পরিবেশবান্ধব পরিকল্পিত নগরায়ণ

ক্রমেই বসবাসের অনুপযোগী পরিত্যক্ত নগরীতে পরিণত হচ্ছে মেগাসিটি ঢাকা। এ অবস্থা থেকে উত্তরণে প্রয়োজন ঢাকা নগরীকে পরিবেশবান্ধব পরিকল্পিত নগরায়ণে রূপান্তর করা। এ বিষয়ে বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের (বুয়েট) স্থাপত্য বিভাগের বিভাগীয় প্রধান অধ্যাপক ড. কাজী আজিজুল মাওলার সাথে আলাপচারিতার পর লিখেছেন সারোয়ার কবির শত বছরের পুরনো ঢাকা নগরীর উন্নয়নে হাজার হাজার কোটি টাকা খরচ করার পরও বিজ্ঞজনের আশঙ্কা, এই নগরী মানুষের বসবাসের অযোগ্য হয়ে পড়বে। এই নগরীর পরিবেশ দূষণ, যানজট, স্বাস্থ্য, পানি, শিক্ষা, যোগাযোগ কোনো বিষয়ই পরিবেশবান্ধব নয়। বরং দিন দিন খারাপ হচ্ছে। অথচ একদিন এই শহরই ছিল একটি আদর্শ নগরী। বিশ্বায়ন ও পরিবর্তিত পৃথিবীর বিভিন্নমুখী চাহিদার প্রেক্ষিতে এ নগরীর পরিকল্পিত পরিবেশবান্ধব রূপ ফিরিয়ে আনা এখন সময়ের দাবি। 

যে কারণে পরিকল্পিত নগরায়ণ

পরিকল্পিত নগর পরিকল্পনায় সর্বপ্রথম জানতে হবে নগর তৈরির উদ্দেশ্য। একটি শহর গড়ে ওঠে মানুষকে উন্নত কর্মসংস্থান, শিক্ষা ও স্বাস্থ্যসেবা, বিনোদনের সুযোগ প্রদান এবং মানুষের পারস্পরিক সম্পর্ক বৃদ্ধির মিলনকেন্দ্র হিসেবে। এই সব সুবিধা মানুষের হাতের নাগালের মধ্যেই থাকা উচিত। এই সুবিধাগুলো প্রদানের মাধ্যমেই পরিকল্পিত নগরায়ণ নিশ্চিত করা সম্ভব।

ঢাকা নগরের আয়তন অনুসারে জনসংখ্যা ৫০ লক্ষ হওয়া উচিত। অথচ বর্তমানে প্রায় ২ কোটি লোক বসবাস করছে। কারণ একটাই, ঢাকা নগরকেন্দ্রিক সব ব্যবস্থার কারণেই মানুষ ঢাকা নগরমুখী হতে চায়। ঢাকা মহানগরী ৫৯০ বর্গমাইল এলাকাজুড়ে বিস্তৃত, যার সম্পূর্ণ এলাকা উন্নয়ন উপযোগী নয়। এ বিষয়ে সুস্পষ্ট নীতিমালা সংবলিত ঢাকা স্ট্রাকচার প্ল্যান (১৯৯৫-২০১৫) চ‚ড়ান্ত অনুমোদন লাভ করে ১৯৯৭ সালে। ডিটেইল্ড এরিয়া প্ল্যানে (ড্যাপ) বলা হয়েছে, ঢাকা নগর ডেভেলপমেন্ট প্ল্যানের আওতায় ঢাকা স্ট্রাকচার প্ল্যান (১৯৯৫-২০১৫) এবং আরবান এরিয়া প্ল্যান (১৯৯৫-২০০৯) প্রণয়নের কাজ ১৯৯২-১৯৯৫ সালে সম্পন্ন করা হয়, যা ১৯৯৭ সালে গেজেট আকারে প্রকাশিত হয়। উক্ত পরিকল্পনার আওতায় তৃতীয় ধাপ হিসেবে ঢাকা নগরের আয়তন বৃদ্ধি করে ৫৯০ বর্গমাইল (১৫২৮ বর্গকিলোমিটার) এলাকাব্যাপী ডিটেইল্ড এরিয়া প্ল্যান (ড্যাপ) প্রণয়ন করা হয়। ড্যাপের আওতাভুক্ত সীমানা উত্তরেÑ গাজীপুর পৌরসভার উত্তরপ্রান্ত; দক্ষিণে ধলেশ্বরী নদী; পশ্চিমে বংশী নদী ও ধলেশ্বরী নদী এবং পূর্বে শীতলক্ষ্যা নদী, মেঘনা নদী ও সোনারগাঁ থানার অংশবিশেষ পর্যন্ত বিস্তৃত। ঢাকা সিটি কর্পোরেশন এলাকাসহ নারায়ণগঞ্জ ও কদমরসুল, সিদ্ধিরগঞ্জ, তারাবো, সাভার, টঙ্গী ও গাজীপুর পৌরসভা, সাভার ইপিজেড, কেরানীগঞ্জ, জিঞ্জিরা এবং রূপগঞ্জ ও কালীগঞ্জ থানার অংশবিশেষ রাজউকের অন্তর্ভুক্ত। সরকার ২০১০ সালের ২২ জুন ‘ডিটেইল্ড এরিয়া প্ল্যান’ (ড্যাপ) গেজেট আকারে প্রকাশ করে। ড্যাপে প্রায় ২০ শতাংশ এলাকা ‘আবাসিক’ ভূমি ব্যবহার হিসেবে চিহ্নিত করা হয়েছে, তা ছাড়া বিভিন্ন প্রকার মিশ্র  ভূমি ব্যবহার হিসেবে ৫ শতাংশ ভূমি চিহ্নিত করা হয়েছে, যা পরিকল্পিতভাবে উন্নয়নের জন্য ডেভেলপার উদ্যোক্তাদের নিরাপদ বিনিয়োগ ক্ষেত্র হতে পারে।

