নিচে দেখো না! দেয়াল ঘেঁষে চলো! সাবধানে এগোও। আপনি যদি পৃথিবীর অন্যতম ভীতিকর ওই রাস্তায় হাঁটতে চান, তাহলে মন শান্ত রেখে আপন মনেই বলতে হবে কথাগুলো। বলতে পারেন রাস্তা পেরোনোর মন্ত্রও এটা। একবারও যদি নিচে না তাকান, তবেই বুঝবেন আপনি আছেন পৃথিবীর সবচেয়ে রোমান্সকর স্থানে। স্বর্গ দেখতে কে না চায়! পৃথিবীর বুকে সেই স্বাদ পেতে চাইলে ওমন রাস্তা আপনাকে পেরোতেই হবে। স্বপ্নে হয়তো প্রায়ই দেখেন আপনি শূন্যে হাঁটচ্ছে! আপনার স্বপ্ন পুরোপুরি সত্য না হলেও তার অনেকটাই কাছাকাছি যেতে পারবেন আপনি। এ কথা কিন্তু হলফ করে বলা যায়। কারণ, চীনের প্রকৌশলীরা সম্পূর্ণ স্বচ্ছ কাচ দিয়ে নির্মাণ করেছেন ঝুলন্ত পায়ে হাঁটা এক পথ। পথটি মিশেছে সোজা স্বর্গের দুয়ারে।
চীনের হুনান প্রদেশের পর্বতঘেরা শহর জেনজিয়াজি (Zhangjiajie)। প্রাকৃতিক সৌন্দর্যের লীলাভূমি খ্যাত পার্বত্য এ শহর থেকে আট কিলোমিটার দূরে পবিত্র পর্বত তিয়ানমেন (Tianmen)। পর্বতটিকে বলা হয় শহরের আত্মা। যুগ যুগ ধরে চীনাদের বিশ্বাস, এই পর্বতেই রয়েছে স্বর্গে প্রবেশের দ্বার। স্বর্গ দুয়ারী পর্বত নামেই এর পরিচিতিটা বেশি। স্বর্গ দ্বারের অবস্থান পর্বতের ইয়ং মেং ফেয়ারি সামিট চূড়ায়। সমুদ্রপৃষ্ঠ থেকে যার উচ্চতা এক হাজার ৫১৮ মিটার। আর প্রাকৃতিক স্বর্গদ্বারের উচ্চতা ১৩১ দশমিক ৫ মিটার। পর্বতের গায়ে রয়েছে বিশাল এক শূন্যস্থান। দেখলে যেন মনে হয় অপার্থিব জগতে প্রবেশের সত্যিকারের দরজা এটি। দিনে সূর্র্য ও রাতে চাঁদের মায়াবী আলো যেন ঠিকরে পড়ে আলো আধারির জগৎ থেকে। তা ছাড়া পুরো পর্বত জুড়েই রয়েছে হাজারো প্রাকৃতিক গুহা। যা পর্বতটিকে করেছে রহস্যমন্ডিত। তাই একে ঘিরে শেষ নেই রূপকথা, গল্প আর কিংবদন্তির। প্রজন্মের পর প্রজন্ম চীনারা বিশ্বাসে যা ধারণ করছে দৃঢ়ভাবে। পবিত্রতার জন্য টং সাম্রাজ্যকালে এই চূড়াতেই একটি বিশাল মঠ নির্মাণ করা হয়। ঐতিহ্যবাহী এ বৌদ্ধ মন্দিরে প্রতিবছর জড়ো হয় হাজারো পুণ্যার্থী। তবে রাজ্য সরকার একে শুধু চীনাদের মধ্যেই সীমাবদ্ধ না রেখে পর্বতেই কাচের রাস্তা, ঝুলন্ত তার গাড়ি (কেব্ল কার), ইকো পার্ক ইত্যাদি নানা সুবিধায় পর্যটকদের জন্য আধুনিকভাবে সাজিয়েছে। তাই পর্বতটি হুনান প্রদেশ ছাড়িয়ে পরিচিতি পেয়েছে চীন জুড়ে; এমনকি সারা বিশ্বে। তবে এখানকার সবচেয়ে আকর্ষণীয় দিক কাচ নির্মিত ওই রাস্তাটি।

