পৃথিবীতে অবাক হওয়ার মতো অনেক কিছুই রয়েছে। অবাক করা সব অনুষঙ্গ সম্পর্কে যতই বৈজ্ঞানিক ব্যাখ্যা থাক কিংবা না থাক, মানুষের কাছে চিরকালই তা আগ্রহের ব্যাপার। যুগ যুগ ধরে গড়ে ওঠা বিশ্ব স্থাপনার অপূর্ব সব কারুকাজ ও গঠনশৈলী মানুষের মনে জন্ম দেয় প্রশ্নের; জাগায় বিস্ময়। ঠিক এমনই এক আশ্চর্য ও দৃষ্টিনন্দন স্থাপনা ইতালির রোমে স্থাপিত পিসার হেলানো টাওয়ার। দিনের পর দিন এ টাওয়ারকে ঘিরে মানুষের কৌত‚হল কমছে না বরং বাড়ছে। দিন যতই যাচ্ছে টাওয়ারটা হেলছে ততই। এই হেলানো বন্ধে নেওয়া হয়েছে নানা উদ্যোগ কিন্তু কিছুতেই হেলানো রোধ করা যাচ্ছে না। বিশ্বে এমন স্থাপনা আর দ্বিতীয়টি নেই। আর তাই ১৯৮৭ সালে ইউনেসকোর বিশ্ব ঐতিহ্যে স্থান করে নিয়েছে পিসার হেলানো টাওয়ার ও তার পার্শ্ববর্তী ক্যাথেড্রাল, বেপ্টিসটেরি ও সিমেট্রিক।
ভূমধ্যসাগর তীরের দেশ ইতালি। সমগ্র দেশেই রয়েছে চমৎকার ও দারুণ সব শিল্প নিদর্শন ও ভুবনবিখ্যাত স্থাপত্যকর্ম। রোম, ভেনিস, মিলান কোথায় নেই এসবের নিদর্শন! কিন্তু সবকিছুকে ছাপিয়ে আকর্ষণীয় এক স্থাপত্যে পিসার হেলানো টাওয়ার। ইতালির পিসা প্রদেশের একটি প্রসিদ্ধ স্থাপনা এটি। লিনিং টাওয়ার নামেই বেশি পরিচিত হলেও প্রকৃতপক্ষে এটি একটি বেল টাওয়ার। রোমান স্থাপত্যশৈলীর আদলেই এই টাওয়ারটি নির্মিত। বিখ্যাত বিজ্ঞানী গ্যালিলিও গ্যালিলি তাঁর মধ্যাকর্ষণের পরীক্ষা এই টাওয়ারের চূড়া থেকেই করেছিলেন। তিনি একটি গিনি ও পাখির পালক ফেলে দেখিয়েছিলেন পতনশীল বস্তুর ধর্ম। কারণ, তখন এই টাওয়ারই ছিল বিশ্বের অন্যতম উঁচু স্থাপনা। মূলত ঘণ্টা বাজানোর উদ্দেশ্যে অর্থাৎ ঘণ্টাধ্বনি যেন বহুদূর থেকে শোনা যায় এ জন্যই এ টাওয়ারটি নির্মাণ করা হয়েছিল। ১১৭৩ খ্রিষ্টাব্দে এ ঐতিহ্যবাহী টাওয়ারটির নির্মাণকাজ শুরু হয়। অভিজ্ঞ স্থাপত্যকর্মী ও অনেক নির্মাণশ্রমিকের অক্লান্ত পরিশ্রমে গড়ে উঠেছে টাওয়ারটি। কিন্তু নির্মাণকাজ শেষ হওয়ার কিছুদিন পর থেকেই টাওয়ারটি ক্রমেই একদিকে হেলতে থাকে। তবে ১১৭৮ সালে এর তৃতীয় তলার কাজ সম্পন্ন হওয়ার পরই হেলে যাওয়ার ব্যাপারটি নিশ্চিত হওয়া যায়। অথচ প্ল্যান ছিল আটতলা মিনারের। কারণ, হিসেবে চিহ্নিত করা হয় নরম মাটিতে মাত্র তিন মিটার গভীরে ভিত স্থাপনের। অনেকে আবার এ জন্য টাওয়ারের নকশাকেও দায়ী করেন। তবে ডেলটা নদীর বালুময় এলাকার মাটির স্থিরতাকেও দায়ী করা