নির্মাণশিল্পে নিরাপত্তা, স্বাস্থ্য ও পরিবেশ (পর্ব-২)

একটি নির্মাণ প্রকল্পের কাজের গুণগত মান রক্ষা করা এবং সময়মতো সব কাজ সুসম্পন্ন করার লক্ষ্যে সুস্থ, নিরাপদ ও পরিবেশবান্ধব একটি কর্মক্ষেত্র সৃষ্টি করার কোনো বিকল্প নেই। তাই প্রতিটি প্রকল্পের সার্বিক নিরাপত্তা নিশ্চিত করা, স্বাস্থ্যঝুঁকি এড়িয়ে চলা এবং পারিপাশ্বিক পরিবেশ রক্ষা করার মধ্য দিয়ে নির্ধারিত সময় ও বরাদ্দকৃত অর্থের মধ্যে সব কাজ সুষ্ঠুভাবে সম্পাদন করা জরুরি একটি বিষয়। এ উদ্দেশ্যে আগের আলোচিত প্রতিটি বিষয় পুঙ্খানুপুঙ্খভাবে দেখা ও বাস্তবায়নে প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ গ্রহণ করা অপরিহার্য।

অন্ন, বস্ত্র, বাসস্থান, শিক্ষা ও চিকিৎসা মানুষের মৌলিক চাহিদা। সেই সঙ্গে বিনোদন ও অর্থনৈতিক সমৃদ্ধিও প্রয়োজন। ফলে প্রতিটি মানুষই তার মানসিক ও শারীরিক চাহিদা পূরণ করতে কাজের মাধ্যমে সার্বিক সমৃদ্ধি লাভ করার চেষ্টা করে। এ ক্ষেত্রে, মানুষের মানসিক ও শারীরিক সুস্থতার বিষয়টি খুবই গুরুত্বপূর্ণ এবং সেটা প্রতিটি শ্রেণির মানুষের জন্যই প্রযোজ্য। কারণ, যেকোনো ধরনের অসুস্থতা মানুষকে কর্মবিমুখ ও কর্মে নিস্পৃহ করে তোলে।

ফলে মানুষের সম্পাদিত কাজের পরিমাণ ও গুণগত মান লোপ পায় এবং প্রকল্পের কাজ সম্পন্ন করতে অতিরিক্ত সময় ক্ষেপণ এবং ব্যয় বৃদ্ধির কারণ হয়ে দাঁড়ায়। সুতরাং একটি প্রকল্প নির্দিষ্ট সময় ও বরাদ্দকৃত অর্থের মধ্যে কাজ শেষ করার লক্ষ্যে কর্মরত প্রতিটি মানুষের সার্বিক সাচ্ছন্দ্য এবং কর্মতৎপরতা ঠিক রাখতে প্রয়োজনীয় সব ব্যবস্থা গ্রহণ করা জরুরি। তাই প্রকল্পের সব কাজ সার্বিকভাবে ও সুষ্ঠুভাবে পরিচালনা করার জন্য প্রয়োজন পদক্ষেপ নেওয়া জরুরি। যেমন-

সড়কে চলমান নির্মাণকাজ
  • প্রতিদিন সকালে প্রকল্পের সবার সমন্বয়ে অনুষ্ঠিত একটি অনুশীলনের মাধ্যমে কাজ শুরু করা
  • কর্মরত অবস্থায় স্বাস্থ্যঝুঁকি এড়িয়ে নিরাপদে কাজ করার জন্য প্রয়োজনীয় পিপিই ব্যবহারে বাধ্য করা
  • অতিরিক্ত সময় কাজ করার জন্য চাপাচাপি করে মানসিক ও শারীরিক চাপের মধ্যে না ফেলা
  • স্বাস্থ্যসম্মত খাবার, বাসস্থান এবং পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন থাকার বিষয়গুলো নিশ্চিত করা
  • সময়মতো বিশ্রাম, বিনোদন ও ঘুমোতে যাওয়ার ব্যাপারে নির্দিষ্ট নিয়মনীতি প্রণয়ন ও বাস্তবায়ন নিশ্চিত করা
  • প্রকল্প এলাকায় বিভিন্ন ধরনের নির্দেশিকা ও নির্দেশনাসংবলিত পোস্টার লাগানোর ব্যবস্থা করা
  • অনৈতিক কার্যকলাপ থেকে সবাইকে বিরত রাখার লক্ষ্যে প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ গ্রহণ করা
  • সংশ্লিষ্ট সব কাজে নির্দিষ্ট বিধিবিধানসমূহ মেনে চলা নিশ্চিত করা
  • অনভিজ্ঞ ও অদক্ষ লোকবলের দক্ষতা বাড়াতে নিয়মিত ট্রেনিং এবং মোটিভেশন দেওয়ার ব্যবস্থা নেওয়া
  • প্রাথমিক চিকিৎসা এবং অগ্নিনির্বাপণ সরঞ্জামাদি মজুত রাখা এবং ব্যবহারবিধি সম্পর্কে সঠিক নির্দেশনা দেওয়া
  • পূর্ব প্রণীত কর্মপরিকল্পনা (ওয়ার্কস প্রোগ্রাম) মোতাবেক প্রকল্পের সব কাজ সম্পাদন নিশ্চিত করা।
  • কাজ সঠিকভাবে সম্পাদিত হচ্ছে কি না দেখার জন্য প্রতিদিন নিয়মিত চেকশিট পূরণ করা
  • প্রয়োজনে সংশোধিত কর্মপরিকল্পনা প্রণয়ন ও বাস্তবায়ন করা
  • সর্বোপরি, ভালো কাজে উৎসাহ দেওয়ার লক্ষ্যে সংশ্লিষ্ট সবাইকে কাজের মূল্যায়নভিত্তিক পারিশ্রমিক প্রদান করা

