বিকল্প এয়ারকন্ডিশনিং

প্রাচীন যুগের কথা চিন্তা করুন। তখন না ছিল ফ্যান, না ছিল এসি। কিন্তু এল-নিনোর ঝড় নিশ্চয় তখনো চলত! পৃথিবীও নিশ্চয় উত্তপ্ত থাকত। রাজা-বাদশাহ কিংবা ধনীরা সে সময় বড় বড় দালানকোঠায় থাকতেন। দেয়ালগুলো হতো বিশাল মোটা মোটা। কিন্তু তবু কেন গরম অনুভব করতেন না? খুব সাধারণভাবে চিন্তা করলে বলা যায় তখন প্রকৃতি এতটা উষ্ণ ছিল না। ছিল প্রচুর গাছপালা, জলাভূমি। অন্যভাবে চিন্তা করলেও বলা যায়, তখনো শিল্পবিপ্লবের সূচনা হয়নি। পৃথিবীর উষ্ণতা বাড়েনি, জনসংখ্যার চাপ বা আধিক্যও ছিল না। তবে যেভাবেই বলি না কেন, গরমের তীব্রতা তখনো ছিল। আর এই প্রচন্ড গরম থেকে রেহাই পেতে স্থাপত্য নির্মাণে নেওয়া হতো বিশেষ ব্যবস্থা। এমন কিছু কৌশল অবলম্বন করা হতো, যাতে সূর্যের প্রখর তাপ স্থাপনায় সরাসরি প্রবেশ করতে না পারে। তবে ঘরের অভ্যন্তরে বাতাস প্রবাহে থাকবে না কোনো বাধা। পাশাপাশি ঘর ঠান্ডা রাখতে পানির ব্যবহারও ছিল লক্ষণীয়, যা কাজ করত বিকল্প প্রাকৃতিক এয়ারকন্ডিশনিংয়ের।

বিকল্প এয়ারকন্ডিশনিংয়ের পুরোনো থেকে আধুনিক রূপায়ণের পথপরিক্রমার কথাই তুলে ধরছেন স্থপতি রাজীব চৌধুরী

আগ্রায় ফতেহপুর সিক্রিতে আকবরের স্ত্রী যোধা বাঈয়ের জন্য দুই ধরনের বাসস্থান ছিল। তিনি গরমকালে থাকতেন যেখানে, সেই ঘরের দেয়ালে ছিল ছোট ছোট ছিদ্র ও খোপ; যেগুলো দিয়ে বাতাস প্রবেশ করত। একটি কৃত্রিম ফোয়ারা দিয়ে অনবরত পানি দেওয়া হতো দেয়ালে। ছাদের ওপর ছিল পানি জমানোর ব্যবস্থা। আবার শীতকালে একই রকমের ডিজাইনের ও একই দেখতে আরেকটা কক্ষে অবস্থান করতেন রানি, যেটা ছিল আগের রুমের ঠিক উল্টো। দেয়ালগুলো নিরেট, ছাদের পানি জমানোর কোনো চল নেই, কিন্তু দুটো কক্ষ একদম একই রকম দেখতে ছিল। আর এভাবেই তখন প্রাকৃতিক নিয়ামকের ব্যবহারের মাধ্যমে ঘরদোর ঠান্ডা রাখা হতো।

১৮৬০ সাল থেকে শুরু হওয়া শিল্পবিপ্লবের পর থেকে, সেই সঙ্গে বিজ্ঞানের ক্রমশ উন্নতির ফলে মানুষের জীবনযাত্রা হয়ে পড়েছে উন্নত। প্রযুক্তির উৎকর্ষতার সঙ্গে সঙ্গে তাপমাত্রাও বেড়েছে। এর সঙ্গে সঙ্গে বেড়েছে এয়ারকন্ডিশনিংয়ের ব্যবহার। একদিকে ক্রমশ উষ্ণায়ন, অন্যদিকে আরামদায়ক জীবনের জন্য বেছে নিতে হয়েছে সহজ সমাধান। কিন্তু সহজ সমাধানের অন্তরালে আমাদের জন্য ভয়াবহ হুমকি অপেক্ষা করছে, তা আর খতিয়ে দেখা হচ্ছে না। বলছি সেই সহজ সমাধান এসি বা এরারকন্ডিশনিংয়ের কথা।

