বাংলা সাহিত্যের পুরোধা কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর তাঁর জীবনের সিংহভাগই কাটিয়েছেন পদ্মা, ইছামতি, নাগর, আত্রাই নদী বিধৌত উত্তরবঙ্গের সবুজ শ্যামল ছায়াঘেরা প্রাকৃতিক সৌন্দর্যে ভরপুর নাগর নদীর তীরে নওগাঁর পতিসরে। যদিও তিনি এখানে এসেছিলেন জমিদারি পরিচালনার কাজে, তবুও তাঁর সাহিত্য জীবনে অনন্য উপাদান তিনি সংগ্রহ করেছিলেন পতিসরের প্রকৃতি ভান্ডার থেকেই। এখানে এসে মুগ্ধ হয়েছিলেন তিনি। তাঁর সাহিত্যে ও চিত্রকর্মে পতিসরের ছবিই সবচেয়ে পরিষ্কার ফুটে উঠেছে। জমিদারি দেখাশোনা করতে বিভিন্ন জায়গায় ঘুরে বেড়ালেও তাঁর হৃদয় ভরে থাকত পতিসরের মধুময় স্মৃতি।
পতিসর কুঠিবাড়ি প্রতিষ্ঠা
ক্রয়সূত্রে ১৮৩০ সালে রবীন্দ্রনাথের পিতামহ দ্বারকানাথ ঠাকুর কালিগ্রাম পরগনার জমিদারি পত্তন করেন। পরবর্তীতে দেবেন্দ্রনাথ ঠাকুর কুঠিবাড়ি স্থাপন করেন। তখন পতিসর কুঠিবাড়িকে পতিসর কাছারি বাড়ি বলা হতো। ওই কাছারি বাড়ি থেকেই কালিগ্রাম পরগনার ঠাকুর পরিবারের জমিদারি পরিচালিত হতো। এরপর জোড়াসাঁকো ঠাকুর পরিবারের মধ্যে জমিদারি ভাগাভাগি হলে কবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর কালিগ্রাম পরগনার জমিদারি পান। তবে জনশ্রæতি আছে, কোনো এক বিদেশি বণিকের নিকট থেকে দ্বারকানাথ ঠাকুর পতিসর কুঠিবাড়ি ক্রয় করেছিলেন। তবে এ কথার কোনো দালিলিক প্রমাণ আজো পাওয়া যায়নি।

কবি এলেন…
জমিদার ও কবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর কালিগ্রাম পরগনার জমিদারি প্রাপ্ত হয়ে প্রথমে আসেন ১৮৯১ সালের ১৫ থেকে ১৮ জানুয়ারির মধ্যে কোনো একদিন। এর আগে কবি সিরাজগঞ্জের শাহজাদপুরের শিলাইদহে আসতেন। ১৮৯১ সালের পর কবি বহুবার এসেছেন পতিসরের কুঠিবাড়িতে নাগর নদী পথে বজরায় করে। পতিসর কবিকে মায়ায় বেঁধে ফেলেছিল। ফলে কবি যতবার পতিসর আসতেন অবস্থান করতেন দীর্ঘ সময় ধরে। তবে তিনি রাত্রি যাপন করতেন বজরায়। দিনের বেলা কুঠিবাড়িতে অবস্থান করলেও রাত্রি বেলায় নাগর নদীর মাঝে বজরা বেঁধে সেখানে রাত্রিযাপন করতেন। কবি নাগর নদীর ঘাটে নেমে পালকিতে চেপে কুঠিবাড়িতে আসতেন। আবার পালকিতে চেপেই ঘাটে ফিরে যেতেন। ঘাট থেকে কুঠিবাড়ির দূরত্ব আনুমানিক ৪শ’ গজ।
কুঠিবাড়িতে কবির যা রয়েছে
কবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর পতিসরেই আসা-যাওয়া করতেন নাগর বজরায় করে। হাজী মুলিয়া প্রামাণিক ছিলেন ওই বজরার মাল্লা। প্রধানত নোঙর উঠানো ও নামানোর কাজ করতেন তিনি। কবি তাকে খুবই ভালোবাসতেন। তিনি ছিলেন পতিসরের বাসিন্দা। তিনি বজরায় কবির সাথে বিভিন্ন জায়গায় বেড়িয়েছেন। কবির সেই বজরার স্মৃতিচিহ্ন হিসেবে কুঠিবাড়িতে সংগ্রহ করে রাখা হয়েছে নোঙর। এখন কুঠিবাড়িতে কবির ব্যবহৃত একটি লোহার সিন্দুুক, কবির স্নানকার্যে ব্যবহৃত একটি