যেকোনো ধরনের স্থাপনায় ফাটল খুব সাধারণ একটা ব্যাপার। কংক্রিট স্থাপনার দৃঢ়তা নিশ্চিতের পাশাপাশি সৃষ্টি করে ফাটলও। স্থাপনায় তখনই ফাটল দেখা যায় যখন নির্মাণ উপকরণের শক্তির চেয়ে প্রযুক্ত চাপ হয় বেশি। ভবনের নির্মাণ উপাদানের ওপর চাপ সৃষ্টি হয় মূলত বাহিক্য বল প্রয়োগের ফলে; যার মধ্যে রয়েছে ভূকম্পীয় চাপ, অভ্যন্তরীণ তাপীয় গতি-প্রকৃতি, আর্দ্রতার পরিবর্তন, রাসায়নিক বিক্রিয়া মতো অনুঘটক।
২০০৩ সালে দেশের প্রায় ১০ হাজার আবাসিক ভবনে বিল্ডিং অ্যান্ড কনস্ট্রাকশন (বিসিএ) পরিচালিত এক জরিপ মতে, ভবনের মালিকেরা বাইরের দেয়াল থেকে পানি চোয়ানোর মতো ত্রুটির সম্মুখীন হন বেশি। মূলত এক স্তরবিশিষ্ট ইটের দেয়ালের কারণেই বাইরের দেয়াল থেকে পানি চুইয়ে পড়ে। প্রায় ৯০ শতাংশ পানি চুইয়ে পড়ে চুন করা ইটের দেয়ালের ফাটল থেকে। সাধারণত ভবন নির্মাণকাজ শেষ হওয়ার পাঁচ বছরের মধ্যেই বাইরের দেয়াল থেকে পানি চোয়ানো শুরু হয়। অধিকাংশ ভবনে বসবাসরত সময়সীমা উত্তীর্ণ হলেই ফাটল দেখা দেয়। সৃষ্ট ফাটল একটি ভবনের গঠনগত দিক থেকে মারাত্মক ঝুঁকিপূর্ণ। ফাটল রোধে পূরক পদার্থ দ্বারা সাধারণ সংস্কার অথবা পুনরায় জোড়া দেওয়ার প্রয়োজন হয়। কেননা ফাটল ভবনটির সেবাদানের ক্ষমতা বা স্থায়িত্বের ওপর প্রভাব ফেলে। ফাটলে ভবনের মূল্য ও বিমা যোগ্যতা কমে বিক্রয় যোগ্যতা হ্রাস পায়। এমনকি ফাটলকৃত ভবন মোকদ্দমার কারণও হতে পারে। এই কারণে সঠিকভাবে সঠিক সময়ে ফাটল যাচাই করে তা দ্রুততার সঙ্গে সংস্কার করা প্রয়োজন।

কংক্রিটে সৃষ্ট ফাটল
কংক্রিটে সৃষ্ট ফাটল মূলত দুই ধরনের-
- কংক্রিট দৃঢ়তা লাভের আগে ও দৃঢ়তা লাভকালীন সৃষ্ট ফাটল।
- কংক্রিটপূর্ণ দৃঢ়তা লাভের পরে সৃষ্ট ফাটল।
কংক্রিটে দৃঢ়তা লাভের আগে এবং দৃঢ়তা লাভকালীন সৃষ্ট ফাটল
স্থায়ী সংকোচন বা Plastic Shrinkage ফলে কংক্রিটে যে ফাটল হয় তা মূলত বাতাসের গতিবেগ, নিম্ন আর্দ্রতা, কংক্রিটের চারপাশের উচ্চ তাপমাত্রা কিংবা এই তিনের মিলিত প্রভাবে কংক্রিটের উপরিভাগে থাকা পানি বাষ্পে পরিণত হয়ে পরিবেশে ফিরে আসে। আর কংক্রিটে এ পানির শূন্যতা পূরণ হয় ব্লিডিংয়ের (Bleeding) মাধ্যমে। ব্লিডিংয়ের মাধ্যমে পানি কংক্রিটের ওপরপৃষ্ঠে (Surface) আসে। কংক্রিটের মধ্যে বা উপরিভাগের অনবরত পানির বাষ্পে পরিণত হওয়ার ফলে ফাটল সৃষ্টি হয়। কংক্রিটের ভার্টিক্যাল বা খাড়া ফাটল সৃষ্টি হয় রিইনফোর্সড স্টিলের চারপাশে অবস্থিত কংক্রিটের সেটেলমেন্ট (Settlement)-এর কারণে। এ ধরনের ফাটল সৃষ্টি হয় তখনই, যখন কংক্রিটের উপরিভাগের সামান্য সেটেলমেন্ট থাকে। কিন্তু অন্যান্য অংশের কংক্রিট তখনো সেটেল (Settle) করতে সক্ষম। কংক্রিটে Sloping ফাটল দেখা দেয় যদি Coarse Aggregate-গুলো কংক্রিটের উপরিভাগে থাকে এবং সিমেন্ট পেস্ট কংক্রিটে অবস্থিত স্টিলের দ্বারা নির্মিত কাঠামো বা ফ্রেমের মধ্যে সেটেল করে আলাদা হয়ে যায়।