অধ্যাপক ড. কাজী আজিজুল মাওলা

দেশের প্রতিটি মানুষই নগরীয় সুযোগ-সুবিধা প্রত্যাশী। সেজন্য নগরীয় জীবনের প্রতি মানুষের বিশেষ দুর্বলতা রয়েছে। পরিসংখ্যান বলছে, বাংলাদেশে বর্তমানে প্রায় ৪ কোটি লোক নগরে বাস করছে। আগামী ২০২০ সাল নাগাদ প্রায় অর্ধেক জনগোষ্ঠী এবং ২০৫০ সাল নাগাদ প্রায় সমগ্র জনগোষ্ঠী নগরীয় এলাকায় বসবাস করবে (যেমনভাবে জাপান, অস্ট্রেলিয়া, জার্মানি, ফ্রান্স, কানাডা, যুক্তরাজ্য, যুক্তরাষ্ট্র, ইতালি প্রভৃতি দেশের জনগণ নগরীয় সুবিধা নিয়ে বসবাস করছে)। তাই এখন থেকে পরিবেশবান্ধব পরিকল্পিত নগরায়ণের বিষয়টি সুনিশ্চিত করতে হবে। এ জন্য প্রয়োজন ঢাকাকে ঘিরে পরিবেশবান্ধব পরিকল্পিত নকশা প্রণয়ন। সরকারের কাজ হবে এই নকশা বাস্তবায়ন করা। কিন্তু বাস্তবে তা হচ্ছে না। উদাহরণস্বরূপ বুড়িগঙ্গা নদী রক্ষার বিষয়টি প্রাসঙ্গিক হতে পারে। সরকার বুড়িগঙ্গা নদীর তলদেশের স্তূপীকৃত পলিথিন ও বর্জ্য অপসারণের জন্য ৫ কোটি ৬২ লাখ টাকার এক পাইলট প্রকল্প হাতে নিয়েছে। কিন্তু একদিকে বর্জ্য উত্তোলন ও অন্যদিকে নতুন করে বর্জ্য ফেলার কারণে পুরো টাকাই জলে যাচ্ছে। প্রতিদিন ৫শ’ লিটার করে বর্জ্য উত্তোলন করা হলেও বিভিন্ন পয়েন্ট থেকে নদীর উভয় পারের লোকজন ১০ টন করে গৃহস্থালি বর্জ্য নতুনভাবে ফেলছে। আর তাই বুড়িগঙ্গা নদী রক্ষার উদ্যোগ নিতে হবে এখনই। 

