ভবনের নিরাপত্তায় গ্রিল

একটি ভবন নির্মাণে ইট, বালু, সিমেন্টের পাশাপাশি সমান গুরুত্বপূর্ণ গ্রিল সংযোজন। নিরাপত্তাই এর প্রধান উদ্দেশ্য হলেও সৌন্দর্যবর্ধন ও অফুরন্ত আলো-বাতাস পেতে এর জুড়ি মেলা ভার। বলা যায়, বাড়িঘরে এর ব্যবহার অপরিহার্য। গ্রিল বা লোহার তৈরি কাঠামো সবচেয়ে বেশি ব্যবহার করা হয় জানালায়। তবে বাড়ির প্রধান ফটক, বারান্দার রেলিং, সিঁড়ির রেলিং, ভেন্টিলিটারে গিলের ব্যবহার চোখে পড়ার মতো। বিশ্বের সর্বত্রই ভবনের একটি অপরিহার্য অনুষঙ্গ হিসেবে ব্যবহৃত হয়ে আসছে গ্রিল।  

যেভাবে এল

গ্রিল যে খনিজ পদার্থের মধ্যে পাওয়া যায়, নানা দেশে তার নানা নাম। চলতি ভাষায় বলা হয় লোহাপাথর। লোহাপাথরের কথাও যখন লোকেরা জানত না, তখন তারা প্রয়োজনীয় লোহা সংগ্রহ করত উল্কাপিণ্ড থেকে। ইংরেজিতে যাকে বলে ‘শুটিংস্টার’। উল্কার বেশির ভাগই ছুটতে ছুটতে বাতাসের ঘষা লেগে আকাশেই জ্বলে-পুড়ে ছাই হয়ে যেত। যেগুলো মাটিতে পড়ত, সেগুলোকেই বলা হতো উল্কাপিণ্ড বা ‘মিটিওর’। এর মধ্যে থাকত প্রচুর লোহা। যে লোহা একেবারে খাঁটি। উল্কাপিণ্ড থেকে পাওয়া লোহা দিয়েই মানুষ তার চাহিদা মেটাত। তবে বলাই বাহুল্য, এর বেশির ভাগই পৃথিবীতে আসতে আসতে ছোট হয়ে যেত। এ জন্য খুব বেশি লোহা জোগান দেওয়া সম্ভব ছিল না। তখন অবশ্য মানুষ একে খুব দামি জিনিস মনে করত। 

ভবনের নিরাপত্তায় গ্রিল

এখন অবশ্য মানুষকে লোহার জন্য উল্কার মুখ চেয়ে থাকতে হয় না। লোহাপাথর থেকেই তারা তাদের লোহা বের করে আনে। আর এসব পাথরে থাকে অক্সিজেন। মাটির চুল্লিতে কাঠ-কয়লা আর এই লোহাপাথর স্তরে স্তরে সাজিয়ে চামড়ার হাপড়ের সাহায্যে গনগনে আগুন জ্বালিয়ে ওই ‘পাথর’ গলানো হয়। লোহাপাথরের অক্সিজেনটুকু কয়লার সঙ্গে মিশে প্রথমে কার্বন ডাই-অক্সাইড বা মনো-অক্সাইড ও শেষে কার্বন ডাই-অক্সাইড হয়ে বেরিয়ে যায়, পড়ে থাকে আসল লোহা আর পাথরের ময়লা ধুলাবালু, যাকে বলে গাদ। গরম অবস্থায় এই লোহা পিটিয়ে গাদ বা ময়লা অনেকটাই বের করে দেওয়া যায়। তখন যা পড়ে থাকে, সেটাই কিন্তু খাঁটি লোহা। তবে লোহা বিশুদ্ধকরণ করা হয় Catalan forge নামের এক ধরনের ফার্নেস বা ব্লাস্ট থেকে, যা প্রচলন শুরু হয়েছিল স্পেনে।

বিদ্যমান খনিজ

এ দেশে যাকে লোহাপাথর বলা হয় তা আসলে একরকম খনিজ পদার্থ বা ‘মিনারেল’। প্রধান উপাদান লোহা আর অক্সিজেন। অবশ্য সেই সঙ্গে কিছু ময়লা ও ভুষোমালও মেশানো থাকে। হিমোটাইট ছাড়া আরও কয়েক রকম খনিজ থেকে লোহা বের করা যায়। যেমন ম্যাগনেটাইট, সাইডেরাইট। তবে আমাদের দেশে হিমোটাইট লোহার প্রধান আকর বা ‘ওর’। অবশ্য এ ছাড়া প্রায় ২০০ রকম খনিজের মধ্যে কিছু না কিছু লোহা আছে। বাংলাদেশের পূর্বাঞ্চলটা এই রকম লাল মাটি বা রাঙামাটির দেশ। এরপর ভারতের সাঁওতাল পরগনা, উড়িষ্যা এবং বিহারের অনেকটাই এ রকম।

