নিসর্গ আর্ট হাব: সংগীতজ্ঞদের কমিউনিটি

তারা চেয়েছিলেন এমন একটা ভবন নির্মিত হোক, যেখানে সংগীতজ্ঞ কমিউনিটির মানুষজনের থাকার ব্যবস্থা করা যায়। এতে করে তাঁরা নানা ধরনের আর্ট ইভেন্টে শিল্পীদেন সঙ্গে উপস্থিত থেকে সঙ্গ দিতে পারেন এবং একে অপরকে সমৃদ্ধ করতে পারেন। নিসর্গ আর্ট হাব তেমনি একটি সংগীতজ্ঞ পরিবারের উদ্যোগ। ভবনটি ভারতের কেরালার এরনাকুলাম অঞ্চলে এক ধানখেতের পাশে। ভবনটি ডিজাইন করেছেন স্থাপত্য প্রতিষ্ঠান ওয়ালমার্ক্স। ২০২৩ সালে ভারতের আলোচিত ভবনগুলোর মাঝে এটি একটি। প্রায় ২ হাজার ৫৫৭ বর্গফুট এলাকাজুড়ে এই ভবনটি নির্মিত। স্থপতি ভিনু ড্যানিয়েল এবং অশীন মরিয়ম ভারুগশি এই ভবনটির ডিজাইন করেছেন।

বন্ধনের জন্য লিখেছেন স্থপতি সুপ্রভা জুঁই।

একটা আর্ট হাব বলতে এমন একটি জায়গা বোঝায়, যেটা যে কমিউনিটিতে অবস্থিত সেই কমিউনিটির মানুষের জন্য ডিজিটাল, ভিজ্যুয়াল এবং পারফর্মিং আর্ট প্রোগ্রামের আয়োজন করে থাকে। তাই এই জায়গাগুলো বিশেষ ধরনের যন্ত্র বাজানোর জন্য বা একটা মনোরম পরিবেশ তৈরির জন্য উপযুক্ত হওয়ার দাবি রাখে। শিল্পকর্ম করা বা উপস্থাপন করা যেমন বিশেষ গুণ, তেমনি করে এই কর্মকে উপভোগ করতে পারাও ভালো একটি গুণ। তবে এই উভয় সুকুমারবৃত্তিকে সুচারুরূপে কাজে লাগাতে স্থাপত্য সন্দেহাতীতভাবে একটি বিরাট ভ‚মিকা পালন করে। তা ছাড়া একটি কমিউনিটির রিসোর্স আদান-প্রদান করা, কমিউনিটির যা চাহিদা তা পূরণ করা এবং আর্ট সৃষ্টি করা একটি আর্ট হাবের অন্যতম বৈশিষ্ট্য। এই বিষয়গুলোকে ধারণ করবে এমন একটি ভবন, সেটি নিশ্চিত করা খুব সহজ ব্যাপার কিছু নয়। স্থাপত্যের বেলায় আর্ট হাব তাই এমন একটি জায়গায় এসে মেলে, যেখানে শিল্পীদের জন্য একটি ছায়াতল ভাবা হয়, যেখানে সৃষ্টিশীলতা এসে মেলে প্রকৃতির মাঝে। এ ছাড়া ভবনের স্থাপত্যে কেরালার ঐতিহ্যকে প্রাধান্য দেওয়া হয়েছে।

এই ভবনের সবচেয়ে মজার জায়গাটা এর ঐতিহ্যবাহী ‘কেরালা ছাদ’। যদিও কেরালার এই ছাদগুলোকে তাপমাত্রার অন্দর-বাহির ফারাকের জন্য ইনস্যুলেটর হিসেবে ব্যবহার করা হয়। কিন্তু এই প্রকল্পে এটি ভূমিরেখার সঙ্গে মিলিয়ে একটা জনসমাগমের স্পেস বের করে নিয়ে আসার ক্ষেত্রে কাজে আসছে। সমসাময়িক স্থাপত্যচর্চায় এমন ছাদ আজকাল ভারতে আর ব্যবহার করতে দেখা যায় না। কারণ এমন ছাদ ব্যবহার করলে ছাদটা যেহেতু দেখতে কালচে হয়, যা আধুনিক মানুষের যে নান্দনিক রুচিবোধ, তার সঙ্গে বিরোধিতা করে। ফলে দুটি বিষয়কেই মাথায় রেখে ছাদটাকে মাঝে মাঝে টুকরো করে ওপর থেকে আলো আনার মধ্য দিয়ে ডিজাইনের মাধ্যমে একটা সমঝোতায় আসা গেছে।

