নবরূপে উত্তরা গণভবন

কবির কল্পনায় নাটোর অমর হয়ে আছে কাব্যে। ঐতিহ্যের জৌলুস, অতীতের রাজ-রাজন্যের স্মৃতি, প্রাচীনত্ব আর ইতিহাসের সোনালি দিনগুলোকে বুকে ধারণ করে নীরব সাক্ষী হয়ে দাঁড়িয়ে আছে নাটোরের দিঘাপতিয়া রাজবাড়ি তথা উত্তরা গণভবন। প্রাচীন ঐতিহ্য আর প্রত্নতাত্ত্বিক ঐশ্বর্যমন্ডিত তিলোত্তমা এই রাজবাড়ি নাটোরকে এনে দিয়েছে বিশেষ এক খ্যাতি ও পরিচিতি। নাটোরের দর্শনীয় স্থানের মধ্যে অন্যতম উত্তরা গণভবন। এখানকার প্রাসাদগুলোর অপূর্ব নির্মাণশৈলী, আধুনিক প্যাটার্নের ইতালীয় বাগান, দৃষ্টিনন্দন ভাস্কর্যের কারণে যে কোনো সৌন্দর্যপিপাসু মানুষ এই রাজবাড়ি দেখে মুগ্ধ হন। এর প্রবেশদ্বারে রয়েছে কলকাতায় তৈরি লন্ডনের কোক এন্ড টেলভি কোম্পানির দৃষ্টিনন্দন একটি ঘড়ি ও ঘড়িঘর। 

নাটোর শহর থেকে মাত্র তিন কিলোমিটার দূরে ৪১.৫১ একর জমির উপর প্রতিষ্ঠিত নাটোরের দিঘাপতিয়া রাজবাড়ি। চারদিকে ১৩ একর জমির উপর লেক, সুউচ্চ প্রাচীরবেষ্টিত ছোট-বড় ১২টি কারুকার্যখচিত ও দৃষ্টিনন্দন ভবন নিয়ে উত্তরা গণভবন। ভবনের অভ্যন্তরে রয়েছে ইতালি থেকে সংগৃহীত মনোরম ভাস্কর্য সজ্জিত বাগান এবং বিরল প্রজাতির উদ্ভিদ। বাগানে রয়েছে পানির কৃত্রিম ফোয়ারাসহ মার্বেল পাথরে নির্মিত নানা ধরনের মূর্তি। বাগানের গঠনশৈলী এবং দুর্লভ প্রকৃতির ফুলের গাছের সৌন্দর্যে যে কোনো পর্যটক বিমোহিত হন। বাগানে রয়েছে বসার জন্য নানা বেদি। আপনি ইচ্ছে করলে কিছুক্ষণ বসতে পারবেন এখানে। হারিয়ে যেতে পারেন সামন্ত প্রভুদের শাসন ব্যবস্থার গৌরবময় অতীত ঐতিহ্যে।

