ভবন নির্মাণে মাটি পরীক্ষা

নগরসভ্যতার সঙ্গে পাল্লা দিয়ে বিশ্বজুড়ে গড়ে উঠছে উচ্চ থেকে সুউচ্চ ভবন। কোনো কোনো শহরে যেন গড়ে উঠছে আকাশছোঁয়া ভবনের বিশাল এক মেলা। অবশ্য মানুষের আবাসনের চাহিদা মেটাতেই বড় শহরগুলোতে সৃষ্টি হয়েছে বিশাল ও সুউচ্চ ভবন নির্মাণের প্রতিযোগিতা। ভবনগুলো একটিকে ছাড়িয়ে মাথা উঁচু করে দাঁড়িয়ে রয়েছে আরেকটি। একদিকে সুউচ্চ এ ভবনগুলো যেমন শহরটির মর্যাদা বাড়াচ্ছে, অন্যদিকে জানান দিচ্ছে তাদের প্রকৌশল জ্ঞান ও ক্ষমতাকে। নগরায়ণ মানেই কিন্তু যত্রযত বহুতল ভবন নির্মাণ নয়। এর জন্য প্রয়োজন সঠিক নগর পরিকল্পনার। আর নগরের নির্দিষ্ট উন্নয়ন পরিকল্পনা অনুযায়ী করতে চাইলে নির্মাণশৈলী প্রয়োগের আগে যথাযথভাবে মাটির পরীক্ষা করে নির্মাণকাজ শুরু করা একান্ত জরুরি। কেননা যেকোনো স্থানে বহুতল ভবন নির্মাণের পূর্বশর্ত ওই স্থানের মাটি এবং এর পারিপার্শি¦ক পরিবেশ সম্বন্ধে ধারণা থাকা। মাটির ভারবহনের ক্ষমতা নির্ণয় ভবনের নির্মাণকাজের জন্য সহায়ক। শুধু সঠিক মাটি পরীক্ষার মাধ্যমে সিদ্ধান্ত গ্রহণ সম্ভব ওই স্থানে কী ধরনের ভবন নির্মাণ করা যাবে এবং কী ধরনের নির্মাণপদ্ধতি ওই স্থানের নির্মাণকাজের জন্য উপযোগী। 

নির্মাণের আগে…

যেকোনো স্থানে যেকোনো ধরনের নির্মাণকাজের আগে দুটি জিনিস জানা থাকা দরকার :

আমরা যে ভবন বা ইমারত নির্মাণ করব তা হতে হবে কাঠামোগত দিক থেকে সব ধরনের ঝুঁকিমুক্ত। 

নির্মাণকাজের ব্যয় হতে হবে বাস্তবসম্মত, যা পরিবেশগতভাবে গ্রহণযোগ্য।

সব জায়গার মাটি এক রকম নয়। তাই মাটির প্রকার-প্রকৃতির ওপর ভিত্তি করে ভবনের নির্মাণকাঠামো ঠিক করা উচিত। অনেক সময় একই স্থানে বিভিন্ন গভীরতায় মাটির ভিন্নতা দেখা যায়। তাই অভিজ্ঞ ও বাস্তব জ্ঞানসম্পন্ন ভূতত্ত্ববিদ বা টেকনিশিয়ান দিয়ে মাটির নমুনা সংগ্রহ করে উন্নতমানের ল্যাবরেটরিতে মাটি পরীক্ষা করাতে হবে। এমনকি প্রকল্পস্থানের মাটি পরীক্ষা করে তার প্রকৃতি ও ধারণক্ষমতা সম্বন্ধে নিশ্চিত হয়ে নির্মাণকাজ শুরু করা একান্ত জরুরি।

ভবন নির্মাণে মাটি পরীক্ষা

মাটির রকমফের

মাটিকে সাধারণত যেসব ভাগে ভাগ করা যায়, তা হলো :

রেসিডিউল সয়েল (Residual Soil)

এ ধরনের মাটি স্থায়ী শিলা বা পাথর থেকে তৈরি। দীর্ঘদিন কোনো স্থানের শিলা বা পাথর পরিবেশের সংস্পর্শে থাকলে ধীরে ধীরে তা মাটিতে পরিণত হয়। পাহাড়ি অঞ্চলে এ ধরনের মাটি দেখা যায় বেশি। যেমন- গ্রানাইট, ব্যাসল্ট, স্যান্ড স্টোন, লাইম স্টোন, লবণ প্রভৃতি।

ট্রান্সপোর্টেড সয়েল (Transported Soil)

