ভ্যাকেশন হাউস (Vacation House) বা বাগানবাড়ি যে নামেই ডাকা হোক না কেন, এ এক এমন বাড়ি, যেখানে স্থায়ীভাবে থাকার কোনো পরিকল্পনা নিবাসীদের নেই। সাধারণত জায়গাটা একটা চমৎকার প্রাকৃতিক পরিবেশে হয়ে ওঠে, যা শহর থেকে অনেকটাই দূরে। বছরের বিশেষ একটি সময় দীর্ঘদিন ধরে এই বাগানবাড়িতে পরিবারের সবাইকে নিয়ে কাটানো হয়। তাই এখানেই লিপিবদ্ধ হয়ে ভরে উঠতে থাকে মিষ্টিমধুর স্মৃতির খাতাগুলো। আপাতভাবে মনে হতে পারে এটা একটা পশ্চিমা রীতি। কেননা বাংলাদেশের প্রেক্ষিতে ভ্যাকেশন হাউসের বিশেষ ধারণা নেই। কিন্তু সচ্ছল পরিবারগুলোতে সেই আদিকাল থেকেই রয়েছে এর চল। এমনকি রবীন্দ্রনাথের সাহিত্যে দেখা মেলে মনের অসুখ সারাতে ডাক্তার বায়ুবদলের পরামর্শ দিতেন এবং তাতে বেশ কাজও হতো। তবে মধ্যবিত্ত বাঙালি সমাজে এমন সংস্কৃতি কম থাকার পেছনে দুটো মৌলিক কারণ থাকতে পারে। এক হলো, এ দেশের মানুষেরা একসঙ্গে নিজ বাড়িতে থাকার মধ্যে এতটাই স্বস্তিবোধ করে থাকেন যে আলাদা করে কোথাও বাড়ি বানিয়ে সেখানে ঘুরতে যাওয়াটা নেহাতই সময় ও অর্থের অপচয় বলে মনে করেন তাঁরা। তা ছাড়া ফলের মৌসুমে বা পরীক্ষার ছুটিতে দাদা, মামা, নানাবাড়িতে যাওয়ার ব্যাপারটা এখনো রয়ে গেছে, যেহেতু আবহমান কাল ধরে যৌথ পরিবারের রেশটা এখনো অনুপরিবারগুলো লালন করে চলেছে। ফলে ভ্যাকেশন হাউসের স্বাদটা মায়েরা সন্তানদের নিয়ে তাদের স্কুলের ছুটির সময়ে নিজের বাবার বাড়িতেই মিটিয়ে নিচ্ছেন। আরেকটি কারণ হলো, সাধ ও সাধ্যের মধ্যে বিস্তর ফারাক থাকায় অনেকে ইচ্ছে থাকলেও অর্থাভাবে এমন একটি বাড়ি বানিয়ে উঠতে পারেন না। তবে ইদানীং বেশ কিছু অনুঘটকের মাধ্যমে বাগানবাড়ির ধারণাটা বাঙালি সমাজে আসতে শুরু করেছে। এবং ব্যাপারটার মাঝে সত্যি বলতে পশ্চিমা কোনো প্রভাব নেই। বরং এই বাংলাদেশের সমাজব্যবস্থার বিবর্তনের সঙ্গে সঙ্গে ঐতিহ্যের সংমিশ্রণে যে দারুণ একটি মিথস্ক্রিয়া ঘটেছে, তার দরুনই এমনটি হচ্ছে। বাপ-মায়ের ভিটে বা গ্রামের বাড়িতে সামান্যের মধ্যে একটা আরামদায়ক আবাস তৈরিতে মজে উঠছেন আজকাল অনেকেই। আজকের প্রকল্পের গল্পটিও সে রকমই।