ভারতের আগ্রার ফতেহপুর সিক্রি ঠান্ডা রাখতে সৃষ্ট জলাধার

বিশ্বের উন্নত দেশ সিঙ্গাপুরের প্রথম প্রধানমন্ত্রী লি কুয়ান এসিকে ইতিহাসের যুগান্তকারী আবিষ্কার বলে অভিহিত করেছিলেন। কিন্তু ক্রমবর্ধমান এসির ব্যবহারের কারণে প্রচুর বিদ্যুৎ খরচ হয় এবং এই বিদ্যুৎ তৈরিতে লাগে প্রচুর জ্বালানি, যা পুড়ে বাতাসে কার্বন ডাই-অক্সাইড ছড়ায়। প্রাপ্ত তথ্যমতে, ১৯০২ সালের পর থেকে যত এসি বসানো হয়েছে, তার সমানসংখ্যক এসি আগামী ১০ বছরে যোগ হবে। International panel on climate change (IPCC)-এর মতে, এসিতে একধরনের যে হাইড্রোফ্লোরো কার্বন রেফ্রিজারেন্ট ব্যবহার করা হয়, সেটা বায়ুমন্ডলে কার্বন ডাই-অক্সাইডের চেয়ে এক হাজার গুণ বেশি ক্ষতি করে, যা গ্রিন হাউস গ্যাসের অন্যতম কারণ। ২০১৮ সালের আগস্টে প্রকাশিত দ্য ইকোনমিস্ট পত্রিকায় বলা হয়, বিশ্বব্যাপী এসির ব্যবহার কমাতে পারলে ১৮ হাজার কোটি টন কার্বন নিঃসরণ কমানো যাবে।

প্রাচীন সভ্যতার কিছু চমকপ্রদ উপায় ছিল, যা শীতাতপ নিয়ন্ত্রণ ছাড়াই ঘর ঠান্ডা হতো। সেই সময়ের স্থপতিরা ছিলেন কৌশলী। তাঁরা মোটা দেয়াল, ছোট জানালা এবং উঠান দিয়ে বিল্ডিং তৈরি করতেন, যা গরম আবহাওয়ায় ঘরগুলোকে বাতাসযুক্ত এবং ছায়াময় রাখত। জলের ব্যবহারের মাধ্যমে তাঁরা ফোয়ারা, পুল এবং বাড়ির চারপাশে বুদ্ধিমত্তার সঙ্গে স্থাপন করা ভেজা কাপড় দিয়ে বাষ্পীভবনের মাধ্যমে ঠান্ডা করতেন নিজেদের। এমনকি শীতল করার জন্য আংশিকভাবে মাটির নিচে ঘরও তৈরি করতেন। সেই মাটির নিচের ঘরে থাকত প্রাকৃতিক প্রসবণ। পানির প্রবাহ। এখনো প্রাচীন স্থাপনার অন্দরমহলে গেলে এই ব্যবস্থাগুলো দেখতে পাওয়া যায়। প্রাকৃতিক উপকরণ (কাদামাটি‌, ভূগর্ভস্থ স্থান, জল, প্রাণীদের কাছ থেকে প্রাপ্ত জ্ঞান যেমন মৌমাছির বাসা) দিয়েই প্রজ্ঞার সঙ্গে ব্যবহার করতেন, যা এখনো আধুনিক আরামবিহীন বিশ্বে শীতল থাকার জন্য এসির বিকল্প হতে পারে।

প্রাচীন সেই জ্ঞানকে কাজে লাগিয়ে ইন্ডিয়ান স্থাপত্য প্রতিষ্ঠান ‘coolAnt’-এর সিইও স্থপতি মনিশ শ্রীপুরাপু এয়ারকন্ডিশনারকে নতুনভাবে ডিজাইন করেছেন। এই মিশনে মূলত ‘নো ইলেকট্রিসিটি’ ব্যবহারের মাধ্যমে জিরো এনার্জি ব্যবহারের মাধ্যমে বাতাস ঠান্ডা করার পদক্ষেপ নেওয়াকে লক্ষ করে এই ডিজাইন শুরু করেন এবং একই সঙ্গে পরিবেশবান্ধব এসিও তৈরি করা যাবে। তিনি লক্ষ করেছিলেন, তাঁদের ঘরে পানি ঠান্ডা করতে ক্লে পট বা মাটির পাত্র ব্যবহার করা হতো। তিনি জানতে পারেন, ছোটবেলায় মাটির পাত্র থেকে ঠান্ডা পানি খেতে ভালোবাসতেন। মাটির এই পাত্রগুলোকে বলা হতো সানকি। এই সানকিগুলোতে ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র ছিদ্র আছে। এসব ছিদ্র দিয়ে বাতাস চলাচল করার মাধ্যমে পানিকে ঠান্ডা করে।

