বাংলাদেশের ভূ-প্রকৃতি সমতল হলেও কিছু এলাকার বিস্তৃতি উঁচু-নিচু পাহাড়-টিলায়। মৌলভীবাজারের শাহবাজপুর তেমনি একটি পাহাড়ঘেরা জনপদ। ভূমি বৈচিত্র্যের কারণে এখানকার বাড়িঘরগুলো স্বাভাবিকভাবেই একটু আলাদা। বাড়ি থেকে বাড়ির দূরত্ব, ঢেউ খেলানো সংযোগ পথ- এ সবকিছুই গড়ে উঠেছে ভূমির প্রকৃতির ওপর নির্ভর করে। অবকাশ যাপনের জন্য এ অঞ্চলেই মো. তোবারক হোসাইন গড়ে তুলেছেন তাঁর নান্দনিক ডুপ্লেক্স বাড়ি। ‘অবকাশ বাড়ি’ নামের স্থাপনাটির স্থপতি রাজন দাশ। পাহাড়ি এলাকার বৈশিষ্ট্য, ভূমির প্রকৃতি ও সম্পূর্ণ দেশজ উপকরণ ব্যবহারের মাধ্যমে দেশীয় ধাঁচে নির্মাণ করেছেন অবকাশ যাপনের এই পরিকাঠামোটি।
স্থপতি রাজন দাশ সিলেটের মানুষ। শৈশব কাটিয়েছেন সিলেটে। মাঝে বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ে (বুয়েট) পড়াশোনা শেষে আবার ফেরেন শিকড়ের টানে। জন্মভূমি সিলেটের ভূ-প্রকৃতি, জলবায়ু, স্থানিক বৈশিষ্ট্য যাঁর আজন্ম পরিচিত। ভাষা, সংস্কৃতি, লোকাচরণের দিকটি মাথায় রেখে কাজ করেছেন সব সময়। স্থানীয় গ্রামীণ পরিবেশের সঙ্গে মিলিয়ে বিস্তার ঘটিয়েছেন বাড়ির নকশা চিন্তার। ডুপ্লেক্স এ বাড়িতে ঢুকতেই প্রথমেই পড়ে একটি খোলামেলা বারান্দা। ডানপাশে অতিথিদের জন্য সাজানো বসার ঘর। খানকিটা এগুলেই খাবার ঘর ও পারিবারিক পরিসর। সেখান থেকে বাইরের বাগানে যাওয়া যায় আবার ঢাল বেয়ে পুকুরে নামার ব্যবস্থাও রয়েছে। পারিবারিক বৈঠক থেকে দু’টি দরজা দিয়ে পাঁচ ধাপের ব্যবধানে দক্ষিণের বড় বারান্দা যেন নিসর্গের সঙ্গে অঙ্গাঙ্গি জড়িত। আমাদের গ্রামীন সংস্কৃতিতে বাড়ির পরিসরকে মোটাদাগে বৈঠকখানা (বাহির-বাটি) এবং অন্দরমহল (ভিতর-বাটি) এই দুই ভাগে বিবেচনা করা হয়। অনেক ক্ষেত্রেই বাড়ির সামনের উঠোনের সাথে লাগোয়া ‘টঙ্গীঘর’ বৈঠকখানা হিসেবে ব্যবহৃত হয়। রাজন দাশ এই বৈঠকখানাকে নিয়ে এসেছেন দ্বিগুন উচ্চতার কেন্দ্রিয় পরিসরে। তৈরী করেছেন ‘অন্তরাঙ্গিনা’ হিসেবে। দ্বিতীয়তলার পারিবারিক পরিসরের সঙ্গে রয়েছে এর দৃশ্যমান সংযোগ। ‘অন্তরাঙ্গিনা’র চতুর্দিকে সাজানো হয়েছ অন্য সব কক্ষ। ভবনের নকশা এবং চারপাশের ভূমিরেখার অদ্ভুত সম্মিলন মনে করিয়ে দেয় বিখ্যাত ভারতীয় স্থপতি চার্লস কোরিয়ার কথা। পাহাড়ি ভূমি ধরে ধাপে ধাপে নেমেছে ভবনের তল। এক তল থেকে আরেক তলে নামছে ছোট সিঁড়ি দিয়ে। পাশের আরেকটি আবার উঠে যাচ্ছে অন্য উচ্চতায়।

