বিশ্বের ইসলামিক স্থাপত্যকলার ইতিহাসে আজ অবধি এমন নিদর্শন আর কখনোই দেখা যায়নি। তাক লাগানো বিস্ময়কর এক মসজিদ, যার গম্বুজসংখ্যা ২০১। তবে এটির অবস্থান মধ্যপ্রাচ্যে নয়, খোদ বাংলাদেশেই। টাঙ্গাইলের গোপালপুর উপজেলায় নির্মাণাধীন মসজিদটির উচ্চতা ৪৫১ ফুট, যেখানকার মিনারটি হবে পৃথিবীর দ্বিতীয় সর্বোচ্চ মিনার।
মসজিদটির অবস্থান টাঙ্গাইল শহর থেকে ৩৫ কিলোমিটার দূরে গোপালপুরের দক্ষিণ পাথালিয়া গ্রামের নয়নাভিরাম ঝিনাই নদীর পাশে। আশপাশে বিশাল সবুজের মাঝে হীরকখন্ডের মতো মসজিদটি বাংলাদেশ তথা বিশ্বের সবচেয়ে বেশি গম্বুজবিশিষ্ট মিনার মসজিদ। এর প্রবেশপথেই রয়েছে বিশালাকৃতির সিঁড়ি, যা দিয়ে প্রবেশ করতে পারবে কয়েক শ মুসল্লি। মসজিদটি নির্মিত হচ্ছে পোস্ট লিন্টেল স্ট্রাকচারে। যদিও গম্বুজ তৈরি করা হচ্ছে মসজিদের বিশালাকার স্ল্যাবকে বিন্যস্ত করতে। গম্বুজের আকার ১৪৪ ফুট বাই ১৪৪ ফুটের বর্গাকার ভূমিতে পুরো স্ট্রাকচারটিকে ফুটিয়ে তোলা হবে। গম্বুজগুলো দুই মিটার উচ্চতাবিশিষ্ট। প্রতিটি গম্বুজ সমআকৃতির। ৮১ ফুট উচ্চতার বিশালাকৃতির গম্বুজ তৈরি করা হচ্ছে ঠিক মাঝে, যা দেখা যাবে অনেক দূর থেকেও। ৮১ ফুট উচ্চতার মোট আটটি ছোট মিনার রয়েছে এর দুই পাশে। প্রবেশপথে চারটি এবং ঠিক এর উল্টোপাশে রয়েছে আরও চারটি, যা খুব সুন্দরভাবে ফুটিয়ে তুলেছে মসজিদের নান্দনিক সৌন্দর্য।
মূল প্রবেশপথেই রয়েছে তিনটি বড় ফোয়ারা। একটির অবস্থান একদম প্রবেশপথে, যা প্রাঙ্গণে প্রবেশ ও বেরোনোর পথ নির্দেশ করে। গোলাকার ফোয়ারায় ব্যবহার করা হবে বিশ্বের সর্বাধুনিক প্রযুক্তি। ল্যান্ডস্কেপ ডিজাইনের অনন্য নিদর্শন এই মসজিদটির মিনার, যা ৪৫১ ফুট উচ্চতাবিশিষ্ট তা নির্মিত হচ্ছে একটি ওয়াটার বডির ওপর। মিনারটিতে থাকছে বিশালাকার এক সিঁড়ি, যা দিয়ে একেবারে ওপর পর্যন্ত ওঠা যায়। মিনারটিতে আছে ইসলামিক ও মহাদেশীয় স্থাপত্যকলার অনন্য নিদর্শন আর্চ। আর্চগুলো তৈরি হবে লাল ইট ও সাদা সিমেন্টে। এতে থাকছে নানা রকম ম্যাটেরিয়ালসের ব্যবহার, যা আগে বাংলাদেশের কোনো মসজিদে ব্যবহৃত হয়নি এতটা বৃহৎ পরিসরে।