স্থপতি কাজী নাজমূল আনাম এশিয়া প্যাসিফিক বিশ্ববিদ্যালয় থেকে স্থাপত্যবিদ্যায় পড়াশোনা শেষ করে পাড়ি জমান ইংল্যান্ডে এবং সেখানেই বসবাস শুরু করেন। তাঁর ভাই এবং বাবা-মা সবাই দেশের বাইরেই থাকতেন বিধায় পারিবারিক জমিজমা দেশে পড়ে ছিল অযত্নে। এরপর জীবনে আসে খুব অনাকাক্সিক্ষত এক বাঁক। একই দিনে ক্যানসারে স্থপতি হারান চমৎকার একটি সম্পর্কে থাকা পিতা-মাতা দুজনাকেই। পিতা-মাতা অসুস্থ থাকাকালীনই সবাই দেশে ফেরেন। শোক কাটিয়ে উঠতে না-উঠতে দায়িত্ব চেপে বসে কাঁধে। এবং সেই প্রথমবারই তিনি পৈতৃক সম্পত্তি সম্পর্কে খোঁজখবর নেওয়া শুরু করেন। এই পর্যায়ে ঝিনাইদহের শৈলকুপার ছোট্ট এই জমিটা সম্পর্কে তিনি জানতে পারেন। তিনি শুনেছিলেন যে তাঁর দাদা নাকি ভীষণ বৃক্ষপ্রেমী একজন মানুষ ছিলেন। সব সময় তাঁর পেছনে দুজন মানুষ থাকত কেবল তাঁর গাছপালা দেখভাল করার জন্য। স্থপতি নিজেও শিশুকালে এই এলাকায় হরেক রকম ফলের গাছ দেখেছেন, যেগুলো বারো মাসব্যাপী ফলনের ওপর থাকত। কিন্তু এই যাত্রায় সেই জমির আগের চেহারা আর দেখা গেল না।

ঢাকা এখন স্থপতির মূল কর্মক্ষেত্র। এখানে বিশ্ববিদ্যালয় জীবনের স্থপতি বন্ধুদের সঙ্গে মিলে কাজ করছেন স্টুডিও মোনো নামক স্থাপত্যবিষয়ক একটা ফার্মে। ঢাকায় সস্ত্রীক ও নবজাত শিশু নিয়েই দিন কাটছে স্থপতির। কিন্তু কিছুদিনের জন্য শৈলকুপায় অর্থাৎ নিজ গ্রামের বাড়িতে এলে জমি থাকলেও মাথা গোঁজার জায়গাটুকু নেই। তাই সব মিলিয়ে এই আদিভিটেয় একটা ছাদের প্রয়োজনীয়তা তাঁর মধ্যে চড়াও হতে থাকে। একটা শোবার ঘর, রান্নাঘর, টয়লেটব্যস এতটুকু থাকলেই আপাতত চলবে এ রকমই একটা ভাবনা ছিল তাঁর। এই পরিকল্পনায় শামিল হলেন স্টুডিও মোনোর আরেকজন স্থপতি সানজিদ মাহমুদ। দুজনই ব্যক্তিগত জীবনে অত্যন্ত ঘনিষ্ঠ বন্ধুও বটে, যেহেতু তাঁরা একই বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীও ছিলেন। এই কারণে নিজের বাড়ি ডিজাইনের ক্ষেত্রে বন্ধুর অংশগ্রহণ থাকাটাই যেন স্বাভাবিক।
জমিসংলগ্ন একটা পুকুর আছে। এলাকায় তাঁর শুভাকাক্সক্ষীরা বুদ্ধি দিচ্ছিলেন যেহেতু জমির দাম বেশি, তাই পুকুরটা মাটিচাপা দিয়ে জমিটা সংরক্ষণ করাটাই বুদ্ধিমানের কাজ হবে। কিন্তু স্থপতিদ্বয় ভালোই জানেন এখানে গাছপালা বাঁচিয়ে রাখতে হলে এবং প্রাণ পরিবেশ অর্থাৎ যার মাঝে তিনি ও তাঁর পরিবারও পড়েন, এই সবাইকে টিকিয়ে রাখতে হলে বরং পুকুরটাকেই সুন্দর করে সাজিয়ে রাখতে হবে। এ জন্য তাঁরা সর্বপ্রথম পুকুরটাকেই সংস্কার করেন, যা নিঃসন্দেহে স্থপতিদের বিচক্ষণতার প্রমাণ।