রাজন দাশ ছাত্রাবস্থায় গভীরভাবে অধ্যয়ন করেছেন আমাদের জাতীয় সংসদের মহান স্থপতি লুই আই কানকে। তাঁর অনেক লেখা পড়েছেন। ‘বস্তুর স্বরূপ ও প্রকৃতি’ নিয়ে আধুনিক দার্শনিক মতবাদ তাঁকে করেছে তুমুল আন্দোলিত। পুরোনো দালান সংরক্ষণের কাজ করতে গিয়ে শিখেছেন পুরোনো দিনের নির্মাণকৌশল, সিক্ত হয়েছেন চুন-সুরকির রসায়নে। ‘Even a brick wants to be something …’ লুই কানের অমর এই উক্তির ক্ষুদ্র একটি প্রতিধ্বনি শাহবাজপুরের এ সাধারণ কিন্তু নান্দনিক বাড়িটি। বহিরাঙ্গনে পলেস্তারাবিহীন উন্মুক্ত ইটের ব্যবহারে পুরো ভবনে প্রকাশ ঘটেছে সরল সৌন্দর্যের। বহিরাঙ্গন সরল হলেও অন্তর্দৃশ্য গভীর মনোযোগ দিয়ে অধ্যয়ন করার মতো। এখানেও করা হয়েছে লাল ইটের ব্যবহার। ইটের কারুকাজ আর সেই সঙ্গে ভবনের ফ্রেম-কাঠামোর কম্পোজিশন তৈরী করেছে মুগ্ধতা।
‘আমি কাজের ক্ষেত্রে ব্যবহার করি এ অঞ্চলের সহজলভ্য, সুলভ নির্মাণসামগ্রী। চকচকে, আমদানিনির্ভর, অতিব্যয়বহুল নির্মাণ উপকরণ পরিত্যাজ্য মনে করি।’ স্থপতির নিজের উক্তির সঙ্গে মিল রেখে তাঁর কাজের সমণ¦য় ঘটিয়েছেন। বাড়ি নির্মাণে সাধারণভাবে পরিচিত নির্মাণ উপাদান কংক্রিট, ইট, কাঠ, বাঁশ, কাচ এবং করোগেটেড শিটের ব্যবহার করা হয়েছে। ছাদের জন্য ব্যবহার করা হয়েছে টিন। টিনের নিচের ফলস সিলিং বাঁশের তৈরি। এমনকি মেঝেতে ব্যবহার করা হয়নি কোনো ধরনের টাইলস। লাল নীট সিমেন্টে সম্পন্ন হয়েছে মেঝের ফিনিশিং।
নিজের ডিজাইন চিন্তার পাশাপাশি ক্লায়েন্টের আর্থিক সামর্থ্যকে শ্রদ্ধার চোখে দেখেন তরুণ এ নির্মাতা। নির্মাণকৌশল এবং উপাদান পছন্দের ক্ষেত্রে অর্থনৈতিক ব্যাপারকেও গুরুত্ব দেওয়া হয়েছে। মাত্র দুজন নির্মাণ-কারিগর আর কিছু যোগালী নিয়ে বাড়িটি বানিয়েছে এবং ব্যয় হয়েছে ৯২৫ টাকা প্রতি বর্গফুট। যে কোন ধরনের অতিরিক্ত কারুকাজ পরিহার করা হয়েছে। জাঁকজমকপূর্ণ বহির্সজ্জার অবকাশ নেই। যা আছে এবং যা হচ্ছে তার একটা সরল প্রকাশই রয়েছে স্থাপনাটির অবয়বে। লোকস্থাপত্য বিবেচনায় এটাই আমাদের আর্থসামাজিক বাস্তবতার প্রতিফলন হওয়া উচিত।

এক নজরে ডুপ্লেক্স হাউস
স্বত্বাধিকারী: মো. তোবারক হোসাইন
স্থপতি: রাজন দাশ
অবস্থান: নান্দুয়া, পূর্ব শাহবাজপুর, বড়লেখা, মৌলভীবাজার
আয়তন: নয় কাঠা, ৬৪৮০ বর্গফুট
বাড়ির আয়তন: ৪৩১৬ বর্গফুট
মোট খরচ: ৪০ লাখ টাকা