স্বর্গে যাওয়ার রাস্তাটা কিন্তু সোজা নয়; নানা বিপত্তি আর চড়াই-উৎরাই পেরিয়েই না সেখানে পৌছাঁ যায়। ঠিক তেমনই তিয়ানমেনের স্বর্গ সড়কটি। পর্বতের গা বেয়ে পুরো ১১ কিলোমিটার লম্বা রাস্তা; বাঁক ৯৯টি, যা এঁকেবেঁকে উঠেছে স্বর্গ সামিটে। একে বলা হয়, স্বর্গের রাস্তা (The Avenue Toward Heaven)। রাস্তাটি পর্বতের যত উঁচুতে উঠবে, ততই সরু হতে থাকবে। একসময় এক পায়ে পথ ধরে এগিয়ে যেতে হবে। আর এই পথটিকে আরও আকর্ষণীয় করতেই তৈরি করা হয়েছে ২০০ মিটার দীর্ঘ একটি কাচ রাস্তা। একদিকে পাথুরে দেয়াল অন্যদিকে বিস্তৃত শূন্যতা। পাথুরে পর্বতের গায়ে এই ক্লিফ ফেইসের উচ্চতা সমুদ্রপৃষ্ঠ থেকে চার হাজার ৭০০ ফুটেরও বেশি। মাত্র তিন ফুট প্রশস্ত এই হাঁটাপথে লাগানো হয়েছে ২ দশমিক ৫ ইঞ্চি মোটা কাচ। কাচগুলো স্টিল ফ্রেমের সঙ্গে স্কু ও বিশেষ ধরনের আঠার সাহায্যে সাঁটানো। চীনে এটাই প্রথম গ্লাসপথ। এর আগে যুক্তরাজ্যের আরিজোনা রাজ্যে গ্রান্ড ক্যানিয়নে এ ধরনের একটি পথ তৈরি করা হয়। রাস্তাটি তৈরিতে চীনা প্রকৌশলীদের ঘাম ছুটে গিয়েছিল। পর্বতের একটি চূড়া থেকে ঝুলে ঝুলে ড্রিল করে ইস্পাতের পাত বসানো হয়েছিল। এর ওপর বসানো হয়েছে কাঠের পাটাতন। সেখানে দাঁড়িয়েই পাথর কেটে ও তার গায়ে ড্রিল করে স্টিলের ফ্রেম বসিয়ে সেখানে শক্তপোক্ত কাচ বসানো হয়। হাজার মিটার উচ্চতা থেকে ঝুলে কাজ করার বিষয়টি প্রকৌশলীদের কাছে ছিল ভয়মিশ্রিত ভালো লাগার মতন চ্যালেঞ্জিং এক কাজ। যা তাঁরা ভালোভাবেই শেষ করতে পেরেছিল। তবে রাস্তাটি যারা নিয়মিত দেখভাল করে, পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন রাখে, এখনো তারা ভয়কে জয় করতে পারেনি। কাজের মাঝে হঠাৎ করেই হাজার মিটার গভীরে দৃষ্টি গেলে আঁতকে ওঠে কেউ কেউ; আওড়াতে থাকে ধর্মীয় শ্লোক। রাস্তাটি নির্মাণে পাহাড়ি ঢল বা ফ্লাশফ্লাডের মতো বিষয়টিও বিতর্কে আসে। তবে প্রকৌশলীরা পর্যটকদের অভয় দিয়ে বলেন, ‘আসুন, দেখুন এবং ভয়কে জয় করুন।’

যদি ভেবে থাকেন ব্যাপারটা একটু বাড়াবাড়ি হয়ে যাচ্ছে, এ আর এমন কি; যে কেউ যেতে পারবেন এ পথ পেরিয়ে। তবে বলতেই হয় আপনি বাস করছেন বোকার স্বর্গে। কাচ রাস্তাটি কোনোভাবেই দুর্বলচিত্তদের জন্য নয়। কেননা, অনেকটা পথ হেঁটে এমনিতেই আপনি ক্লান্ত। এরপর যখন কাচ রাস্তায় আসবেন, তখন রীতিমতো পা দুটি কাঁপতে থাকবে থরথর করে; পায়ের ভেতর শিরশির অনুভূতি হবে; গলা শুকিয়ে যাবে। ভয়ে আপনি পর্বতের গায়ের লতা-গুল্মকে জড়িয়ে ধরতে চাইবেন। পদার্থবিজ্ঞান যদি আপনি নাও জানেন, তাহলেও আইনস্টাইনের আপেক্ষিক