এ ধরনের মাটি বিভিন্ন ধরনের প্রাকৃতিক মাধ্যম; যেমন- বাতাস, নদী, সাগর, বরফ ইত্যাদির সাহায্যে মূল অংশ থেকে বিতাড়িত ও পরিবাহিত হয়ে কোনো নির্দিষ্ট স্থানে জমা হয়ে ধীরে মাটিতে রূপ নেয়। প্রাথমিকভাবে এই মাটি আলগা (Loose) থাকলেও ধীরে ধীরে এটা মূল ভূমির সঙ্গে যুক্ত হয়ে শক্ত ও দৃঢ় হয়।

 আকার-আকৃতির মাধ্যমে ফিল্ড অনুযায়ী মাটির বিন্যাসকৃত শ্রেণী 

১. বালু (Sand), নুড়ি (Gravel) এবং বোল্ডার (Boulder)- বালু, নুড়ি ও বোল্ডারসমূহকে সাধারণত তাদের আকার দ্বারা নির্ধারণ করা হয়।

মাটি যখন ২০ সে.মি. থেকে বড় হয় তখন তাকে বোল্ডার বলে।

মাটি যখন ৩ মি.মি. থেকে বড় কিন্তু ২০ সে.মি. থেকে ছোট হয় তখন তাকে নুড়ি বলে।

মাটি যখন ৩ মি.মি. থেকে ছোট হয় তখন তাকে বালু বলে।

২. পলিময় মাটি (Silt Soil)- এটি ফাইন গ্রেইন সয়েল, যা বিভিন্ন ধরনের জৈব বা অজৈব পদার্থ সমন্বয়ে গঠিত।

৩. কাদামাটি (Clay Soil)- এরা সাধারণত প্লাস্টিক-জাতীয় ও কম ছিদ্রযুক্ত (Low Permeable) মাটি।

৪. পিট সয়েল (Peat Soil)- এই মাটি সাধারণত আঁশযুক্ত মাটি এবং পচনশীল ভগ্নাংশ দ্বারা গঠিত।

ভূগর্ভস্থ মাটির অনুসন্ধান

ভূগর্ভস্থ মাটির অনুসন্ধানমূলক কাজ দুই ভাগে বিভক্ত

মাটির অনুসন্ধান। 

ভূগর্ভস্থ মাটির অনুসন্ধানে বোরিং কাজ।

গবেষণাগারে মাটি পরীক্ষা ও পরীক্ষণ যন্ত্রে মাটি পরীক্ষা

আবার ভূগর্ভস্থ মাটির অনুসন্ধান এবং বোরিংয়ের কাজের মধ্যে রয়েছে-

ক.     টেস্ট বোরিং (Test Boring)

খ.     টেস্ট পিট এবং স্যাফট (Test Pit and Shaft)

গ.     টেস্ট ড্রিলিং (Test Drilling)

ক. টেস্ট বোরিং 

এ ধরনের টেস্ট বোরিং সাধারণত লোহার রড বা স্টিল রডে সৃষ্ট। এ ধরনের টেস্ট বোরিং সাধারণত স্বল্প গভীরতাসম্পন্ন মাটি টেস্টে করা হয়। কাজেই এ ধরনের টেস্টকে সাধারণভাবে ম্যানুয়েল টেস্ট বলা যেতে পারে।

খ. টেস্ট পিট ও স্যাফট (Test Pit and Shaft)

সাধারণত মাটির এ ধরনের পরীক্ষার অগার নামক যন্ত্র ব্যবহার করে টেস্ট বা পরীক্ষা সম্পন্ন করা হয়। এই যন্ত্রের ওজন প্রায় ৪৫ কেজি এবং এ যন্ত্রের সাহায্যে ১ মিটার পর্যন্ত বোরিং করা যায়।

গ. টেস্ট ড্রিলিং (Test Drilling)

সাধারণভাবে বিভিন্ন পদ্ধতির মধ্যে ড্রিলিং, কোর ড্রিলিং এবং ফোর ড্রিলিং পদ্ধতি সবচেয়ে বেশি ব্যবহৃত হয়।

১. সাউডিং রড (Sounding Rod)

সাউন্ডিং রড দিয়ে প্রাথমিকভাবে শিলার অবস্থান নির্ণয় করা যায়। তা ছাড়া সাউন্ডিং রড দিয়ে বিভিন্ন গভীরতায় মাটির রেজিস্ট্যান্স নির্ণয় করা যায়।

২. ওয়াশ বোরিং (Wash Boring)