কংক্রিট দৃঢ়তা লাভের পরে সৃষ্ট ফাটল
কংক্রিটে সৃষ্ট এ ধরনের ফাটল সেই সব কংক্রিটের মধ্যে হয়, যাদের আকার-আকৃতি শুধু ভাঙা বা ধ্বংস ছাড়া পরিবর্তন সম্ভব নয়। কংক্রিটের যেসব উপাদান পরিবেশের সংস্পর্শে থাকে, তাপমাত্রা পরিবর্তনের সঙ্গে তাতে ফাটলের সৃষ্টি হয়। ভবন নির্মাণের সময় যদি কাঠামোর নির্মাণশৈলীর বিভিন্ন অংশে Movement-কে Permit করা না থাকে। সেক্ষেত্রে এ ফাটলের পরিমাণ বাড়বে।

কংক্রিটের সম্পূর্ণ দৃঢ়তা অর্জনের পরেও যদি এটা অত্যাধিক পরিমাণে পানির সংস্পর্শে আসে তাহলে পানি সিমেন্টকে কংক্রিটের উপরিতলে টেনে নেয়। এতে কংক্রিটের উপরিভাগ দুর্বল হয়ে কংক্রিট উচ্চ সংকোচনের সম্মুখীন হয়। এ ছাড়া এ ধরনের সমস্যা নিম্নমানের কিউরিংয়ের জন্যও হয়ে থাকে। কংক্রিটপূর্ণ শক্তি অর্জনের পরে কংক্রিটের ফাটল সাধারণত কংক্রিটে পর্যাপ্ত পরিমাণে স্টিলের ব্যবহার না করায় হয়। কংক্রিট স্থাপনায় স্টিল বারের জাল বা Nesting যথাউপায়ে না হওয়ায় কংক্রিটে ফাটল দেখা দেয়। আবার উপযুক্ত স্থানে সংকোচন ও প্রসারণ যথাযথ না হওয়ায় সৃষ্টি হয় ফাটলের।
ভবনের কাঠামোর গুরুত্ব বা ঝুঁকি বিবেচনায় কংক্রিটের ফাটলকে দুইভাবে ভাগ করা যায়-
- স্ট্রাকচারাল ফাটল
- নন-স্ট্রাকচারাল ফাটল।
স্ট্রাকচারাল ফাটল
স্ট্রাকচারাল ফাটল মূলত কংক্রিটে সৃষ্ট এমন সব ফাটল যা অপরিণত বা ভুল ডিজাইনের কারণে হয়। এ ছাড়া নিম্নমানের নির্মাণকাজ বা ভুল নির্মাণ পদ্ধতি কিংবা ডিজাইনে অধিক লোড প্রয়োগে ফাটল সৃষ্টি হয়। এ ধরনের ফাটল যেকোনো স্থাপনার আয়ুস্কাল কমিয়ে এর স্থায়িত্বের জন্য হুমকি হয়ে দাঁড়ায়। তা ছাড়া এ ধরনের ফাটলে বড় ধরনের দুর্ঘটনার আশঙ্কা থাকে। রিইনফোর্সড কংক্রিটে নির্মিত বিমের Extensive ফাটলগুলো সাধারণত স্ট্রাকচারাল ফাটলের ফলে সৃষ্ট। স্ট্রাকচারাল ফাটলের ফলে যেসব ভবনের স্থায়িত্ব হুমকির সম্মুখীনম সেসব ভবনে রেক্ট্রোফিটিংয়ের মাধ্যমে কাঠামোকে অনেক বেশি মজবুত করে এর স্থায়িত্ব বাড়ানো সম্ভব। তা ছাড়া কোনো স্থাপনায় যদি ডিজাইনের চেয়ে বেশি লোড চলে সেক্ষেত্রে এই পদ্ধতির সাহায্যে এর ফাউন্ডেশন শক্তি বাড়িয়ে একে সামগ্রিকভাবে ঝুঁকিমুক্ত করা যায়।
নন-স্ট্রাকচারাল ফাটল
