জানালা ও দরজার আকৃতিতে কুলঙ্গিত খিলান শোভিত। ইমারতের পশ্চাদভাগ নিরেট দেয়াল দিয়ে সুরক্ষিত। রাস্তার দিকে সম্মুখভাগে রয়েছে এর প্রধান প্রবেশপথ। এ ছাড়া উত্তর দিকের দেয়ালের মধ্যভাগে দোতলার সিঁড়ির পাশে রয়েছে অপর একটি প্রবেশপথ। ছাদ-পাঁচিলের বহির্গত অংশ সারিবদ্ধ মারলন নকশা শোভিত। সদর দেয়ালের মূল খিলানশ্রেণীর প্রান্তভাগ স্থানে স্থানে খাঁজকাটা নকশা দিয়ে সুশোভিত। ইমারতটি স্থানীয় অলংকরণসংবলিত মোগল স্থাপত্যের একটি অনন্য নির্দশন।

সোনারগাঁয়ের ইতিহাস গবেষক সামসুদ্দোহা চৌধুরী মতে, ১৭৬৫ থেকে ১৭৮০-এর মধ্যে এ কুঠি নির্মিত হয়েছিল। কৃত্রিম নীল আবিষ্কারের পরে নীল চাষ বন্ধ হয়ে গেলে এ কুঠি ব্যবহৃত হতো মসলিনের গোডাউন হিসেবে। জেমস টেইলরের লেখা থেকে জানা যায়, তিনি এ কুঠিতে মসলিন কারিগরদের তালিকা দেখেছিলেন।

পানাম সেতু
সেতুটি সোনারগাঁয়ের অন্তর্গত হাবিবপুরের পূর্ব দিকে কোম্পানিগঞ্জ ও বারি-মজলিশ গ্রামের মধ্যবর্তী পাকা রাস্তায় অবস্থিত। সেতুটি হাজীগঞ্জের সঙ্গে বৈদ্যের বাজারের সংযোগকারী কাঁচা সড়কে পঙ্খীরাজ খালের ওপর মোগল আমলে (১৭০০ শতক) নির্মিত। তিন খিলানবিশিষ্ট এই সেতুর মধ্যবর্তী খিলানটি অপেক্ষাকৃত প্রশস্ত ও উঁচু।

লক্ষীনারায়ণ মন্দিরের প্রবেশদ্বার
লক্ষীনারায়ণ মন্দিরের প্রবেশদ্বার

পানামের স্থাপত্য দীক্ষণ
পানাম নগরের স্থাপনাগুলো প্রাচীন বাংলার স্থাপনার গুণ ও নিয়মাবলির সমন্বয়। সে আমলে প্রাচীন দস্যুদের আক্রমণ ও অন্য সব নিত্যনৈমিত্তিক কারণে এ অঞ্চলের ঘরবাড়িগুলো ছিল অনেকটাই চাপা ও একের সঙ্গে আরেকটা লাগানো। একীভূত এসব বাড়ি দেখলে একটা বাড়ি বলে ভ্রম হতো। এটাকে কাজে লাগিয়ে শত্রু পক্ষকে কাবু করে দেয়ার প্রচলন ছিল। এই প্রাচীন রীতির প্রতিফলন ঘটেছে পানামে। একটি সরু রাস্তার আশপাশে গড়ে ওঠা প্রাচীন এই নগরের মধ্যে প্রতিটি বাড়িই প্রায় একের সঙ্গে আরেকটা লেগে থেকে নিজের স্বগুণে স্থাপিত হয়েছিল। আবার প্রতিটি বাড়ি নিজেদের কাছ থেকে ছিল সম্মানজনক দূরত্বে।

পানাম নগরের পরিকল্পনা নিখুঁত। নগরের পানি সরবরাহের জন্য দুই পাশে দুটি খাল ও পাঁচটি পুকুর আছে। প্রায় প্রতিটি বাড়িতেই আছে কুয়া বা কূপ। নগরকে জলাবদ্ধতামুক্ত রাখতে করা হয়েছে খালের দিকের ঢালু। প্রতিবেশীদের মধ্যে সম্প্রীতির ধারক ও বাহক এই সংস্কৃতিই পানামকে সমৃদ্ধ করে তুলেছিল বলে ঐতিহাসিকদের মত। পানামের বাড়িগুলোর মধ্যে রড আয়রন ও অন্যান্য বিল্ডিং ম্যাটেরিয়েলসের ব্যবহার মনে করিয়ে দেয় সে আমলের মানুষের রুচিশীলতা ও চারুশিল্পের প্রতি আগ্রহের কথা। এখানকার ড্রেনেজ সিস্টেমও ছিল দেখার মতো। ড্রেনের পানিগুলো গড়িয়ে চলে যাওয়ার ব্যবস্থা ছিল। প্রতিটি বাড়িতে ছিল সুন্দর শৌচাগার ও এর পানি সংরক্ষণের ব্যবস্থা। প্রতিটি বাড়ির সঙ্গেই এ রকম গর্ত দেখতে পাওয়া যেত যাতে পয়োনিষ্কাষণের জন্য স্যুয়ারেজ ট্যাংক ও আলাদা শ্যাফটে হিউম্যান ওয়েস্ট রাখার ব্যবস্থা ছিল। ঘরের ভেতর থেকে ময়লা-আবর্জনা এখানে এসে পড়ত। ধারণা করা, হয় শহর পরিষ্কার রাখতে প্রতিদিন এগুলো পরিষ্কার করে ফেলার ব্যবস্থা করা হতো।