ওয়াশ বোরিং হচ্ছে মাটির গুণাগুণ অনুসন্ধানের বিশেষ এক পদ্ধতি, যাতে সাধারণত কেজিং ড্রাইভ করা হয় এবং ভেতরের মাটি ও মাটির মিশ্রিত পানি ওয়াশ করে বের করে আনা হয়। শক্ত শিলা ও বোল্ডার ব্যতীত এটা সব ধরনের মাটিতে ব্যবহার করা হয়।

৩. টেস্ট পিট (Test Pit)

টেস্ট পিট পদ্ধতিতে মাটির পরীক্ষা করা অনেক বেশি ব্যয়বহুল। কিন্তু অধিক ব্যয়বহুল হওয়া সত্ত্বেও টেস্ট পিট পদ্ধতিতে মাটি পরীক্ষা করলে মাটি সম্বন্ধে সঠিক ও নির্ভুল তথ্য সংগ্রহ করা সম্ভব।

৪. অগার বোরিং (Augur Boring)

অগার বোরিং হচ্ছে মাটি পরীক্ষার ব্যবহৃত সাধারণ যন্ত্র। এই যন্ত্র দ্বারা বালু ও কাদামাটির ফাউন্ডেশন অনুসন্ধান করা হয়। সাধারণত ৫ সে.মি. ব্যাসের কাঠের অগার এবং ২.৫ সে.মি. পাইপ দিয়ে একটি সেকশন পরিপূর্ণ করা হয়।

মাটি পরীক্ষার প্রয়োজন যে কারণে

ছোট-বড় যেকোনো ধরনের নির্মাণকাজে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ হচ্ছে ওই সাইটের মাটি। কিন্তু দেখা যায়, নির্মাণকাজের আনুষঙ্গিক বিষয়কে মাটি থেকে অনেক বেশি গুরুত্বের সঙ্গে বিবেচনায় নেওয়া হয় এবং সাইটের মাটি সব থেকে কম গুরুত্ব পায়। সব ধরনের অবকাঠামো, ভবন, ব্রিজ, রাস্তা, বাঁধ এমনটি পৃথিবীতে যেসব প্রাণীর প্রাণের অস্তিত্ব আছে এবং যাদের প্রাণ নেই সবকিছুই বেড়ে ওঠা মাটিকে ভিত্তি করে। মাটি হচ্ছে সবকিছুর প্রাকৃতিক ভিত্তি, যা সব ধরনের কাঠামো এবং বিনিয়োগকে সহায়তা দেয়। যেকোনো ধরনের নির্মাণকাজের ক্ষেত্রে মাটি পরীক্ষা বা অনুসন্ধান হচ্ছে সবচেয়ে কম ব্যয়সাপেক্ষ কিন্তু অধিকাংশ বিনিয়োগকারী মাটি পরীক্ষাকে অযথা অর্থের অপচয় বলে মনে করেন। কিন্তু হিসাব বলছে, মাটি পরীক্ষার খরচ মূল নির্মাণকাজের মোট খরচের শতকরা এক ভাগেরও কম। অনেক ঠিকাদার মাটির যথাযথ পরীক্ষাকে অবহেলা করেন। মাটির সেটেলমেন্টের হার, মাটির বিয়ারিং ক্যাপাসিটি বা ধারণক্ষমতার একটি আনুমানিক ধারণা থেকে ভবনের ভিত্তি নকশা করিয়ে থাকেন।

মাটি পরীক্ষাগার

মাটির নানা ধরনের পরীক্ষা মাটির ভৌত ও রাসায়নিক বৈশিষ্ট্যসমূহ সিকশনে ব্যাপকভাবে সাহায্য করে। মাটির এসব বৈশিষ্ট্য বিভিন্ন অঞ্চল বা স্থানভেদে ভিন্ন হয়। এমনকি এটা মাটির বিভিন্ন স্তরে স্তরে এবং ভবনের মাটির মধ্যে যত দূর পর্যন্ত যাবে তার মধ্যেও ভিন্ন ভিন্ন হতে পারে। মাটির বৈশিষ্ট্য খুবই সামান্য জায়গায়ও ব্যাপক পরিবর্তন দেখা যায়। আবহাওয়া, জলবায়ু পরিবর্তন এবং সাইটের ব্যবস্থাপনা ভবিষ্যতে মাটির বিয়ারিং ক্যাপাসিটি ওপর প্রভাব ফেলে। যদি কোনো ভবনের ভিত মাটির সঠিক বিয়ারিং ক্যাপাসিটি অনুযায়ী নির্মাণ করা না হয়, তবে ভবনের ভিত এবং এর মূল কাঠামো ভেঙে পড়বে। এই বিষয়টি খুবই গুরুত্বপূর্ণ, কেননা এতে সম্পূর্ণ প্রকল্পটি দীর্ঘ সময়ের জন্য জটিলতায় পড়বে। তদুপরি এর ফলে বিশাল ও ব্যাপক অর্থের এমনকি জীবননাশের আশঙ্কা থাকে। এ ছাড়া যেকোনো স্থানের ভবনধসের ফলে এর আশপাশের ভবনগুলোও ঝুঁকির মধ্যে পড়ে, এতে ভবনে বসবাসকারী বাসিন্দারা ভোগেন নিরাপত্তাহীনতায়।