হয়। টাওয়ার হেলে পড়ার কারণ খুঁজতে দিশেহারা নির্মাণকাজের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা কাজ বন্ধ করে দেন। কীভাবে মিনারটিকে সোজা করা যায় সে ব্যাপারে চলতে থাকে ব্যাপক পরিকল্পনা আর অনুসন্ধান। কিন্তু কোনো সমাধান মিলছিল না। মজার ব্যাপার হলো, এই টাওয়ারটি নির্মাণ করতে সময় লেগেছে শতাধিক বছর। কখনো অর্থাভাব, কখনো যুদ্ধবিগ্রহ এর কাজে বাধা হয়ে দাঁড়িয়েছে। প্রায়ই পিসার অধিবাসীরা জেনোয়া, লুক্কা এবং ফ্লোরেন্সের সঙ্গে যুদ্ধকর্মে লিপ্ত থাকত। ১০০ বছর পর মিনার সংরক্ষণ কমিটি জিওভ্যানি-ডি-সিমোনি নামে এক জাঁদরেল স্থপতির হাতে এর পুনর্নির্মাণের দায়িত্ব দেয়। সিমোনি মূল প্ল্যানের সামান্য রদবদল করে আরও চারটি তলা নির্মাণ করেন। কিন্তু মিনারের হেলে পড়ার প্রবণতা তিনিও রোধ করতে পারেননি। অষ্টম তলার কাজ শেষ করেন টোম্যাসো, ১৭৭ বছর পর ১৩৫০ সালে। আশা করা গিয়েছিল, বিশেষ কারিগরি কৌশল অবলম্বন করে শেষ পর্যায়ের কাজে টোম্যাসো মিনারের বিপজ্জনক অবস্থার একটি বিপরীত গতি এনে দিতে পারবেন। বাস্তবে কিন্তু তা হয়নি। হেলে পড়া মোকাবিলায় উত্তর দিকে ওজন বাড়ানো হয়। নির্মাণ শুরুর প্রায় ২০০ বছর পর এর কাজ শেষ হয় ১৩৭২ সালে। এ সময় শেষ তলা এবং বেল চেম্বারের কাজও শেষ হয়। তখন সাধারণ মানুষ ২৯৬ ধাপ পার হয়ে বেল চেম্বার পর্যন্ত উঠতে পারত।

বিখ্যাত এই টাওয়ারটির মোট উচ্চতা ১৮৩.২৭ ফুট বা ৫৫.৮৬ মিটার (মাটি থেকে ১৮৬.০২ ফুট বা ৫৬.৭০ মিটার)। আট তলাবিশিষ্ট এর ওজন ১৪,৫০০ মেট্রিক টন। বর্তমানে এটি প্রায় ৩.৯৯ ডিগ্রি কোণে হেলে রয়েছে। সর্বশেষ মাপ অনুযায়ী তা প্রায় ১৪ ফুট হেলানো, যা সপ্তম তলা থেকে মাপলে ১০% অবনমন। এর ঠিক পেছনেই বিখ্যাত ক্যাথিড্রাল এবং তারও পেছনের ব্যাপিস্ট্রি। পাশেই রয়েছে কবরস্থান। এগুলো অবশ্য তৈরি হয়েছিল বেল টাওয়ারের অনেক আগেই। সে হিসাবে এটা পিসার সবচেয়ে পুরোনো স্থাপনা নয়। ব্যাপিস্ট্রির পেছনে পিসার পুরোনো প্রতিরক্ষা দেয়ালও রয়েছে। দক্ষিণে সবুজ ঘাসের মাঠ ও পূর্ব-পশ্চিমে লম্বা রাস্তা। এই রাস্তার পাশে সারি সারি গিফট শপ। সব মিলিয়ে বিশাল এক প্রান্তর বলা যায়। টাওয়ারটির দরজাগুলো সুবিশাল। সবগুলোই মোটামুটি ধাতব তৈরি। ধাতব দরজাগুলোতেও রয়েছে দারুণ সব কারুকাজ। টাওয়ার তৈরিতে ব্যবহৃত হয়েছে সাদা মার্বেল পাথর। এই টাওয়ারে রয়েছে দেয়ালঘেঁষা পেঁচানো