এরপরে তাঁরা বাড়িটি নির্মাণের কাজে হাত দেন। শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত পুরো প্রক্রিয়াটা বেশ একটা রোমাঞ্চকর ব্যাপার ছিল। নানাবার নানাভাবে পরিকল্পনার রদবদল এবং বাজেটের আওতায় থাকার জন্য নানা রকমের চেষ্টা করতে করতে শেষ পর্যন্ত সুন্দর একটা সমাপ্তির দিকে এগোানো গেছে, সেটাই আসল প্রাপ্তি। ঢাকায় বসে ডিজাইন করে শৈলকুপায় টানা চার মাস থেকে ছাদ ঢালাই শেষ করেন স্থপতি। পরে তিন বছর ধরে সময় নিয়ে একটু একটু করে বাসাটিকে করে তুলেছেন পরিপূর্ণ।
বাড়িটি ডিজাইনের সময় স্থপতিদ্বয় কতগুলো উপাদানকে তাঁদের প্রধান হাতিয়ার হিসেবে নিয়েছিলেন। প্রথমত, তাঁরা চেয়েছিলেন বাড়িটা যেহেতু একটা বাগানের মধ্যে আছে, এই ভাবটা যেন অক্ষুণ্ণ থাকে। পাশাপাশি আলো যেন পর্যাপ্ত থাকে, সেটাও নিশ্চিত করতে হবে। এই জমিতে অনেক পুরোনো সুপারিগাছ আছে। ফলে বাগানে এলেই চোখ আপনা থেকেই ওপরে চলে যায়, যেহেতু এই গাছগুলো লম্বাটে (Vertical)। তখন রাতে চাঁদ, তারা আর দিনের নির্মল নীল আকাশের দিকে স্বয়ংক্রিয়ভাবেই আগন্তকের দৃষ্টি চলে যায়। তাই স্থপতিদ্বয় ভাবলেন বাসায় আলোটা ছাদ থেকে আনলেই ভালো মানাবে। তারা খেয়াল করেছেন, আশপাশে আত্মীয়স্বজনদের বাড়ি বন্ধ রেখে কিছুদিন পর তারা যখন ফিরে আসেন, তখন তাঁদের বাড়িঘর ড্যাম্প হয়ে যায়। যেহেতু এটা বাগান, তাই জায়গাটা অনেক আর্দ্র। যেকোনো প্রাণের মতোই যে বাড়ি অনেক প্রাণকে ধরে রাখে, সে নিজেও এক বিরাট প্রাণ। কাজেই আমাদের মনে রাখতে হবে, একটি বাড়িও কিন্তু দম নেয়। একটা বাড়ি যে আসলেও দম নেয় আলো-বাতাসের মধ্য দিয়ে, এমন কথাটি স্থপতির কাছ থেকে শুনে সত্যি খুব ভালো লেগেছে। কারণ এই সামান্য ব্যাপারটা নিশ্চিত করতে পারলেই বাড়ি সই (বন্ধু) হয়ে উঠবে। শুধু এই কারণেই তাঁরা সিদ্ধান্ত নিলেন এই বাড়ির নাকটাকে একটু বড় করে দিতে হবে, যাতে সে পর্যাপ্ত পরিমাণ দম নিতে পারে এবং এতে করে বাড়িঘর ড্যাম্প হওয়ার আশঙ্কাটাও আর থাকবে না। একই সঙ্গে বাড়িতে বসবাসরত মানুষেরাও দম নিতে পারবেন। এমন ধারণা থেকেই স্থপতিদ্বয় জালি দেওয়া দেয়ালের কথা ভাবেন। কিন্তু একতলা ভবনে নিরাপত্তাজনিত ব্যাপারটা থাকায় এই জালিটা তারা ইট দিয়েই বানানোর সিদ্ধান্ত নেন। আলোয় সমৃদ্ধ বাতাসে ঠাঁসা এই বাসায় স্থপতির স্ত্রী এসে নিজেকে সুস্থ বোধ করেন। তার মানে কেবল ভালো খাওয়া ও কাজ করা নয়, বরং একটা মনোরম পরিবেশে একটা সুন্দর বাড়িতে থাকাও মানুষের মানসিক স্বাস্থ্য ঠিক রাখার অন্যতম একটি বিষয়। এই বাস্তব সত্যকে অস্বীকারের যে আর কোনো সুযোগ নেই শহরের ঘুপচি ঘরে থাকা মানুষের থেকে, তা আর কেইবা ভালো জানে।