নগর উন্নয়ন পরিকল্পনা

নগর পরিকল্পনা একটি বহুমাত্রিক ক্ষেত্র, যার সাথে দেশের অবকাঠামোগত পরিকল্পনা, পরিবেশ ব্যবস্থাপনা, ভূমি ব্যবহার পরিকল্পনা, ড্রেনেজ ব্যবস্থা উন্নয়ন, পরিবহন পরিকল্পনা, ট্রাফিক ব্যবস্থাপনা, ইউটিলিটি এবং সার্ভিসেস পরিকল্পনাসহ নানা বিষয় সম্পৃক্ত। বাংলাদেশে তিন পর্যায়ের নগর উন্নয়ন পরিকল্পনার প্রচলন রয়েছে। যথা ক. দীর্ঘমেয়াদি কৌশলগত পরিকল্পনা (Structure Plan) খ. মধ্যমেয়াদি শহরায়িত এলাকার মাস্টার প্ল্যান (Urban Area Plan) এবং গ. বিস্তারিত এলাকা পরিকল্পনা (Detailed Area Plan)। সংবেদনশীল নগর পরিকল্পনার মাধ্যমে সব নাগরিকের জন্য নিরাপদ আবাসন, স্বাস্থ্যসম্মত পরিবেশ, সব ধরনের কমিউনিটি সেবা যেমন- স্কুল, হাসপাতাল, বর্জ্য নিষ্কাশন ব্যবস্থা নিশ্চিতকরণের মাধ্যমে নিরাপদ ও ঝুঁকিহীন পরিবেশ সৃষ্টি করে নাগরিকের সুন্দর জীবন নিশ্চিত করা যায়।

ইট পাথর আর কংক্রিটের নগর

মিশ্র এলাকা

মিশ্র এলাকা একটি শহরের জন্য আদর্শ। নগরবাসীর মূল উদ্দেশ্য যাতায়াত নয় বরং দ্রব্য এবং সেবাপ্রাপ্তি। এই সব সুবিধা থাকার জায়গার খুব কাছাকাছি পাওয়া গেলে যাতায়াতের প্রয়োজনীয়তা কমে যায়, এর ফলে অবকাঠামো গঠনের সময় রাস্তাঘাট নির্মাণের চেয়ে অন্যান্য প্রয়োজনীয় বিষয়ে অধিক গুরুত্ব দেওয়া যায়। উপরোক্ত সুবিধাগুলো নগর পরিকল্পনায় সমন্বিত করার মাধ্যমে মানুষের জীবনযাত্রার মান যেমন উন্নত হয়, তেমনি একটি আন্তরিক, পরিবেশবান্ধব বসবাস উপযোগী শহর গড়ে ওঠে। আমাদের দেশের নগরগুলোর অধিকাংশ এলাকা মিশ্র ব্যবহারভিত্তিক। এখানে খুব অল্প দূরত্বেই প্রায় সব নাগরিক সুবিধা পাওয়া যায়। কিন্তু বর্তমান নগর পরিকল্পনা, বিশেষ করে ঢাকায় ক্রমেই এই সুবিধাটুকু নষ্ট হয়ে যাচ্ছে।

ঢাকা শহরের কর্মকান্ডকে সুষ্ঠুভাবে পরিচালনার লক্ষ্যে ১৩টি জোনে বিভক্ত করা হয়েছে। কোন্ জোন কী কাজে ব্যবহৃত হবে সেটিও নির্ধারণ করা হয়েছে। কোনোটি আবাসিক, কোনোটি আবার বাণিজ্যিক। শহরের কর্মকান্ড সুষ্ঠুভাবে পরিচালনার জন্য জোন ভাগ করার প্রয়োজন রয়েছে। তবে প্রতিটি জোনের জন্য কী কী সুবিধা থাকা প্রয়োজন তা নির্ধারণ করা কঠিন। তার পরও কিছু বিষয় বা উপাদান রয়েছে যেগুলো মানুষের বসবাসের ক্ষেত্রে অত্যাবশ্যকীয়। যেমন শিক্ষা, স্বাস্থ্য, বাজার, বিনোদন, আবাসন, কর্মসংস্থান ইত্যাদি। প্রতিটি জোনে অল্প দূরত্বে এ সব সুবিধা থাকলে যাতায়াতের চাহিদা কমানো যাবে। এদিক থেকে ঢাকা শহরের কাঠামোটি ইতিবাচক। তবে সমস্যা হলো ঢাকার বিভিন্ন অঞ্চলের মধ্যে বৈষম্য বৃদ্ধি পাচ্ছে। শহরে কোনো একটি এলাকায় গড়ে উঠছে ভালো ভালো শিক্ষা-স্বাস্থ্য সেবাদানকারী প্রতিষ্ঠান, বাজার, অফিস, বিনোদন কেন্দ্র। শহরের প্রতিটি জোনে প্রয়োজনের ভিত্তিতে এ সব সুযোগ-সুবিধা নিশ্চিত করতে হবে; যা যানজট নিয়ন্ত্রণ করবে এবং যাতায়াতের চাহিদা হ্রাস পাওয়ায় মানুষ অতিরিক্ত খরচের হাত থেকে মুক্তি পাবে।

