রাজধানীর বায়ুদূষণের ভয়াবহতা

ক্ষতিকর রাসায়নিক গ্যাস বা গ্যাসীয় পদার্থ যে প্রক্রিয়ায় বায়ুতে মিশে জীবজগতের স্বাভাবিক বিকাশের অন্তরায় হয়ে দাঁড়ায়, সেটাই মূলত বায়ুদূষণ। কার্বন মনোঅক্সাইড (CO), সালফারডাই অক্সাইড (SO2), ক্লোরোফ্লোরো কার্বন (Cfc) ইত্যাদি বায়ু দূষণকারী গ্যাস কলকারখানা অথবা যানবাহনের সৃষ্ট। সম্প্রতি বিশ্বস্বাস্থ্য সংস্থা (WHO) বায়ুদূষণকে ক্যানসারের অন্যতম কারণ বলে ঘোষণা করেছে।

বায়ুদূষণ রাজধানী ঢাকায়

রাজধানী ঢাকার বাতাস এ শহরের বাসিন্দাদের জন্য বিপজ্জনক হয়ে ওঠছে, হুমকিতে ঢাকার প্রায় দেড় কোটি মানুষ। জনসংখ্যার বিবেচনায় বিশ্বের অষ্টম বৃহত্তর নগর ঢাকার পরিবেশের যে অবস্থা, তাতে নগরবাসীরা রয়েছে ভয়ানক স্বাস্থ্যঝুঁকিতে। এ নগরের বাসিন্দাদের রোগ-ব্যাধির কমপক্ষে ২২ শতাংশের জন্য সরাসরি দায়ী বায়ুদূষণ। এক সমীক্ষা মতে, বায়ুদূষণে ঢাকা শহর বিশ্বের অন্য যেকোনো বড় শহরের চেয়ে অনেক বেশি এগিয়ে। এখানকার বাতাসে এত বেশি দূষিত পদার্থ মিশে আছে যে কোনো সাধারণ মানুষ রাজপথে হাঁটলেই টের পাবেন এর বিরূপতা। পরিবেশ অধিদপ্তরের হিসাব অনুযায়ী, ঢাকা শহরে প্রতিদিন প্রায় দুই লাখ ইঞ্জিনচালিত যান চলাচল করে। এগুলো থেকে নির্গত কালো ধোঁয়া মূলত আবদ্ধ কার্বন বা ছোট ছোট কণার আকারে বেরিয়ে আসে। অনেক পরিবেশবিদ ঢাকার বায়ুতে সিসা কণার উপস্থিতি ব্যাপকতর বলে উল্লেখ করেছেন। পরিবেশবিদেরা ত্রুটিযুক্ত যানবাহন চলাচলের ওপর জোর আপত্তি জানিয়ে বলেছেন যে যানবাহনের নির্গত বিষাক্ত ধোঁয়ায় ঢাকা নগরবাসী বছরে প্রায় ৬০ কোটি টাকার আর্থিক ক্ষতির সম্মুখীন হচ্ছে। বিশ্বব্যাংকের একটি প্রতিবেদন বলছে, ঢাকা শহরে প্রতিবছর বায়ুদূষণের কারণে ১৫ হাজার মানুষ অকালে মারা যায় এবং ৬৫ লাখ মানুষ মারাত্মক অসুস্থতায় আক্রান্ত হয়, ৮৫ লাখ মানুষ ছোটখাটো অসুস্থতার শিকার হয়। বিশ্বব্যাংক পরিচালিত ‘দ্য ঢাকা অটো ক্লিনিক প্রোগ্রাম’ শীর্ষক গবেষণায় দেখা যায় বায়ুদূষণের ফল মারাত্মক। বায়ুদূষণে গত আট বছরেই মৃত্যুবরণ করেছে আট হাজার ১৩৯ জন এবং বিভিন্ন রোগে আক্রান্তের সংখ্যা এক লাখ ২৪ হাজার ৭২৯ জন। বায়ুদূষণজনিত রোগে আক্রান্ত শিশুর সংখ্যা পাঁচ লাখ ৬৫ হাজার ৮৫৬ এবং অন্যান্য শারীরিক অসুস্থতায় ভুগছে আরও ১১ হাজার ৪৭৪ জন।