কিন্তু বর্তমানে মনিশ ভারতীয় মাটিকে এয়ারকুলিং করার জন্য ব্যবহার করছে, যার নাম দেওয়া হয়েছে ‘সয়েল এয়ারকন্ডিশনার ইনসপায়ারড বাই বিহাইভ’। অনেকটা মৌমাছির মৌচাকের ডিজাইনের সঙ্গে এর মিল আছে। এটি ব্যবহারে ৬-৭ ডিগ্রি তাপমাত্রা কমে যায়, যা প্রচলিত এয়ারকন্ডিশনারগুলোর বিপরীতে একটি যুগান্তকারী আবিষ্কার। বিহাইভ তার শক্তির শূন্য বিচ্যুতির মাধ্যমে পরিবেশগত উত্তাপ কমাতে অবদান রাখে, খুব কম শক্তি খরচ করেই এগুলো থেকে আশানুরূপ ফল পাওয়া যায়। মনিশ বলেন, ‘বর্তমানে প্রচলিত এয়ারকন্ডিশনারগুলো ২০৫০ সালের মধ্যে ভারতের প্রায় ৪৫ শতাংশ বিদ্যুৎ খরচ করবে।’ তাই মনিশের ভাবনা হলো, ভারতের একটি টেকসই ভবিষ্যৎ নিশ্চিত করা।

মাটির সানকিতে পানি প্রবাহের মাধ্যমে ঘর শীতল করার ব্যবস্থা

এটি যেভাবে কাজ করে
মনিশ মূলত মৌমাছির বাসা থেকে নকশা কাঠামো গ্রহণ করেছিলেন। মৌচাকের মতো কাঠামো তৈরি করা হয়েছে মাটির সানকি দিয়ে। ঠান্ডা বাতাসের জন্য মাটির পাত্রের পৃষ্ঠের ক্ষেত্রফলকে বাড়ানো হয়েছে। এরপর মাটির পাত্রগুলোকে মৌমাছির বাসার মতো স্তূপ করা হয় এবং তাদের ওপর জল ঢেলে ভিজিয়ে রাখা হয়। তারপরে জল বাষ্পীভ‚ত হয়ে শীতল হয়, আশপাশের তাপমাত্রা হ্রাস করে। প্রক্রিয়াটির পরিবেশগত খরচ কমানোর জন্য জল তখন পুনর্ব্যবহৃত হয়। কারণ এটি পোড়ামাটির তৈরি। মনিশ বলেন, ‘এটির উৎপাদন প্রক্রিয়াটি সহজ এবং সাশ্রয়ী মূল্যের। কারণ মাটি ভারতের যেকোনো জায়গায় পাওয়া যায়।’

সয়েল এয়ারকন্ডিশনারের সাফল্য
সম্প্রতি CoolAnt কোম্পানি একটি ডিজেল জেনারেটরের ওপর নির্ভরশীল কারখানায় এই মাটির এসি ইনস্টল করে। আগে যেখানে তাপমাত্রা নিয়মিতভাবে ৫০ ডিগ্রি সেলসিয়াস পর্যন্তও বেড়ে যেত, মাটির এয়ারকুলার স্থাপনের কারণে সেখানে ৯ ডিগ্রি তাপমাত্রা হ্রাস হয়, যা দিল্লির এল-নিনো থেকে মুক্তি দেয়। মনিশ বিভিন্ন স্থানের সঙ্গে মানানসই সয়েল এয়ারকন্ডিশনার ইনস্টলেশন কাস্টমাইজ করে তা কারখানা, বাড়ি বা শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে স্থাপন করার দিকে নির্দেশ দেন।