গণভবনের প্রবেশদ্বার

রাজবাড়ির পত্তন

ইতিহাসবিদদের মতে, দিঘাপতিয়া রাজবাড়ির পত্তন করেন নাটোরের রাজা রামজীবনের অনুগত এবং বিশ্বস্ত দেওয়ান দয়ারাম রায়। নাটোরের রাজার উত্থানের পেছনে দয়ারাম রায়ের অসামান্য ভূমিকা ছিল। ১৭১৪ সালে যশোরের ভূষণার জমিদার সিতারাম রায়ের পতনের মূলে ছিল দয়ারাম রায়ের কূটকৌশল। সিতারামকে দমন করার জন্য নবাব মুর্শিদকুলি খাঁ প্রেরিত সেনাবাহিনীর সাথে নাটোর রাজের দয়ারাম রায় যুদ্ধে অংশগ্রহণ করেন এবং কূটকৌশলে সিতারামের সেনাপতি মেনাহাতি বা মৃণাল রায়কে গুপ্তহত্যা করান এবং সিতারাম রায়কে বন্দি করতে সক্ষম হন। এতে নবাব মুর্শিদকুলি খাঁ খুশি হয়ে দয়ারাম রায়কে রায় রায়ন উপাধি দেন। রাজা রামজীবন পুরস্কার স্বরূপ দয়ারাম রায়কে দান করেন বর্তমানে বগুড়া জেলার সারিয়াকান্দি উপজেলার চন্নবাইশ এলাকার নওখিলা পরগনা। এটাই দিঘাপতিয়া রাজবংশের প্রথম জমিদারি। সিতারামের গৃহ দেবতা কৃষ্ণজীর মূর্তি দয়ারাম রায়ের বাসভবন দিঘাপতিয়ায় প্রতিষ্ঠা করেন। রাজা রামজীবন এই দেবতার বিগ্রহ প্রতিষ্ঠা এবং সেবার জন্য দিঘাপতিয়ায় একটি মন্দির নির্মাণ করেন এবং বেশ কিছু সম্পত্তি দান করেন। একই বছর নির্মাণ করা হয় দিঘাপতিয়া রাজবাড়ি। নাটোর রাজের দেওয়ান থাকাকালে রামজীবন ও মুর্শিদাবাদের নবাবের কাছে লাভ করেন পরগনা ভাতুরিয়ার তরফ নন্দকুজা, যশোর জেলার মহল কালনা, পাবনা জেলার তরফ সেলিমপুর এবং বগুড়া ও জামালপুর জেলার নওখোলা। ১৮৯৭ সালের ১২ জুন ভূমিকম্পে দিঘাপতিয়া ও নাটোর রাজবাড়িসহ নাটোর শহরের গুরুত্বপূর্ণ স্থাপনা ধ্বংস হয়ে যায়। এ সময় দিঘাপতিয়ার রাজা প্রমদানাথ বর্তমান প্রাসাদ নির্মাণ করেন। এটিই বর্তমানে উত্তরা গণভবন হিসেবে খ্যাত।

প্রাসাদ ভবনের মনোরম সভাকক্ষ

উত্তরা গণভবন

১৯৪৭ সালে জমিদারি প্রথা উচ্ছেদ হলে শেষ রাজা প্রতিভানাথ ১৯৫২ সালে সপরিবারে কলকাতায় বাস করতে থাকেন। ১৯৫২ থেকে ১৯৬৫ সাল পর্যন্ত দিঘাপতিয়া রাজবাড়ি পরিত্যক্ত অবস্থায় ছিল। ১৯৬৬ সালে তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানের গভর্নর আবদুল মোনায়েম খানের নির্দেশে গণপূর্ত বিভাগ প্রায় ১৭ লাখ টাকা ব্যয়ে দিঘাপতিয়া রাজবাড়ি সংস্কার করেন। ১৯৬৭ সালের ২৪ জুলাই তদানীন্তন পূর্ব পাকিস্তানের গভর্নর আবদুল মোনায়েম খান দিঘাপতিয়া রাজবাড়িকে গভর্নর হাউজ হিসেবে উদ্বোধন করেন। বাংলাদেশ স্বাধীন হওয়ার পর বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ১৯৭২ সালের ৯ ফেব্রুয়ারি দিঘাপতিয়া গভর্নর হাউজে আগমন করেন এবং গভর্নর হাউজকে উত্তরা গণভবন হিসেবে ঘোষণা করেন। এ সময় হতে দিঘাপতিয়ার এই ঐতিহ্যবাহী রাজবাড়ি উত্তরা গণভবন হিসেবে খ্যাত। এর পর রাষ্ট্রপতি ও প্রধানমন্ত্রী পর্যায়ের মন্ত্রিপরিষদের বৈঠক এই গণভবনে অনুষ্ঠিত হয়েছে।