নন-স্ট্রাকচারাল ফাটল সাধারণত বিল্ডিং ম্যাটেরিয়ালের মধ্যে সৃষ্ট অভ্যন্তরীণ (Internal) চাপে হয়। বিল্ডিং এ সৃষ্ট অভ্যন্তরীণ চাপ শেয়ার টেনসাইল ও কম্প্রেসিভ হতে পারে। ভবনের যেসব উপাদান ফাটলের মুখে পড়ে তা হলো কংক্রিট, মর্টার এবং মেশনারি (Masonry)। ভবনের উপাদানসমূহ সাধারণত শেয়ার এবং টেনশনে দুর্বল হয়। তাই এ ধরনের চাপে খুব সামান্য পরিমাণে হলেও ফাটল সৃষ্টি হতে পারে। ফাটলের আকার-আকৃতি ও প্রকৃতি দেখে খুব সহজেই শেয়ারে সৃষ্ট ফাটল এবং টেনশনে সৃষ্ট ফাটলকে আলাদা করা যায়। এ ধরনের নন-স্ট্রাকচারাল ফাটলসমূহ ভবনের কাঠামোতে কোনো ধরনের প্রভাব না ফেলায় ভবনের কাঠামো দুর্বল হয় না। তবে কিছু কিছু নন-স্ট্রাকচারাল ফাটল ভবনের আয়ুস্কালের ওপর প্রভাব ফেলে। কেননা এ ধরনের ফাটলের মাধ্যমে বৃষ্টির পানি, বাতাসের জলীয় বাষ্প প্রভৃতি খুব সহজেই কংক্রিটের স্টিল বার অবধি পৌঁছায়। ফলে কংক্রিটে অবস্থিত স্টিলবারে মরিচা ধরায় তা ক্ষয়প্রাপ্ত হয়ে মূল স্থাপনাকে অরক্ষিত করে ফেলে, যা ভবনের স্থায়িত্বের জন্য হুমকি হয়ে দাঁড়ায়। দীর্ঘ কম্পাউন্ট (Compound) দেয়ালে সংকোচন বা উত্তাপীয় চলাচলের ফলে খাড়া (Vertical) নন-স্ট্রাকচারাল ফাটলের সৃষ্টি করে। নন-স্ট্রাকচারাল ফাটলসমূহ ভবনের স্থায়িত্বে কোনো ধরনের সমস্যা সৃষ্টি না করলেও এটা ভবনের সৌন্দর্যে প্রভাব ফেলে। নন-স্ট্রাকচারাল ফাটলসমূহ নিম্নমানের নির্মাণকাজ পরিচালনার ফল, যা ভবনে বসবাসকারী বাসিন্দাদের জন্য ঝুঁকির কারণ।

ফাটল পর্যবেক্ষণ
যত তাড়াতাড়ি সম্ভব ফাটল পর্যবেক্ষণ করা উচিত। দীর্ঘ সময় ধরে ফাটল পর্যবেক্ষণ করলে ফাটলের কারণ নির্ধারণে যাবতীয় তথ্য পাওয়া সম্ভব। প্রক্রিয়াটি তথ্য একত্রকরণ, অনুসন্ধান এবং নিরাময়কার্য সম্পন্ন অবধি চলে। পর্যবেক্ষণ করা গুরুত্বপূর্ণ কেননা কংক্রিটের অন্তর্নিহিত চাপের কারণেও দেখা দেয় ফাটলের।
ফাটল সৃষ্টির কতিপয় কারণ
আমাদের দেশের বেশির ভাগ অল্প উচ্চতাসম্পন্ন ভবন ইট, কংক্রিট, ব্লক বা চূর্ণ পাথরে তৈরি। এই উপাদানগুলোর বিশেষ চাপ সহ্য করার ক্ষমতা থাকলেও এর খাপ-খাওয়ানোর ক্ষমতা সীমিত। চাপ বাড়লে সহজেই ফাটলের সৃষ্টি হয়। সম্ভাব্য অনেক কারণেই ফাটল সৃষ্টি হতে পারে। ফাটল সৃষ্টির কয়েকটা সাধারণ কারণ-
ভিত প্রশমন বা হ্রাস
ভিত প্রশমন ভিতের নিম্নভিমুখী গতি। এটি স্বাধীনভাবে বা ভিতের চাপের কারণে হতে পারে।
ভিত প্রশমনের রূপক কারণসমূহ-
- আর্দ্রতার পরিবর্তনের সঙ্গে মাটির সংকোচন ও প্রসারণের প্রভাব।
- প্রাক্তন মাইনওয়ার্কিং ধ্বংসে পড়া।
- ছিদ্রযুক্ত নালা, যা মূলত অকেজো।
- ভিতকে ধরে রাখা মাটি নরম হয়ে যাওয়া।
- ঢালু ভূমিতে ভূমি ধ্বংস।
- পিট বা খাসের চাপড়া।
ভিত্তি পত্তন
ভিত্তি পত্তন (Settlement) হচ্ছে নিম্নমুখী গতি, যা ভবনের চাপে সৃষ্ট হয়। এটা বন্ধনহীন, নরম এবং উচ্চচাপযুক্ত, যা স্থানিক মাটির ভিতকে ধরে রাখে। এখানকার অতিরিক্ত চাপ হ্রাস বা পত্তন ভবনের কাঠামোতে ফাটল বা বিচ্যুতির কারণ হতে পারে।