সিঁড়ি। টাওয়ারের চ‚ড়া পর্যন্ত সিঁড়ির রয়েছে মোট ২৯৪টি ধাপ। তবে এই সিঁড়ি বেয়ে উঠতে ব্যয় করতে হবে তিন হাজার লিরা। ওপরে ওঠার পথটিও বেশ ক্ষীণকায়, তাই ওঠাও বেশ কষ্টকর। মিনারের প্রতিটি তলায় রয়েছে ধনুকাকৃতি ঢেউ-খেলানো নকশা ও বারান্দা। অষ্টম তলায় রয়েছে ক্যাম্পানিলি (ঈধসঢ়ধহরষব) বা ঘণ্টাঘর। একসময় এই টাওয়ারে ছিল নানা সুরধারার সাতটি বিশাল ঘণ্টা। গত শতাব্দীর শুরুর দিকেও প্রতিদিন শহর কম্পিত করে বেজে উঠত সব কটি ঘণ্টা। তখন ইতালির আকাশে-বাতাসে ছড়িয়ে যেত সেই সুরধ্বনি। কিন্তু ১৯০৭ সালে মিনার সংরক্ষণ কমিটির স্থপতিদের এক তদন্ত কমিশন রিপোর্টে জানা যায়, ভারী ঘণ্টাগুলোর দোলন এবং একসঙ্গে বেজে ওঠার ফলে যে কম্পন তরঙ্গের সৃষ্টি হয়, তা টাওয়ারের ক্রমাগত হেলে পড়ার অন্যতম কারণ। তাই ঘণ্টাগুলোর নড়ন-চড়ন সেই থেকে বন্ধ করে দেওয়া হয়। এই টাওয়ারের সৌন্দর্য এমনই যে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় মিত্রবাহিনী জার্মান সেনাদের টাওয়ারের অভ্যন্তরে দেখতে পায়, যা তারা পর্যবেক্ষণ কেন্দ্র হিসেবে ব্যবহার করত। মার্কিন সেনাবাহিনীর একজন সার্জেন্ট জার্মান বাহিনীর অবস্থান নিশ্চিত করতে টাওয়ারে যান। তিনি টাওয়ারের শৈল্পিক দক্ষতায় অভিভূত হন এবং ক্যাথেড্রালের সৌন্দর্য উপভোগ শেষে সেনাবাহিনীকে টাওয়ার আক্রমণ না করতে নির্দেশ দেন। এভাবেই টাওয়ারটি নিশ্চিত ধ্বংসের হাত থেকে রক্ষা পায়।
পিসার এ টাওয়ারের প্রকৃত স্থপতি কে ছিলেন তা নিয়ে যথেষ্ট বিতর্ক রয়েছে। দীর্ঘ দিন ধরে ধারণা করা হতো গাগলিমো এবং বোনানো পিসানোই এর ডিজাইনার। বোনানো পিসানো ছিলেন দ্বাদশ শতকের সুপ্রসিদ্ধ পিসা নগরের অধিবাসী ও শিল্পী। তিনি ব্রোঞ্জ দিয়ে গড়া পিসা দুমোর জন্যও স্মরণীয় হয়ে আছেন। ১৮২০ সালে টাওয়ারের পাদদেশে তাঁর নামাঙ্কিত এক টুকরো চিহ্ন খুঁজে পাওয়া যায়। কিন্তু এটি ১৫৯৫ সালে ধ্বংস হয়ে যাওয়া ক্যাথেড্রেলের ব্রোঞ্জের দরজার সঙ্গে সম্পর্কিত ছিল। এ ছাড়া সাম্প্রতিককালের গবেষণায় দেখা গেছে যে দিওতিসালভি নামীয় ব্যক্তি টাওয়ারের প্রকৃত স্থপতি। নির্মাণকাজের সময়কাল, দিওতিসালভির কাজকর্ম, স্যান নিকোলা টাওয়ারের ঘণ্টা ইত্যাদিতে এর প্রতিফলন ঘটেছে। সচরাচর তিনি তাঁর কাজকর্মগুলোয় স্বাক্ষর করতেন কিন্তু টাওয়ারের ঘণ্টায় কোনো স্বাক্ষর করেননি।