মাটির পরীক্ষা সম্পূর্ণ নির্ভর করে ভবনের আকার-আকৃতির ওপর। মাটি পরীক্ষায় যে বিষয়গুলো সম্পর্কে নিশ্চিত হওয়া যায় :

মাটির প্রকৃত ভারবাহী ক্ষমতা।

মাটির Settle হওয়ার অনুপাত। যার দ্বারা এর ওপর নির্মিত ভবনের Settle হওয়ার অনুপাত সঠিকভাবে নিরূপণ করা যায়।

মাটির পরীক্ষার দ্বারা কোনো নির্দিষ্ট ভবনের জন্য কী ধরনের ফাউন্ডেশন বা ভিত উপযুক্ত হবে এবং এদের আকার-আকৃতি নির্ণয় সহজ হয়।

মাটির পরীক্ষা দ্বারা ওই স্থানের জন্য কী ধরনের নির্মাণকৌশল ও নির্মাণ-প্রযুক্তি উপযুক্ত হবে তা নির্ধারণ সম্ভব হয়।

ভবনের ভিতের সঙ্গে যুক্ত যেকোনো ধরনের সমস্যা সম্বন্ধে ধারণা এবং তা সমাধানের জন্য যথাযথ পদক্ষেপ গ্রহণ করা যায়।

মাটির পরীক্ষা দ্বারা নির্মাণ সাইটটি নিমজ্জন (Subsidence) সম্মুখীন হবে কি না এবং এর দ্বারা নির্মিত ভবনটি নিমজ্জনের সম্মুখীন হবে কি না তা নির্ণয় করা যায়।

মাটির নিচে অবস্থিত পানির স্তর সম্বন্ধে সঠিক ধারণা পাওয়া যায়। যার দ্বারা ভিত কী পরিমাণ আর্দ্রতার সম্মুখীন হবে তা নিরূপণ করা যায়।

মাটির পানি ধারণের সঙ্গে মাটির বৈশিষ্ট্য অনেক বেশি নির্ভরশীল। তাই মাটির পরীক্ষা দ্বারা মাটি কী ধরনের আচরণ করতে পারে তা নির্ণয় করা যায়।

মাটির পরীক্ষা দ্বারা সাইটের মাটি নুড়ি, বালু, বোল্ডার মাটি কি না তা নির্ণয় করে ওই সাইটের জন্য কী ধরনের নির্মাণসামগ্রী ব্যবহার উপযুক্ত হবে তা নির্ণয় করা যায়।

এ ছাড়া সঠিক ফাউন্ডেশন ডিজাইন এবং ব্যয় বা খরচ নির্ধারণে মাটির পরীক্ষা অত্যাবশ্যক। একটি কথা মাথায় রাখা দরকার, সঠিক ও নির্ভুলভাবে নির্মাণ সাইটের মাটি পরীক্ষা ছাড়া বাড়ি বা ভবনের জন্য সঠিক ফাউন্ডেশন ডিজাইন সম্ভব নয়। তাই ভবনের স্ট্রাকচারাল ডিজাইন তৈরি করার আগে অভিজ্ঞ প্রকৌশলী দিয়ে নির্মাণ সাইটের যথাযথ পরীক্ষালব্ধ মাটি পরীক্ষা রিপোর্ট প্রয়োজন। স্ট্রাকচারাল ইঞ্জিনিয়ার ওই সয়েল টেস্ট রিপোর্ট পরীক্ষা করে ভবনের ফাউন্ডেশন সাইজ, গভীরতা ইত্যাদির নকশা করবেন।

ডিজিটাল পিএইচ মিটারে ও অন্যান্য মাধ্যমে মাটি পরীক্ষা

মাটি পরীক্ষার পদ্ধতি

মাটি পরীক্ষার পদ্ধতির মধ্যে রয়েছে-

সাইট বা প্লট পরিদর্শন ও জরিপ করা

ফিল্ডের অবস্থা অনুযায়ী বোরিংয়ের সংখ্যা ও স্থান নির্ধারণ করা এবং সেই অনুযায়ী বোরিংয়ের কাজ সম্পন্ন করা