যদিও বাড়িটি পুরোটা মনমতো করা যায়নি, যেহেতু স্থাপত্য মূলত বড় শহরকেন্দ্রিক। ফলে স্থপতি তাঁর দরকারমতো নির্মাণকর্মী পাননি। এ জন্য অনেক কিছু যেমন মনমতো হয়নি তেমনই অনেক কিছুতে নব্যতা প্রবর্তন (Innovation) করে কাজটি করতে হয়েছে, সেদিক থেকে নিঃসন্দেহে কাজটি ভীষণই উৎসাহব্যঞ্জক। যে কারণে সাধ-সাধ্য এবং সুবিধা ও বাজেট সব মিলিয়ে মানানসই একটা দিকে স্থপতিদের সিদ্ধান্ত নিয়ে এগোতে হয়েছে, তাই হয়তো গ্যাসের ভাঁজ করা স্ক্রিন করতে চাইলেও শেষমেশ সেখানে অ্যালুমিয়ামের খড়খড়ি বানিয়ে আপস করতে হয়েছে। খুব চমকদার দেখতে না হলেও কাজটা যত্নে করা বলে সেখানে নিজের বাড়ির ভাবটা কিন্তু ঠিকই প্রকাশ পায়।
বাড়িটির সামনে রাস্তা এবং পেছনে পুকুর রয়েছে। বাড়িসংলগ্ন পুকুর বলে সে প্রান্তে একটা ছোট ঘাট অতি যত্নের সঙ্গে ডিজাইন করা হয়েছে। গ্রামবাংলায় যেমন করে রান্নাঘরের সঙ্গে পুকুরের সংযোগ থাকে, তেমনি করেই স্থপতি নিজ বাড়ির রান্নাঘরের সঙ্গেও পুকুরের খুব ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক রেখেছেন। স্থপতি ও তাঁর জীবনসঙ্গী দুজনেই যেহেতু পুকুর, পানি, সাঁতার কাটা, মাছ ধরা আর জোছনা রাতকে সম্পূর্ণরূপে উপভোগ করতে পছন্দ করেন, তাই এই পুকুরঘাটটি তাঁদের বাড়ির প্রাণকেন্দ্রে পরিণত হয়ে উঠেছে। এই প্রাকৃতিক পরিবেশকে যেহেতু বাড়িটি উদযাপন করছে, সেই কারণেই তাঁদের বন্ধুদের কাছেও বাড়িটি আরও আকর্ষণীয় হয়ে উঠেছে।
বাড়ির নির্মাণসামগ্রীর ক্ষেত্রে বাংলার চিরায়ত ইট প্রধান উপাদান হিসেবে বিবেচিত হয়েছে। স্থপতিবৃন্দ বরাবরই ম্যাটেরিয়ালকে স্পষ্ট বা প্রকাশ্য রাখতে চান, যাতে করে স্বচ্ছতা ও শ্রদ্ধা বজায় থাকে। এর সঙ্গে নান্দনিকতার বিষয়টিও জড়িত। ফলে স্থপতি সাধারণ ইট এবং সংক্রিয় ইটে এক অদ্ভুত সংমিশ্রণের মধ্য দিয়ে নির্মাণ প্রণালি চিন্তা করেছেন, যা সাশ্রয়ী। তিনি এক স্তরে দেশি ইট দিয়েছেন এবং আরেক স্তরে সংক্রিয় ইট দিয়েছেন। অর্থাৎ, দশ ইঞ্চি দেয়ালের এক স্তর পাঁচ ইঞ্চি ইট সাধারণ ইট আরেক স্তর পাঁচ ইঞ্চি ইট সংক্রিয় ইট দিয়ে তৈরি। প্রাপ্যতা জটিলতায় সংক্রিয় ইট জোগাড় করতে দীর্ঘ সময় অপেক্ষাও করতে হয়েছে।
