ইরানের ঐতিহাসিক ক্যারাভানসরাই

এমন একটা সময় ছিল যখন বাণিজ্যের জন্য বণিকদের এক দেশ থেকে আরেক দেশে পাড়ি দিতে হতো পণ্য কেনাবেচার জন্য। তখন ছিল না কোনো যান্ত্রিক পরিবহনব্যবস্থা। ঘোড়া, গাধা, উট, নৌকা ইত্যাদিই ছিল পণ্য বহনের একমাত্র মাধ্যম। তবে আতঙ্কের বিষয় ছিল বণিকদের নিরাপত্তার। তবু ঝুঁকি নিয়েই চলত আন্তর্জাতিক বাণিজ্য। আমরা সেই বণিকদের সওদাগর বলে জানি, যাকে ইংরেজিতে বলা হয় ক্যারাভান। বণিক বা ক্যারাভানরা যে রুটে চলাচল করত, সেখানে নিরাপত্তার ব্যবস্থা নিজেকেই করতে হতো। পরে বিভিন্ন দেশের রাজা ও ধনাঢ্যদের উদ্যোগে বণিকদের নিরাপত্তা এবং রাজস্ব আয়ের চিন্তা করেই স্থানে স্থানে নির্মিত হয় আশ্রয়স্থল বা বিশ্রামাগার, যাকে বলা হতো ক্যারাভানসরাই (Caravanserai)। ইরান ছিল এমনই একটি উল্লেখযোগ্য দেশ, যেখানে গড়ে ওঠে অনেক গুরুত্বপূর্ণ ক্যারাভানসরাই। ইরানের কারাভানসরাইগুলো এখন দেশটির অন্যতম দর্শনীয় এবং গুরুত্বপূর্ণ স্থাপনা। প্রাচীন বাণিজ্যিক সিল্ক রুট ও ক্যারাভানসরাই সম্পর্কে জানাচ্ছেন-সারোয়ার আলম

ক্যারাভানসরাই
মধ্যপ্রাচ্য, মধ্য এশিয়া এবং উত্তর আফ্রিকার দেশগুলোর মধ্যে হাজার হাজার বছর আগে যখন বাণিজ্য হতো, তখন পথ ছিল বিপৎসঙ্কুল। প্রতিকূল আবহাওয়া আর মরুদস্যুরা ছিল তাদের বাণিজ্যিক পথের কাঁটা। সে কারণে বণিকেরা একা চলাচল করত না। একদল বণিক বা ক্যারাভানরা সবাই মিলে কাফেলা আকারে যাত্রা করত। কোথায় ছিল সেই ক্যারাভানসরাই? ক্যারাভানসরাই কোনো একক স্থান বা স্থাপনা নয়। ঐতিহাসিক আন্তর্জাতিক বাণিজ্যিক রুট সিল্ক রোড ছিল বিভিন্ন দেশের বণিকদের চলাচলের প্রধান রুট। খ্রিষ্টপূর্ব দ্বিতীয় শতাব্দী থেকে অষ্টাদশ শতক পর্যন্ত এশিয়ার উপমহাদেশীয় অঞ্চলগুলোর মধ্য দিয়ে পূর্ব ও পশ্চিম এশিয়া, ইউরোপ ও ভূমধ্যসাগরীয় অঞ্চলের সিল্ক বা রেশমের ব্যবসা ছিল তখন প্রসিদ্ধ। রেশম বাণিজ্যের জন্য বণিকেরা এক দেশ থেকে অন্য দেশে যাওয়ার জন্য যে রাস্তা বা রুট ব্যবহার করত, কালক্রমে তা সিল্ক রোড হিসেবে খ্যাতি পায়। প্রায় ৪ হাজার মাইল (৬ হাজার ৫০০ কি.মি.) দীর্ঘ এই পথের নামকরণ চীনা হান রাজার রাজত্বকালে আরম্ভ হয়েছিল। চীন, কোরিয়া, জাপান, ভারতীয় উপমহাদেশ, ইরান, ইউরোপ, আফ্রিকা ও আরবের সভ্যতাসমূহের মধ্যে দীর্ঘ দূরত্বে রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক সম্পর্ক স্থাপন ও উন্নয়নে সে সময় সিল্ক রোডের অবদান ছিল সবচেয়ে বেশি। পথে দস্যুদের আক্রমণ কিংবা প্রতিক‚ল আবহাওয়ার সঙ্গে ব্যবসায়ীদের যেন রাত কাটাতে না হয়, সে জন্য নির্দিষ্ট দূরত্বের পরপর ক্যারাভানসরাই তৈরি করা হয়েছিল। তারা প্রায় ৩২-৪০ কিলোমিটার দূরত্বে একেকটি ক্যারাভানসরাই নির্মাণ করেছিল।