অক্লান্ত পরিশ্রম ও অর্থ ব্যয়ে তৈরি এ টাওয়ারটি হেলে যাওয়ায় দুশ্চিন্তায় পড়ে যান এর নির্মাতারা। কারণ, যদি এই টাওয়ারটি ভেঙে পড়ে তাহলে স্থাপত্যের স্বর্গ ইতালির জন্য তা হবে অত্যন্ত লজ্জার। বর্তমানে এ অবকাঠামোটিকে রক্ষাকল্পে উল্লেখযোগ্য পদক্ষেপ গ্রহণ করায় এর হেলানো রোধ ও ভূপাতিত হওয়া থেকে রক্ষা করা সম্ভব হয়েছে। এই টাওয়ারকে সোজা করতে অনেক চেষ্টাই করা হয়েছে। এর মাঝে একটা বিখ্যাত প্রচেষ্টা ছিল ইতালির সমরনায়ক মুসোলিনির, কিন্তু তার চেষ্টার কারণে এটা আরও বেশি হেলে পড়ে। ২১ বছর ধরে এর চতুর্দিকে অস্থায়ীভাবে মাচা তৈরি করা হয়েছিল। ২০১১ সালে এর সর্বশেষ মাচাটি অপসারণ করা হয়। এর ফলে টাওয়ারটিকে পুনরায় সঠিকভাবে দেখা যায়। আর তাই সঙ্গে সঙ্গে বিশেষজ্ঞদের ডাকা হয় এর সম্পর্কে নিশ্চিত সিদ্ধান্ত গ্রহণ ও ভবিষ্যৎ সম্পর্কে বিচার-বিশ্লেষণ করার জন্য। মাপজোক ও পরীক্ষা-নিরীক্ষা করে দেখা গেল যে টাওয়ারটি খাড়াভাবে অবস্থান না করে লম্ব রেখা থেকে প্রায় পাঁচ মিটার সরে গেছে। পরিস্থিতি এমন পর্যায়ে পৌঁছেছে যে বছরে ১.২৫ সে.মি. করে হেলতে হেলতে যেকোনো সময় বিপজ্জনক পরিস্থিতির উদ্ভব হতে পারে।
টাওয়ারটি কেন হেলে চলেছে তা জানার জন্য বিশ্বের স্বনামধন্য সব স্থপতিকে ডাকা হয়। শুরু হয় আবার নতুন করে মাপজোক ও খোঁড়াখুঁড়ির কাজ। দীর্ঘদিন পরীক্ষা-নিরীক্ষার পর তাঁরা জানান, পিসার টাওয়ারটির প্রায় ৫০ মিটার তলায় রয়েছে পানির স্তর আর এর চাপেই টাওয়ারটি হেলে পড়ছে। তাঁরা পরামর্শ দেন বৈদ্যুতিক পাম্পের সাহায্যে ভূগর্ভস্থ পানির স্তরের সমতা রক্ষা করে হেলে পড়ার প্রবণতা বন্ধ করা যেতে পারে। টাওয়ারটি তৈরির পর থেকে এখন পর্যন্ত বিজ্ঞানী ও গবেষকেরা এটিকে টিকিয়ে রাখার জন্য অব্যাহত রেখেছেন নানা গবেষণা ও কর্মতৎপরতা। ১৯৮২ সালে পিসার টাওয়ারটির ভবিষ্যৎ সম্পর্কে নতুন করে গবেষণা শুরু হয়। তবে ৮০০ বছরের অধিক কেন মিনারটি ভেঙে পড়ল না তারও কারণ বিশ্লেষণ করে ভূ-বিজ্ঞানীরা বলছেন, যখন কোনো বস্তুর ভারকেন্দ্র দিয়ে অঙ্কিত উলম্বরেখা বস্তুর তলদেশ দিয়ে গমন করে, তখন তা সুস্থিত অবস্থায় থাকে। বস্তুর ভারকেন্দ্র এমন এক বিন্দু, যেখানে বস্তুর সমগ্র পদার্থ কেন্দ্রীভূত আছে বলে ধরা হয়। মিনারের ভারকেন্দ্র থেকে অঙ্কিত উলম্বরেখাটি আজও তার তলদেশ দিয়ে গমন করছে বলেই মিনার ধরাশায়ী হয়নি। কিন্তু অনন্তকাল ধরে সে যে দাঁড়িয়ে থাকবে না এই সতর্কবাণীটিও তাঁরা দিয়েছেন।