প্রয়োজন অনুযায়ী বোরিংয়ের গভীরতা নির্ণয় করা

প্রতিটি বোরিংয়ের স্থানে মাটির অক্ষত (Undisturbed Sample) এবং বিখ্যত (Disturbed Sample) নমুনা সংগ্রহ করা এবং সেই সব নমুনা ফিল্ড ও ল্যাবরেটরিতে পরীক্ষা করা

বোরিং বা ড্রিলিংয়ের সাহায্যে প্রতি ৫ ফুট পরপর এসপিটি (SPT) ভ্যালু নির্ণয় করা এবং মাটির নিরাপদ ভারবহন ক্ষমতা (Safe Bearing Capacity) বের করা

ফিল্ড টেস্ট এবং ল্যাব টেস্টের ফলাফল বের করা

শেষে মাটি পরীক্ষার চ‚ড়ান্ত রিপোর্ট তৈরি করে সে অনুযায়ী ভবন ফাউন্ডেশন সম্পর্কে মন্তব্য প্রদান।

মাটির স্যাম্পল সংগ্রহ প্রক্রিয়া

মাটি পরীক্ষার জন্য সাইট বা প্লট পরিদর্শন

মাটি পরীক্ষা করার আগে অবশ্যই সাইট পরিদর্শন করতে হবে। এতে মাটির প্রকৃতি বা বৈশিষ্ট্য সম্বন্ধে প্রাথমিক ধারণা পাওয়া যায়। সাইট পরিদর্শনের সময় বোরিং বা ড্রিলিং করার জন্য প্রাথমিক পরিকল্পনা করে বোরিংয়ের স্থান চিহ্নিত বা নির্ধারণ করা হয়।

মাটি পরীক্ষায় সতর্কতা

যেকোনো ধরনের নিচু বা ভরাট মাটির জায়গায় নির্মাণকাজ পরিচালনার জন্য অবশ্যই বোরিং টেস্ট করতে হবে।

সাইটে মাটির নমুনা সংগ্রহ

সাইট থেকে সাধারণত নমুনা সংগ্রহ করা হয় :

বিক্ষত নমুনা (Disturbed Sample)

অক্ষত নমুনা (Undisturbed Sample)

বিক্ষত নমুনা 

মাটির বিক্ষত নমুনা সংগ্রহের সময় মাটিতে সাইটের এ ধরনের বৈশিষ্ট্য বহন করে না, যার কারণে প্রকৌশলীরা তাঁদের সাইটের যথাযথ প্রতিরক্ষা হিসেবে গণ্য করেন না। সাধারণত মাটির বিক্ষত নমুনা দিয়ে মাটির টেক্সার, মাটির আর্দ্রতা, প্রকৃতি ইত্যাদি নির্ণয়ের উদ্দেশ্যে মাটির বিক্ষত নমুনা ব্যবহার করা হয়।

২. অক্ষত নমুনা 

মাটির অক্ষত নমুনা সাইটের মাটির বৈশিষ্ট্য অনেকাংশে বহন করে। যদিও একদম অক্ষত নমুনা সংগ্রহ করা খুবই দুরূহ। অক্ষত নমুনার সাহায্যে প্রকৌশলীরা খুব সহজেই মাটির শক্তি, ভেদ্যতা, মাটিতে সৃষ্ট ফাটলের ধরন, সংকোচনের ক্ষমতা প্রভৃতি নির্ণয় করা যায়। যার দ্বারা ওই সাইটের নির্মিত ভবনের ফাউন্ডেশন ডিজাইন করা যায়।

পাহাড়ে স্থাপনা নি‍র্মাণের পূ‍র্বে মাটি যাচাই-বাছাই করণ

সাধারণ নিয়ম অনুযায়ী প্রতি তলা ভবনের জন্য তিন মিটার করে বোরিং করতে হয়।

ভবনের প্রস্থ বা পার্শ্বদিক অবস্থান অনুযায়ী বোরিং গভীরতা

মাটির ভারবহন ক্ষমতা

১. যেকোনো ভবনের ফাউন্ডেশন ফুটিং ডিজাইন করার আগে মাটির নিরাপদ ভারবহন ক্ষমতা (Safe Bearing Capacity) জানা একান্ত জরুরি বা অত্যাবশ্যক। মাটির গ্রহণযোগ্যতা ভারবহন ক্ষমতা সাধারণত মাটির পরীক্ষা এবং টেস্ট বোরিংয়ের লগ থেকে নির্ণয় করা যায়।