গণভবনের অভ্যন্তরে…

নাটোর শহর থেকে মাত্র ৩ কিলোমিটার উত্তরে দিঘাপতিয়া গণভবন অবস্থিত। দিঘাপতিয়া বাজারে যাওয়ার জন্য সুউচ্চ প্রাচীর বেষ্টিত ঘন আমবাগানে ছাওয়া এ রাজপ্রাসাদটি। বাজারের প্রধান মোড়েই রয়েছে গোলচত্বর। এই গোলচত্বরের পশ্চিম পাশেই গর্ব ভরে দাঁড়িয়ে রয়েছে উত্তরা গণভবনের প্রবেশদ্বার। প্রবেশদ্বারের সামনেই রয়েছে প্রাচীন দিনের কামান। ত্রিতল এই ভবনের গেট পেরিয়ে ভেতরে ঢুকলেই চোখে পড়বে নিরাপত্তার জন্য নির্মিত পরিখার উপরে ছোট্ট একটি ব্রিজ। ব্রিজটি পেরোলেই পাকা সড়কের বাঁ-পাশেই রয়েছে সুসজ্জিত মনোরম বাগান। এর পরই রয়েছে মূল প্রাসাদ ভবন। এর সামনেই রয়েছে আরো দুটি কামান। প্রাসাদ ভবনের সামনেই রয়েছে রাজা প্রসন্ন নাথের আবক্ষ মূর্তি। বাগানে রয়েছে মার্বেল পাথরে নির্মিত কয়েকটি ভাস্কর্য। এর মধ্যে রয়েছে স্খলিত বসনে মায়ের বুকের আঁচল টেনে ধরেছে শিশু মাতৃদুগ্ধ পানের জন্য। রয়েছে অপূর্ব নারী মূর্তির ভাস্কর্য, লেকের ধারে কালো পাথরে নির্মিত ভাস্কর্যটি বড়শি দিয়ে নিবিষ্ট মনে মাছ শিকারে ব্যস্ত। শিল্পীর নিপুণ হাতের ছোঁয়ায় এ ভাস্কর্যগুলিকে মনে হয় জীবন্ত। প্রাসাদ ভবনের উত্তর পাশেই ২.৮৯ একরের উপর রয়েছে ঘন আম পাম্পিং বাগান। দেশি-বিদেশি নানা জাতের আম গাছ রয়েছে এই আম বাগানে। দক্ষিণে রয়েছে কুমার ভবন ও অতিথিশালা। মূল প্রাসাদের দক্ষিণে রয়েছে সৌন্দর্যমন্ডিত ইতালিয়ান ফুলের বাগান। বাগানে রয়েছে পানির কৃত্রিম ফোয়ারাসহ মর্মর পাথরে নির্মিত নানা ধরনের ভাস্কর্য। বাগানের গঠনশৈলী এবং দুর্লভ প্রকৃতির ফুলের গাছের সৌন্দর্যে যে কোনো পর্যটক বিমোহিত হবেন। বাগানে বসার জন্য রয়েছে বেঞ্চের ব্যবস্থা। আপনি ইচ্ছে করলে কিছুক্ষণ বসতে পারেন এখানে। বসতে পারেন বাগান লাগোয়া লেকের ধারেও। এই বাগানের পাশেই রয়েছে একটি হাওয়াখানা ঘর। সিঁড়ি দিয়ে উপরে উঠে কাচ দিয়ে ঘেরা এই ঘরে বসেই হাওয়া খেতেন রাজবাড়ির রানী কিংবা রাজা। অপরদিকে কুমার ভবনের পাশ দিয়ে একটু দক্ষিণে গেলেই দেখতে পাবেন একটি নেমপ্লেট। এতে লেখা রয়েছে রানীভবন। কিন্তু রানীভবনের অস্তিত্ব আর খুঁজে পাওয়া যাবে না। গণভবন সংস্কার করার সময় এই ধ্বংসস্ত‚পগুলো সরিয়ে ফেলা হয়েছে। ফলে রানীভবনের অস্তিত্ব বিলীন হয়ে গেছে। সেই সাথে বিলীন হয়ে গেছে রাজাদের বিনোদনের জন্য নির্মিত রংমহল। যেখানে নূপুরের নিক্বণে আর সুরার নেশায় মেতে উঠতেন রাজা আর তার আমন্ত্রিত অতিথিরা। উপভোগ করতেন নর্তকীদের নাচ। অপরদিকে ১২টি ভবন বলা হলেও দৃশ্যত আপনি ৪টি ভবন পাবেন। এর মধ্যে রয়েছে মূল প্রাসাদ ভবন। যেটি রাজা কাছারি ঘর হিসেবে ব্যবহার করতেন। অপূর্ব কারুকার্যময় এই প্রাসাদ ভবনে রয়েছে রাজার সিংহাসন, যুদ্ধ করার জন্য বর্ম এবং তলোয়ার। অপরদিকে প্রাসাদ ভবনের প্রবেশ পথে রয়েছে একটি কাঠের তৈরি মৌচাক। আপনি দেখে চমকে যেতে পারেন সত্যিকারের মৌচাক মনে করে। রয়েছে অত্যাধুনিক ঝাড়বাতি ও আাসবাবে সাজানো মনোরম সভাকক্ষ।

