শান্ত নদীর তীরে ভেড়ানো সারি সারি নৌকা। গাছে গাছে বর্ণিল আলোকসজ্জা। লাল, নীল, সবুজ রঙের নিয়ন বাতি দিয়ে সাজানো গাছগুলো। আলো-আঁধারির মাঝে অন্য রকম উৎসবমুখর এক পরিবেশ। কেউ একা, কেউ বা দলবেঁধে বসে আছে এখানে-সেখানে। ল্যাপটপ হাতে ইন্টারনেট চ্যাটিংয়ে ব্যস্ত তরুণেরা। কারও হাতে ধোঁয়া ওঠা কফির মগ। নদীর পার থেকে ভেসে আসছে গিটারের টুংটাং আওয়াজ, সঙ্গে এলোমেলো গানের সুর। তারুণ্যের একটি দল বিরামহীনভাবে কোরাস তুলছে সমন্বিত সুরে চেনা সব গানে। বয়সীরা ওয়াকওয়ে ধরে জগিং করতে করতে সামনে এগোচ্ছেন। ফাস্টফুডের দোকানগুলোও বেশ রমরমা। হালকা ক্ষুধা ও রসনা মেটাতে অনেকেই ঢুঁ মারছে ফুডকোর্টগুলোতে। চটপটি, ফুচকা, হালিম, কোমল পানীয় খাওয়ার পাশাপাশি চলছে জম্পেশ আড্ডা। রাতে এ ধরনের দৃশ্য সচরাচর অন্য কোথাও দেখা না গেলেও শিক্ষানগর রাজশাহীর পদ্মাপাড়ের রাতের নিত্যনৈমত্তিক দৃশ্য এটি।
বরেন্দ্রবিধৌত ভূমি রাজশাহী। ছিমছাম গোছানো শহর। স্কুল, কলেজ, বিশ্ববিদ্যালয়, জাদুঘর কোনো কিছুরই কমতি নেই এখানে। অন্যান্য শহরের মতো এ শহরেও লেগেছে ব্যস্ততার ছোঁয়া। ফলে স্বাভাবিক ও নির্মল বিনোদনের একটা অভাব সব সময়ই বোধ করত নগরবাসী। এই উপলব্ধি থেকেই দেরিতে হলেও এখানে গড়ে তোলা হয়েছে একটি বিনোদন পার্ক। তাও আবার নগরের প্রাণ ঐতিহ্যবাহী পদ্মা নদীর তীরে। বিনোদনকেন্দ্রটির অবস্থান রাজশাহীর বড় কুঠিরে। কাগজ-কলমে পার্কটিকে বড় কুঠি বিনোদন বা রিক্রিয়েশন স্পট নামকরণ করা হলেও স্থানীয় মানুষের কাছে এটি পদ্মা রিভারভিউ গার্ডেন নামেই পরিচিত। প্রকল্পটি বাস্তবায়ন ও তত্ত্বাবধানকারী সংস্থা রাজশাহী সিটি করপোরেশন। প্রায় দুই মাসের প্রচেষ্টায় এটি গড়ে উঠেছে। নির্মাণে ব্যয় হয়েছে প্রায় ৩৪ লাখ টাকা। পার্কটি তৈরিতে একদিকে যেমন সাধারণ মানুষের বিনোদনের ব্যবস্থা হয়েছে, অন্যদিকে নদীভাঙন থেকে পদ্মাপাড় রক্ষার পাশাপাশি নদীতীরের সৌন্দর্যও বেড়েছে বহুগুণ।

পার্কটিতে সাধারণ মানুষের বিনোদনের জন্য রয়েছে বেশ কিছু আয়োজন। আগত দর্শনার্থীরা যেন স্বাভাবিকভাবে হাঁটাচলা করতে পারে সে লক্ষ্যে গড়ে তোলা হয়েছে প্রায় এক কিলোমিটার দীর্ঘ পায়ে চলা পথ (ওয়াকওয়ে)। এর পাশেই বিভিন্ন স্থানে বসার সুবিধার্থে স্থাপন করা হয়েছে বিভিন্ন আকৃতির বেঞ্চ বা বসার জায়গা। এর কোনো কোনোটি আবার গোলাকার ছাউনিতে ঘেরা। ঘুরতে ঘুরতে ক্লান্ত হয়ে কিংবা রোদ-বৃষ্টির হাত থেকে বাঁচতে দর্শনার্থীরা সহজেই এখানে আশ্রয় নিতে পারে। পায়ে চলা রাস্তার পাশেই