শিলামাটি ফাউন্ডেশন সামগ্রী হিসেবে সবচেয়ে ভালো উপাদান।

বালু এবং নুড়ি ফাউন্ডেশনের সামগ্রী হিসেবে বেশ ভালো।

২. এখানে উল্লেখ্য, মাটির ভারবহন ক্ষমতা যে বিষয়গুলোর ওপর নির্ভর করে-

মাটির ধরন ও প্রকৃতি এবং এর ভৌত ধর্মের ওপর নির্ভর করে। যেমন- ঘনত্ব (Density), শেয়ার স্ট্রেন্থ (Shear Strength)।

মাটির সংকোচনের ওপর নির্ভর করে।

মাটির নিচে পানির স্তরের ওপর নির্ভর করে।

মাটির স্যাম্পল সংগ্রহ

মাটির ভারবহন ক্ষমতা ফাউন্ডেশনের আকৃতির ওপর নির্ভর করে। যেমন-

১. ফাউন্ডেশনের টাইপ বা ধরন

২. ফাউন্ডেশনের সাইজ এবং স্লেপ (Slape)

৩. ফাউন্ডেশনের গভীরতা ইত্যাদি।

মাটি পরীক্ষাগার

মাটির নিরাপদ ভারবহন ক্ষমতার ছক

নরম মাটির ভারবহন ক্ষমতা বাড়ানোর উপায়

নরম মাটির ভারবাহী ক্ষমতা বাড়াতে যে যে ব্যবস্থা নেওয়া যেতে পারে :

প্রয়োজনে ফাউন্ডেশনের গভীরতা বাড়াতে হবে।

প্রয়োজনীয় গভীরতায় মাটি খননের পর দুরমুজ দিয়ে সংকোচন করতে হবে। প্রয়োজন বোধে ইট-পাথরের টুকরো দুরমুজ দিয়ে মাটির ভেতরে ঢুকিয়ে দিতে হবে।

নরম মাটি সরিয়ে তা বালু দিয়ে পূর্ণ করে পানিসহযোগে তা শক্ত করতে হবে।

প্রয়োজনে কাঠ বা কংক্রিটের পাইলিং করতে হবে।

ফাউন্ডেশনের তলায় অতিরিক্ত পানি থাকলে তা অপসারণ করতে হবে।

সয়েল কমপেকশন 

মাটির কমপেকশন বা সংকোচনের জন্য : 

এর ফলে মাটির ঘনত্ব, শেয়ার ও বেয়ারিং ক্যাপাসিটি বৃদ্ধি পায়।

রাস্তার মাটি বা ভিত্তির শক্তি বৃদ্ধি পায়।

চাপের ফলে মাটির সংকোচন কমাতে সাহায্য করে।

মাটি পরীক্ষাকরণ প্রক্রিয়া

মাটির যত পরীক্ষা

মাটির পরীক্ষা সাধারণত দুই ভাবে ভাগ করা হয় :

১. সাইট বা ফিল্ড টেস্ট 

২. ল্যাবরেটরি টেস্ট 

বিভিন্ন স্থানের মাটির উপাদানের ভিন্নতার ওপর নির্ভর করে মাটির যত পরীক্ষা :

১. বালুময় মাটি পরীক্ষা

  • SPT (Standard Penetration Test)
  • Dynamis Cone Test.
  • Static Cone Test.
  • Flat Plate Diatometer Test.
  • Pressure Meter Test.

২. কাদামাটি পরীক্ষা

  • Static Cone Test.
  • Field Vane Test.
  • Flat Plate Diato Meter Test.
  • Plate Bearing and Screw Test.

উপরিউক্ত টেস্টে প্রাপ্ত ফলাফলের মাধ্যমে মাটি পরীক্ষার চ‚ড়ান্ত রিপোর্ট তৈরি করা হয়।

মাটি পরীক্ষায় ফিল্ড টেস্ট

 মাটির ফিল্ড টেস্টেও মধ্যে রয়েছে-

ক. প্লেট লোড বেয়ারিং টেস্ট (Plate Load Bearing Test)

এই পরীক্ষাটি খুবই সাধারণ যন্ত্রে পরিচালিত হয়। এই পরীক্ষার মাধ্যমে যেকোনো স্তরের চূড়ান্ত বেয়ারিং ক্যাপাসিটি ও মাটির সংকোচন নির্ণয় করা যায়। তা ছাড়া এ টেস্টের মাধ্যমে প্রস্তুতকৃত ফলাফলের তুলনা এবং সত্যতা যাচাই করা যায়।

খ. এসপিটি টেস্ট (Standard Penetration Test-S.P.T. Test)