গাড়ির কালো ধোঁয়ায় দূষিত হচ্ছে বায়ু

গবেষণায় প্রাপ্ত তথ্যের ভিত্তিতে ঢাকার বাতাসে দূষণের মাত্রাকে মারাত্মক বলে উল্লেখ করা হয়েছে এবং দক্ষিণ এশিয়ায় দূষণের ক্ষেত্রে ঢাকাকে উল্লেখযোগ্য বলে বিবেচনা করা হয়েছে। গবেষণায় ঢাকার সঙ্গে দেশের অন্যান্য অঞ্চলের বায়ুদূষণের তুলনামূলক চিত্রে দেখা যায়, ঢাকার বাতাসে বায়ুদূষণের হার ৫০ দশমিক আর আন্তর্জাতিক স্ট্যান্ডার্ড হলো ১৫ (ইএডি)। অন্য এক সমীক্ষা মতে, সিসাযুক্ত বায়ুর কারণে দেশের অসংখ্য শিশুর জীবন এখন হুমকির মুখে। রাজধানীস্থ ইবনে সিনা হাসপাতালের সূত্রমতে, এ সময়ে এখানকার জরুরি বিভাগে চিকিৎসা নিতে আসা রোগীদের শতকরা প্রায় ১১ ভাগ রোগীই শ্বাসকষ্টজনিত রোগে ভুগছে। হাসপাতালের চিকিৎসকের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, বায়ুদূষণের কারণে প্রতিনিয়ত আমাদের শরীরে অক্সিজেনের সঙ্গে ঢুকছে বিষাক্ত সিসা। ফলে এতে সব শ্রেণীর (শিশু, বৃদ্ধ, প্রাপ্তবয়স্ক) মানুষের রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা কমছে দ্রুতই।

ঢাকা শহরে যে কারণে বায়ুদূষণ

ঢাকায় বায়ুদূষণের অন্যতম কারণ রাস্তায় চলাচলকারী গাড়ি, আশপাশের শিল্পাঞ্চল, ইটভাটা ও অন্যান্য বর্জ্য। গাড়ির সংখ্যা প্রতিবছর গড়ে বাড়ছে ১০ শতাংশ হারে। প্রতিদিন রাস্তায় প্রায় ১০০টি নতুন প্রাইভেটকার নামছে। ঢাকার ভেতরে সচল গাড়িগুলোর ৭০ থেকে ৮০ শতাংশই ত্রুটিপূর্ণ ইঞ্জিনের কারণে ছড়াচ্ছে বিষাক্ত ধোঁয়া। ইদানীং প্রচুর পরিমাণ সিএনজিচালিত গাড়ি চলাচল করছে। এসব সিএনজিচালিত গাড়ি থেকে বেরুচ্ছে ক্ষতিকারক বেনজিন। আর এই বেনজিনের কারণে ঢাকায় ক্লাসারের প্রভাব বেড়েছে বহুলাংশে। এ ছাড়া সালফার ও সিসাযুক্ত পেট্রল ব্যবহার, জ্বালানি তেলে ভেজাল ও ত্রুটিপূর্ণ ইঞ্জিনের কারণে এসব গাড়ির ধোঁয়ার সঙ্গে কার্বন ডাই-অক্সাইড, কার্বন মনোঅক্সাইড, নাইট্রোজেন অক্সাইড, সালফার ডাই-অক্সাইড, অ্যালডিহাইডসহ বিভিন্ন বস্তুর কণা ও সিসা নিঃসরিত হয়ে বাতাসকে করছে দূষিত। ১৯৯৪ থেকে ১৯৯৭ পর্যন্ত বাতাসে সিসার পরিমাণ ছিল বিপজ্জনক পর্যায়ে। পরিবেশবাদীদের আন্দোলনের মুখে সরকার সিসাবিহীন পেট্রল আমদানি শুরু করলে অবস্থা অনেকটাই নিয়ন্ত্রণে আসে।