কাসর-ই-বাহরাম সরাই-এর জলাধার। ছবি: উইকিমিডিয়া

ক্যারাভানসরাই ভবনগুলোর নকশা দেখেই বোঝা যায় তা ছিল প্রতিরক্ষা দুর্গের মতো। এগুলো নিকটতম শহর বা গ্রামের কাছাকাছি নির্মাণ করা হতো। দুর্গের দেয়াল ছিল অনেক উঁচু। প্রধান ফটকে ছিল ভারী লোহার দরজা, যা শিকল দিয়ে আটকে রাখা হতো। বণিকদের জানমালের নিরাপত্তার জন্য ভারী লোহার গেটের পাশে রাতভর পাহারার ব্যবস্থাও থাকত। ক্যারাভানসরাই বাইরে থেকে দুর্গের মতো লাগলেও ভেতরে থাকত নানা ব্যবস্থা। নিচতলায় ঘোড়া ও গাধার আস্তাবল, থাকত বিস্তৃত উঠোন, যার এক কোণে রান্নাবান্নার ব্যবস্থাও রাখা হতো। দ্বিতীয় তলায় ক্যারাভানদের থাকার জন্য ছোট-বড় কক্ষ ছিল। বড় বড় ক্যারাভানসরাইগুলোতে বিশাল স্নানঘর এবং প্রার্থনার জন্য আলাদা জায়গাও রাখা হতো।

পুরোনো ক্যারাভানসরাগুলোর মধ্যে অনেক আজও টিকে রয়েছে। তবে সেগুলোর বেশির ভাগই ধ্বংসস্তূপ, যা শুধু পর্যটকদেরই আগ্রহের বিষয়। এগুলো থেকে বিশেষ কোনো তথ্য পাওয়া না গেলেও মধ্যযুগীয় ক্যারাভানসরাই থেকে অনেক তথ্যই পাওয়া যায়। দেয়ালে অঙ্কিত বিভিন্ন ধরনের মানুষের চিত্র, ভাষা, পণ্য রীতিনীতি আধুনিক মানুষের সাদৃশ্যপূর্ণ বলেই মনে করেন প্রত্নতাত্ত্বিকেরা।

ইরানের বিখ্যাত কারাভানসরাই
ইরান নিজেদের ক্যারাভানসরাই নিয়ে গর্ব করে, যার প্রতিটির নিজস্ব বিশেষত্ব রয়েছে। ইয়াজদ প্রদেশের আইকনিক জেইন-ও-দিন কারাভানসরাই থেকে শুরু করে কাজভিনের মনোরম সাদ আল-সালতানাহ পর্যন্ত, এই স্থাপনাগুলো ইরানের সমৃদ্ধ ঐতিহ্যের ঐতিহাসিক সাক্ষী। ক্যারাভানসরাইগুলোর অবশিষ্ট যে বর্তমান অবস্থা রয়েছে, তা ইরানের সংস্কৃতির একটি অবিচ্ছেদ্য অংশ হিসেবেই রয়ে গেছে। কোনো সরাইকে জাদুঘর, কোনোটি রেস্তোরাঁ আবার কোনোটি বর্তমানে প্রসিদ্ধ হোটেল হিসেবে পুনরুদ্ধার হয়েছে। তবে যে হিসেবেই ইতিহাসের স্মৃতিবিজড়িত এসব স্থাপনা পুনরুদ্ধার করা হোক না কেন, প্রতিটি ইটের ভাঁজে ভাঁজে নকশার কোনায় কোনায় এখনো রয়ে গেছে ইতিহাসের ছাপ, যা পর্যটকদের দারুণভাবে কাছে টানে। ইরানে এমন অনেক ক্যারাভানসরাই রয়েছে, তার মধ্যে উল্লেখযোগ্য কয়েকটির সংক্ষিপ্ত আকারে উল্লেখ করা হলো।

