গত দুই পর্বের বিস্তারিত আলোচনার পরিপ্রেক্ষিতে বলা যায়, একটি প্রকল্পের কাজ ভালোভাবে সম্পন্ন করার জন্য সঠিক পরিকল্পনা প্রণয়ন এবং তা বাস্তবায়ন নিশ্চিত করা জরুরি। তাই প্রতিটি প্রকল্প বাস্তবায়ন-পূর্ব এবং পরবর্তী পদক্ষেপের সব কাজ সুসম্পন্ন করতে সুনির্দিষ্ট কিছু নিয়মনীতি মেনে চলা অপরিহার্য, যা নিশ্চিত করার জন্য ‘পিডিসিএ’ (প্ল্যান-ডু-চেক-অ্যাক্ট) সাইকেল নিয়ন্ত্রণ এবং তার যথাযথ মূল্যায়ন নিশ্চিত করতে পর্যায়ক্রমে নিম্নোক্ত কাজগুলো সম্পাদন করা জরুরি। যেমন-
- সুনির্দিষ্ট এবং বিস্তারিত কর্মপরিকল্পনা প্রণয়ন করা
- প্রণীত কর্মপরিকল্পনা অনুযায়ী সব কাজ সম্পাদন করা
- পরিকল্পনা ও নিয়মমাফিক কাজ সম্পন্ন হয়েছে কি না চেক করা
- সম্পাদনকৃত কাজে কোনো ত্রুটিবিচ্যুতি আছে কি না পর্যবেক্ষণ করা
- পরিলক্ষিত ত্রæটিবিচ্যুতিসমূহ সংশোধন করা
- সর্বশেষে প্রকল্পের সার্বিক ব্যবহার উপযোগিতা সুনিশ্চিত করার পর সর্ব সাধারণের জন্য উন্মুক্ত করে দেওয়া।
- যাতে ব্যবহারকারী জনসাধারণ সর্বোচ্চ সুযোগ সুবিধা ভোগ করতে পারে।
সব প্রকল্প সুষ্ঠু ও কার্যকরীভাবে বাস্তবায়ন নিশ্চিত করার জন্য বিস্তারিত এবং সুচিন্তিতভাবে একটি কর্মপরিকল্পনা প্রণয়ন করতে পর্যায়ক্রমিকভাবে যে সব কাজ করা দরকার, তা ধারাবাহিকভাবে নিম্নে উল্লেখ করা হলো। যেমন-
- প্রস্তাবিত প্রকল্প এলাকাটি সরেজমিনে পরিদর্শন করা
- এলাকার ট্রাফিক চলাচল এবং লোক বসতির ঘনত্ব নির্ণয় করা
- বিদ্যমান অবকাঠামোসমূহ এবং পারিপাশ্বিক অবস্থা পর্যবেক্ষণ করা
- প্রস্তাবিত প্রকল্পের জন্য বিস্তারিত ডিজাইন এবং ড্রয়িং প্রস্তুত করা
- প্রকল্পের শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত নির্মাণকাল নির্ধারণ করা
- প্রয়োজনীয় নির্মাণসামগ্রীর উৎস নির্বাচন এবং গুণগত মান যাচাই করা
- প্রকল্পটি সুষ্ঠুভাবে সম্পাদনে সম্ভাব্য সর্বোচ্চ ব্যয় নিরূপণ করা
- টাকার উৎস নির্বাচন করাসহ প্রকল্পের প্রয়োজনীয়তা এবং সার্বিক সম্ভাব্যতা যাচাই করা ইত্যাদি
- এ ছাড়া, প্রকল্প বাস্তবায়নকালে-
- কাজ ও মালামালের গুণগত মান যাচাই করা
- প্রতিটি ক্ষেত্রে মালামাল ও সময়ের অপচয় রোধ করা এবং
- সব কাজে যথা সম্ভব ব্যয় নিয়ন্ত্রণ করা নিশ্চিত করতে হবে

প্রসঙ্গত উল্লেখ্য, উপরোল্লিখিত প্রতিটি ক্ষেত্রেই কিছু ফ্লেক্সিবিলিটি থাকতে পারে, তবে তা অবশ্যই একটি নির্ধারিত সীমার মধ্যে হতে হবে, যাতে প্রকল্পটি অনির্দিষ্টকালের জন্য ঝুলে না যায়।