লোহার রকমফের

লোহা মূলত তিন রকমের- কাঁচা লোহা (পিগ আয়রন), পেটা লোহা (রুট আয়রন) আর ইস্পাত (স্টিল)।

লোহা তৈরি করা

তিনটি পদ্ধতিতে লোহা তৈরি হয়, বেসিমার, ওপেন হার্থ ও ইলেকট্রিক ফার্নেস বা বৈদ্যুতিক চুল্লি পদ্ধতিতে। যে চুল্লিতে হিমোটাইট গলিয়ে কাঁচা লোহা তৈরি করা হয়, তাকে বলা হয় ব্লাস্ট ফার্নেস। ব্লাস্ট মানে বাতাসের ঝাপটা। এই চুল্লিতে তাপ সৃষ্টির জন্য গরম বাতাসের ঝাপটা ব্যবহার করা হয় বলেই এমন নাম। নামে চুল্লি হলেও ব্লাস্ট ফার্নেস আকারে বিশাল। উঁচুতে ৯০, ১০০, এমনকি ১৫০ ফুটের বেশি উঁচু ফার্নেস দেখেই ইস্পাত নগর চেনা যায়। এই চুল্লিগুলোতে ১৫০০ ডিগ্রি সেন্টিগ্রেড পর্যন্ত তাপ তৈরি করা যায়। বেশি গরমে যাতে চুল্লি ফেটে না যায় সে জন্য চুল্লিটা ঘেরা থাকে ইস্পাতের খোল দিয়ে। ভেতরে থাকে তাপ সহ্য করার উপযোগী সাদা ইট বা ফায়ার ক্লের আস্তর। দেখতে অনেকটা উঁচু চিমনির মতো। তবে মাঝখানটার একটু নিচে হঠাৎ চওড়া হয়ে আবার সরু হয়ে গেছে। এখানেই চক্রাকারে কতুনালি নল ঢুকিয়ে তার ভেতর গরম বাতাসের ঝাপটা দেওয়া হয়।

শৈল্পিক ডিজাইনের লোহার গ্রিল

ব্লাস্ট ফার্নেসে প্রথমে চুল্লিটা কয়লা বা কাঠ দিয়ে জ্বালিয়ে দেওয়া হয়। সঙ্গে সঙ্গে চলে গরম বাতাসের ঝাপটা আর মাথার ওপর থেকে ঢেলে দেওয়া হতে থাকে লোহার মসলা। অর্থাৎ হিমোটাইট কয়লা আর চুনাপাথর ঢালার পরই মাথার ওপরকার মুখ আপনি বন্ধ হয়ে যায়। চুল্লির ভেতরকার তাপ এক এক জায়গায় কম, ৩০০ ডিগ্রি, তারপর বাড়তে বাড়তে একদম নিচে ১৫০০ ডিগ্রি। ওপর থেকে লোহার মসলা নিচে নামার সময় স্তরভেদে বিভিন্ন রাসায়নিক বিক্রিয়া চলতে থাকে। হিমোটাইটের অক্সিজেন কয়লা কার্বনের সঙ্গে মিশে প্রথমে তৈরি হয় কার্বন মনো-অক্সাইড। সেটাও আবার হিমোটাইটের অক্সিজেনের সঙ্গে মিশে তৈরি হয় কার্বন মনো-অক্সাইড। পরবর্তী সময়ে তৈরি হয় কার্বন ডাই-অক্সাইড। ফলে হিমোটাইটের সব অক্সিজেন বেরিয়ে গিয়ে সেটা পরিবর্তিত হয় খাঁটি লোহায়। অবশ্য শেষ পর্যন্ত খাঁটি থাকে না, আবার খানিকটা কার্বন ও অন্যান্য পদার্থ গিয়ে ওই লোহায় থেকে যায়। ওদিকে চুনাপাথর ভেঙে হয় চুন। সেই চুন ভুষোমালের সঙ্গে মিশে তাকে গলিয়ে আলাদা করে ফেলে তৈরি করে গাদ। একে বৈজ্ঞানিক পরিভাষায় বলা হয় ‘স্ল্যাগ’। চুল্লির একদম তলার দিকে যে উত্তাপ, তাতে লোহাও স্লাগ দুটো গলে তরল হয়ে যায়। লোহা বেশি ভারী বলে সেটা তলায় পড়ে, আর তার ওপর ভাসতে থাকে তরল গাদ, স্লাগ। চুল্লির এখানে দুটো নালা বসানো থাকে, একটা ওপরে, অপরটা নিচে। ওপরের নালার মুখ খুলে বের করা হয় তরল স্লাগ। আর নিচেরটার মুখ খুলে বের করে আনা হয় তরল লোহা। তরল বটে, কিন্তু দুটোই ভীষণ গরম। আগুনের  মতো লাল।  যখন বিরাটাকৃতির বালতিতে ঢালা হয়, বিশেষত রাত্রে তখন সেই ‘তরল আগুনের’ দৃশ্য সত্যিই দেখার  মতো জিনিস। বালতি থেকে সেই লোহা ছাঁচে ঢেলে জুড়িয়ে নিলেই তৈরি হয় কাঁচা লোহা। এরই নাম পিগ আয়রন।