ক্যারাভানসরাই-এর আবাসন ব্যবস্থা। ছবি: টেস্টইরান

সাদ আল-সালতানার কারাভানসরাই
ইরানের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ কারভানসরাই হলো কাজভিন শহরে অবস্থিত সাদ আল-সালতানাহ। সাধারণত সব ক্যারাভানসরাই সিল্ক রোডের পাশে অবস্থিত হলেও এটিই একমাত্র সরাইখানা, যা শহরের একটি বাজারের মধ্যে অবস্থিত। ইরানি বাজারগুলো ঐতিহ্যগতভাবে প্রাচীন শহরের প্রধান অর্থনৈতিক ও সামাজিক কেন্দ্র ছিল, যা কার্পেট এবং বীজহীন আঙুরের জন্যও বিখ্যাত। তা ছাড়া পার্সিয়ান স্থাপত্যের একটি খুব অসামান্য অংশ হল সাদ আল-সালতানাহ কারাভানসরাই। ইরানের সবচেয়ে বড় ছাদযুক্ত ক্যারাভানসরাই হিসেবে পরিচিত সাদ-আল-সালতানাহ। ২৬ হাজার বর্গ মিটারের বেশি আয়তনের জায়গাজুড়ে নির্মাণ করা হয়েছিল এই সরাইখানা।


এই সুন্দর ঐতিহাসিক স্থানটি ইরানের ক্যারাভানসরাইগুলোর মধ্যে অন্যতম। এখানে বেশ কয়েকটি স্নান, বাণিজ্য স্থান, গুদাম, চৌরাস্তা, মসজিদ, চা ও পানীয়ের দোকানসহ দীর্ঘ করিডর রয়েছে। প্রাচীন এই বাজার ও ক্যারাভানসরাইয়ের রয়েছে প্রায় ৪০০ কক্ষ ও দোকান। এই সরাইখানাটি কাজার যুগের একটি স্থাপত্য প্রদর্শনীর মতো। এর নির্মাণে একমাত্র প্রধান উপকরণ হিসেবে ইট ব্যবহার করা হয়েছে। বর্গাকার প্রধান উঠোনের চারপাশে রয়েছে চারটি কারুকার্যখচিত মোকারনা এবং ইটের স্বতন্ত্র জ্যামিতিক নকশা দ্বারা সজ্জিত চারটি ইভান। উঠানের চারপাশে এক মিটার উঁচু প্ল্যাটফর্মে রয়েছে হুজরেহ বা বিশ্রামের কক্ষ, যেখানে ভ্রমণকারীরা থাকতে পারে।

কাসর-ই-বাহরাম কাফেলা
তেহরানের ১৫৪ কিলোমিটার দক্ষিণে গারমসার শহরের কাছে অবস্থিত কাসর-ই বাহরামের ক্যারাভানসরাই। এটি সাসানিদের আমলে (৫ খ্রিষ্টাব্দ) নির্মিত হয়েছিল এবং রাজা আব্বাস সাফাভিদের (১৬ খ্রিষ্টাব্দ) অধীনে পুনর্নির্মিত হয়েছিল। কাসর-ই-বাহরাম এর স্থাপত্যের জন্য উল্লেখযোগ্য। আপনি যখন বাইরে থেকে এই ভবনটি দেখবেন তখন একটি বর্গাকার ভবন দেখতে পাবেন, যার সম্মুখভাগ বড় সাদা চুনাপাথর দিয়ে আবৃত। ইরানের অন্য সব ক্যারাভানসরাই থেকে ভিন্ন এই সরাইখানার নির্মাণে কোনো ইট বা কাদামাটি ব্যবহার করা হয়নি। দুটি উত্তর ও দক্ষিণের গেট দিয়ে ক্যারাভানসরাইয়ে প্রবেশ করা যায়। গেট দিয়ে ভেতরে প্রবেশ করতেই পাওয়া যাবে বড় অষ্টভুজাকৃতির উঠান, যা ২৪টি কক্ষ দ্বারা বেষ্টিত। উঠানের মাঝখানে রয়েছে একটি সামান্য গভীর আলংকারিক পুকুর, যা এই সরাইখানার নান্দনিকতাকে বাড়িয়ে তুলেছে বহুগুণ।