মনিশের অবদান এখানেই শেষ নয়। তাঁর দল ব্যক্তিগত কুলিং ডিভাইস তৈরি করছে, আকারে কমপ্যাক্ট কিন্তু কুলিং ব্যাসার্ধে শক্তিশালী। এই ডিভাইসগুলো মাত্র এক ফুট ব্যাস এবং ন্যূনতম শক্তির ব্যবহারসহ ৪ থেকে ৫ ফুট ব্যাসার্ধের মধ্যে স্থানীয়ভাবে শীতল করে। তাই বলা যায়, সম্পদের চাপ ছাড়াই ব্যক্তিগত আরামের জন্য এটি একটি প্রতিশ্রুতিশীল সমাধান।

মনিশ সম্প্রতি ইউএন এনভায়রনমেন্ট প্রোগ্রামের এশিয়া-প্যাসিফিক লো কার্বন লাইফস্টাইল চ্যালেঞ্জ থেকে স্বীকৃতিস্বরূপ প্রযুক্তিগত অগ্রগতির জন্য পুরস্কৃত হন; যা তাঁর কাজকে স্বীকৃতি দেয় এবং প্রাকৃতিক এয়ারকুলার ব্যবহার করতে মানুষকে উৎসাহ দেবে।

মৌচাকের ব্যবহার ও এর প্রতিক্রিয়া
যদিও এই মৌচাক স্ট্রাকচার ব্যবহার করে সহজেই এসির বিকল্প তৈরি করা যাচ্ছে, কিন্তু এর জন্য বেশ বড় স্থান প্রয়োজন হচ্ছে। ছোট একটা পাত্র ব্যবহার করে তেমন ঠান্ডা পরিবেশ পাওয়া যায় না বলে বেশ বড় একটা স্থানজুড়ে এটি বসানো হচ্ছে। তাই এটির ফুটপ্রিন্ট এরিয়া বেড়ে গেছে।

বাঁশ দিয়েও তৈরি করা বিকল্প এয়ার কন্ডিশনিং

এর নির্মাণে কার্বন নিঃসরণ থামানো যায়নি। এটি নির্মাণ করতে হয় সিরামিক মাটি দিয়ে। এরপর পোড়াতে হয়। একটা নির্দিষ্ট তাপমাত্রায় এটি পুড়ে লাল সিরামিক সানকিতে রূপান্তর হয়। এই পোড়ানোর প্রক্রিয়ায় ব্যবহার হয় কাঠ। আর কাঠ জোগাড় করতে গিয়ে কাটতে হয় গাছ। বন উজাড় করে তৈরি করা কাঠের চুল্লিতে পোড়ানো সিরামিক দিয়ে পরিবেশ ঠান্ডা হচ্ছে ঠিকই। কিন্তু এতে পরিবেশ ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে।

পানির ক্রমশ প্রবাহ রাখতে গিয়ে বেশ বেগ পেতে হয়। আমরা জানি, জিরো এনার্জি বলে পৃথিবীতে কিছু হয় না। এই ঠান্ডা বায়ুপ্রবাহ আসলে তৈরি করছে পানি। আর এই পানি মৌচাকের ওপর ফেলতে বেশ বেগ পেতে হয়। তৈরি করতে হয় একটি স্বয়ংক্রিয় ঝরনা। এই ঝরনাা চালাতে ব্যবহার করা হয় নবায়নযোগ্য বা অনায়নযোগ্য জ্বালানি, যা পরিবেশের গ্রিন হাউস ইফেক্ট তৈরিতে ভূমিকা রাখছে। পরিবেশে বৈদ্যুতিক যন্ত্র চালাতে গেলে যে জ্বালানি পোড়াতে হয়, বিদ্যুৎ তৈরিতে জ্বালানি পোড়ানোজনিত কারণে কার্বণ নিঃসরণ হয়, সেটা আমাদের পরিবেশের জন্য আসলেই ক্ষতিকর। যদিও এই ক্ষতি এক দিনে দর্শনে আসে না। কিন্তু সেটা একটু হলেও ঘটে। আর এ জন্য আমাদের মৌচাকের জন্য এনার্জি এফিসিয়েন্ট সেচব্যবস্থা তৈরি করতে হবে।