অতএব, একটি প্রকল্পের কর্মপরিকল্পনা প্রণয়ণে উপরোল্লিখিত প্রতিটি কাজই সুচিন্তিত হওয়া বাঞ্ছনীয়। এ ক্ষেত্রে, কর্মপরিকল্পনা প্রণয়ন এবং প্রকল্প বাস্তবায়নে নিয়োজিত সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিবর্গের লব্ধ জ্ঞান এবং বাস্তব অভিজ্ঞতা থাকার বিষয়টি নিশ্চিত করতে হবে। বিশেষ করে প্রকল্প পরিচালক কিংবা টিম লিডার যা-ই বলি না কেন, তার বাস্তব জ্ঞান এবং যথাযথ অভিজ্ঞতা থাকা অপরিহার্য একটি বিষয়। মনে রাখা দরকার, প্রকল্পের কর্মপরিকল্পনা প্রণয়ন করা এবং বাস্তবায়নসংক্রান্ত প্রতিটি কাজ হতে হবে কোয়ালিটিসম্পন্ন, যেখানে যথার্থ জ্ঞান এবং অভিজ্ঞতার কোনো বিকল্প নেই। তাই, বিশ্বের অন্যতম কোয়ালিটি গুরু ‘জাপান’-এর ম্যানেজমেন্ট কনসেপ্ট অনুযায়ী টিম লিডার/প্রকল্প পরিচালক নির্বাচন/নিয়োগের ক্ষেত্রে একটি প্রবাদ আছে- ‘High focus on experience rather than intellectual’ অতীব গুরুত্বপূর্ণ একটি বিষয় এবং তা মেনে চলা জরুরি।
অথচ, আমাদের দেশে ‘টিম লিডার/প্রকল্প পরিচালক’ নিয়োগের ক্ষেত্রে স্বজনপ্রীতি এবং তোষামোদপ্রিয়তাই প্রাধান্য পেয়ে থাকে। এই টিম লিডার/প্রকল্প পরিচালক নিয়োগ দানের আগে তার লব্ধ জ্ঞান এবং বাস্তব অভিজ্ঞতাসমূহ যথাযথভাবে যাচাই করার বিষয়গুলো বিবেচনায় নেওয়া হয় বলে মনে হয় না। আর সেই সূত্র ধরে অন্যান্য লোকবল নিয়াগের ক্ষেত্রেও একই অবস্থা বিরাজ করে। ফলে, নিম্নলিখিত বিষয়গুলো যেমন-
- প্রকল্পের নির্মাণব্যয়
- সম্পাদনের কার্যকাল
- কাজের কোয়ালিটি
- প্রকল্পের কার্যকারিতা ইত্যাদি
প্রতিটি ক্ষেত্রেই বৈষম্য দেখা দেয় এবং প্রকল্পের সার্বিক গ্রহণযোগ্যতা লোপ পায়। তাই, যেকোনো প্রকল্প হাতে নেওয়ার আগে দক্ষ ও অভিজ্ঞ লোকবল নির্বাচন করা এবং নিয়োগ দেওয়ার বিষয়টি বিশেষভাবে বিচেনায় নেওয়া অপরিহার্য।

আমাদের দেশ ধনে, মানে, জ্ঞানে আজ অনেক সমৃদ্ধ। শুধু অব্যবস্থাপনা, দুর্নীতি, স্বজনপ্রীতি, আর অদূরদর্শিতাই আমাদের যোজন যোজন মাইল পেছনে ঠেলে দিচ্ছে। কবে আমাদের এ অবস্থার অবসান ঘটবে, কীভাবে নৈতিক উন্নতি হবে তা ভবিতব্যই ভালো জানে। যুগে যুগে নানা প্রবাদ বাক্য উঠে এসেছে, কিন্তু কোনো কাজে আসেনি। আমাদের কিছু ভালো গুণাবলি অর্জন করা জরুরি, যা বাস্তবায়নে দুর্নীতি দমন করা, অব্যবস্থাপনা নিরসন করা এবং সার্বিক আইনশৃঙ্খলা মেনে চলার ক্ষেত্রে উল্লেখযোগ্য কোনো উন্নতি হচ্ছে বলে প্রতীয়মান নয়, এর থেকে বড় দুর্ভাগ্য আর কী হতে পারে?