বসেছে চটপটি, ফুচকা, হালিমের দোকান। এখানে ফুচকা খেতে খেতে নদীর সৌন্দর্য উপভোগ করার মজাই আলাদা। স্থানীয় বিভিন্ন সাংস্কৃতিক গোষ্ঠী যেন তাদের কর্মকাণ্ড প্রদর্শন করতে পারে সে বিষয়টিকে প্রাধান্য দিয়ে এখানে রয়েছে বেশ কটি উন্মুক্ত মঞ্চ। এসবের পাশাপাশি আকর্ষণ হিসেবে রয়েছে ফুডকোর্ট ও কফিশপ। ফুডকোর্টগুলোতে বার্গার, প্যাটিস, স্যান্ডউইচ, চটপটি, ফুচকার পাশাপাশি কফি ও কোমল পানীয় পাওয়া যায়। আগত দর্শনার্থীদের জন্য এখানে রয়েছে নৌকা ভ্রমণের ব্যবস্থা। নদীর ঘাটে নৌভ্রমণের জন্য সব সময়ই রয়েছে বেশ কিছু নৌকার আনাগোনা। কয়েকজন মিলে একটি নৌকা ভাড়া করে নদী ও নদীতীরের সৌন্দর্যমণ্ডিত নান্দনিক দৃশ্যগুলো উপভোগ করতে পারবে। নদীর ওপারেই রাশি রাশি কাশের বন। সাদা শুভ্র এ কাশবন থেকেও নৌকা নিয়ে কিছু সময়ের জন্য ঘুরে আসা যাবে সহজেই। সঙ্গে যদি ল্যাপটপ কিংবা পামটপ বা আইফোন থাকে, তাহলে পেয়ে যাবেন সম্পূর্ণ বিনা মূল্যে ইন্টারনেট ব্রাউজিংয়ের সুবিধা। কেননা এলাকাটি ফ্রি ওয়াইফাই জোনের আওতায়। একসঙ্গে প্রায় ২০০ জন বিশেষ এই সুবিধা ভোগ করতে পারবে। রাজশাহীসহ আশপাশের বিভিন্ন এলাকার বাসিন্দারা বনভোজন, আনন্দ ভ্রমণ, গেট টুগেদার ইত্যাদি সামাজিক অনুষ্ঠানের আয়োজন করতে এ পার্ক ও পদ্মার ওপারের বিশাল চরে সমবেত হয়। শুটিংস্পট হিসেবে ক্রমেই জনপ্রিয় হয়ে উঠছে এটি। মাঝেমধ্যে নাটক, ডকুমেন্টারি ও অন্যান্য অনুষ্ঠানের শুটিংও হয় এখানে। এলাকাটি পরিষ্কার রাখতে সিটি করপোরেশন থেকে দেওয়া হয়েছে ছোট ছোট ডাস্টবিন। এ ছাড়া এখানে রয়েছে মিনি চিড়িয়াখানা। যেখানে শোভা বাড়াচ্ছে কয়েকটি হরিণ ও নানা ধরনের রংবেরঙের পাখি। স্বল্প সময়ে এটি ছোটদের বিনোদনের অন্যতম আকর্ষণীয় কেন্দ্রে পরিণত হয়েছে।

প্রকল্পটি বাস্তবায়নের পর পাল্টে গেছে এলাকাটির দৃশ্যপট। একসময় জায়গাটি ছিল মাদকসেবী, ভবঘুরে ও বখাটেদের আড্ডাস্থল। কিন্তু এখন এটি শহরের অন্যতম আকর্ষণীয় বিনোদনকেন্দ্র। অনেকেই সপরিবারে বা বন্ধুবান্ধবসহ অবসর সময়টুকু কাটাতে আসে এখানে। বাচ্চারা মেতে ওঠে আনন্দ উল্লাসে। শহরের স্কুল, কলেজ, বিশ্ববিদ্যালয়সহ বিভিন্ন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের শিক্ষার্থীদের পদচারণে মুখর থাকে জায়গাটি। অতি উৎসাহীরা নদীর ওপারে গিয়ে চরে খেলাধুলায় মেতে ওঠে। ডায়াবেটিসে আক্রান্ত রোগী কিংবা স্বাস্থ্যসচেতন মানুষেরা এখানে নিয়মিত আসে হাঁটাহাঁটি ও ব্যায়াম করতে। তবে পার্কটি স্থাপনে সবচেয়ে বেশি উপকৃত হয়েছে