বর্তমান বিশ্বে যেখানে প্রযুক্তিগত অগ্রগতিগুলো প্রায়ই আমাদের পরিবেশগত জীবজন্তুর সঙ্গে সংঘর্ষে লিপ্ত হয়, মনিশের উদ্ভাবন সেখানে ভারসাম্যের আলোকবর্তিকা হিসেবে দাঁড়িয়ে আছে। আধুনিক বুদ্ধিমত্তার সঙ্গে প্রাচীন জ্ঞানকে একত্র করে তিনি উদাহরণ দেন যে কীভাবে উদ্ভাবন প্রকৃতির সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ হতে পারে, প্রযুক্তিগত উৎসাহী এবং পরিবেশ সংরক্ষণবাদী উভয়ের কাছ থেকে একইভাবে প্রশংসা অর্জন করে।

রেডিয়েটিভ কুলিং সিস্টেম
রেডিয়েটিভ কুলিং সিস্টেম মূলত রেডিয়েশনের মাধ্যমে তাপ আমাদের শরীর থেকে শোষণ করে ঠান্ডা পরিবেশ দেওয়ার মাধ্যমে ঘরের তাপমাত্রা কমায়। আমরা রেডিয়েটিভ কুলিং সিস্টেমের মাধ্যমে ঘরে বিদ্যুতের স্বল্প অথবা শূন্য ব্যবহারের মাধ্যমে তাপমাত্রা কমাতে পারি। আর এই কুলিং সিস্টেমের মধ্যে আছে চিলার কুলিং সিস্টেম ও প্যাসিভ কুলিং সিস্টেম।

চিলার কুলিং সিস্টেম: একটি বাড়ির ছাদে চিলার স্থাপন করে এই চিলারের সঙ্গে বাড়ির দেয়াল বা ফ্লোর বা ছাদে বিছিয়ে দেওয়া হয় অনেক তামার পাইপ। এই পাইপ ইনস্টলেশনের পর সেখান দিয়ে পানি প্রবাহিত করা হয়। এই পানি তামার ঠান্ডা পাইপের মধ্য দিয়ে যাওয়ার সময় ঠান্ডা হয়ে যায়। আর এই ঠান্ডা প্রবাহিত হয় ঘরের ভেতরে। আর এভাবেই ঘরের গরম বাতাস ঠান্ডা হয়ে আসে। এই কুলিং সিস্টেমের কারণে ঘরের তাপমাত্রা ৩ থেকে ৫ ডিগ্রি পর্যন্ত কমানো সম্ভব।

বোতল এয়ার কন্ডিশনার

প্যাসিভ কুলিং সিস্টেম: ঘরের বাইরে ও ভেতরে তাপনিরোধক রঙের ব্যবহারের মাধ্যমে ঘরের তাপমাত্রা কমিয়ে আনা সম্ভব। এই পদ্ধতি আবিষ্কার করেছেন আইআইটি গুয়াহাটির গবেষকদের একটি দল। এর পোশাকি নাম ‘রেডিয়েটিভ কুলিং সিস্টেম’ (CoolAnt Radiative Cooling System)। এটি চালাতে কোনো প্রকারের বিদ্যুৎ প্রয়োজনই হবে না। এটা এক প্রকারের কোটিং ম্যাটেরিয়াল। আইআইটির গবেষকেরা বলছেন, এই রেডিয়েটিভ কুলার কোটিং ম্যাটেরিয়ালটি ব্যবহার করা যাবে রুফটপ বা ছাদে। এর ব্যবহার করা হলে সহজেই এটি বাইরে থেকে আসা গরম বাতাসের হলকা ও সূর্যের প্রচন্ড তাপ রক্ষা করতে পারে।

আই আইটির অধ্যাপক প্রফেসর আশির কুমার বলেন, ‘এটি মূলত রেডিয়েটিভ কুলিং সিস্টেম। তাপকে রেডিয়েশনের মাধ্যমে ঠান্ডা করার মাধ্যমে এটি ঘরের তাপমাত্রা সহজেই কমিয়ে আনতে পারে। তবে এটি কুলিং সিস্টেম হিসেবে খুবই প্রচলিত এই সময়। রঙের আস্তরণের ব্যবহারের মাধ্যমে এটি ছাদ থেকে আসা উত্তপ্ত রেডিয়েশনকে আটকে দিয়ে পরিবেশ ঠান্ডা রাখে, যাতে এক বিন্দু ও বিদ্যুতের প্রয়োজন নেই।’