নগরের পরিবেশ ও স্বাস্থ্য

মানুষের সার্বিক কল্যাণের কথা চিন্তা করে একটি টেকসই নগর গড়ে তোলার জন্য গণমুখী ইকো নগরায়ণের প্রতি গুরুত্ব দেওয়া প্রয়োজন। গণমুখী ইকো নগর পরিকল্পনায় নগরকে কিভাবে সর্বস্তরের মানুষের জন্য বাসযোগ্য এবং পরিবেশ উপযোগী হিসেবে গড়ে তোলা যায় সেদিকে নজর দেওয়া হয়। নগরের যে কোনো অবকাঠামো বা উন্নয়ন কর্মকান্ড কিভাবে পরিবেশবান্ধব এবং সকল শ্রেণীর মানুষের জন্য সহজগম্য করা যায় সেটিই গণমুখী নগর পরিকল্পনার মূল লক্ষ্য।

নগরীর অসহনীয় যানজট ও আকাশ ছোঁয়া ইমারত

একটি শহরের পরিকল্পনা নাগরিকদের দৈনন্দিন জীবন এবং কার্যক্রমকে নানাভাবে প্রভাবিত করে। নগর পরিকল্পনা হওয়া প্রয়োজন মানুষের কথা মাথায় রেখে। একটি সুষ্ঠু সুন্দর পরিবেশবান্ধব পরিকল্পিত নগরী দক্ষ মানবগোষ্ঠী গড়ে তুলতে সহায়ক। গণমুখী টেকসই সমন্বিত নগর পরিকল্পনা প্রণয়নের মাধ্যমে মানুষের জীবনযাত্রার মান যেমন উন্নত হবে, তেমনি একটি আন্তরিক, পরিবেশবান্ধব বসবাস উপযোগী নগর গড়ে উঠবে।

আমাদের শহরগুলোতে বাসস্থানের পাশাপাশি প্রচুর গাছপালা থাকা উচিত, প্রাকৃতিক পরিবেশ ক্ষতিগ্রস্ত হবে না, শিশুরা ঘরের বাইরে নিরাপদে খেলাধুলার পরিবেশ পাবে, নগরবাসী পাবে একটি সুস্থ বিনোদনের পরিবেশ; যেখানে নগরের গতানুগতিক যান্ত্রিকতা এড়িয়ে আন্তরিকতাপূর্ণ সুন্দর জীবন উপভোগ করা যাবে।

বর্তমানে বিশ্বব্যাপী জলবায়ু পরিবর্তনের ব্যাপক প্রভাব পড়ছে। জলবায়ু পরিবর্তন রোধে ইকো নগরায়ণ অত্যন্ত কার্যকর ভূমিকা পালন করে। ইউরোপের বিভিন্ন শহরের সবচেয়ে আকর্ষণীয় অংশগুলো অনেক পুরনো এবং এগুলো গড়ে উঠেছিল কোনো রকম পরিকল্পনা ছাড়া শহরে বসবাসকারীদের বিভিন্ন প্রয়োজনের ধারাবাহিকতায়।

অপরদিকে দেখা যাচ্ছে, আধুনিক পরিকল্পিত নগরী নগরজীবনে বিভিন্ন সমস্যা তৈরি করছে। পরিকল্পনার মাধ্যমে একটি কংক্রিটে ঘেরা নগরী আমরা তৈরি করতে পারব কিনা সেটা অবশ্যই আদর্শ বসবাস উপযোগী নগরী হবে না। বর্তমানে নগর পরিকল্পনায় যেটি প্রধান সমস্যা, আমরা নগরীর অন্যান্য সব রকম চিন্তা বাদ দিয়ে প্রাধান্য দিচ্ছি নগরীর যাতায়াত ব্যবস্থাকে এবং যাতায়াত ব্যবস্থায় প্রাধান্য পাচ্ছে প্রাইভেট কার।