পার্কসংলগ্ন অধিবাসীরা। নিরাপদ ও নির্মল বিনোদন স্থান পেয়েছে তারা। ইচ্ছে করলেই যখন তখন এখানে আসতে পারা যায়। গরমের দিনে এখানে ভ্রমণপিয়াসী মানুষের আনাগোনা বেড়ে যায়। নদীতীরের মুক্ত হাওয়ায় শরীর জুড়াতে ঘর ছেড়ে বেরিয়ে আসে অনেকেই। সন্ধ্যা থেকে রাত অবধি থাকে দর্শনার্থীদের সরব উপস্থিতি। বাংলাদেশ বেতার রাজশাহী কেন্দ্রের ডিউটি অফিসার জাহানারা বেগম তাঁর এক প্রতিবেশীকে নিয়ে প্রতিদিন হাঁটতে আসেন এখানে। হেঁটে হেঁটে কিছুটা ক্লান্ত হতেই বসে একটু জিড়িয়ে নিচ্ছেন, করছেন পারিবারিক আলাপও। তিনি জানালেন, ‘পাশেই আমার বাড়ি। আগে এখানকার পরিবেশ ছিল খুব খারাপ, পার্ক হওয়ায় পরিবেশটা এখন অনেক ভালো। এখানে বসে নদীতীরের মুক্ত আলো-বাতাস উপভোগ করা যায়।’ অল্প কিছুদিন হলো ডায়াবেটিস ধরা পড়েছে পূবালী ব্যাংকে কর্মরত ব্যাংকার সাঈদ আহমেদের। প্রতিদিন সকালে হাঁটতে আসেন এখানে। তাঁর মতে, সকালে নদীতীরের মুক্ত বাতাসে হাঁটাটা স্বাস্থ্যসম্মত। তাই পার্কটি তাঁদের জন্য আশীর্বাদস্বরূপ। তবে এখানে ঘুরতে আসা রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের একদল শিক্ষার্থী কিছু অসংগতির কথা জানালেন। তাঁদের মতে, পার্কটিতে পর্যাপ্ত বৃক্ষরোপণ করা হয়নি। নদীর পাড়গুলোকে আরও সুন্দরভাবে বাঁধানো যেত। এখানে ফুলের বাগান করার কথা থাকলেও যথাযথভাবে তা করা হয়নি। নদীতে পলি জমে নদীর গভীরতা অনেক কমে গেছে। নদীতে ড্রেজিং করতে পারলে এর প্রশস্ততা আরও বাড়ত। তা ছাড়া নদীর ওপারের বিশাল চর এলাকাকেও এই পরিকল্পনার আওতায় আনা যেত। রাজশাহী কলেজিয়েট স্কুলের নবম শ্রেণীর ছাত্র শুভ জানাল, পার্কটিতে দেশীয় প্রজাতির মাছের একটি অ্যাকুরিয়াম তৈরি করলে তা তাদের জ্ঞানার্জনে সহায়ক হতো।

বিনোদনের নতুন এ কেন্দ্র সম্পর্কে রাজশাহী সিটি করপোরেশনের প্রকৌশলী মোঃ নূর ইসলাম জানান, ‘এই পার্কটি গড়ে তোলায় রাজশাহীবাসী বিনোদনের একটি আদর্শ জায়গা পেয়েছে। আমরা স্বল্প বাজেটে এ রকম একটি প্রকল্পের সফল বাস্তবায়ন করতে সক্ষম হয়েছি।’ পার্কটিসহ নদীপাড়ের বিনোদনকেন্দ্রের উন্নয়ন সম্পর্কে পরিপূর্ণ তথ্য দিলেন সিটি করপোরেশনের প্রধান প্রকৌশলী মোঃ আশরাফুল হক। তিনি জানান, ‘৯ নম্বর ওয়ার্ডে কেন্দ্রীয় ঈদগাহের দক্ষিণে পাঠানপাড়ায়েপ্রায় দুই একর জায়গা নিয়ে আরও একটি বিনোদনকেন্দ্র গড়ে তোলা হচ্ছে। এর নির্মাণ ব্যয় ধরা হয়েছে এক কোটি ৭৭ লাখ ১৯ হাজার ৪৬৯ টাকা। ইতিমধ্যেই প্রকল্পটির প্রায় ৬৫ শতাংশ কাজ শেষ হয়েছে। প্রকল্পটিতে পূর্বের