কাসর-ই-বাহরাম ক্যারাভানসরাইটি দাশত-ই কাবিরের বিস্তীর্ণ সংরক্ষিত এলাকার মাঝখানে অবস্থিত, যেখানে প্রায় কোনো বাসিন্দা নেই। অবস্থানগত কারণে কাসর-ই-বাহরাম স¤প্রতি জ্যোতির্বিজ্ঞানী ও ফটোগ্রাফারদের কাছে এক স্বর্গভূমি। কারণ এখানে কোনো আলোকদূষণ নেই।

জেইন-ও-দিন কারাভানসরাই
জেইন-ও-দিন কারাভানসরাই ইরানের ইয়াজদের জেইন-ও-দিনে অবস্থিত। জেইন-ও-দিন ১৬ শতকের প্রাচীন সিল্ক রোডে অবস্থিত ক্যারাভানসরাইয়ের অন্যতম একটি। শাহ আব্বাসের রাজত্বকালে ভ্রমণকারীদের সুবিধা প্রদানের জন্য নির্মিত ৯৯৯টি সরাইখানার মধ্যে এটি এমন একটি সরাই, যার অস্তিত্ব আধুনিক সময়ে বহাল রয়েছে আগের মতোই। এর মধ্যে জেইন-ও-দিন বৃত্তাকার টাওয়ার দিয়ে নির্মিত দুটি ক্যারাভানসরাইয়ের একটি। এর সংস্কারের পর এটি একটি সরাইখানা হিসেবে পরিচালিত হয়েছে। এসফাহানের কাছে একইভাবে নির্মিত ক্যারাভানসরাই ধ্বংসপ্রাপ্ত ছিল, যা পরে সংস্কার করা হয়েছে।

সাদ আল-সালতানার কারাভানসরাই। ছবি: টেস্টইরান

২ হাজার ৫০০ বছর আগে প্রথম ক্যারাভানসরাইগুলো নির্মাণ করা হয়েছিল, যখন পারস্য আকেমিনেড সাম্রাজ্য দ্বারা শাসিত হয়েছিল। ইরানে সাফাভিদের সময়কালে, ক্যারাভানসরাইগুলো প্রতি ২০ থেকে ৩০ মাইল দূরত্বে সুবিধাজনক স্থানে প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল ও শাহ আব্বাস (১৬৪২-৬৬)-এর নির্দেশে এই ধরনের অনেক ভবন পুরোনো এবং নতুন কাফেলার রুটে নির্মিত হয়েছিল। জেইন-ও-দিনে একটি ৮ ফুট বর্গক্ষেত্রের কক্ষের জন্য দৈনিক ফিসহ একটি প্রবেশ ফি নেওয়া হতো। কক্ষগুলোতে একটি লণ্ঠন লাগানো থাকত আলোর জন্য এবং চাকরদের থাকার জন্য আলাদা জায়গা ছিল। ক্যারাভানসরাইয়ের তত্ত্বাবধায়ক বৈধভাবে বিক্রয় কর সংগ্রহ এবং সব লেনদেন তত্ত্বাবধান করত। তারা কখনো কখনো বণিকদের অতিরিক্ত চার্জ এবং তাদের সঙ্গে প্রতারণাও করত। অথচ তত্ত্বাবধায়কদের দায়িত্ব ছিল চুরির বিরুদ্ধে ব্যবসায়ী এবং তাদের পণ্যের নিরাপত্তা প্রদান করা।

ক্যারাভানসরাইয়ের জন্য বিখ্যাত ইরান। এই দেশে এ রকম প্রায় ৯৯৯টি ক্যারাভানসরাই নির্মাণ করা হয়েছিল। তবে তার বেশির ভাগই ধ্বংসস্তূপ। পাওয়া যাবে না কোনোটির ভগ্নাবশেষও। তবে যেগুলো জনপ্রিয়, ঐতিহ্যবাহী এবং বেশি টেকসই ছিল, যেগুলোর অবস্থান গুরুত্বপূর্ণ জায়গায় সেগুলো বহু সংস্কারের পর এখনো টিকে আছে আপন মহিমায়। এখনো কোনো কোনো ক্যারাভানসরাই হোটেল, গেস্ট হাউস, মিউজিয়াম হিসেবে ব্যবহার হচ্ছে।

প্রকাশকাল: বন্ধন ১৬৩ তম সংখ্যা, এপ্রিল ২০২৪

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Scroll to Top