নির্মাণের সময় থেকে বছরে ১.২৫ সেন্টিমিটার করে হেলতে হেলতে মিনারটি এমন এক বিপজ্জনক অবস্থায় এসে পড়েছে যে মনে হতো যেকোনো মুহূর্তে হুড়মুড়িয়ে ভেঙে পড়বে। কিন্তু ১৮৪৬ সালের প্রবল ভূমিকম্পে যেমন ভূমিসাৎ হয়নি, তেমনই ১৯৪৪ সালে অর্নোতে লড়াইয়ের সময় কামানের গোলায় তিনতলার তিনটি স্তম্ভ উড়ে গেলেও মিনার ভেঙে পড়েনি। অদ্ভুত হেলে পড়ার সৌন্দর্য ও খ্যাতি নিয়ে আট শতাধিক বছর ধরে দিব্যি দাঁড়িয়ে আছে। মিনারের এই চ্যুতি-বিচ্যুতি নিয়ে বিশ্বের কল্পনা-বিলাসী কৌতূহলী মানুষের কোনো দিনই মাথাব্যথা ছিল না। বরং পতনোন্মুখ মিনারটি সম্পর্কে তাঁরা অবলীলায় ভাবতে ভালোবাসেন, দর্শকদের তাক লাগিয়ে দিতেই কঠিন জ্যামিতিক আঁক কষে এটি গড়া হয়েছে। কিন্তু নির্মম সত্য হলো, ত্র“টিপূর্ণ নির্মাণ প্রকল্প এবং দুর্বল মাটির জন্যই মিনারটি হেলে পড়েছিল। পরন্তু ১৪,৫০০ টনের বিশাল মিনারের জন্য ভিত খোঁড়া হয়েছিল মাত্র তিন মিটার। তা ছাড়া টাওয়ারের ৫০ মিটার নিচে যে জলস্তর রয়েছে, তার চাপের ওপর নির্ভর করে এর হেলে পড়ার পরিমাণ। ভূগর্ভস্থ জলের চাপ কমে এলে হেলে পড়ার পরিমাণও বেড়ে যায়। এর প্রমাণও পাওয়া গেল ১৯৯১ সালে ইতালিতে অতি বর্ষণের সময় মিনারের চ্যুতি এবং গতি-প্রকৃতি নিয়ে স্থপতিরা যখন উদ্বেগের চরম সীমায়, একদিন হঠাৎ সবাইকে চমকে দিয়ে মিনারটি নিজেই গা-ঝাড়া দিয়ে তিন মিলিমিটার সোজা হয়ে দাঁড়াল। এই বিপরীত গতি দেখে স্থপতিরা প্রথমে ঘাবড়ে গেলেও ভূতাত্তি¡ক বিশেষজ্ঞরা বললেন, সপ্তদশ শতাব্দীতেও অতি বৃষ্টিপাতের দরুন ভূপৃষ্ঠের নিচে জলতল উঠে আসায় এমনটি ঘটেছিল।
এসব বৈজ্ঞানিক ব্যাখ্যা ছাড়া টাওয়ার হেলে পড়া নিয়ে চালু আছে কিছু কিংবদন্তিও। মিনারের পাশে যে গির্জাটি আছে, তাতে ছিলেন এক দুষ্টু প্রকৃতির পাদ্রি। সূর্যকে আড়াল করে কেন একটি টাওয়ার গির্জার সামনে দাঁড়িয়ে থাকবে! পাদ্রি একদিন সেদিকে বাকরুদ্ধ দৃষ্টিতে তাকিয়ে বললেন, ‘এই শয়তানটার জন্য গির্জায় রোদ পড়ছে না।’ আর সঙ্গে সঙ্গে নাকি টাওয়ারটি হেলে পড়েছিল। দ্বিতীয় মিথটি হলো, ১৮৪৬ সালের ভূকম্পের সময় পিসার বহু অধিবাসী সবিস্ময়ে দেখেছিলেন, মিনারটি হঠাৎ ধনুকের মতো বেঁকে ভূমিস্পর্শ করে ফের উঠে দাঁড়ায়, কিন্তু খানিকটা ঝুঁকে। ‘লিনিং টাওয়ার’ নিয়ে প্রচলিত আছে নানা রোমান্স বা গল্প-কাহিনি। শোনা যায়, বারতা নামে এক উৎসাহী শিল্পরসিক মহিলা এ কাজের জন্য ৬০টি স্বর্ণমুদ্রা দান করেছিলেন। সেই অর্থে কেনা হয় মিনার তৈরির প্রথম পাথর ও অন্যান্য উপাদান।