নগরের আবাসন সংস্থান করতে গিয়ে আমরা মানুষের কল্যাণের দিকটি চরমভাবে উপেক্ষা করছি। নগরের মধ্যে এবং শহরের নিকটবর্তী স্থানে বিভিন্ন আবাসিক এলাকা গড়ে তোলার ক্ষেত্রে প্লটভিত্তিক উন্নয়ন করায় মানুষের মধ্যে পারস্পরিক যোগাযোগের সুযোগ কমে যাচ্ছে। এ ধরনের আবাসিক এলাকায় কাছাকাছি বাজার, শিক্ষা ও স্বাস্থ্যসেবা প্রতিষ্ঠান, অফিস না থাকায় দূরে যাওয়ার প্রয়োজন পড়ে। এ ছাড়া বিনোদনের সুবিধা ও মানুষের মেলামেশার জন্য উন্মূক্ত জায়গা না থাকায় পারস্পরিক যোগাযোগ ব্যাহত হয়। একইভাবে অ্যাপার্টমেন্ট ভিত্তিক যে আবাসন ব্যবস্থা গড়ে উঠছে তাতেও মানুষের সাথে মানুষের সামাজিক যোগাযোগের সুযোগ রাখা হচ্ছে না। ফলে আগে আমাদের এলাকাভিত্তিক যে আন্তরিক পরিবেশ ছিল তা ক্রমেই নষ্ট হয়ে যাচ্ছে। মানুষের সাথে মানুষের দূরত্ব বেড়ে যাচ্ছে, যা সমাজের সার্বিক নিরাপত্তার জন্য হুমকিস্বরূপ।

নগরীর যানজট নিরসনে প্রস্তাবিত মেট্রােরেল প্রকল্প

একটি পরিবেশবান্ধব বসবাস উপযোগী নগরী গড়ে তোলার ক্ষেত্রে নগর পরিকল্পনায় যে বিষয়গুলো প্রাধান্য দেওয়া দরকার-

গণমুখী সমন্বিত পরিবহন পরিকল্পনা

আমাদের নগর পরিকল্পনায় পরিবহন ব্যবস্থা এবং তার সাথে সম্পৃক্ত অন্যান্য বিষয়কে বিবেচনা করা দরকার। আমাদের মনে রাখতে হবে, মানুষের মূল উদ্দেশ্য যাতায়াত নয় বরং দ্রব্য এবং সেবাপ্রাপ্তি। আমাদের পরিবহন পরিকল্পনার মূল সমস্যা এখানেই যে, যাতায়াত উদ্দেশ্য বিবেচনা না করেই পরিকল্পনা করা হয়। মানুষ যদি তার প্রয়োজনীয় জিনিসগুলো হাতের কাছেই পেয়ে যায়, তা হলে আর দূরে যাওয়ার প্রয়োজন হয় না। শহরের অবকাঠামো এমনভাবে তৈরি করা প্রয়োজন যার ফলে মানুষের দূরে যাওয়ার প্রয়োজনীয়তা অনেকাংশে হ্রাস পায়।

এখন পর্যন্ত আমাদের শহরগুলোতে কাছাকাছি বাজার, শিক্ষা ও স্বাস্থ্যসেবা প্রতিষ্ঠান, কর্মসংস্থান, বিনোদনের সুবিধা অধিকাংশ যাতায়াতই হয়ে থাকে স্বল্প দূরত্বে। আর এর জন্য হেঁটে চলা বা অযান্ত্রিক যানের ব্যবহার হয়ে থাকে সবচেয়ে বেশি। কিন্তু আমাদের নগরের পরিবহন পরিকল্পনাগুলো কখনই এই সকল গুরুত্বপূর্ণ যোগাযোগ মাধ্যম যথাযথ গুরুত্ব পায়নি। একই সাথে নগরের ভূমি ব্যবহার পরিকল্পনা এবং পরিবহন পরিকল্পনার মধ্যে যে ওতপ্রোত সম্পর্ক আছে তাও কখনও তেমনভাবে অনুধাবন করা হয়নি।