মসজিদের পেছনে নদীতীর ঘেঁষে নির্মিত হচ্ছে চারটি ভবন। এগুলো বানানো হচ্ছে দুস্থ ও সুবিধাবঞ্চিত মানুষের থাকার জন্য। এতে দুস্থ মহিলা ও শিশুদের জন্য বিনা মূল্যে হাসপাতাল, এতিমখানা, বৃদ্ধাশ্রম ও দুস্থ মুক্তিযোদ্ধাদের পুনর্বাসনের ব্যবস্থা করা হবে। পাঁচতলা স্ট্রাকচারের এই ভবনগুলোও পোস্ট লিন্টেল স্ট্রাকচারের। আছে বড় বড় কক্ষ, যাতে একসঙ্গে অনেকেই থাকতে পারবে। আছে সুসজ্জিত বাথরুম ও রন্ধনশালা। প্রতিটি কক্ষ থেকেই রয়েছে বাইরের স্থাবর সৌন্দর্য দেখার অপরূপ সুযোগ।
দিল্লির কুতুব মিনার পৃথিবীর সবচেয়ে উঁচু ইটের তৈরি মিনার, যার উচ্চতা ৭৩ মিটার বা ২৪০ ফুট। সুলতান মোহাম্মদ ঘৌরির সেনাপতি ও প্রতিনিধি কুতুবউদ্দিন আইবেক ১১৯২ খ্রিষ্টাব্দে চৌহান রাজা পৃথ্বীরাজকে তরাইনের দ্বিতীয় যুদ্ধে পরাস্ত করে বিজয়কে স্মরণীয় করতে এ মিনার তৈরি করেছিলেন। তাজমহলের চেয়েও বেশি পর্যটক এটি পরিদর্শন করে। এরপর সবচেয়ে উঁচু মিনার এখন আছে মরক্কোর কাসাব্লাকায় দ্বিতীয় হাসান মসজিদে। এর উচ্চতা ২১০ মিটার বা ৬৮৯ ফুট। কিন্তু ইটের তৈরি নয় এটি। এ দিক থেকে বিবেচনা করলে বাংলাদেশের এই মসজিদই হবে বিশ্বের সবচেয়ে উঁচু ইটের তৈরি মিনার। যদিও এর স্ট্রাকচার সিস্টেম পোস্ট লিন্টেল। বিশালাকার পোস্ট আর লিন্টেল এবং সঙ্গে ইটের ব্যবহার পৃথিবীর আর কোনো মসজিদেই নেই।

বীর মুক্তিযোদ্ধা রফিকুল ইসলাম মসজিদটির প্রতিষ্ঠাতা। মসজিদটি তৈরির কোনো চিন্তাই তাঁর ছিল না। তিন বছর আগে একদিন তিনি মসজিদে খুতবা শুনছিলেন। সেখানেই তিনি শুনলেন কোনো স্থাপনাই মৃত্যুর পর মানুষের সঙ্গে পরকালে যায় না। এমন কিছু করা উচিত, যা মানুষের মনের ভেতর থেকে যায় আজীবন। এমন একটি স্থাপনা করার চিন্তা থেকেই তিনি রেকর্ডের পাতায় নাম লেখানো এই স্থাপনা নির্মাণের উদ্যোগ নেন।
মুক্তিযোদ্ধা রফিকুল ইসলাম বাংলাদেশ ব্যাংক অ্যামপ্লয়িজ (সিবিএ) ফেডারেশনের সভাপতি। তিনি দেশের প্রয়োজনে ১৯৭১ সালে হানাদার বাহিনী মুক্ত করতে যুদ্ধ করেছেন, পরাধীনতা থেকে মুক্ত করে এনেছেন প্রিয় মাতৃভ‚মির স্বাধীনতা। দেশ ও মানবতার কল্যাণে সাধ্যমতো কাজ করছেন সেই তরুণ বয়স থেকেই। দীর্ঘ ৪৩ বছর জনতা ব্যাংক বাংলাদেশ লিমিটেডের নির্বাচিত সিবিএ প্রেসিডেন্ট হিসেবে দায়িত্ব পালন করছেন। এই বয়সে তাঁর নতুন করে চাওয়া-পাওয়ার কিছু নেই, বাকি জীবনটুকু মহান আল্লাহ তাআলা ও মানবসেবায় নিজেকে নিয়োজিত রাখতে চান। চান না তাঁর মৃত্যুর সময় ব্যাংক অ্যাকাউন্টে এক হাজার টাকাও জমা থাকুক, এ লক্ষ্যেই মহান আল্লাহ্ পাকের নামে দুঃসাহসী উদ্যাগ হাতে নিয়েছেন নিজ থেকেই।

২৭১/৪৫০ শতাংশ জায়গাজুড়ে নির্মাণাধীন মসজিদটির ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপন করা হয় ২০১৩ সালে। এর ভেতর দেয়ালজুড়ে থাকবে পবিত্র কোরআন শরিফের সমগ্র আয়াতসমূহ। মসজিদে প্রবেশ করেই যে কেউ বসে বা দাঁড়িয়ে পুরো কোরআন শরিফ পড়তে পারবে। মসজিদের পশ্চিম দেয়ালে যা শোভা পাবে। এর প্রধান দরজায় ব্যবহার করা হবে ৫০ মণ পিতল। ঝিনাই নদীর পাশেই তৈরি করা হবে একটি সেতু। মসজিদের চারপাশে তৈরি করা হবে দেশি-বিদেশি ফুলের বাগান। পুরো মসজিদটির নির্মাণব্যয় ধরা হয়েছে ১০০ কোটি টাকা। ২০১৭ সালের শেষ দিকে পূর্ণতা পাবে এর নির্মাণ। আশা করা যাচ্ছে, মক্কার পবিত্র কাবা শরিফের ইমামের উপস্থিতিতে এটি অবমুক্ত করা হবে। একযোগে ২০ হাজার মুসল্লির নামাজের পবিত্র স্থান হিসেবে যা পৃথিবীর বুকে বাংলাদেশের নাম লিখবে সোনার অক্ষরে।
স্থপতি রাজীব চৌধুরী
প্রকাশকাল: বন্ধন ৭৬ তম সংখ্যা, আগস্ট ২০১৬