বোতল এরারকন্ডিশনার
শিস দেওয়ার মতো করে গোল করলে দেখা যায় মুখ থেকে বের হওয়া বাতাস ঠান্ডা হয়ে সামনে আসছে। আমরা চাইলেই এভাবে মুখের ভেতর জমে থাকা বাতাস বের করে সামনের পরিবেশের তাপমাত্রা কমিয়ে দিতে পারি। আর এই ব্যাপারটা মাথায় রেখে কিছু খুদে বিজ্ঞানী আবিষ্কার করেছেন এই বোতল এয়ারকন্ডিশনার। এই এয়ারকন্ডিশনিং সিস্টেম খুব সাধারণ। কিছু প্লাস্টিকের বোতল অর্ধেক কেটে একটা শক্ত বেইজ তৈরি করে সেখানে এভাবে বসিয়ে দেন। আর পুরো বেইজটা বসানো হয় জানলার সঙ্গে, যেখান দিয়ে প্রচুর বাতাস প্রবাহিত হয়। আর এই বাতাসের প্রবাহ থেকেই ঘর এমনিতেই ঠান্ডা হয়ে আসে।

এই পদ্ধতিতে বেশ কিছু সফলতার পাশাপাশি ব্যর্থতাও দেখতে পাই। যেমন এই পদ্ধতিতে বেশ কিছু প্লাস্টিক বোতল ব্যবহার হয়, যা পরিবেশ রক্ষায় ভূমিকা রাখে। আবার দ্বিতীয়বার ব্যবহার করা যেত এমন বোতলের ব্যবহার হওয়ার ফলে বেশ কিছু প্লাস্টিক বর্জ্য তৈরি হয়, যা পরিবেশের জন্য আরও বেশি ক্ষতিকর। যদিও এই বোতলগুলোর অর্ধেক ব্যবহার হচ্ছে। বাকিটা বর্জ্যে পরিণত হচ্ছে। এই বোতল এয়ারকন্ডিশনিং পদ্ধতিতে বাতাসের একটা বিরাট ভ‚মিকা রয়েছে। বাতাস যদি প্রবাহিত না হয়, এই বোতল এয়ারকন্ডিশনিং সিস্টেম অকার্যকর হয়ে থাকবে। মূলত এটি গরম বাতাস সরু পথ দিয়ে যাওয়ার সময় বাতাসকে ঠান্ডা করে। এখন বাতাস যদি প্রবাহিতই না হয়, তাহলে তো আর সেই বাতাস ঠান্ডা হওয়ার প্রশ্ন আসেই না। যদিও এটি দিয়ে বাতাসের সাধারণ প্রবাহ ও পরিবেশ ঠান্ডা রাখতে সাহায্য করে। কিন্তু এটি দীর্ঘমেয়াদি ব্যবহার এখনো সম্ভব হয়নি। মূলত এটি এখনো একটি হাইপোথিসিস হিসেবেই আছে।

আবার এই বোতল এয়ারকন্ডিশনার যেখানেই বসানো হোক, সেই জায়গাটার দৃশ্যমান স্থান কমে যায়। যেহেতু জানালা পুরোটাই এই বোতলে ঢাকা থাকে, তাই এই বোতলযুক্ত জানালা দিয়ে না বাইরে দেখা যায় না বাইরের থেকে এটি অন্দরমহলে সুরক্ষা দেয়। এটি বসানো মানেই হলো এটি একটি সুরক্ষিত কক্ষকে অরক্ষিত করে দিল। যদিও বিজ্ঞানীরা এটার বিভিন্ন বিকল্প তৈরি করতে শুরু করে দিয়েছেন।

আন্ডারগ্রাউন্ড এয়ার টানেল সিস্টেম
মাটির ওপরে আমাদের বসবাস। কিন্তু মাটির নিচটা অনেক ঠান্ডা। আর এই ঠান্ডা আমাদের ভবনের ওপরতলা পর্যন্ত উঠে আসে না। নিচতলায় যাঁরা বাস করেন, তাঁরা জানেন যে ভবনের নিচতলা সবচেয়ে ঠান্ডা হয়। আর এই ঠান্ডা আসে মাটি থেকে। তাই কোনোভাবে যদি মাটির এই ঠান্ডা পুরো ভবনে নিয়ে আসা যায়, এই চিন্তা থেকে এই আন্ডারগ্রাউন্ড এয়ার টানেল এয়ারকন্ডিশনার সিস্টেমের আবির্ভাব।