কাছে যাতায়াতের থেকে যখন দূরের যাতায়াত বেশি সুবিধাজনক হবে মানুষ তখন দূরে যাতায়াত করতে আগ্রহী হবে। মানুষের বাসস্থান থেকে তার কর্মক্ষেত্র, বাচ্চাদের স্কুল ইত্যাদি দূরে দূরে থাকবে। উদাহরণস্বরূপ বলা যায়, আজিমপুর থেকে ধানমন্ডি যাওয়ার চেয়ে আজিমপুর থেকে উত্তরা যাওয়া বেশি সুবিধাজনক হলে মানুষ উত্তরা থেকে আজিমপুর যেতে আগ্রহী হবে। মানুষের দূরে যাতায়াতের প্রবণতা বৃদ্ধি পেলে, যত বেশি রাস্তাঘাটই নির্মাণ করা হোক না কেন শহরের যানজট বৃদ্ধি পায়। অপরদিকে মানুষ সহজে কাছাকাছি দূরত্বে যাতায়াত করার সুযোগ পেলে তার বাসস্থানের কাছাকাছি সবকিছু পেতে চেষ্টা করবে, এবং এর ফলে যানজট কমবে। ফলে একদিকে যেমন সময়ের অপচয় কম হবে অন্যদিকে মানুষের জীবনযাত্রার মান বৃদ্ধি পাবে এবং পাশাপাশি স্বল্প দূরত্বে যাতায়াতের ফলে জ্বালানির অপচয় কম হবে এবং শব্দ ও বায়ু দূষণের হারও কমবে। এক স্থান থেকে অন্য স্থানে দ্রুত এবং কম খরচে যাওয়া যাবে। যানবাহনের তুলনায় মানুষের জন্য বেশি জায়গা প্রদান করা হলে মানুষের বিনোদনের সুযোগ বৃদ্ধি পাবে।

নাগরিক বিনোদন সুবিধা সমৃদ্ধ আধুনিক পার্ক

বিনোদন সুবিধা

বিনোদন মানুষের অন্যতম অধিকার। মানুষের পরিপূর্ণ মানসিক বিকাশের জন্য বিনোদন, খেলাধুলা এবং শরীরচর্চার গুরুত্ব অপরিসীম। শুধু অবকাশযাপন নয়, বিনোদনকেন্দ্রগুলো সামাজিকীকরণের জন্য আদর্শ জায়গা। সর্বসাধারণের জন্য উন্মুক্ত এসব বিনোদনকেন্দ্রে বিভিন্ন শ্রেণীপেশার মানুষ আসে, এর মাধ্যমে পরস্পরের পরিচিত হওয়ার সুযোগ ঘটে। ফলে বিভিন্ন মানুষের মধ্যে একটি যোগসূত্র স্থাপিত হয়। সমাজে একটি সুন্দর আদর্শ সামাজিক পরিবেশ বিরাজ করে।

বিভিন্ন দেশে নগরবাসীর সুস্থ, সুন্দর মানসিক ও শারীরিক বিকাশের কথা চিন্তা করে বিনোদন ও খেলাধুলার জন্য বিভিন্ন উদ্যোগ নেওয়া হলেও বাংলাদেশে এ ধরনের উদ্যোগ উপেক্ষিত। বাংলাদেশের বিভিন্ন শহরে, বিশেষ করে ঢাকায় বিনোদনের সুযোগ খুবই সীমিত। ঢাকায় হাতে গোনা যে ক’টি পার্ক ও খেলার মাঠ রয়েছে তা প্রয়োজনের তুলনায় খুবই অপ্রতুল। তবে যে কয়টি পার্ক, মাঠ রয়েছে, প্রয়োজনীয় রক্ষণাবেক্ষণের অভাবে বর্তমানে এই পার্ক ও খেলার মাঠগুলো খুবই বেহাল। বর্তমানে এর সাথে যুক্ত হয়েছে অন্য এক নতুন সমস্যা, প্রতি মাসেই নগরীর কোনো না কোনো মাঠে মেলা বসে। এ ছাড়া সৌন্দর্যবর্ধনসহ বিভিন্ন অজুুহাতে পার্ক, খেলার মাঠগুলো অবৈধভাবে দখল করার চেষ্টা চলে। এভাবেই আরো সঙ্কুচিত হয়ে পড়ছে নাগরিকদের বিনোদনের ক্ষেত্র।