নির্মাণকর্মী নিয়ে জটিলতা ছিল বরাবরই। কারণ প্রত্যন্ত এলাকায় সাধারণত কেউই পেশাদার নির্মাণশিল্পী নন। মৌসুমি নানা কাজ করে তাঁরা জীবিকা নির্বাহ করে। সহজ কথায়, তাঁরা দিনমজুর। মূলত কৃষিকাজ করে আর ধান কাটার পর কাজ না থাকলে তখন রাজমিস্ত্রির কাজ করে। অথচ ভবন নির্মাণে দরকার পড়ে বেশ নিখুঁত দক্ষতাসম্পন্ন কর্মীর।

স্থপতিদ্বয় সেই চ্যালেঞ্জটা নিয়ে নিজেরা পাশে দাঁড়িয়ে তাঁদের শিখিয়েছেন। এ নিয়ে বেশ ধকল পোহাতে হয়েছে সন্দেহ নেই। একই সঙ্গে ড্রয়িংয়ের ইটের সাইজ এবং বাস্তবের ইটের সাইজের সামঞ্জস্য না থাকায় সাইটে বসে পুনরায় প্ল্যানকে সাজাতে হয়েছে। ফলে ডিজাইন করা থেকে নির্মাণ পর্যন্ত ভ্রমণটা খুব একটা মসৃণ ছিল না। হয়তো এই কারণে কাজ শেষ হলে তৃপ্তিটাও আসে অনেক বেশি মাত্রায়। আমি নিশ্চিত যে এই আনন্দবোধটাই একজন স্থপতিকে আরও চ্যালেঞ্জ নিতে উৎসাহিত করে। এ যেন নিজেকে চ্যালেঞ্জ করার জন্য আদর্শ এক ময়দান।
ভবনের প্রবেশমুখে একটা বড় বারান্দা আছে, যেটা একই সঙ্গে সিঁড়ির ল্যান্ডিং হিসেবেও কাজ করেছে। আর এর ঠিক পাশেই একটা জায়গা আছে, যেন এখানে যাঁরা গাছপালার দেখাশোনা করেন বা মাটি নিয়ে কাজ করেন, তাঁরা ফয়ার স্পেসটায় বসার জায়গা পান। তা ছাড়া স্থপতির সঙ্গে বাড়ির বাইরে এটুকু জায়গায় আলাপ-আলোচনার জন্যও তাঁরা সুযোগ পান। এতে বাড়ির ভেতরের মানুষের প্রাইভেসিও রক্ষা হলো। এরপরে লিভিং রুমে আসা যায়, সেখান থেকে রান্নাঘর এবং টয়লেট ও বেডরুমে প্রবেশ করা যায়। এই সংযোগস্থলে ছাদের ওপর থেকে আসছে স্বর্গীয় আলো। দিন কিংবা রাতে প্রকৃতির রদবদলটা বেশ চমৎকারভাবে উপলব্ধি করা যায় এখানে। স্থপতি জানান, জোছনা রাতে ঘরের আলো নিভিয়ে দিলে এই ছাদের আলোয় নাকি ঘর উজাড় হয়ে থাকে।
বেশ এইটুকু ছোট্ট সুন্দর জায়গা কিন্তু সেগুলোতে আলো-বাতাস এমনভাবে আনা হলো যে সত্যি ছোট্ট বাড়িটা আর ছোট্ট থাকল না, বরং বিশাল অনুভূতি দেওয়ার মতো একটা জায়গায় রূপান্তরিত হলো। তা ছাড়া শহরের অলিগলিতে বাড়ি না হয়ে উঁচু উঁচু গাছপালা আর পুকুর ছিল বলেই যে বাড়িটা তার যথাযথ মর্যাদা পেয়েছে তা নিয়ে সন্দেহের আর অবকাশ নেই।
৭৯৪ বর্গফুটের ছোট্ট এই পৈতৃক সম্পত্তি বিদেশবিভুঁইতে কাটানো স্থপতি মায়া বলে দাবি করছেন। আসলেও কি জীবনে এরকম কিছু ঘটবে যার দরুন উনি দেশে বসবাস শুরু করে দেবেন- এসব কেউ কি জানত! অতঃপর এই মায়ার শিকড় গজিয়ে যায় এবং নিজেকে বটগাছ মনে হতে শুরু করে যার নিচে এসে অনেকে আশ্রয় নেয়। এ কথাগুলো স্থপতির নিজের। বেশ বুঝতে পারলাম এলাকার অনেক সুবিধাবঞ্চিত মানুষের মাথার ছায়া হতে শুরু করেছেন তিনি। এরকমই কিন্তু হয়। একজন এগিয়ে থাকা মানুষকে ধরেই অনেকে সামনে এগিয়ে যেতে থাকে।