বাঁশে তৈরি এয়ার কুলিং সিস্টেম

মাটির ৪ মিটার গভীরে যদি কোনোভাবে কোনো পাইপ রাখা যায়, যার একটি মুখ মাটির ওপর থাকবে এবং আরেকটি মুখ থাকবে ভবনের ভেতর। সেই পদ্ধতিতে বাইরের বাতাস মাটির তল দিয়ে প্রবাহিত হয়ে ভবনে প্রবেশ করবে এবং এতে ভবনের তাপমাত্রা কমে যাবে ৫-৬ ডিগ্রি পর্যন্ত। আর এভাবেই ভবন ঠান্ডা থাকবে। এই পদ্ধতি একটু ব্যয়বহুল হলেও বেশ কার্যকর। মাটির ৪ মিটার গভীরে পাইপ বসিয়ে বাতাস এই টানেলের পাইপের মাধ্যমে ঘরের ভেতর নিয়ে যাওয়ার সিস্টেম যতটা সহজ মনে হচ্ছে, ততটা সহজ না। এই পদ্ধতিতে এই পুরো পাইপিং সিস্টেম মাটির তলায় স্থাপন করতে হয়, যা ব্যয়বহুল। বাড়ির ভেতর ভেন্টিলেশন সিস্টেম অন্য রকমভাবে ডিজাইন করতে হয়। আমরা সাধারণত বাড়ি ডিজাইনের সময় বারান্দাগুলো বাড়ির বাইরে রাখি। আর ভেতরের দিকে থাকে অন্যান্য ঘর। কিন্তু এই পদ্ধতিতে এয়ারকন্ডিশনিং করতে গেলে বারান্দাগুলোর একটা অংশ ঘরের ভেতরের দিকে থাকতে হয়।

এই পদ্ধতিতে কিছু ত্রæটি রয়েছে, যার ফলে এটি এখনো কার্যকর নয়। তবে অদূর ভবিষ্যতে এটি আলোর মুখ দেখবে।

এই পদ্ধতিতে অনেক দূর থেকে পাইপ টেনে নিয়ে আসতে হয়। এ কারণেই এটা বেশ ব্যয়সাপেক্ষ।
অনেক সময় এই পাইপ দিয়ে বন্যার পানি ঢুকে যায়, যার ফলে পুরো পাইপ থেকে সব পানি বন্যার পানি নেমে যাওয়ার পর বের করতে হয়, যা একটি আলাদা সমস্যা।
এই পদ্ধতিতে দিনের বেলায় তেমন ফল পাওয়া যায় না। বাতাসের প্রবাহ না থাকলে ও দুপুরবেলা এই পদ্ধতি তেমন কাজ করে না। তবে দিনের বেলায় যদি বাতাস প্রবাহিত হয়, তাহলে কোনো সমস্যা হয় না।

বিকল্প কন্ডিশনার; এটি জলবায়ু চ্যালেঞ্জ মোকাবিলায় মানুষের সৃজনশীলতা এবং চিন্তাশীলতার একটি প্রমাণ। বিজ্ঞানীদের নানা রকম উদ্ভাবন আমাদের একটি শীতল, সবুজ ভবিষ্যতের স্বপ্ন দেখায়। ক্রমাগত প্রযুক্তিগত বিবর্তনের যুগে, বিজ্ঞানীদের অগ্রগামী সত্তা মনে করিয়ে দেয় যে কিছু ক্ষেত্রে আমাদের অগ্রগতির প্রয়োজন নেই। বরং পুরোনোকে আঁকড়ে ধরলেই আমরা সেই পৃথিবীতে টিকে থাকতে পারব আরও হাজার বছর।

গবেষণা সহকারী: নন্দিতা পাল

প্রকাশকাল: বন্ধন ১৬৫ তম সংখ্যা, জুন ২০২4

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Scroll to Top