বর্তমানে ঢাকায় মোট পার্ক, উদ্যান, খেলার মাঠের সংখ্যা ৮০-১২০টি। এর মধ্যে ঢাকা সিটি কর্পোরেশনের অধীনে রয়েছে ৪৭টি পার্ক এবং ১০টি খেলার মাঠ। পিডব্লিউডির অধীনে রয়েছে রমনা পার্ক, সোহরাওয়ার্দী উদ্যান, চন্দ্রিমা উদ্যানসহ আরো কয়েকটি পার্ক এবং মাঠ। অন্যান্য সরকারি প্রতিষ্ঠানের আওতাধীন রয়েছে ঢাকা চিড়িয়াখানা, বোটানিক্যাল গার্ডেন, বলধা গার্ডেনসহ ছোট বড় প্রায় ২৭টি পার্ক এবং খেলার মাঠ। এ ছাড়া পাবলিক স্পেস হিসেবে ব্যবহৃত হয়ে থাকে ধানমন্ডি লেক, টিএসসির মতো কয়েকটি স্থান। এসব মিলিয়ে ঢাকার উন্মুক্ত স্থান রয়েছে প্রায় ৫০৩.৬৪ একর। এর মধ্যে আহসান মঞ্জিল, লালবাগ দুর্গ রয়েছে। বর্তমানে ঢাকার জনসংখ্যা প্রায় ১ কোটি ২০ লক্ষ। পরিসংখ্যান অনুযায়ী ঢাকায় প্রতি ১ হাজার জনে উন্মুক্ত স্থান রয়েছে প্রায় ৪ শতাংশ। ব্রিটেনের জাতীয় ক্রীড়াক্ষেত্র সমিতির মতে প্রতি ১ হাজার জনপিছু ৬ একর পরিমিত উন্মুক্ত জায়গা, খেলার মাঠ থাকা উচিত, যার ৪ একর সর্বজনীন আর ২ একর ব্যক্তিগত। এ ছাড়া প্রতি ১ হাজার জনে ১ একর থাকবে বাগান এবং ৩ একর থাকবে বিদ্যালয় ক্রীড়াক্ষেত্র। এভাবে সর্বমোট ১০ একর খোলা জায়গা থাকতে হবে প্রতি ১ হাজার লোকের জন্য। এই পরিসংখ্যান অনুযায়ী ঢাকায় পার্ক, খেলার মাঠ, বিনোদনকেন্দ্রের পরিমাণ নিতান্তই অপর্যাপ্ত।

বর্তমানে সীমিত সংখ্যক পার্ক, খেলার মাঠের কারণে শিশু-কিশোররা বঞ্চিত হচ্ছে বাইরে খেলাধুলার এবং বিনোদনের সুযোগ থেকে। তাদের অবসর সময় কাটছে টিভি দেখে বা কম্পিউটারে গেম খেলে, যা তাদের পরিপূর্ণ শারীরিক ও মানসিক বিকাশে বাধা সৃষ্টি করছে। এ ছাড়া বিনোদনের অপ্রতুল সুযোগ নাগরিকদের দৈনন্দিন কর্মব্যস্ত জীবনকে একঘেয়ে করে তুলছে। শিশু-কিশোরদের খেলাধুলার সুবিধা প্রদান, নগরবাসীর বিনোদনের জন্য শহরগুলোতে পর্যাপ্ত বিনোদনকেন্দ্র হিসেবে পার্ক, খেলার মাঠ গড়ে তোলা এবং পুরনোগুলোর সংস্কার জরুরি। একই সাথে নগরবাসীর শারীরিক ও মানসিক সুস্থতার কথা চিন্তা করে পায়ে হেঁটে চলাচল ও শরীরচর্চার জন্য উপযুক্ত পরিবেশ তৈরি খুবই গুরুত্বপূর্ণ। 

বিকেন্দ্রীকরণ

রাজধানী শহর হিসেবে ঢাকা মহানগরীর গুরুত্ব অনেক। দেশের সার্বিক উন্নয়ন ও তার সুফল সর্বত্র সুষম বণ্টনের লক্ষ্যে অন্যান্য শহরের উন্নয়ন জরুরি। কিন্তু দেশে সব কিছুই ঢাকার মধ্যে পুঞ্জীভূত করা হচ্ছে। প্রশাসনিক-নিরাপত্তা কর্মকান্ড থেকে ব্যবসা-বাণিজ্য, কল-কারখানা, শিক্ষা-স্বাস্থ্যসেবা, অফিস আদালত সব কিছুই ঢাকাকে কেন্দ্র করে। তাই চাকরি, ব্যবসা, ছেলেমেয়েদের পড়ালেখা, পরিবারের সুচিকিৎসা, বিনোদন এ সবকিছুর আশায় মানুষ আজ ঢাকামুখী। তা ছাড়া দেশে যে কোনো দুর্যোগে সর্বহারা মানুষ দু’মুঠো ভাত পাওয়ার আশায় কাজের জন্য ছুটে আসছে ঢাকা শহরে। এই অতিরিক্ত মানুষের চাপে ঢাকার জনজীবনে নানা সঙ্কট তৈরি হচ্ছে। ধীরে ধীরে লোপ পেতে বসেছে মানুষের সকল সুযোগ-সুবিধা। কোনো কোনো ক্ষেত্রে পোহাতে হচ্ছে অবর্ণনীয় দুর্ভোগ। যার মধ্যে যানজট অন্যতম। ঢাকা শহরের উদ্ভূত যানজট পরিস্থিতি মোকাবেলায় ঢাকা শহরের সঙ্গে সঙ্গে দেশের অন্যান্য শহরের উন্নয়নেও জরুরি পদক্ষেপ গ্রহণ প্রয়োজন।

