প্রাচীন প্রযুক্তির বাংলাদেশের ইট শিল্প কালো ধোঁয়াসহ বহুমুখী দূষণের বৃহৎ উৎস। ইট তৈরিতে এখন ব্যবহৃত হচ্ছে কম পরিবেশ দূষণ ও জ্বালানিনির্ভর পরিবেশবান্ধব বেশ ক’টি প্রযুক্তি। এর মূল লক্ষ্য উন্নতমানের ইট তৈরি করা। সনাতনী ও আধুনিক প্রযুক্তি সমৃদ্ধ পরিবেশবান্ধব ইটভাটা নিয়ে ন্যাশনাল ব্রিক অ্যাডভাইজারি কমিটির সদস্য এবং বাংলাদেশ প্রকৌশল ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের (বুয়েট) কেমিকৌশল বিভাগের অধ্যাপক ড. এজাজ হোসেনের সাথে আলাপচারিতার পর লিখেছেন সারোয়ার কবির
নগরায়ণ ও নগর সম্প্রসারণের সাথে সাথে নির্মিত হচ্ছে নতুন নতুন ভবন। ভবন ছাড়াও অন্যান্য অবকাঠামোগত নির্মাণের প্রয়োজনীয়তা দেখা দিচ্ছে। বলাবাহুল্য, বাংলাদেশে নির্মাণ সামগ্রীর তালিকায় ইটের চাহিদা বেড়েছে বহুগুণ। আর চাহিদার সাথে সাথে দেশের সর্বত্র গড়ে উঠছে ইটের ভাটা। আসছে শুষ্ক মৌসুম। শুরু হবে সারা দেশের ইটভাটাগুলোতে ধুমসে ইট তৈরির কাজ। শুষ্ক মৌসুম এলেই ইটভাটাগুলো পুরোদমে উৎপাদনে চলে যায়। এ সময় ব্যস্ততা চোখে পড়ে ইটভাটাগুলোয়। দূর থেকে দেখা যায় অগণিত ইটভাটার চিমনি দিয়ে কালো ধোঁয়া বের হওয়ার দৃশ্য। এই ধোঁয়ার কারণে ইটভাটার পাশ দিয়ে চলাই দায়। মনে হয় দম বন্ধ হয়ে আসছে। রাজধানী ও এর আশপাশে অবস্থিত ইটভাটাগুলো ঢাকা শহরের বাতাস দূষণের জন্য শতকরা ৩৫ ভাগ দায়ী। প্রতিবছর এ ইটভাটাগুলো থেকে ৮ মিলিয়ন টন কার্বন ডাই-অক্সাইড নির্গমন হচ্ছে। উদ্গিরণ হচ্ছে অন্যান্য ক্ষতিকর গ্যাসও। এ দেশের ইট শিল্প সনাতনী পদ্ধতির, যা দেড়শ’ বছরেরও বেশি পুরনো। গত কয়েক দশকে এ শিল্পের প্রবৃদ্ধি বেড়েছে ৫ দশমিক ৩ শতাংশ। সনাতনী ইটভাটাগুলো থেকে বছরে যে পরিমাণে কার্বন নিঃসরণ হয় তা অব্যাহত থাকলে ২০১৪ সাল নাগাদ এর পরিমাণ দাঁড়াবে প্রায় ৯ কোটি টন।

সরকারি হিসাব অনুযায়ী, দেশে ইটখোলার সংখ্যা চার হাজার ৫১০। এর মধ্যে অবৈধ (পরিবেশগত ছাড়পত্র নেই) এক হাজার ১৯৯টি। এসব ইটখোলায় প্রতিবছর পোড়ানো হয় তিন হাজার ২৪০ কোটি ইট। প্রতি হাজার ইটের জন্য কাঠ পোড়াতে হয় আট থেকে ১০ মণ। তবে বাংলাদেশ ইট প্রস্তুতকারী মালিক সমিতি এবং সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিদের মতে, দেশে ছোট-বড় মিলিয়ে ইটখোলার সংখ্যা প্রায় ছয় হাজার। এসব ইটখোলার প্রতিটিতে উৎপাদন বছরে গড়ে ৭৫ লাখ ইট। এক চিমনি বা সিঙ্গেল সেকশনবিশিষ্ট ছোট একটি ইটভাটায় প্রতি মৌসুমে ইট পোড়ানো হয় ৩০ থেকে ৩২ লাখ পর্যন্ত। আর ডবল সেকশন বা দুই চিমনিবিশিষ্ট ইটভাটায় প্রতি মৌসুমে ইট পোড়ানো হয় ৭০ লাখেরও বেশি।
বাড়ছে বায়ুদূষণ
