সোনালি ঐতিহ্যের স্মারক খান মোহাম্মদ মৃধা মসজিদ

৪০০ বছরের প্রাচীন এ নগরের অনেক কিছু পুরোনো হলেও কিছু স্থাপনা সব সময়ই নতুন ও  জীবন্ত। সোনালি অতীত ফেলে এলেও মানুষের হৃদয়ে এর স্মৃতি আজও অমলিন। ফেলে আসা ঐতিহ্যবাহী সময়ে এমনই এক কালজয়ী স্থাপনা নির্মাণ করেছিলেন খান মোহাম্মদ মৃধা; নাম যাঁর খান মোহাম্মদ মৃধা মসজিদ।

ঢাকার বুড়িগঙ্গার তীরঘেঁষে সগৌরবে দাঁড়িয়ে আছে ঐতিহ্যের স্মারক প্রায় ৩০০ বছরের প্রাচীন এ মসজিদটি। ঢাকার আজিমপুরের শেখসাহেব বাজারসংলগ্ন লালবাগ কেল্লার সন্নিকটে এর অবস্থান। ফারসি কবি কাজী এবাদুল্লাহর মতানুসারে, বাদশাহ আওরঙ্গজেবের শাসনামলে খান মোহাম্মদ মৃধা এই মসজিদটি নির্মাণ করেন। ১১১৭ হিজরির ১৭০৫ খ্রিষ্টাব্দে মসজিদটি নির্মিত হয়। খান মোহাম্মদ মৃধার ইচ্ছে ছিল এটিকে মসজিদসহ মাদ্রাসায় রূপ দেওয়ার। পুরান ঢাকার পুরোনো এই মসজিদটির আয়তন ১৫.২৬ মিটারX৭.৬৫ মিটার। এটির প্ল্যাটফর্ম তথা ভিত্তিবেদির আয়তন ৩৭.৮৭ মিটারX৩৬.৩৬ মিটার। উচ্চতা ৫ মিটার। সম্পূর্ণ শিলালিপিবেষ্টিত মসজিদটি নান্দনিক কারুকার্যে সমৃদ্ধ। এর উত্তর-পশ্চিম কোনায় অবস্থান মাদ্রাসাটির। তিন দিকেই রয়েছে একটি করে কক্ষ। ইবাদতের পাশাপাশি শিক্ষার জন্য মাদ্রাসাটি মসজিদের পাশে নির্মাণ করেন খান মোহাম্মদ মৃধা।

মসজিদের একাংশ

অপরূপ সৌন্দর্যমণ্ডিত দৃষ্টিনন্দন এই মসজিদটি দেখতে কারুকার্যখচিত প্রধান গেট দিয়ে প্রবেশ করতে হবে। প্রথমেই চোখ যাবে একটি সমাধিসৌধে। সমাধিটি মসজিদটির নির্মাতা খান মোহাম্মদ মৃধার। আরও চোখে পড়বে মনোরম পরিবেশের চমৎকার ফুলের বাগানে। আর একটু এগোলেই দেখা মিলবে রাজকীয় কুয়ার। মসজিদটি দুই তলাবিশিষ্ট। নিচে ও ওপরে রয়েছে বেশ কয়েকটা রুম। মসজিদটির লাল রঙের ইটের গায়ে লেগেছে সুরকি, মাটি আর চুন। দেয়ালগুলো খাঁজকাটা। মসজিদটির শীর্ষে রয়েছে তিনটি গম্বুজ। মাঝখানেরটা বড় আর দুই পাশের দুটি ছোট আকৃতির। এ ছাড়া ওপরে চার কোনায় চারটি সমপর্যায়ী মিনার রয়েছে। মসজিদের নিচতলার রুমসংখ্যা ২৪। রুমগুলোর পরিসর ছোট। এ ছাড়া নিচের তলায় ২৪টি রুমের পাশেই রয়েছে ২৮টি নান্দনিক গ্রিল। মসজিদের মাঝ বরাবর কারুকার্যময় সুন্দর একটি মিহরাব। মসজিদের বাইরে ২৪ ধাপবিশিষ্ট সিঁড়িগুলো ব্রিটিশ আমলের মার্বেল পাথরে নির্মিত।

মসজিদের অভ্যন্তর ও পূ‍র্ণ‍াঙ্গ অবয়বে মসজিদটি

ঐতিহ্যবাহী এ মসজিদে এলাকাসহ দূর-দূরান্তের মুসল্লিরা নামাজ পড়তে আসেন। নামাজের পাশাপাশি বিভিন্ন ধরনের ইসলামিক কর্মকাণ্ডের অংশ হিসেবে এখানে ইসলামি তাফসির হয়। এ ছাড়া মাদ্রাসার শিক্ষাদানের পাশাপাশি বছরে দুইবার ঈদুল ফিতর ও ঈদুল আজহায় জামাতে নামাজ আদায় করে থাকেন এলাকার মুসল্লিরা।

চার শতবর্ষী প্রাচীন ঢাকার ঐতিহ্যবাহী এ স্থাপনাটি দেখভালের দায়িত্ব বাংলাদেশ সরকারের প্রত্নতাত্ত্বিক অধিদপ্তরের। এই স্থাপনাটির সব ধরনের সংস্কারকাজ হয়েছে প্রত্নতাত্ত্বিক অধিদপ্তরের অধীনে। মসজিদ ব্যবস্থাপনার রয়েছে স্থানীয় মসজিদ কর্তৃপক্ষ। তবে মসজিদ দেখভালের দায়িত্বে যাঁরা আছেন, তাঁরা কোনো প্রকার অনুদান পান না বলে জানান মসজিদটির মোতাওয়াল্লি।

প্রাসঙ্গিক তথ্য

প্রত্নতাত্ত্বিকদের মত, এ স্থাপনাটি ছিল একতলাবিশিষ্ট পুরোনো ধ্বংসাবশেষ মন্দির। পরে খান মোহাম্মদ মৃধা একে দ্বিতল মসজিদে রূপ দেন।

ঐতিহ্যবাহী এ স্থাপনাটি লালবাগ দুর্গের অংশ নয়।

মসজিদসংলগ্ন তালগাছটির বয়স প্রায় ৪০ বছর, যা এখনো একই রকম আছে।

মসজিদের বহিরাঙ্গন

ফুলের বাগান সুসজ্জিত থাকলেও রাজকীয় কুয়াটির অবস্থা বিবর্ণ; নিয়মিত এখানে ফেলা  হচ্ছে ময়লা, যার দরুন এটা নিমেষেই মিশে যাচ্ছে মাটির সঙ্গে। প্রত্নতাত্ত্বিক অধিদপ্তর এটি সংস্কারের উদ্যোগ নিলে কুয়াটি টিকবে দীর্ঘদিন।

পুরান ঢাকার ঐতিহ্যবাহী এ নিদর্শনটি দেখতে প্রতিদিন দেশ-বিদেশ থেকে শিক্ষার্থী ও পর্যটকেরা আসেন এখানে, যা আগত দর্শনার্থীদের ফিরিয়ে নেয় ইতিহাসমৃদ্ধ ঢাকার ফেলে আসা সোনালি ঐতিহ্যে। 

গোলাম রব্বানী

[email protected]

প্রকাশকাল: বন্ধন ৪৮ তম সংখ্যা, এপ্রিল ২০১৪

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Scroll to Top