নির্মাণকাজে উপাদানের অসংগতি
একই ভবন নির্মাণে বিভিন্ন উপাদান ব্যবহার করার ফলে ফাটলের সৃষ্টি হতে পারে। যেমন- কাঠের দণ্ডবা চৌকাঠের ওপর ভঙ্গুর কংক্রিটের দেয়াল চাপানো। কাঠ নমনীয় এবং আর্দ্রতা কমার সঙ্গে সঙ্গে সংকুচিত হয়ে অধিক ভরের কারণে নিজের স্থান থেকে সরে যায়। ফলে কংক্রিট বন্ধ দেয়ালে সৃষ্টি হয় ফাটলের।
উপাদানের রাসায়নিক বিক্রিয়া
ভবন নির্মাণের কাজে ব্যবহৃত অনেক উপাদানে রাসায়নিক বিক্রিয়া ঘটাতে পারে। যেমন- সমতলের ফাটল হয় মূলত চুনের সঙ্গে ইটের সালফোনিক বিক্রিয়ায়।
উষ্ণতার তারতম্য
তাপমাত্রা পরিবর্তনের কারণে ইমারত নির্মাণ উপাদানের ওপর সংকোচন ও প্রসারণ যোগ্যতায় চাপ বাড়ে। উপাদানের ওপর চাপের প্রসার তাপের বিস্তারের গুণাগুণের ওপর নির্ভর করে। যদি ভবনের উপাদানসমূহের গতি সামলানোর জন্য যথেষ্ট সংযোগের অভাব থাকে, তবে ফাটল সৃষ্টি হয়।
আর্দ্রতার পরিবর্তন
নির্মাণের পরে বিশেষত প্রথম কয়েক মাসের মধ্যে ভবনের উপাদানে আর্দ্রতার পরিমাণে লক্ষণীয় পরিবর্তন হয়। মাটির ইটগুলো প্রাথমিকভাবে বিস্তৃত হয়ে আরোগ্যকরণের জন্য কংক্রিট ব্লকগুলো সংকোচনের মুখে পড়ে। যদিও এই উপাদানগুলো একসঙ্গে আপেক্ষিকভাবে ব্যবহারের ফলে চাপ বেড়ে গিয়ে সৃষ্টি হতে পারে ফাটলের।
সাংগঠনিক অস্থিরতা
ভবনের সাংগঠনিক ব্যর্থতায় ফাটল সৃষ্টি হতে পারে। এর সঙ্গে প্রতিটি উপাদানের ক্রমবর্ধমান চাপ ফাটল সৃষ্টি করে।
সাংগঠনিক পরিকল্পনা
দুর্বল সাংগঠনিক পরিকল্পনা ও নির্দিষ্ট কংক্রিটের কাজে ফাটল সৃষ্টি হয়। এটা গুরুত্বপূর্ণ পরিকল্পনাকারী যেন পরিবেশের সব দিক বিবেচনায় নিয়ে মাটি ও অনুসন্ধানের সহায়তায় পরিকল্পনাকারীকে একটি যথাযথ ভিতের ডিজাইন তৈরিতে সহায়তা করে। সাধারণত ইমারতের ডিজাইন করা হয় বিশেষ ধরনের ব্যবহার সুবিধা পেতে। যেমন- একটি ভবন যা বসবাসের জন্য নকশাকৃত তার সঙ্গে যন্ত্রচালিত ভবনের বিশেষ কিছু সংগঠনিক পার্থক্য রয়েছে।
রক্ষণাবেক্ষণের অভাব
স্থাপনার প্রতি যত্নশীল হওয়া সব সময় গুরুত্বপূর্ণ। রক্ষণাবেক্ষণ করা উচিত নির্দিষ্ট সময় পরে। এটি স্থাপনাকে অক্ষত রেখে স্থায়িত্ব বাড়ায়।
প্রাকৃতিক প্রভাব
- ভূমিকম্প, ঝড়, বৃষ্টি, বন্যাসহ আরও নানা কারণে স্থাপনায় ফাটল সৃষ্টি হয়।
- অধিকাংশ ক্ষেত্রে কংক্রিটের যেখানে ফাটল দেখা দেয় তার পেছনে ফাটলের যথাযথ কারণ নিহিত থাকে। কংক্রিটের স্থাপনায় বিভিন্ন ধরনের ফাটলের ওপর জরিপকৃত পাওয়া ফলাফল-
- নির্মাণ এবং পর্যবেক্ষণজনিত ত্রুটি বা সমস্যার কারণে প্রায় ৩৬ ভাগ কংক্রিটে ফাটল দেখা দেয়।
- নকশাজনিত ত্রুটির কারণের কংক্রিটে ফাটলের হার প্রায় শতকরা ২৭ ভাগ।