কলকারখানার নি‍র্গত ধোঁয়া বায়ুদূষণের অন্যতম কারণ

কিন্তু বর্তমানে পরিস্থিতি আবার বিপজ্জনক পর্যায়ে পৌঁছেছে। জরিপ বলছে, ঢাকা শহরে গাড়ি থেকে নির্গত ধোঁয়া বছরে প্রায় তিন হাজার ৭০০ টন সূক্ষ্ন বস্তুকণা (এসএমপি/সাসপেন্ডেড পার্টিকুলেড ম্যাটার) বাতাসে ছড়িয়ে দিচ্ছে। বাতাসে ভাসমান ও সূক্ষ্ন বস্তুকণার আকার ১০ মাইক্রোনের চেয়েও কম। কণা যত সূক্ষ্ন হয়, স্বাস্থ্যঝুঁকি বাড়ায়; শক্তিতে তা ততই প্রবল হয়। পরিবেশ অধিদপ্তর ঢাকার গাড়িতে ব্যবহৃত ডিজেল, পেট্রল ও অকটেনের পরিমাণের ওপর জরিপ চালিয়ে দেখেছে গাড়িগুলো থেকে প্রতিদিন গড়ে প্রায় ২০০ কিলোগ্রাম সিসা, সাড়ে তিন টন অন্যান্য বস্তুকণা, দেড় টন সালফার ডাই-অক্সাইড, ১৬ টন নাইট্রোজেন অক্সাইড, এক টন হাইড্রোকার্বন এবং ৬০ টন কার্বন মনোঅক্সাইড নির্গত হচ্ছে। ইতিমধ্যে সহনীয় মাত্রার চেয়ে বেশি পরিমাণ কার্বন ও ভাসমান সূক্ষ্ন বস্তুকণা ঢাকার বাতাসকে মারাত্মক পর্যায়ে ছড়িয়ে পড়ছে। গত দুই বছরে বাতাসে কার্বনের পরিমাণ ৪ শতাংশের বেশি হারে বেড়েছে। বর্তমানে তা ৩৫০ পিপিএস (পটাশ পার মিলিয়ন)। একটি বড় শহরের কার্বনের সর্বোচ্চ গ্রহণযোগ্য মাত্রা ২৯০ থেকে ৩০০ পিপিএম। বাতাসে কার্বনের মাত্রা বেড়ে যাওয়ায় ঢাকার বার্ষিক গড় উষ্ণতাও বাড়ছে। ফলে নষ্ট হচ্ছে পরিবেশের ভারসাম্য। বৃষ্টিপাত ও উষ্ণতার স্বাভাবিক নিয়মের ঘটছে ব্যতয়।