স্থাপনার অভ্যন্তরে সংগীত চর্চার পরিসর। ছবি: আর্কডেইলি

চালার অ্যাঙ্গেল হলো ৩৫ ডিগ্রি এবং গাণিতিক নিয়ম মেনে এই ঢালু ছাদটি সুন্দরভাবে খোলা হাওয়ায় নির্মিত ছাদের ওপরের এম্ফিথিয়েটারের সঙ্গে জুড়ে গেছে। আর ছাদ ফুটো করে যে আলো আনা হলো, ঠিক সেই জায়গাগুলো দর্শক-শ্রোতাদের বসার জায়গা হিসেবে অবধারিত স্থান হিসেবে ফুটে বের হয়ে এল। সিরিয়াল ধরে কতগুলো কাঠের গদিবিহীন তক্তা বসানো হয়েছে সুইমিংপুলের পাশ দিয়ে, যেটা স্বয়ংক্রিয়ভাবে একটা স্টেজের আকার নিয়েছে। এই সুইমিংপুলসংলগ্ন জায়গাটিতেই সংঘটিত হয় উন্মুক্ত কনসার্ট, যা খুবই মনোরম পরিবেশের জন্ম দেয়। খোলা আকাশের নিচে ছাদের ওপরে বসে এখানে প্রায় ৭০ থেকে ৮০ জন দর্শক বসে কনসার্ট উপভোগ করতে পারেন।

এই ভবনে যেহেতু একাধিক প্রবেশদ্বার রয়েছে, তাই ভবনের ভেতরের কার্যক্রমগুলো যেন বাধাগ্রস্ত না হয়, সেটি নিশ্চিত করা হয়েছে। প্রতিটা প্রবেশদ্বার দিয়েই যাওয়া যায় উন্মুক্ত লিভিং স্পেসে, যা মাঠের দিকে মুখ ফিরিয়ে আছে। অভ্যন্তরীণ স্পেসগুলো উন্মুক্ত এবং ফ্লেক্সিবল বিধায় এখানে যাঁরা আসেন, তাঁদের বেশির ভাগই কাঠের মেঝেতে বসেই অতিথিদের সঙ্গে আড্ডায় মেতে ওঠেন। আবার কখনো ডাইনিংরুমেও এই আলাপটা করতে তাঁরা আরামবোধ করেন। ম্যাটেরিয়াল ব্যবহারে একটু সচেতনতার হাল এই ভবনে সুস্পষ্ট। ভবনের ভেতরে কংক্রিটের দেয়াল আর কাঠের আসবাব এবং মেঝেতে বেশ একটা নির্মল পরিবেশ এবং দৃঢ়চরিত্র প্রকাশ পায়। ছাদ ফুটো করে প্রকৃতির মাঝে নিজেকে মেলে ধরা আর ঘরের ভেতরে থাকলে ধানখেত দেখতে দেখতে মেঝে গেঁথে গিয়ে ত্রিমাত্রিক বসার জায়গাগুলো যেভাবে স্পেসকে নানা মাত্রা প্রদান করেছে, তাতে করে চিন্তার ভাঁজগুলোও যেন সযতেœ বের হয়ে আসতে থাকে।