- বিরূপ পরিবেশগত (তাপমাত্রা, আর্দ্রতা) কারণে প্রায় ২১ ভাগ কংক্রিটে ফাটল দেখা দেয়।
- যথাযথ মানের নির্মাণসামগ্রী ব্যবহার না করার ফলে প্রায় ১৭ ভাগ কংক্রিটে ফাটল দেখা দেয়।

কংক্রিটে সৃষ্ট ফাটল কমাতে…
কংক্রিটে সৃষ্ট ফাটল সাধারণত কংক্রিট ফ্রেমওয়ার্ক (Formwork)-এর মধ্যে স্থাপনের দুই-তিন দিনের মধ্যে ঘটে। কংক্রিটে সৃষ্ট ফাটলের আশঙ্কা অনেকাংশে কমিয়ে আনতে-
- সাব গ্রেড (Sub-Grade) ভালোভাবে Compact করতে হবে।
- কংক্রিট স্থাপনের জন্য নির্মিত ফ্রেমওয়ার্ক যেন যথাযথ ও মজবুতভাবে স্থাপিত হয়।
- কংক্রিট স্থাপনের আগে সাব গ্রেড এবং ফ্রেমওয়ার্ক ভালোভাবে পানিতে ভেজাতে হবে।
- রেডিমিক্স কংক্রিটে নির্মাণকাজের সময় অতিরিক্ত কোনো ধরনের পানি যেন না দেওয়া হয় সে দিকে লক্ষ রাখতে হবে।
- কংক্রিটের উপাদানসমূহকে যথাযথভাবে মেশাতে হবে।
- সংকোচনের জন্য যথাযথ Contraction Joint প্রয়োগ করতে হবে।
- যেসব জায়গায় প্রসারণ সংযোগ প্রয়োজন, সেখানে প্রসারণ সংযোগ (Expansion Joint) দিতে হবে।
- কংক্রিট স্থাপনের পর যত দ্রুত সম্ভব কিউরিং শুরু করতে হবে।
- যথাযথ কিউরিং পদ্ধতিতে নির্দিষ্ট সময় পর্যন্ত কিউরিং করতে হবে।
ফাটল নিয়ন্ত্রণে ব্যবস্থাসমূহ
ভবনে ফাটল সৃষ্টি হওয়া খুবই সাধারণ ব্যাপার। কংক্রিটের স্থাপনায় ফাটল সৃষ্টি হবে, এটা অনেকটা না দেখেই ভবিষ্যদ্বাণী করা সম্ভব। কিন্তু এই ফাটল যেন স্থাপনার বড় ধরনের ক্ষতির কারণ না হয়ে দাঁড়ায় সেদিকে লক্ষ রাখতে হবে। কিছু উপায় বা ব্যবস্থা নিলে ভবনের ফাটলকে নিয়ন্ত্রণ ও সহনীয় মাত্রায় আনা সম্ভব। নিয়ন্ত্রণব্যবস্থার মধ্যে রয়েছে-
কংক্রিট প্রস্তুতের সময় পানির পরিমাণ নিয়ন্ত্রণ করা উচিত। এর জন্য বড় সাইজের এগ্রিগেট ও অধিক পরিমাণে কোর্স এগ্রিগেট, যা কম সংকোচনশীল তা ব্যবহার করা উচিত।
নির্মাণকাজের সময় যথাযথ শক্তিমাত্রা প্রাপ্তি এবং স্থাপনের সুবিধার্থে সব থেকে কম পরিমাণ পানি ব্যবহার করা উচিত, যা অতিরিক্ত Wet Consistency-কে অনুমোদন করে না।
ক্যালসিয়াম ক্লোরাইডের অ্যাডমিক্সার প্রয়োজনবোধে ব্যবহার করা উচিত।
কংক্রিটের ওপরিভাগ থেকে অনবরত আর্দ্রতা হ্রাস রোধ করা উচিত। এ জন্য কংক্রিটের দৃঢ়তাকালীন পানি স্প্রে করা উচিত। এ ছাড়া প্লাস্টিক সংকোচন রোধের জন্য প্লাস্টিকের সিট ব্যবহার করা উচিত (বিশেষ করে গ্লাসের জন্য গুরুত্বপূর্ণ)।
নির্দিষ্ট এবং প্রয়োজনীয় Interval পরে সংকোচন Joint প্রয়োগ করতে হবে। ওয়ালের পুরুত্বের ৩০ গুণ দৈর্ঘ্য পরপর সংকোচন Joint প্রদান করা একটা ভালো Thumb Rule হিসেবে বিবেচনা করা হয়।
Formwork-এর মধ্যে কংক্রিট স্থাপন এবং প্রাথমিক কিউরিংয়ের সময় অতিরিক্ত তাপমাত্রার পরিবর্তন রোধ করা উচিত।