বাড়ির নিরাপত্তায়

বাড়ির নিরাপত্তায় গ্রিলের ব্যবহার বেশি। জানালা থেকে শুরু করে সর্বত্রই এর বিস্তার। বারান্দায় এর ব্যবহার ডিজাইন ও মাপভেদে। দরজায় গ্রিলের ব্যবহার বেশি দেখা যায় গ্রামাঞ্চলে। তবে ইদানীং শহুরে বাড়ির দরজায় ক্রমেই বাড়ছে এর কদর। এ ছাড়া গাড়িতে নেট হিসেবে গ্রিল ব্যবহার করা হয়, যাতে গাড়ির গ্লাস ভেঙে না যায়। 

দরদাম

এখন চট্রগ্রাম ও ঢাকায় পাওয়া যায় তৈরি লোহা। তবে এর মধ্যে চট্টগ্রামের লোহা তুলনামূলকভাবে ভালো, দামও বেশি। এগুলো জাহাজ কেটে গলিয়ে প্রস্তুত করা হয়। আর তাই বিভিন্ন মাপ ও দামের হয় লোহাগুলো। লম্বায় যা ১৪-১৫ ফুট। মানভেদে মাপ ও দামের তারতম্য ঘটে। দাম ধরা হয় স্কয়ার ফুটে।

কলাপসিক্যাল গেইট

দরজার জন্য

  • 11/2 অ্যাংগেল আউট ফ্রেম
  • ১” অ্যাংগেলের পাল্লা ২২ কেজি সিট (৩-৪”)  ফ্ল্যাট বারসহ প্রতি স্কয়ার ফুটের দাম ২১০-২২০ টাকা
  • 11/2” অ্যাংগেল আউট ফ্রেম (৩-৪)”  অ্যাংগেলের পাল্লা ২৬ কেজি সিট (৩-৪)”  সুতা ফ্ল্যাট করসহ দাম ১৮০-১৯০ টাকা

মূল দরজা বা কেচি গেট

  • ১ ইঞ্চি অ্যাংগেল (৩-৪)”  ফ্ল্যাটবার দ্বারা বিয়ারিং সিস্টেম গ্যাপ র্৪র্ – ৩৫০ টাকা
  • ১ ইঞ্চি অ্যাংগেল ১ ইঞ্চি ফ্ল্যাটবার বিয়ারিং সিস্টেম গ্যাপ ৩ ইঞ্চি -৫০০ টাকা
  • এ ছাড়া বাড়ির মেইন গেটের মাপ মালামালের ওপর নির্ভর করে করা হয়।

সাবধানতা

অনেক সময় ওয়েল্ডিং ভালো না থাকার কারণে গ্রিল খুলে যেতে পারে। তাই ভালোভাবে ওয়েল্ডিং করা উচিত। বৃষ্টির পানি পড়ে এটিতে যাতে মরিচা না পড়ে, সেদিকেও খেয়াল রাখতে হবে। সর্বোপরি গ্রিল বাড়ির কংকাল; এর বন্ধন ছাড়া বাড়ি তৈরি অসম্ভব। তবে গ্রিলের প্রয়োজনীয়তা শুধু বাড়িতে নয় কলকারখানা, শিল্পক্ষেত্রেও ছড়িয়ে পড়েছে। শুধু তা-ই নয়, প্রাচীন রাজবাড়িতেও ছিল গ্রিলের ব্যবহার।

প্রকাশকাল: বন্ধন ৪২ তম সংখ্যা, অক্টোবর ২০১৩

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Scroll to Top