পার্কটির তুলনায় অধিক সুযোগ-সুবিধার ব্যবস্থা রাখা হয়েছে। এখানে থাকবে কৃত্রিম ঝরনা, কফিশপ, মুক্তমঞ্চ, বিশ্রামাগার প্রভৃতি। প্রকল্পটির মেয়াদকাল ১২০ দিন। এ ধরনের আরও কিছু প্রকল্প বাস্তবায়ন করা হবে, যা নদীর ধার দিয়ে বিশ্ববিদ্যালয় পর্যন্ত বিস্তৃত হবে। নদীর ধারে ২৮ নম্বর ওয়ার্ডে ফুলতলা ও ২২ নম্বর ওয়ার্ডে কুমারপাড়ায় আরও দুটি প্রকল্পের টেন্ডার হয়েছে। এ ছাড়া তালাইমারী, পঞ্চবতী, টিবাঁধসহ নদীপাড়ের বিভিন্ন স্থানে বিনোদন পার্ক গড়ে তোলা হবে। পদ্মা নদীর কোল ঘেঁষেই প্রায় ১০০ বিঘা জায়গা নিয়ে রাজশাহী শহীদ কামারুজ্জামান কেন্দ্রীয় উদ্যানকে একটি আকর্ষণীয় বিনোদনকেন্দ্রে রূপান্তর করা হবে।’ তিনি আরও বলেন, ‘প্রায় ১৭ কিলোমিটার লম্বা এবং এক কিলোমিটার প্রশস্ত চরের একটি এলাকা উন্নয়নের পরিকল্পনা নেওয়া হয়েছে। ভবিষ্যতে সেখানে স্বল্পপরিসরে হলেও একটি ইকো পার্ক গড়ে তোলা হবে। খেলাধুলার উন্নয়নের স্বার্থে পদ্মার বালুচরের বিভিন্ন স্থানে ফুটবল, ভলিবলের মতো খেলার ব্যবস্থা করা হবে। সেখানে কিছু ছাতা বসিয়ে বিশ্রামের স্থান নির্মাণ করা হবে। শহরকে ঘিরে পদ্মা নদীর যে পাড় রয়েছে, তার উন্নয়ন করা হবে। আরও মহাপরিকল্পনা রয়েছে পুরো এলাকাকে ঘিরে। ইতিমধ্যে এক কিলোমিটার ওয়াকওয়েসহ ১২ কিলোমিটার বাঁধে রাস্তা করা হয়েছে, সেখানে কালভার্ট ও ব্রিজও রয়েছে। নদীতীর এলাকায় ১০টি বিনোদন পার্ক করার ইচ্ছা রয়েছে। তবে এ কাজগুলো ভালোভাবে সম্পন্ন করতে আরও এক কোটি টাকার প্রয়োজন। পদ্মাপাড় তথা রাজশাহী শহরকে একটি আধুনিক শহর হিসেবে প্রতিষ্ঠা করতে রাজশাহী সিটি করপোরেশনের তরফ থেকে সব ধরনের প্রচেষ্টা অব্যাহত রয়েছে।’
নদীমাতৃক বাংলাদেশের নদীগুলো নানাভাবে হচ্ছে দখল আর দূষণের শিকার। অবৈধ স্থাপনা নির্মাণ করে এর পাড়গুলোকে দখলমুক্ত করার দাবি এখন সবার। সারা বাংলাদেশে নদীর পাড়গুলোকে যদি এ ধরনের পার্ক বা বিনোদনকেন্দ্র হিসেবে গড়ে তোলা যায় তাহলে একদিকে যেমন বাঁচবে নদী, অন্যদিকে মানুষের স্বাভাবিক বিনোদনও নির্র্র্শ্চিত হবে। এ জন্য এগিয়ে আসতে হবে সরকারের সংশ্লিষ্ট মহলকে। তা ছাড়া দেশের সব সিটি করপোরেশন, পৌরসভা, ইউনিয়ন পরিষদের তরফ থেকে যদি এ ধরনের উদ্যোগ গ্রহণ করা হয় তা হলে তাতে উপকৃত হবে এলাকাবাসী, রক্ষা পাবে সবুজ প্রকৃতি ও পরিবেশ। তাই এ ধরনের উদ্যোগ বাস্তবায়নে প্রয়োজন সংশ্লিষ্ট মহলের একটু সদিচ্ছা ও সরকারের ঐকান্তিক সহযোগিতা।
মাহফুজ ফারুক
প্রকাশকাল: বন্ধন ৩৫ তম সংখ্যা, মার্চ ২০১৩