সঠিকভাবে কংক্রিট স্থাপন ও শক্তিমাত্রা অর্জনের ব্যাপারে যথাযথ ব্যবস্থা নেওয়া উচিত।
তা ছাড়া অতিরিক্ত ঠান্ডা এবং কংক্রিটের সিক্ততা, এগ্রিগেটের ক্ষারতার আক্রমণ, সালফেটের আক্রমণ এবং কংক্রিটের মধ্যে অবস্থিত স্টিলের মরিচা বা ক্ষয়ের কারণে কংক্রিটে ফাটল দেখা দিতে পারে। যদিও এই সব উৎস থেকে সৃষ্ট ফাটলসমূহ প্রাথমিকভাবে নির্মাণের প্রারম্ভিক বছরগুলোতে দৃশ্যমান হয় না। যথাযথ মিক্স ডিজাইন এবং সঠিক ও মানসম্মত কংক্রিটের উপাদানসমূহ ব্যবহারের মাধ্যমে কংক্রিটের ফাটল নিয়ন্ত্রণ সম্ভব।
স্থাপনায় ফাটলের প্রভাব
যেকোনো ধরনের স্থাপনায় স্ট্রাকচারাল বা নন-স্ট্রাকচারাল উভয় ধরনের ফাটলেরই রয়েছে সুদূরপ্রসারী প্রভাব। সাধারণত স্ট্রাকচারাল ফাটলের প্রভাবে স্থাপনার অস্তিত্ব হুমকি মুখে পড়ে। তবে নন-স্ট্রাকচারাল ফাটলের প্রভাবও কিন্তু কোনো অংশে কম নয়। স্ট্রাকচারাল ফাটলের ফলে স্থাপনার কাঠামো দুর্বল হয়ে পড়ে। ফলে এর লোড বহন ক্ষমতা হ্রাস পাওয়ায় স্থাপনার ওপর প্রযুক্ত চাপ বহন করতে পারে না। ফলে স্থাপনার অস্তিত্ব সংকটে পড়ে আয়ুস্কাল কমে অনেকাংশে। ফলে যেকোনো সময় স্থাপনা ধসে বড় ধরনের দুর্ঘটনার আশঙ্কা থাকে। এতে স্থাপনায় অবস্থানকারী কিংবা স্থায়ীভাবে বসবাসকারী বাসিন্দাদের বিপদের আশঙ্কা থাকে। নন-স্ট্রাকচারাল ফাটল স্থাপনার কাঠামোগত কোনো ক্ষতি করে না। ফলে এর দ্বারা ভবনের স্থায়িত্বে কোনো ধরনের সমস্যা হয় না। যদিও দীর্ঘ সময় এই ফাটল স্থায়ী হলে এর দ্বারা কংক্রিটের মধ্যে অবস্থিত স্টিল পানি ও জলীয় বাষ্পের সংস্পর্শে এসে ক্ষয় হয়ে স্থাপনার কাঠামোকে ধীরে ধীরে দুর্বল করে দেয়। তা ছাড়া বাহ্যিকভাবে এ ধরনের ফাটলে অনেকেই এ ধরনের স্থাপনায় বসবাস বা ব্যবহারে অনীহা প্রকাশ করে। কারণ, এ ধরনের ফাটলকে অনেকে স্থাপনাটির স্থায়িত্বের জন্য হুমকিস্বরূপ মনে করায় এটি হয়ে পড়ে অনিরাপদ। এতে কমে স্থাপনার মূল্যমান। এ ছাড়া স্থাপনার প্লাস্টারে অনেক সময় দেখা দেয় হেয়ার ক্র্যাক। এর ফলে স্থাপনাটির সৌন্দর্য কমে অনেকাংশে। যদিও পুনরায় প্লাস্টার করে এ সমস্যা অনেকটাই নিরসন করা সম্ভব।
ফাটল সংস্কার যে উদ্দেশ্যে
স্থাপনায় ফাটল সৃষ্টি হলে যে উদ্দেশ্যগুলোকে সামনে রেখে ফাটলের সংস্কার জরুরি। তা হলো-
- ভবনের জন্য গুরুত্বপূর্ণ স্ট্রাকচারাল মেমবারগুলোকে সংস্কার করে পুরোনো আকার-আকৃতি ও শক্তিমাত্রা প্রদান।
- পানির ট্যাঙ্কিগুলোর Sloping করা এবং Seal করে দেওয়া, যাতে করে পানিসহ স্থাপনাটির জন্য ক্ষতিকর অন্যান্য পদার্থ যেন সহজেই অভ্যন্তরে প্রবেশ করতে না পারে।