আসবাবপত্র ও বাহুল্যবর্জিত স্থাপনার অভ্যন্তর। ছবি: আর্কডেইলি

ছাদের কনসার্ট এবং ভবনের ভেতরের কনসার্টের আমেজ দুটি এতটাই ভিন্ন মাত্রা আর স্বাদের জোগান দেয় যে সত্যিই ডিজাইনারের কতগুলো সহজ সিদ্ধান্ত স্পেসে যে তরঙ্গ নিয়ে আসে, সেটাই স্থাপত্যকে একটা ম্যাজিক্যাল জায়গায় নিয়ে আসে। নিসর্গ আর্ট হাবের বাহ্যিক এবং অভ্যন্তরীণ সৌন্দর্য যেন দুজন দুজনার সঙ্গে পাল্লা দিয়ে চলছে। সত্যিই কোনো ভবনে এতটা যত্ন যেন বহুদিন চোখে পড়েনি। Form Follows Function বলে যে মডার্নিস্ট স্থাপত্যের ধারণা রয়েছে, সেখানে কোথাও গিয়ে আমরা নান্দনিক প্রসঙ্গটিকে ভুলে যাই বা মনে করি বিষয়টি গুরুত্ব রাখে না। তবে এই একই ধারণাকে যখন সঠিক সুর-তাল-লয়ে ধরা যায়, তখন সেখানে অটোমেটিক্যালি নান্দনিক ভাব বেরিয়ে আসে।

নিসর্গ আর্ট হাবে ঠিক একই ঘটনা ঘটেছে। ভবনটির সহজ প্ল্যানে যেমন সেই ভাবটা প্রকাশ পায় আবার এর ভিডিওগুলো দেখতে থাকলেও একটা অপ্রয়োজনীয় বিষয় যেমন চোখে পড়ে না এবং সেই সঙ্গে সৌন্দর্য এতটাই প্রভাব ফেলে যে মনে তখন আর ওই বিচারী ব্যাপারটা থাকে না। ভবনের ক্লায়েন্ট যাঁরা, তাঁদের মাঝে ‘পদ্মাসন’কে বিশেষত্ব দেওয়ার একটা প্রবণতা আছে বলে মেঝেতে বসে কথোপকথন বা ভাবের আদান-প্রদান গুরুত্ব পেয়েছে বেশি। ভবনটির দেয়াল নির্মিত হয়েছে স্থাপত্য অফিসের নিজস্ব পেটেন্ট করা আবিষ্কার, যার নাম শাটার্ড ডেব্রিস ওয়াল টেকনিক। এই প্রক্রিয়ায় ডেব্রিসগুলো সংগ্রহ করা হয় আশপাশের শহর থেকে এবং জমিসংলগ্ন মাটি থেকে। এই দেয়ালগুলো ভারবহনে সক্ষম। এমনকি চার মিটারের ক্যান্টিলিভারের ভারবহনেও সক্ষম। এই ভবনের যে রেকর্ডিং স্টুডিও আছে, একতলায় সেই কক্ষটিরও এভাবে ভারবহন করে থেকেছে এই দেয়াল।

সেকশন। ছবি: আর্কডেইলি

পশ্চিমমুখী এই ভবনে যে অতিথিকক্ষ আছে, সেগুলো স্ক্র্যাপইয়ার্ড থেকে সংগ্রহ করা বাতিল র‍্যাকগুলো দিয়ে তৈরি এবং সুরক্ষিত গ্রিল হয়ে ওঠে। বিকেলের সূর্যের প্রখর তাপ থেকে রক্ষা করার জন্য ভবনটিকে লতার একটা পর্দা দ্বারা আবৃত করা হয়েছে। ভবনের ছাদে কৌশলগতভাবে ডিজাইন করা ভাঙা ভাঙা অংশগুলো দিয়ে ডিফিউজ আলোকে ঝরনাধারার মতো প্রবেশ করতে দেয় আর ঘরের ভেতরের উষ্ণ বাতাস সেখান দিয়ে বেরিয়ে যেতে পারে। ভাঙা ভবন থেকে পুনরুদ্ধার করা ল্যাটেরাইট ব্লকগুলো বাড়ির সামনে বারান্দা তৈরি করে, যা কেরালার ঐতিহ্যবাহী বাড়ির পুরোনো ‘মুত্তামাস’-এর কথা মনে করিয়ে দেয়।

বিল্ডিংটিকে সংগীতের মতো ডিজাইন করা হয়েছে, যেখানে নোটগুলোর মধ্যে বিরতিগুলো নোটগুলোর চেয়ে বেশি গুরুত্বপূর্ণ, যেখানে নির্মিত স্থাপত্য থেমে যায় এবং মাঝে ফাঁকা জায়গাগুলো কথা বলে…

প্রকাশকাল: বন্ধন ১৬৩ তম সংখ্যা, মার্চ ২০২৪

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Scroll to Top