উপরোল্লিখিত বিষয়গুলো বাস্তবায়ন করা ছাড়াও একটি প্রকল্প সুষ্ঠুভাবে এবং সময়মতো সম্পন্ন করতে পারিপার্শ্বিক পরিবেশের ভারসাম্য রক্ষা করার বিষয়টিও বিশেষভাবে লক্ষ রাখা প্রয়োজন। বিশেষ করে, প্রকল্প এলাকার আশপাশ দিয়ে মানুষ যাতে নিরাপদ ও নির্বিঘ্নে চলাচল করতে পারে, রাতে শান্তিতে ঘুমোতে পারে এবং বিভিন্ন অজুহাতে প্রকল্পের কাজে বিঘ্ন সৃষ্টি করে কাজের গতি বিঘ্নিত করতে না পারে ইত্যাদি বিষয়ের ওপর নজরদারি থাকা অপরিহার্য। অতএব, সময়মতো প্রকল্পের কাজ শেষ করতে কাজের সার্বিক গতি ত্বরান্বিত করাসহ গুণগত মান রক্ষা করা এবং নির্বিঘ্নভাবে সব কাজ চালিয়ে যেতে নিম্নলিখিত বিষয়গুলো মেনে চলা জরুরি। যেমন-

  • রাস্তার ওপর মালামাল রেখে সাধারণ মানুষের চলাচলে বিঘ্ন সৃষ্টি না করা
  • যথাসম্ভব মানুষের ঘুমের সময় উচ্চ শব্দে কাজ না করা
  • উচ্চ শব্দযুক্ত মেশিন চালানোর জন্য নির্দিষ্ট একটি সময় নির্ধারণ করা
  • আইনশৃঙ্খলা বিঘ্নিত হয় এমন কাজ থেকে বিরত থাকা
  • আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী প্রশাসনের সঙ্গে যোগাযোগ রক্ষা করা
  • নির্মাণসংক্রান্ত সব বিধিবিধান যথাযথভাবে মেনে চলা
ঝুঁকিপূর্ণ নির্মাণকাজ

মনে রাখা দরকার, নির্মাণসংক্রান্ত প্রতিটি কাজ সঠিক ও সুষ্ঠুভাবে পরিচালনা করার জন্য সুচিন্তিত ও ফলপ্রসূ ব্যবস্থাপনা নিশ্চিত করা না গেলে কাজের গতি ও গুণগত মান লোপ পাবে এবং সময় ও অর্থের অপচয় হবে। পাশাপাশি, নির্মাণ-পরবর্তী সময়ে নানা অসুবিধা দেখা দিতে পারে। এ ছাড়া পেশাগত নিরাপত্তা, স্বাস্থ্য ও পরিবেশরক্ষা নিশ্চিত করতে না পারলে মানুষের অসুখবিসুখ হওয়াসহ নানা দুর্ঘটনা ঘটা এবং হতাহতের ঝুঁকি থেকে যায়। অতএব, প্রতিটি কাজের ক্ষেত্রে সঠিক দিকনির্দেশনা দেওয়া, প্রয়োজনে গুরুত্বপূর্ণ স্থানসমূহে লিখিত নির্দেশিকা ঝুলিয়ে রাখার ব্যবস্থা করাসহ সার্বক্ষণিক তদারকি নিশ্চিত করা অপরিহার্য।

প্রকৌশলী মো. হাফিজুর রহমান, পিইঞ্জ
লেখক:
লাইফ ফেলো- আই.ই.বি; লাইফ মেম্বর- বি.এ.এ.এস; বি.এস.টি.কিউ.এম; এ.ও.টি.এস (জাপান), এক্স-এক্সিকিউটিভ ডিরেক্টর (সার্ভিসেস), এ.ডি.টি.এল

প্রকাশকাল: বন্ধন ১৬৭ তম সংখ্যা, জুলাই ২০২৪

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Scroll to Top