এসপিটির মাধ্যমে মাটির N-Value যেমন নির্ণয় করা যায়। তেমনি সংগৃহীত মাটির নমুনা ল্যাবরেটরিতে পরীক্ষা সম্ভব। সাইটে বা ফিল্ডে প্রতি পাঁচ ফুট পর পর বোরিং করে N-Value নির্ণয় করা হয়, যা মাটির ভারবহন ক্ষমতার সরাসরি দিকনির্দেশনা দেয়। সাধারণত N-Value-এর মান ১০ থেকে ৩০-এর মধ্যে থাকলে বহুতল ভবন নির্মাণের জন্য উপযুক্ত বা গ্রহণযোগ্য বলে বিবেচনা করা হয়। এসপিটি টেস্টের মাধ্যমে ফিল্ডে সরাসরি মাটির ভারবহন ক্ষমতা নির্ণয় করা যায় এবং এর মাধ্যমে প্রাপ্ত N-Value ওপর ভিত্তি করে নির্মাণকাজ সম্পন্ন করা হলে তা অনেকাংশে সফল হয়।

২. মাটির ল্যাব টেস্ট (Lab Test)

অঝঞগ অনুযায়ী মাটির ল্যাব টেস্ট যত ধরনের :

ময়েশ্চার কনটেন্ট টেস্ট (Moisture Wantent Test)

প্লাস্টিসিটি টেস্ট (Playsticity Test)

আপেক্ষিক গুরুত্ব পরীক্ষা (Specitic Gravily Test)

ঘনত্ব টেস্ট (Density Test)

কনসোলিডেশন টেস্ট (Consolidation Test)

ডাইরেক্ট শেয়ার টেস্ট (Direct Shear Test)।

ল্যাবরেটরিতে মাটির এসব পরীক্ষা ছাড়াও মাটির কমপ্যাকশন পরীক্ষা করা হয়। ল্যাবরেটরিতে মাটির কমপ্যাকশন পরীক্ষা করা হয় মূলত মাটির ঘনত্ব, ভারবহন ক্ষমতা বাড়াতে।

স্ক্যাভেটরের সাহায্যে মাটি উত্তোলন

সঠিকভাবে মাটি পরীক্ষা না করলে

শুধু মাটি পরীক্ষা নয়, এর যথাযথ মান নিয়ন্ত্রণের ওপর গুরুত্ব আরোপ করতে হবে। কেননা মাটি পরীক্ষা থেকে প্রাপ্ত ফলাফল ভবন নির্মাণে ব্যাপক ও সুদূরপ্রসারী প্রভাব ফেলে। ভবনের ভিত্তির প্রকৃতি ও ডিজাইন নির্ভর করে ভবনটির জন্য কী ধরনের ফাউন্ডেশন উপযুক্ত, যা মাটি পরীক্ষা থেকে নির্ধারণ করা হয়। মাটির পরীক্ষা যদি যথাযথভাবে করা না হয়, তবে দুই ধরনের প্রভাব পরিলক্ষিত হয়। মাটি সঠিকভাবে পরীক্ষা না করে ভবনের ফাউন্ডেশন ডিজাইন করলে ফাউন্ডেশন ওভার কিংবা আন্ডার ডিজাইন (Over or Under Design) হতে পারে। যাতে মূল ভবনের নিরাপত্তাজনিত সমস্যা হয়। ভবনের ভিত যদি আন্ডার ডিজাইন হয়, তাহলে সম্পূর্ণ ভবনটি ধসে বিশাল সম্পদ ও প্রাণের ক্ষয়ক্ষতি করতে পারে। তদুপরি ভবনধসের ফলে এর আশপাশের ভবনগুলোও ঝুঁকিপূর্ণ হয়ে পড়ে। আর যদি ভবনের ভিত ওভার ডিজাইন হয়, তবে নির্মাণখরচ বাড়ে অনেকাংশে। যেমন- মাটি SPT টেস্টের মাধ্যমে নির্ণয়কৃত N-Value যদি প্রকৃত N-Value থেকে বেশি হয় এবং এর ওপর ভিত্তি করে যদি ভবনের ফাউন্ডেশন ডিজাইন করা হয়, তবে তা হবে আন্ডার ডিজাইন এবং এটা ভবনকে করে তুলবে ঝুঁকিপূর্ণ। আর যদি SPT টেস্ট দ্বারা নির্ণয়কৃত N-Value প্রকৃত N-Value থেকে কম হয়, তাহলে এর ওপর ভিত্তি করে ফাউন্ডেশন ডিজাইন করলে তা হবে Over Design এবং এর ফলে ভবনের নির্মাণখরচ বেড়ে যাবে অনেকটাই। তাই বহুতল ভবন নির্মাণে মাটি পরীক্ষার পাশাপাশি এর গুণগত মান নিশ্চিত করা একান্ত প্রয়োজন।