এই ছোট্ট সুন্দর বাড়িটা শেষমেশ একটা আরামদায়ক স্বস্তির আভাস দেয়। জালির মধ্য দিয়ে পরিশুদ্ধ হয়ে আসা আলোটা বেশ আদরমাখা ও নম্র। এর দরুন জায়গাটা বেশ ধ্যানস্থ এবং শান্তিপূর্ণ হয়ে ওঠে। বাড়িতে বসবাসরত মানুষজনের দেহের সঙ্গে যেন বাড়ির ভেতরের ও বাইরের স্পেসের একটা সাক্ষাৎ-সম্পর্কের সৃষ্টি হয়, সত্যি বলতে স্থাপত্য সেই চেতনাকে কেন্দ্র করে কাজ করে। একটি ভবনও একটি জীবিত দেহ মাত্র। এর যে নিজস্ব অভিজ্ঞতা, যে স্পেসগুলো সরব এবং যেগুলো নীরব, যেগুলো অনধিকারচর্চা করছে এবং যারা কথাহীন হয়ে আছে, এগুলো যেমনি করে একজন মানুষের গুণাগুণ ঠিক তেমনি করেই একটি ভবনের বেলায়ও এর ভিন্নতা নেই। ফলে এর মাঝেই শেওলা গজিয়ে উঠবে না তো আর কোথায় উঠবে! বাতাসের আর্দ্রতা ইটের গায়ে সময়ের চিহ্ন বয়ে নিয়ে যাবে সতত। সূর্য যেমন করে গাছের সাদা কিনারগুলোকে রঞ্জিত করে তোলে, একজন মানুষ যেমন সময়ের সঙ্গে সঙ্গে প্রজ্ঞাবান হতে পারে এবং যার প্রমাণস্বরূপ তাঁর গায়ে পড়ে অনেক অভিজ্ঞতার রেখা, তেমনই করেই স্থপতির মতে একটি বাড়িও সময়ের সঙ্গে সঙ্গে এভাবে নিজের মাঝে একটা ভারিক্কি নিয়ে আসতে সক্ষম হয়, পুষ্ট হয়। এভাবেই সময়ের তালে তালে যত হাসি, যত ফিসফাস এই বাড়িকে ঘিরে, এটাই-ই যে তার বেঁচে থাকার মূল রসদ।

বেডরুমে নাক বাড়িয়ে দেওয়া আছে অর্থাৎ চোঙা হয়ে বেরিয়ে এসেছে একটা আয়তক্ষেত্র, ওদিকে পূর্ব। চাঁদ আর সূর্য দুজনাকেই দেখা যায়। এখানে পুকুর আর সব গাছপালাও দেখা যায় নির্মোহে। বৈদ্যুতিক বাতি বন্ধ রাখলে এই ছোট্ট জঙ্গলের ছোট্ট বাড়িটা যে আলোকিত হয়ে ওঠে সমগ্র অস্তিত্বকে উদযাপনের জন্য, এটাই এক অসম্ভব প্রাপ্তি। সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়ের ‘ছবির দেশে কবিতার দেশে’ বইটি থেকে মনে পড়ে পিয়ের এমানুয়েলের সেই কবিতাটি-
রক্তের মধ্যে এক তোলা ভালোবাসা
আত্মার মধ্যে এক বিন্দু সত্য
মাত্র কয়েক দানা খুদ, খুব শীতের একটি দিনে
একটি চড়াই পাখির বাঁচার জন্য যে-টুকু দরকার
তোমরা কি ভাবো, পৃথিবীর মহত্তম সন্তদের ওজন
এর চেয়ে বেশি?
– সুপ্রভা জুঁই
স্থপতি ও লেখক
ছবি: স্থপতি কাজী নাজমূল আনাম
প্রকাশকাল: বন্ধন ১৪১ তম সংখ্যা, মে ২০২২