কংক্রিট ও ইটের তৈরি ইনডিভিজুয়াল স্ট্রাকচার সিস্টেম ও কোনো কোনো স্থানে কমপ্লেক্স স্ট্রাকচারের বাড়িগুলোর পেছনে গেলেই এসব বাড়ির স্থাপত্যকর্মগুলোর সুচারু রূপ চোখে পড়ে। নগরের ভেতরে আবাসিক ভবন ছাড়াও আছে মসজিদ, মন্দির, গির্জা, মঠ, গোসলখানা, নাচঘর, পান্থশালা, চিত্রশালা, খাজাঞ্চিখানা, দরবার কক্ষ, গুপ্তপথ, বিচারালয়, পুরোনো জাদুঘর। এ ছাড়া আছে ৪০০ বছরের পুরোনো টাঁকশাল বাড়ি। সোনারগাঁ লোকশিল্প জাদুঘর থেকে পশ্চিম দিকে রয়েছে গোয়ালদী হোসেন শাহি মসজিদ। এ মসজিদটি সুলতান আলাউদ্দিন হোসেন শাহির শাসনামলে নির্মিত। মোগড়াপাড়া চৌরাস্তা দিয়ে একটু দক্ষিণ দিকে এগোলে রয়েছে আরও কিছু ইমারত, বারো আউলিয়ার মাজার, হজরত শাহ ইব্রাহিম দানিশ মন্দা ও তাঁর বংশধরদের মাজার, দমদম গ্রামে অবস্থিত দমদম দুর্গ ইত্যাদি। এ ছাড়া নগরের আশপাশে ছড়িয়ে আছে ঈসা খাঁ ও তাঁর ছেলে মুসা খাঁর প্রমোদ ভবন, ফতেহ শাহের মসজিদ, সোনাকান্দা দুর্গ, পঞ্চপিরের মাজার, কদম রসুল, চিলেকোঠাসহ বহু পুরাতাত্ত্বিক গুরুত্ববহ স্থাপনা।

কোম্পানি কুঠি ও ১৮৭০ সালে তোলা আলোকচিত্রে নীলকুঠি
কোম্পানি কুঠি ও ১৮৭০ সালে তোলা আলোকচিত্রে নীলকুঠি

পানাম কি সত্যিই হারিয়ে যাবে? পানামের কী হবে আজ থেকে বছর দশেক পরে? সোনারগাঁর আর্কিওলজি ডিপার্টমেন্ট থেকে বড় সরদারবাড়ির রিনোভেশন চলছে। এখনো শেষ হয়নি। শেষ হলে বলা যাবে আদতে কী হতে চলেছে পানামের। এটা কি এর সৌন্দর্য হারিয়ে ধবংস হবে আমাদেরই হাতে? নাকি একেবারেই নতুন রূপে ফিরবে বিশ্বদরবারে? এতে কি পুরো শহরটাকে মিউজিয়াম করে ফেলা হবে? নাকি কিছুই হবে না? এভাবেই তিলে তিলে ধ্বংস হবে? দেখার অপেক্ষা রইল। অপেক্ষা করছে মহাকালও। মানুষের সঙ্গে যার আজন্ম শত্রুতা। সৃষ্টিশীলতাকে গ্রাস করার জন্য যার অনন্ত অপেক্ষা। কে জিতবে? মননশীল বুদ্ধিবৃত্তি? নাকি দানবিক চৌর্যবৃত্তি ও দখলদারি? দেখার আমন্ত্রণ রইল। আপনি নিজেও এ খেলার একজন নিশ্চুপ দর্শক বটে! 

স্থপতি রাজীব চৌধুরী
আলোক চিত্রী: রোকনউদ্দৌলা ও রাজীব চৌধুরী

প্রকাশকাল: বন্ধন ৫৪ তম সংখ্যা, অক্টোবর ২০১৪

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Scroll to Top