প্রেক্ষিত বাংলাদেশ

মাটি পরীক্ষা যেকোনো ভবন নির্মাণের পূর্বশর্ত হলেও এ ব্যাপারে বাংলাদেশের বাস্তব চিত্র খুবই হতাশাজনক। অধিকাংশ ক্ষেত্রেই জমির বা ভবনের মালিক মাটি পরীক্ষার ব্যাপারে অনীহা প্রকাশ করেন। এমনকি প্রকৌশলীরা অনেক সময় এসব ক্ষেত্রে উদাসীন থাকেন। অনেক ক্ষেত্রে মাটি পরীক্ষা করা হলেও এর যথাযথ ও গুণগতমান যাচাই-বাচাই করা হয় না। আমাদের দেশে সাধারণত SPT টেস্টের মাধ্যমে নির্ধারিত N-Value-এর ওপর ভিত্তি করে ফাউন্ডেশন ডিজাইন করা হয়। তারপরও এই পরীক্ষাটি যথাযথ মান নিয়ন্ত্রণের মাধ্যমে করা হয় না। মাটির বিভিন্ন ধরনের পরীক্ষা থাকা সত্ত্বেও SPT-কে মাটি পরীক্ষার জন্য বেছে নেওয়ার পেছনে মূল কারণ এটা অন্য সব পরীক্ষা থেকে কম খরচে এবং সহজে মাঠে করা সম্ভব। তা ছাড়া SPT টেস্ট দ্বারা নির্ধারিত N-Value-এর ওপর ভিত্তি করে ফাউন্ডেশন ডিজাইন করলে তা অনেকাংশে শক্ত নির্মাণের নিশ্চয়তা দেয়।

ভবন নির্মাণে মাটি পরীক্ষা

আমাদের দেশে কিছু জমি বা প্লটের মালিক বা ভবন নির্মাণকারী অনভিজ্ঞ মিস্ত্রি কিংবা ঠিকাদারের পরামর্শ অনুযায়ী মাটি পরীক্ষা ছাড়াই বাড়ি নির্মাণ করেন। আবার কিছু জমির মালিক অজ্ঞতার কারণে মাটি পরীক্ষা না করে পাশাপাশি নির্মিত বাড়ির প্ল্যান, ডিজাইন ও মাটির ভারবহন ক্ষমতা ইত্যাদি দেখেন এবং অনুমান করে বাড়ির প্ল্যান ও ডিজাইন করে থাকেন। এসব ক্ষেত্রে সতর্ক থাকা উচিত, এ ধরনের অনুমাননির্ভর মাটি পরীক্ষা দিয়ে বাড়ি নির্মাণ করা মোটেই গ্রহণযোগ্য নয়। কেননা মাটির শক্তি বা ভারবহন ক্ষমতা সব স্থানে একই রকম নয়। তা ছাড়া মাটির শক্তি ধর্ম ও স্থানভেদে পরিবর্তনশীল। তাই সঠিক ফাউন্ডেশন ডিজাইন আর ব্যয় নির্ধারণের জন্য সাইটের মাটি পরীক্ষা অত্যাবশ্যক। 

যেকোনো ধরনের ভবন বা ভবনের নির্মাণকাজের আগে অবশ্যই যথাযথ মান নিয়ন্ত্রণের মাধ্যমে মাটি পরীক্ষা করা উচিত। মাটির পরীক্ষা ব্যতীত নির্মাণকাজ চালানো আধুনিক নির্মাণশৈলীতে কাম্য নয়। ভবন নির্মাণের ক্ষেত্রে অনেকে মাটি পরীক্ষাকে অর্থের অপচয় মনে করলেও বাস্তবিক অর্থে এটা ভবন নির্মাণের সঠিক ব্যয় নিরূপণের পাশাপাশি ভবনের নির্মাণব্যয় অনেকাংশে কমিয়ে দেয়। তাই ভবন নির্মাণে মাটি পরীক্ষার ক্ষেত্রে সংশ্লিষ্ট সবার যত্নশীল হওয়া উচিত। তবেই আমরা নিজেদের ও আগামী প্রজন্মের জন্য বড় বড় শহর ও নগরে ঝুঁকিমুক্ত ও নিরাপদ আবাসস্থল গড়ে তুলতে পারব।

প্রকৌশলী সনজিত সাহা

[email protected]

প্রকাশকাল: বন্ধন ৪৮ তম সংখ্যা, এপ্রিল ২০১৪

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Scroll to Top