নগর পরিকল্পনায় পুরো অবকাঠামোর সাথে সমন্বয় রেখে পরিকল্পিতভাবে বিনোদন স্থান, নাগরিক বিনোদন কেন্দ্র গড়ে তোলা জরুরি। নগর মানেই শুধু ইট, কাঠ, পাথরের বসতি বা যান্ত্রিকতা নয়। বহু মানুষের মিলনকেন্দ্রই হচ্ছে নগর। একটি নগরীর গড়ে ওঠা নগরবাসীর শারীরিক ও মানসিক বিকাশকে নানাভাবে প্রভাবিত করে। একটি সুষ্ঠু সুন্দর পরিকল্পিত নগরী, দক্ষ মানবগোষ্ঠী গড়ে তুলতে সহায়ক। পরিকল্পিত নগরী গড়ে তোলার ক্ষেত্রে বিষয়টি গুরুত্বপূর্ণ।

নগরীর খোলামেলা উন্মুক্ত ক্ষেত্র

ঢাকায় গণমুখী পরিকল্পিত নগরায়ণ করতে…

  • নগর পরিকল্পনায় মিশ্র  এলাকা গড়ে তোলার উপর মনোযোগ দিতে হবে। যেমনÑ আবাসন, শিক্ষা ও স্বাস্থ্যসেবা প্রতিষ্ঠান, বাজার, কর্মস্থল, বিনোদন ইত্যাদি সুযোগ সুবিধা কাছাকাছি দূরত্বে থাকতে হবে।
  • ঢাকার জলাধারগুলো সংরক্ষণে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নিতে হবে। 
  • জলাবদ্ধতা নিরসনে রিটেনসন পন্ড রাখার ব্যবস্থা করতে হবে।
  • স্যুয়ারেজ বর্জ্য অপসারণের বা ট্রিটমেন্ট প্ল্যান্ট তৈরি করার পদক্ষেপ গ্রহণ করতে হবে।
  • নাগরিকদের বিনোদনের জন্য পর্যাপ্ত পরিমাণ উন্মুক্ত স্থানের ব্যবস্থা করতে হবে। 
  • নগরের পরিবহন পরিকল্পনায় পায়ে হাঁটাকে সবচেয়ে গুরুত্ব দিতে হবে এবং পথচারীদের সুবিধার কথা চিন্তা করেই সকল অবকাঠামো নির্মাণ ও সংস্কার করতে হবে।

ঢাকা শহরের জন্য প্রণীত কৌশলগত পরিবহন পরিকল্পনা (এসটিপি) ও রাজউক প্রণীত ঢাকা মেট্রোপলিটন ডেভেলপমেন্ট প্ল্যান (ডিএমডিপি) প্রস্তাবিত Mass Rapid Transit (MRT) বা Bus Rapid Transit (BRT) প্রস্তাবসমূহ বাস্তবায়ন করতে হবে।

সমগ্র ঢাকা মহানগরী এলাকায় পরিকল্পিত আবাসন বিকাশের জন্য বিদ্যুৎ, গ্যাসসহ সকল সেবার ভবিষ্যৎ চাহিদা নিরূপণ করে সে অনুযায়ী তা সংস্থানের জন্য দীর্ঘমেয়াদি ইউটিলিটি অ্যান্ড সার্ভিসেস প্ল্যান প্রণয়ন করতে হবে।

পরিকল্পিত নগরায়ণ নগরের সামগ্রিক উন্নয়ন ও সমৃদ্ধি অর্জনের মাপকাঠি। পরিকল্পনা প্রণয়ন প্রক্রিয়ার পদ্ধতিগত সংস্কার করে উন্নয়নের মূল স্রোতধারায় ঢাকা নগরীর পরিবেশবান্ধব আবাসনকে সম্পৃক্ত করতে পারলে সবার সম্মিলিত প্রচেষ্টায় এ নগরী হয়ে উঠবে সমৃদ্ধিশালী স্বপ্নের মেগাসিটি।

প্রকাশকাল: বন্ধন ২৯ তম সংখ্যা, সেপ্টেম্বর ২০১২

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Scroll to Top