সবাই বলে মেধা পাচার হয়ে যাচ্ছে, অর্থ পাচার হয়ে যাচ্ছে। কিন্তু কেন হচ্ছে, কীভাবে হচ্ছে তা অনুসন্ধান করা এবং তার প্রতিরোধে কার্যকরী কোনো ব্যবস্থা নেওয়া হচ্ছে বলে মনে হয় না। তাই বলতে বাধা নেই, নানা অব্যবস্থাপনাই আমাদের সব অনিষ্টের মূল। অনেক আগের একটা প্রবাদ- ‘We are not poor, but poorly managed’। নানাবিধ সমস্যা বিরাজ করছে আমাদের চারপাশে। টোটাল কোয়ালিটি ম্যানেজমেন্ট (টিকিউএম) এর ভাষায়- ‘Problem is every where all around us, we should actively search them out and solve them eliminating it’s root causes’। অতএব, প্রকৃত অর্থে কোথায়, কিসে আমাদের সমস্যা তা বের করতে হবে, রুট কজ অ্যানালাইসিস করে তা নির্মূল করতে হবে, এটাই হোক আমাদের অভীষ্ট লক্ষ্য।
দিনে দিনে বেড়ে চলেছে সার্বিক অনিয়মের ভয়াবহতা আর অব্যবস্থাপনা। ফলে, দেশের প্রান্তিক উদ্যোক্তা আর ভোক্তারাই হচ্ছে সর্বোচ্চ ক্ষতির স্বীকার, ফায়দা লুটে নিচ্ছে মধ্যস্বত্বভোগীরা। অনিয়ন্ত্রিত এবং অবৈধ অর্থের ঝনঝনানিতে সাধারণ মানুষ আজ অনেক ক্ষেত্রেই জিম্মি। বাংলায় একটা প্রবাদ আছে- ‘আঙুল ফুলে কলাগাছ’ এবং সেটা একমাত্র আমাদের দেশেই সম্ভব। ব্যবসায়ীরা সিন্ডিকেট করে সাধারণ জনগণকে জিম্মি করছে কারও কিছু করার নেই। কোথায় দেশের আইনশৃঙ্খলা, কোথায় সুশাসন কিছুই বুঝে উঠতে পারি না। একটি দেশের বিজ্ঞ ও অভিজ্ঞ জনগোষ্ঠী যখন নীরব হয়ে যায় কিংবা সরব হয়েও কিছু করতে পারে না, তখন আর কিছু বলার বা করার থাকে না।

এত কিছুর পরও বলতে দ্বিধা নেই, দেশের উন্নয়নের চাকা সচলভাবেই চলছে। নানাবিধ অনিয়মের মধ্য দিয়েও যতটুক উন্নয়ন সাধিত হচ্ছে, তা শুধু সুশাসন আর আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির উন্নতি সাধন করতে পারলে উন্নতি আরও ত্বরান্বিত করা যেত বলে আমার বিশ্বাস।
প্রকৌশলী মো. হাফিজুর রহমান, পিইঞ্জ, চিফ ইঞ্জিনিয়ার (অপারেশন), এনা প্রপার্টিজ লি.
প্রকাশকাল: বন্ধন ১৬৫ তম সংখ্যা, মে ২০২৪