কারুকার্য খচিত জানালা ও সিলমোহরের কারুকার্য খচিত জানালা

ঘড়িঘর

উত্তরা গণভবনের প্রধান ফটকের উপরেই রয়েছে সুদৃশ্য কারুকার্যখচিত ঘড়িঘর। সুদৃশ্য এই তোরণের ত্রিতলা জুড়ে রয়েছে ঘড়ির বিভিন্ন যন্ত্রপাতি। এগুলো দেয়ালে কেটে বসানো হয়েছে। ঘড়ির যন্ত্রপাতি দেখার জন্য আপনাকে সিঁড়ি দিয়ে উপরে উঠতে হবে। এ জন্য তোরণের দু’পাশেই রয়েছে সিঁড়িঘর। লন্ডনের বিখ্যাত কোক এন্ড টেলভি কোম্পানি এই ঘড়িটি প্রস্তুত করেছিল। দু’পাশেই ডায়াল বিশিষ্ট এই ঘড়ির সময় পূর্ব ও পশ্চিম দিক থেকে দেখা যায়। এই ঘড়িটি পরিচালনার জন্য সপ্তাহে একদিন চাবি দিতে হয়। শতবর্ষেরও বেশি সময় ধরে এই ঘড়িটি এখনো সঠিক সময় দিয়ে যাচ্ছে। স্থানীয়দের ভাষ্য, এই ঘড়ির ঘণ্টার শব্দ এখনো এক কিলোমিটার দূর থেকে শোনা যায়।

পুকুর ও পরিখা

উত্তরা গণভবন চত্বরে গোলপুকুর, পদ্মপুকুর, শ্যামসাগর, কাছারিপুকুর, কালীপুকুর, কেষ্টজীর পুকুর নামে ছয়টি পুকুর রয়েছে। এ ছাড়া গণভবনের ভেতরের চারপাশে সুপ্রশস্ত পরিখা রয়েছে। প্রতিটি পুকুর পরিখায় শানবাঁধানো একাধিক ঘাট আছে। প্রাচীন এই অবকাঠামোকে ঘিরে অজস্র আম, জাম, লিচু, কাঁঠাল, মেহগনি, পাম ও চন্দনাসহ দুর্লভ জাতের গাছ লাগানো ছিল। আজ আর তা খুঁজে পাওয়া যায় না।

মাছ শিকারে ব্যস্ত ভাস্কর্য

 দর্শনীর বিনিময়ে গণভবনে প্রবেশ

দীর্ঘদিন সাধারণ দর্শনার্থীদের জন্য অবরুদ্ধ থাকার পর অবশেষে ২০১২ সালের ২৫ অক্টোবর থেকে নাটোরের উত্তরা গণভবন দর্শনীর বিনিময়ে জনসাধারণের জন্য উন্মুক্ত করে দেওয়া হয়েছে। সাপ্তাহিক ছুটির দিনসহ প্রতিদিন ৪ ঘণ্টা করে এটি জনসাধারণের জন্য উন্মুক্ত থাকে। উত্তরা গণভবনের অভ্যন্তরে প্রবেশের জন্য দেশি পর্যটক-দর্শনার্থীদের জন্য ১০ টাকা এবং বিদেশি পর্যটকদের জন্য ৫ ডলার বা সমপরিমাণ বাংলাদেশি টাকা দিতে হবে। তবে অনূর্ধ্ব ৫ বছর বয়সী শিশুদের জন্য কোনো ফি লাগবে না। দর্শনার্থীরা উত্তরা গণভবনের অভ্যন্তরে কোনো প্রকার ক্যামেরা, মোবাইল ফোন, ইলেকট্রনিক যন্ত্রপাতি ও খাবার নিয়ে যেতে পারবেন না। উত্তরা গণভবন সাপ্তাহিক ছুটির দিনসহ প্রতিদিন বেলা ১১টা থেকে বিকেল ৪টা পর্যন্ত খোলা থাকে।

মা ও শিশু ভাস্কর্য, অস্পরীর ভাস্কর্য, অপূর্ব নারী মূর্তি ভাস্কর্য ও কালো পাথরে নির্মিত ভাস্কর্য (বা থেকে)

উত্তরা গণভবনে সার্বিক নিরাপত্তার জন্য সিসিটিভি ক্যামেরা, আর্চওয়ে, মেটাল ডিটেকটরসহ বিভিন্ন নিরাপত্তা উপকরণ, অভ্যর্থনা কেন্দ্রসহ গাইডের ব্যবস্থা রয়েছে। 

মেহেদী হাসান

প্রকাশকাল: বন্ধন ৩৩ তম সংখ্যা, জানুয়ারি ২০১৩

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Scroll to Top