- স্থাপনায় ফাটলের ফলে ভবনের সৌন্দর্য নষ্ট হয়। তাই স্থাপনার প্রারম্ভিক সৌন্দর্য ফিরিয়ে আনতে সংস্কারকাজ করা হয়।
- এই উদ্দেশ্যগুলো বিবেচনায় রেখে মেরামত বা সংস্কারকাজকে তিন ভাগে ভাগ করা যায়-
- অখণ্ডতা বা পূর্ণতা প্রদান (Integrity Repair), স্থাপনার কাঠামোসমূহকে আগের আকৃতি ও শক্তি প্রদান করে।
- ফাটলের Sealing করা।
- সৌন্দর্যবর্ধনে মেরামত সাধন।
ভবনের ফাটল সংস্কার
কংক্রিটের স্থাপনায় যেকোনো ধরনের ফাটল দেখা দেওয়ার পরে কোনোভাবেই অবহেলা করা উচিত নয়। ফাটলের আকার-আকৃতি বিবেচনায় যথাযথ ও উপযুক্ত সংস্কারপ্রক্রিয়া অনুসরণ করা উচিত। ফাটল দেখা দেওয়ার পরে তার সংস্কারপদ্ধতি নির্ভর করে কংক্রিটে সৃষ্ট ফাটলের অবস্থানের ওপর। সংস্কারকাজকে ভাগ করা হয় কংক্রিটে সৃষ্ট ফাটল কত বড় আকৃতির তার ওপর নির্ভর করে। সহজ ও নির্দিষ্ট কিছু পদক্ষেপ গ্রহণ করে কংক্রিটের ফাটল ও এর Corner-সমূহ যথাযথভাবে সংস্কার করা সম্ভব। কংক্রিটের এ ফাটল সাধারণত শুকানোর ফলে সংকুচিত হয়ে কিংবা তাপ চলাচলের ফলে হয়। এ ছাড়া অন্য যেসব কারণে কংক্রিটে ফাটল সৃষ্টি হয় তা খুবই কম বিবেচ্য। কেননা এগুলো তেমন বড় ধরনের সমস্যার কারণ হয় না। সাধারণত ভিত্তি বা ফাউন্ডেশনে সৃষ্ট ফাটল সময়ের সঙ্গে সঙ্গে চওড়া হয়। যার ফলে ভবনে Seepage-এর মাধ্যমে পানি প্রবেশ করায় ভবনের অস্তিত্ব হুমকির মুখে পড়ে।
চওড়া ফাটল সংস্কার
কংক্রিটে সৃষ্ট চওড়া ফাটল সংস্কারের জন্য প্রয়োজন যথাযথ পদ্ধতি ও দক্ষতার। সংস্কারকাজের জন্য প্রথমে ছোট হাতুড়ি ও বাটালি (Chisel) দিয়ে কংক্রিটের Undercut বা কিছু অংশ ভেঙে নেওয়া হয়। সংস্কারের প্রথম ধাপই হলো কংক্রিটের ফাটলকে আরও একটু চওড়া করে নেওয়া। এতে করে ফাটলের Surface-এ একটু Keyed যুক্ত হয় এবং মেরামতের জন্য প্রয়োগকৃত কংক্রিট যথাযথভাবে নির্দিষ্ট স্থানে প্রয়োগ করা যায়। এর ফলে মেরামতকাজটি অনেক বেশি মজবুত হয়। এখন কংক্রিটের যে Wide Base সৃষ্টি হয়, তার উপরিভাগে তারের ব্রাশ দিয়ে খুব ভালো করে পরিষ্কার করা হয়। যাতে করে Damp ও ফাঁপা ও ছোট উপাদানগুলো এর উপরিভাগ থেকে যুক্ত হয়। এসব উপাদানের উপস্থিতি মেরামতের জন্য প্রয়োগকৃত কংক্রিটের সঙ্গে ফাটলে সৃষ্ট কংক্রিটের দৃঢ় বন্ধন সৃষ্টিতে অন্তরায়।

পরবর্তী ধাপে মেরামতের জন্য কংক্রিটের বিভিন্ন উপাদানের মিশ্রণ ঘটিয়ে কংক্রিট প্রস্তুত করা হয়। অবশ্যই মনে রাখতে হবে যে প্রতিটি উপাদানের জন্য এর প্রস্তুতকারক দ্বারা নির্দিষ্ট কিছু Instruction থাকে; সেগুলো মেনে চলা উচিত। যখনই কংক্রিটের মিক্স প্রস্তুত হয়ে যায়, তখন এই কংক্রিট ফাটলের সব স্থানে ছড়িয়ে ভালোভাবে স্থাপন করা হয় এবং কংক্রিট স্থাপনের পরপর Tamping শুরু করতে হয়, যাতে করে কংক্রিটের মধ্যে কোনো Air Pocket বা ফাঁকা জায়গা না থাকে। এতে করে মেরামতকৃত অংশটুকুতে কংক্রিটের যথাযথ শক্তিমাত্রা বজায় থাকে।