তত্ত্ব কী তা খুব সহজেই বুঝবেন এখানে এলে। সামান্য এই ২০০ মিটার রাস্তা পেরোতে আপনার মনে হবে আপনি যেন মাইল মাইল পথ পাড়ি দিচ্ছেন। এর প্রমাণও মেলে ভূরি ভ‚রি। প্রায়ই অনেক টুরিস্ট এই পথের মাঝামাঝি এসে আর সামনে এগোতে চায় না। থেমে বসে পড়ে; আতঙ্কে চিৎকার করে। অনেকে আবার গাইড কিংবা সহযাত্রীর হাত ধরে চোখ বুজে রাস্তাটি পার হয়। এ নিয়ে পার্ক কর্তৃপক্ষকেও কম বিড়ম্বনা পোহাতে হয় না! যদিও নেই কোনো দুর্ঘটনা ঘটার শঙ্কা। কারণ, রাস্তায় রয়েছে শক্তপোক্ত কাচ ও স্টিলে রেলিং। হাইট ফোবিয়া বা উচ্চতাজনিত ভীতির কারণে স্নায়ু সহজেই দুর্বল হতে পারে, তাই টুরিস্টসহ অন্যদের প্রতি পরামর্শ থাকে, যতটা সম্ভব পাথরের গা ঘেঁষে চলার। মহিলা ও শিশুদের ক্ষেত্রে থাকে বাড়তি সতর্কতা। বৃষ্টি কিংবা শিশির পড়ে যখন কাচ ভিজে যায় তখন এ পথ হয় আরও ভয়াবহ। তবে ভয়কে জয় করে যে এই পথে যাবে সে দেখা পাবে এক নৈসর্গিক অনাবিল সৌন্দর্যের। কাচ রাস্তার ওপর থেকে নীচে তাকালেই দেখা মিলবে বিশাল সবুজ উপত্যকায় যেন কার্পেট বিছানো। শতবর্ষী বৃক্ষগুলোও যেন ছুঁতে চাইছে আকাশ।
তিয়ানমেন পার্বত্য এলাকাটি ১৯৯২ সালে প্রতিষ্ঠা লাভ করে ন্যাশনাল ফরেস্ট পার্ক হিসেবে। পর্যটকদের নজর কাড়তে নেওয়া হয় আকর্ষণীয় নানান ব্যবস্থা। তাই পর্বতটি এখন দুর্গমতা ছাড়িয়ে ভ্রমণপিপাসুদের জন্য হয়ে উঠেছে আদর্শ এক পর্যটনকেন্দ্র। সকলের সুবিধার্থে পর্বতের গায়ে নির্মিত হয়েছে যন্ত্রযানচালিত রাস্তা। পর্বতের ওপরে যেখানে রাস্তা করা সম্ভব হয়নি, সেখানে করা হয়েছে পায়ে হাঁটা পথ। পর্বতের গা বেয়ে গড়ে তোলা রাস্তা ধরে মাইলের পর মাইল হাঁটা যায়। পুরো এলাকাটি ভালোভাবে পরিদর্শনের জন্য সংযোজিত হয়েছে ৭ দশমিক ২ কিলোমিটার দীর্ঘ কেব্ল কার। পার্বত্য এলাকায় এটাই বিশ্বের সবচেয়ে বড় কেব্ল কার সিস্টেম। পর্বতটি দুর্লভ প্রজাতির উদ্ভিদ ও প্রাণীদের বিশাল এক ভান্ডার। তাই ভ্রমণের পাশাপাশি অদেখা বিচিত্র সব প্রাণী ও উদ্ভিদ দর্শনের সুযোগও দর্শনার্থীদের বাড়তি পাওনা।

কাচ রাস্তাটি যতই ভীতি জাগানিয়া হোক, তাই বলে কি সেখানে আপনার পদচিহৃ পড়বে না? ভয় তো লাগতেই পারে; ভয়কে করতে হবে জয়। ঘুরে ও দেখে আসতে পারেন বিশ্বের অন্যতম ভয়ঙ্কর কাচ রাস্তা, চড়তে পারেন হাজার মিটার ওপরে কেব্ল কারে যা আপনাকে পৌঁছে দেবে স্বর্গ দুয়ারে। এ পৃথিবীতেই যদি পান স্বর্গের স্বাদ, তবে মন্দ কী?
মারুফ আহমেদ
প্রকাশকাল: বন্ধন ৪৫ তম সংখ্যা, জানুয়ারি ২০১৪