বাথটাব, একটি ইজি চেয়ার, একটি হাতল চেয়ার, কলের ট্রাক্টরের ফলার ভগ্নাংশ, খাট, ফোল্ডিং চেয়ার, পতিসরে পাওয়া কবির স্বহস্তে লিখিত ৬ পৃষ্ঠার চিঠির ফটোকপি, দেয়াল ঘড়ি, বজরার আয়নাযুক্ত পাল্লা, টেবিল, গ্লোব, আলমারি, কাঠের দলিল রাখার বাক্সসহ রবীন্দ্রনাথের বিভিন্ন বয়সের ছবি সংরক্ষিত আছে। অপরদিকে রবীন্দ্র সরোবরে ঘাটের কাছে নতুনভাবে স্থাপন করা হয়েছে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের একটি ভাস্কর্য।

কুঠিবাড়ি যেমন আছে
বর্তমানে নওগাঁর পতিসর কুঠিবাড়িকে আগের আদলে ঢেলে সাজানোর প্রক্রিয়া চালাচ্ছে প্রত্নতত্ত্ব বিভাগ। পূর্বের হলুদ রঙ পাল্টিয়ে কুঠিবাড়ির রঙ হয়ে উঠেছে দুধসাদা। কবির প্রিয় রবীন্দ্র সরোবর ঘাটটি সংস্কার করা হয়েছে। ঘাটের পাশে স্থাপন করা হয়েছে কবির ভাস্কর্য। প্রাচীন দেবদারু গাছগুলো এখনো ঘাটের শোভাবর্ধন করে চলেছে। মূলভবনও সংস্কার করা হয়েছে। কুঠিবাড়ির সামনে সিংহদুয়ার। দুয়ারে পড়েছে গাঢ় সবুজ রঙ। সামনে বিশাল প্রাঙ্গণ। প্রাঙ্গণ ঘেঁষে বয়ে গেছে নাগর নদী। সিংহদুয়ার পেরোলেই কুঠি অভ্যন্তর, সামনে প্রশস্ত আঙিনা। আঙিনার তিনদিকে উঠে গেছে সিঁড়ি। সিঁড়ি পেরোলেই বারান্দা সংলগ্ন বিশাল বিশাল কক্ষ। এক কোণ দিয়ে উঠে গেছে চিলে কোঠার সিঁড়ি। এই সিঁড়ি বেয়ে উপরে উঠলে দেখা যাবে বিস্তৃৃত সবুজ মাঠ, জলাশয় ও প্রাকৃতিক সৌন্দর্য। কুঠিবাড়ির অন্দরমহলের কক্ষগুলো ধসে গেছে। কুঠিবাড়ির পেছনে একটি পাকা বেঞ্চ। কবি অবসর মুহূর্তে বসতেন এই নির্জন বৃক্ষ ছাওয়া বেঞ্চিতে। পতিসরে গিয়ে মনে হবে সবখানেই বোধহয় লেগে আছে কবির ছোঁয়া। বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের কর্মময় জীবনের একটি উল্লেখযোগ্য অধ্যায়ের সঙ্গে জড়িয়ে রয়েছে পতিসরের স্মৃতি। কবির স্মৃতিকে নিজের অনুভবের সঙ্গে মিলিয়ে দেখার জন্য আজো কবির ভক্তরা ছুটে যান পতিসর কুঠিবাড়িতে।
পতিসরে কবির সাহিত্য চর্চা
পতিসরে বসে কবি রচনা করেছিলেন কাব্য নাটিকা বিদায় অভিশাপ, গোরা ও ঘরে বাইরে উপন্যাসের অনেকাংশ। ছোটগল্পের মধ্যে প্রতিহিংসা, ঠাকুরদা, ইংরাজ ও ভারতবাসী প্রবন্ধ। গানের মধ্যে যেমন- তুমি সন্ধ্যার মেঘমালা/ তুমি আমার নিভৃত সাধনা, বধু / বঁধু/ বধূ মিছে রাগ করো না, তুমি নবরূপে এসো প্রাণেসহ অনেক গান। এ পতিসরে বসেই কবি রচনা করেছেন চৈতালী কাব্যের ৫৪টি কবিতা। সন্ধ্যা, দুই বিঘা জমির মতো বিখ্যাত কবিতা। পদ্মা বোটে বসে কবি রচনা করেছিলেন তালগাছ এক পায়ে দাঁড়িয়ে/সব গাছ ছাড়িয়ে/উঁকি মারে আকাশে। বারেক তোমার দুয়ারে দাঁড়ায়ে/ফুকারিয়া ডাকো জননী। প্রান্তরে তব সন্ধ্যা নামিছে, আঁধারে ঘেরিছে ধরণী, মাতার আহ্বানসহ বহু কবিতা রচনা করেছেন এই পতিসরেই। এখানে বসেই তিনি বহু চিঠি লিখেছিলেন তাঁর প্রিয়জনদের।
কবির উল্লেখযোগ্য যত অধ্যায়