এরপর মেরামতকৃত কংক্রিটের Finishing করতে হয়। কংক্রিট ফাটলের মধ্যে স্থাপনের পরে সেট হওয়ার জন্য যথেষ্ট সময় দিতে হয়। কংক্রিট ভালোভাবে সেট হলে Existing Surface-এর সঙ্গে এটাকে মিলিয়ে Finishing করা হয়।
কংক্রিটের উপরিভাগকে Seal করে দেওয়া একটা ভালো ধারণা। কংক্রিট খুব সহজেই রংকে শোষণ করে তবে Sealing করে দিলে এটা প্রতিরোধ করা সম্ভব। কংক্রিটের Sealing কাজের জন্য বাজারের একাধিক Product আছে তবে অধিক কর্মক্ষম পানি প্রতিরোধী পলিরেথিন (Polyurethane) এ ক্ষেত্রে দারুণ কার্যকর।
কংক্রিটের সরু ফাটল মেরামত
কংক্রিটের সরু (Narrow) ফাটলের মেরামত কাজ চওড়া ফাটলের মেরামতের তুলনায় অনেক সহজ। যদি কি না নির্দিষ্ট ও নির্দেশিত Product মেরামতকাজের জন্য ব্যবহার করা যায়।
প্রথমেই কংক্রিটের ফাটল থেকে কোনো ধরনের আলগা Debris থাকলে তা পরিষ্কার করতে হয়। ঝাঁটা ও তারের ব্রাশ দিয়ে কংক্রিটের উপরিভাগ থেকে ময়লা ও রং পরিষ্কার করে নিতে হয়। পরবর্তী সময়ে ফাটলযুক্ত স্থানটি ভালোভাবে পানি দিয়ে ধুয়ে নিতে হয়।
কংক্রিটের সরু ফাটলসমূহকে খুব সহজেই Crack Elastomeric Filler দ্বারা মেরামত সম্ভব। ছোট ধরনের কংক্রিটের ফাটল ও প্লাস্টারের হেয়ার ক্র্যাক খুব সহজেই Viny। এতে কংক্রিট ব্যবহার করে মেরামত করা সম্ভব। পরবর্তী সময়ে এর ওপরে Finishing করা হয়।
যদি এ ধরনের মেরামতকাজের জন্য শুধু ঠরহু কংক্রিট ব্যবহার করায় কংক্রিটের উপরিতলে বন্ধন সৃষ্টিতে অন্য কোনো পদার্থ ব্যবহার করার প্রয়োজন হয় না।
বর্তমানে আর্কিটেকচারাল কংক্রিটের জনপ্রিয়তা বেড়ে যাওয়ায় ফাটলের কসমেটিক সংস্কার বেড়েছে। যদিও অনেক ক্ষেত্রে কসমেটিক মেরামতের কাজে ফাটলের Sealing প্রয়োজন। পদ্ধতি যা-ই হোক না কেন মেরামত কাজের মূল উদ্দেশ্য সিদ্ধ হলেই এটা পায় ব্যাপক গ্রহণযোগ্যতা। স্থাপনায় ফাটল সৃষ্টি হলে প্রভাব পড়ে এর দাম ও বিমায়। তা ছাড়া স্ট্রাকচারাল ফাটলের কারণে স্থাপনার স্থায়িত্ব ঝুঁকিতে পড়ায় সর্বসাধারণের ব্যবহারের জন্য স্থাপনাটি নিরাপদ নয়। অন্যদিকে নন-স্ট্রাকচারাল ফাটলসমূহে স্থাপনা ধসের আশঙ্কা কমায় এটি পায় সবার গ্রহণযোগ্যতা। তাই স্থাপনায় যেকোনো ধরনের ফাটল দেখামাত্রই যথোপযুক্ত সংস্কারপদ্ধতি গ্রহণের মাধ্যমে সব ধরনের ফাটল মেরামতের জন্য উপযুক্ত ও কার্যকর পদক্ষেপ নেওয়া দরকার, যা স্থাপনাটিকে তার আগের কার্যক্ষমতা ও সৌন্দর্য ফিরিয়ে দিতে সক্ষম শতভাগ।
প্রকৌশলী সনজিত সাহা
প্রকাশকাল: বন্ধন ৪৬ তম সংখ্যা, ফেবু্রুয়ারি ২০১৪