প্রবল মস্তিষ্কচর্চা, কম্পিউটার আর আধুনিক অন্তর্দৃষ্টি কাজে লাগিয়ে তাঁরা মিনারের ত্রুটি শুধরে তাকে সোজা করার এক দীর্ঘ কর্মসূচি গ্রহণ করলেন। বিপরীত ভারসাম্য বজায় রাখতে প্রতিরোধমূলক ব্যবস্থা হিসেবে মিনারের পাদদেশে প্রথমে ৬০০ টন ওজনের ধাতুপিণ্ড স্থাপন করা হয়। হেলে পড়ার গতি কমাতে উঁচিয়ে ওঠা উত্তর দিকের অংশে চাপানো হলো তাল তাল ভারী সিসার চাঙড়। শক্ত লোহার বেড় দিয়ে মজবুত করা হলো মিনারের দ্বিতল। তৃতীয় তলে ইস্পাতের মোটা তারের বাঁধনে টানা দিয়ে রাখা হলো। তারপর নিয়ন্ত্রিত উপায়ে ড্রিল করে উত্তর ভাগের নিচে থেকে সরিয়ে দেওয়া হলো মাটি। ভূগর্ভস্থ জলস্তরের চাপের সমতা রক্ষার জন্য বৈদ্যুতিক পাম্পের সাহায্যও নেওয়া হয়। এভাবে মেরামতির পর ভূমিতল থেকে ৪০ সেন্টিমিটারের মতো মিনারের তলিয়ে যাওয়া অংশ উদ্ধার করা গেছে। সামান্য ঝোঁক রেখে দেওয়া হয়েছে পর্যটকদের মুখ চেয়ে। কেননা, এই হেলানো গঠন-বৈচিত্র্যের জন্যই লিনিং টাওয়ারের ভুবনজোড়া খ্যাতি, এত কদর।
প্রতিবছর দেশ-বিদেশের অনেক পর্যটক টাওয়ারটি দেখতে আসেন। এর পাশাপাশি আকর্ষণ করে ক্যাথিড্রাল, যা এখন জাদুঘর। পর্যটকেরা সবাই যে কাজটি করে থাকে তা হলো হেলানো টাওয়ারের সামনে এমনভাবে পোজ দেওয়া, যাতে ছবি তুললে মনে হয় সে প্রচণ্ড শক্তি দিয়ে টাওয়ারের পড়ে যাওয়া রোধ করছে। রাতে সাদা মার্বেলে তৈরি বেল টাওয়ার আর ক্যাথিড্রাল চাঁদের আলোয় মায়াবী রূপ ধারণ করে। সৌন্দর্যপিপাসু মানুষেরাও যেন নিমজ্জিত হয় সে সৌন্দর্যে। ঘাসের ওপর চুপচাপ বসে দর্শনার্থীরা উপভোগ করেন প্রকৃতি ও স্থাপত্যের সখ্যের চিত্র। ক্যাথিড্রাল স্কয়ারের বিস্তৃত ঘাসের আঙিনায় তার চূড়া থেকে সমগ্র শহরের অনুপম দৃশ্য আর বঙ্কিমরেখায় প্রবাহিত ছোট্ট অর্নো নদী পর্যটকদের মুগ্ধ করে।
২০২০ সাল নাগাদ ভূ-পতিত হতে পারে কালজয়ী এই স্থাপনাটি এমনটিই ধারণা অনেক বিশেষজ্ঞের। তবে প্রখ্যাত স্থপতি মাইকেল জামিওল কাওস্কি জানিয়েছেন, বিগত শেষ ১১ বছরের সংস্কারের পর ঐতিহ্যবাহী পিসার এই মিনার প্রায় ৩০০ বছরের জন্য নিশ্চিন্ত ও নিরাপদ। এখন দেখার অপেক্ষায় কতকাল টিকে থাকতে পারে বাঁকা সৌন্দর্যের পড়ন্ত এই টাওয়ার!
মারুফ আহমেদ
প্রকাশকাল: বন্ধন ৩৭ তম সংখ্যা, মে ২০১৩