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর নিভৃত এই পল্লীতে গ্রামবাসীদের শিক্ষিত করার লক্ষ্যে তাঁর পুত্রের নামানুসারে প্রতিষ্ঠা করেন ‘কালিগ্রাম রথীন্দ্রনাথ ইনস্টিটিউট’, যা এখনো রয়েছে। তার নিজস্ব পরিকল্পনায় নির্মিত বিদ্যালয় ভবনটি দর্শনীয়। তবে বিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ বিদ্যালয়ের মাটির ভবনসহ অনেক স্মৃতিচিহ্ন নষ্ট করে ফেলেছে। প্রতিষ্ঠানটিতে নিয়মিত পর্যটক এলেও প্রধান গেটসহ সব স্থানে রয়েছে পরিচ্ছন্নতার অভাব। ১৯০৫ সালে তিনি কৃষকদের উন্নয়নকল্পে ‘পতিসর কৃষি ব্যাংক’ স্থাপন করেন। ১৯১৩ সালের নোবেল পুরস্কারের প্রাপ্ত টাকা থেকে ১ লাখ ৮ হাজার টাকা এই কৃষি ব্যাংকে জমা দেন। এ ছাড়া সামাজিক শৃঙ্খলা রক্ষার জন্য পতিসরে সালিশি ব্যবস্থা প্রচলন করেন। রবীন্দ্রনাথ দুস্থ মানুষের আর্থ-সামাজিক উন্নয়নের লক্ষ্যে পতিসরে পল্লী সংগঠনের কাজ শুরু করেছিলেন। স্থাপন করেছিলেন চিকিৎসালয়।

পতিসরে কবির শেষ দিনগুলো
বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর তাঁর হাজারো স্মৃতিবিজড়িত নাগর নদীর তীরে পতিসর কুঠিবাড়িতে শেষ বারের মতন আসেন ১৯৩৭ সালে। ১৯৩১ সালে বিখ্যাত সাহিত্যিক অন্নদা শংকর রায় ছিলেন নওগাঁ মহকুমার প্রশাসক। প্রজাহিতৈষী জমিদার কবি পতিসরে বিদায়ের শেষ দিনটিতে কুঠিবাড়ির সামনের রবীন্দ্র সরোবর ঘাটে সমবেত প্রজাদের উদ্দেশে বলেছিলেন, ‘আমি অসুস্থ। আর হয়তো তোমাদের কাছে আসিতে পারিব না। তোমরা আমাকে অনেক দিয়াছ। আমি তোমাদের কিছুই দিতে পারি নাই। আমি প্রার্থনা করি তোমরা সুখী হও, শান্তিতে থাক।’ সেদিন সেই নিভৃত পল্লীতে নেমেছিল শোকের ছায়া।
বিলুপ্তির হাত থেকে মুক্তি
১৯৪৭ সালের পর থেকেই ক্রমাগত বিলুপ্ত হতে থাকে কবির সাজানো বাগান। হারিয়ে যেতে থাকে কাছারি বাড়ির সকল জিনিসপত্র। দেশ বিভাগের পর ১৯৫২ সালের অর্ডিন্যান্স বলে তদানীন্তন পূর্ব পাকিস্তান সরকার এই জমিদারি অধিগ্রহণ করে। কবির মৃত্যুর ৫০ বছর পর ১৯৯১ সালে তৎকালীন সরকারের সিদ্ধান্তে পতিসরে প্রথম সরকারিভাবে রবীন্দ্রনাথের জন্মবার্ষিকী পালন করা হয়। এখানে ছিল না কোনো পাকা রাস্তাঘাট। জমির পাশ দিয়ে কোনো রকমে মানুষ যাতায়াত করত। আর কাছারি বাড়িতে যাওয়ার রাস্তা বলতে ছিল পাড়ার বাড়িগুলোর পাশ দিয়ে কোনো রকমে হেঁটে যাওয়া, এ ছাড়া কোনো যানবাহন যেত না। তবুও বৃষ্টি আর কাদা পানির মধ্যে তারা কবির জন্মবার্ষিকী অনুষ্ঠান পালন করত। পতিসরকে ঘিরে তৈরি হয়েছে পাকা রাস্তাঘাট, বাজার, ডাক বাংলো, লাইব্রেরি ইত্যাদি। রবীন্দ্রনাথের কাছারি বাড়ি পতিসর রবীন্দ্র ভক্ত ও সাধারণ মানুষের কাছে নতুন করে নতুন আঙ্গিকে পরিচিত হওয়ার পর ১৯৯১ সাল থেকে এখন অবধি সরকারিভাবে রবীন্দ্র জন্মজয়ন্তী পালিত হচ্ছে।
মেহেদী হাসান
প্রকাশকাল: বন্ধন ৩২ তম সংখ্যা, ডিসেম্বর ২০১২