নির্মাণের সমাপ্তি: ২০১৩ সালে
স্থপতির সাতকাহন
রাজন দাশের জন্ম সুনামগঞ্জের ছাতকের ধনপুর গ্রামে। বাবা দীপক রঞ্জন দাশ ও মা অনিমা দাশ। সিলেট সরকারি পাইলট বালক উচ্চবিদ্যালয়ে কেটেছে শৈশবের মধুর দিনগুলো। ২০০৪ সালে বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয় থেকে স্থাপত্যে গ্র্যাজুয়েশন শেষ করে কিছুদিন স্থাপত্য চর্র্চা করেছেন বেশ কয়েকটি প্রতিষ্ঠানে। এরপর ফিরে আসেন জন্মভূমি সিলেটের মাটিতে। ২০০৭ সালে সিলেটস্থ বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় লিডিং ইউনিভার্সিটির স্থাপত্য বিভাগে যোগ দেন। স্থাপত্য চর্চার শুরু থেকেই বড় কাজের পেছনে না ছুটে ছোট পরিসরে ভালো মানের স্থাপত্য সৃষ্টির সুযোগ খুঁজেছেন। সময় দিয়েছেন ছোট ছোট স্বপ্নকে সাজিয়ে তোলার কাজে। সিলেট ক্লাব ভবন, শ্রীমঙ্গলে ‘কুটুমবাড়ি’ রেস্তোরাঁ, মদন মোহন কলেজ প্রাঙ্গণে ‘শহীদ মিনার’, কবি নজরুল অডিটোরিয়ামের মুক্ত প্রাঙ্গণে বিদ্রোহী মঞ্চ – ‘অগ্নিশিখা’, জিন্দাবাজারে রেস্তোরাঁ ‘উন্দাল’ তাঁর মনোযোগের যথার্থ প্রমাণ। ‘উন্দাল’ রেস্তোরাঁর জন্য ২০০৯ সালে ICE-TODAY- AQUA PAINT Interior Design Award লাভ করেন। সম্প্রতি আরেকটি প্রজেক্টের জন্য ২০১৫ সালে বার্জার এক্সেলেন্স ইন আর্কিটেকচার অ্যাওয়ার্ডের জন্য প্রাথমিক মনোনয়নের তালিকায় ছিলেন।

রাজন দাশ লোকস্থাপত্য অনুসন্ধানী মানুষ। মধ্যবিত্ত আর নিম্নবিত্ত মানুষের জীবনাশ্রয় বা ঠাই কেমনতর হবে, তা নিয়ে কাজ করাই তাঁর অন্যতম কর্মলক্ষ্য। ছাত্রজীবন থেকেই স্থপতি লুই আই কানের চিন্তাধারায় গভীরভাবে প্রভাবিত। বৃটিশ বংশদ্ভূত ভারতীয় স্থপতি লরি বেকারের একলব্য-শিষ্য তিনি। বর্তমানে সিলেটের সুরমা পয়েন্টে নাগরী চত্বর, সিলেট কৃষি বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসে কৃষি প্রকৌশল অনুষদ ভবন ও অডিটোরিয়াম ভবনের নকশা নিয়ে কাজ করছেন। সম্রাট আকবরের ফতেহপুর সিক্রির একাংশের ছায়া অবলম্বনে গোলাপগঞ্জের একটি গ্রামে অবকাশযাপন কেন্দ্র ডিজাইন করছেন তিনি। স্থপতি রাজন দাশের ভাবনায় পরিসর নির্মাণের ক্ষেত্রে আমাদের আবহমান লোকস্থাপত্য, লোকসাহিত্য, মিথোলজি পথপ্রদর্শক হিসেবে কাজ করে। তাঁর অন্তঃনকশায় তাই লোকজ পরিসরের ধারাবাহিকতা আনার চেষ্টা দৃশ্যমান।
– স্থপতি খালিদ মাহমুদ
প্রকাশকাল: বন্ধন ৭০ তম সংখ্যা, ফেব্রুয়ারি ২০১৬