বায়ুদূষণ রোধে এ মুর্হূতের করণীয়

রাতারাতি রাজধানী ঢাকার বায়ুদূষণ নিয়ন্ত্রণ করা সম্ভব নয়। তাই একটি দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনা গ্রহণ করে পরিকল্পনা অনুযায়ী সামনে এগুতে হবে। যেমন- ঢাকা শহরে প্রতিদিন যে দুই লাখ গাড়ি চলাচল করে, তার শতকরা ৭৫ ভাগ থেকে নির্গত হয় কালো ধোঁয়া আর বিষাক্ত সিসা। সেই গাড়িগুলোকে চিহ্নিত করে গাড়ির ফিটনেস চেক করে সেগুলোর বিরুদ্ধে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নিতে হবে। এ ছাড়া অপরিকল্পিতভাবে স্থাপিত শিল্প-কারখানা থেকে নির্গত ধোঁয়ার সঙ্গে বেরুনো কার্বন ডাই-অক্সাইড, কার্বন মনোঅক্সাইড, সালফার ডাই-অক্সাইড, সিসাযুক্ত ধোঁয়া, মিথেন নিকেলযুক্ত গ্যাস দিন দিন নির্মল বাতাসকে করে তুলছে বিষাক্ত। ঢাকা শহরের ভেতরে ও চারপাশে গড়ে ওঠা টেক্সটাইল, ট্যানারি, ফার্মাসিউটিক্যাল, ইঞ্জিনিয়ারিং ওয়ার্কশপ, কেমিক্যাল, কীটনাশক, প্লাস্টিক পেপার অ্যান্ড পার, সার, সিমেন্ট, ডিস্ট্রিলারি ইত্যাদি শিল্প-কারখানা, যা বায়ুদূষণের অন্যতম উৎস এগুলো নিয়ন্ত্রণে বা অপসারণে সঠিক নীতিমালা সরকার কর্তৃক প্রণয়ন করতে হবে। ঢাকা শহরের আবাসিক এলাকায় অপরিকল্পিতভাবে স্থাপিত ছোট-বড় অনেক শিল্প-কারখানা থেকে নির্গত ধোঁয়া প্রতিনিয়ত দূষিত করছে নগরীর বাতাসকে। যা আবাসিক এলাকায় পরিবেশ ও জনস্বাস্থ্যের ওপর ফেলছে ক্ষতিকর প্রভাব।

উন্মুক্ত ব‍‍র্জ্যে দূষিত হচ্ছে বায়ু

শিল্প-কলকারখানা আবাসিক এলাকা থেকে নির্দিষ্ট স্থানে স্থানান্তর করতে হবে। ইটের ভাটা কর্তৃক নির্গত ছাই ভাসমান বস্তুকণা হিসেবে নির্গত হয়, তা নিয়ন্ত্রণের জন্য এগুলোকে বিজ্ঞানসম্মতভাবে আধুনিকীকরণ করার পাশাপাশি মেশিনে পরিবেশবান্ধব ইট তৈরিতে উৎসাহিত করতে হবে। রাস্তায় যানজটের কারণে আটকে পড়া যানবাহন থেকে নির্গত ধোঁয়া জনজীবন অতিষ্ঠ করে তোলো। ত্রুটিপূর্ণ যানবাহনে আবদ্ধ বিষাক্ত ধোঁয়া নির্গমন নিয়ন্ত্রণ করতে হবে, পাশাপাশি যানবাহন কমানোর জন্য ঢাকার চারপাশে নৌপথে ওয়াটার ওয়ে নিয়মিতভাবে চালু রাখতে হবে। নৌপথে চলাচলের জন্য সদরঘাট থেকে আশুলিয়া বাজার পর্যন্ত নৌ রুট চালু করতে হবে। অন্যদিকে আশুলিয়া বাজার থেকে টঙ্গী হয়ে রামপুরা ও বেগুনবাড়ি হয়ে এটি বিস্তৃত করতে হবে নারায়ণগঞ্জ পর্যন্ত, এ ব্যাপারে কার্যকর পদক্ষেপ নিতে হলে ঢাকা শহরের নৌপথ খনন ও পুনঃখনন প্রয়োজন। এতে ঢাকা শহরের যানজট কমে আসবে, একই সঙ্গে যানবাহনের বিষাক্ত ধোঁয়া নিয়ন্ত্রণ করা সম্ভব হবে। বায়ুদূষণ প্রতিরোধে ও পরিবেশ সংরক্ষণে সরকারিভাবে পরিবেশ অধিদপ্তর সংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠানের পক্ষ থেকে নিতে হবে জোরালো পদক্ষেপ। বায়ুদূষণ রোধে ও পরিবেশ সংরক্ষণে ঢাকা শহরের প্রত্যেক নাগরিকের প্রত্যক্ষ অংশগ্রহণ এখন সময়ের দাবি।

মোঃ নাজমুল ইসলাম (দীদার)

প্রকাশকাল: বন্ধন ৫০ তম সংখ্যা, জুন ২০১৪

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Scroll to Top