পরিবেশ বিশেষজ্ঞদের মতে, দেশের পরিবেশ দূষণের কয়েকটি স্তরের মধ্যে ইটভাটা অন্যতম। সনাতনী পদ্ধতির ইটভাটায় ইট পোড়ানোর ফলে বাতাসের সঙ্গে কার্বন ডাই-অক্সাইডের মিশ্রণে ব্যাপক হারে বায়ুদূষণ ঘটছে। রাজধানী ঘিরে অপরিকল্পিত ও অবৈধভাবে গড়ে ওঠা কয়েক শ’ ইটভাটা থেকে নির্গত কালো ধোঁয়া ভয়াবহভাবে পরিবেশ দূষণ করছে। ফলে ক্রমেই হুমকির মুখে পড়ছে জনস্বাস্থ্য ও জীববৈচিত্র্য। বুয়েটের গবেষণা মতে, দেশের মোট বায়ুদূষণের ৩৫ ভাগই হচ্ছে ইটভাটা থেকে। ভাটা থেকে নির্গত ধোঁয়ার সঙ্গে কার্বন পার্টিকেল, সালফার, নাইট্রোজেনসহ অন্যান্য রাসায়নিক উপাদান মিশ্রিত থাকে। ইটভাটা থেকে নির্গত ধোঁয়ার আণবিক কণা মানবদেহের জন্য মারাত্মক ক্ষতিকর। এসব বস্তুকণার পরিমাণ শীতকালের ১২০ দিন আরো বেশি থাকে। বাতাসে এর পরিমাণ বৃদ্ধি পেলে তা মানুষের অ্যাজমাসহ নানা ধরনের জটিল রোগ সৃষ্টি করে।
বিশিষ্ট চিকিৎসক প্রফেসর একিউএম সিরাজুল ইসলাম ও চট্টগ্রামের সাবেক সিভিল সার্জন ডাক্তার খুরশিদ জামিল চৌধুরী জানান, ইটভাটার কালো ধোঁয়ার কারণে সাধারণ মানুষ বিভিন্ন রোগে আক্রান্ত হচ্ছে। নিউমোনিয়া, ব্রঙ্কাইটিস, হৃদরোগ, শ্বাসকষ্ট, চর্মরোগ, লিভার ও কিডনি অকেজো হওয়াসহ মূত্রথলি ও খাদ্যনালির ক্যান্সারের মতো মারাত্মক সব রোগ ছড়িয়ে পড়ছে। শিশু ও মহিলাদের অ্যাজমা, ফুসফুসের ক্যান্সারসহ বিকলাঙ্গ শিশুর জন্ম হওয়ার আশঙ্কা থাকে। এ ছাড়া ভাটায় নির্গত ধোঁয়ায় নাইট্রোজেন ও সালফার ডাই-অক্সাইড মিলে ‘ওজোন’ নামে এক ধরনের গ্যাস তৈরি করে, যা পাতাজাতীয় ফসল ও সবুজ উদ্ভিদের সরাসরি ক্ষতি করে। গাছের সবুজ পাতা কুঁকড়ে যাওয়াসহ অসংখ্য ছিদ্র সৃষ্টি হয়। এতে গাছের খাদ্য গ্রহণ ক্ষমতা কমে যায় এবং একসময় মারা যায়।

কমছে আবাদি জমি ও কৃষি উৎপাদন
শুধু ইটভাটার কারণে প্রতিবছর প্রায় ৩০ হাজার হেক্টর কৃষি ও পাহাড়ি জমি কমে যাচ্ছে। ইট প্রস্তুতের জন্য ফসলি জমির উপরের অংশের ১ থেকে দেড় ফুট পর্যন্ত মাটি কেটে নিয়ে ভাটায় জমানো হয়। ইটখোলায় ব্যবহার করা মাটির অধিকাংশই এঁটেল-দোআঁশ ও বেলে-দোআঁশ (ফসলি) মাটি। আর ফসলের পুষ্টি জোগায় উপরের ৬ ইঞ্চি মাটি। জমির উর্বরাশক্তিসম্পন্ন মাটি কেটে নেওয়ার ফলে সে জমিতে ফসল ফলে না। প্রকৃতির নিয়মে পলি জমে এক ফুট ফসলি ও উর্বর মাটি তৈরি হতে ৩৫ থেকে ৪০ বছর সময় লাগে। আবার এক বিঘা পরিমাণ জমির এক ফুট মাটি কেটে নিলে পরবর্তী সময়ে বৃষ্টিতে আশপাশের ৭-৮ বিঘা জমির উপরের ১ থেকে ২ ইঞ্চি মাটি ধুয়ে আসে। এতে মাটির উৎপাদন শক্তি কমে যায়। ভূমির উপরি অংশের এক থেকে দেড় ফুট মাটি কেটে নিয়ে ইট প্রস্তুত করা হয়। দেশে ছোট-বড় প্রায় ছয় হাজার ইটখোলায় উৎপাদন হয় বছরে সাড়ে চার হাজার কোটি ইট। গড় মানের সাড়ে ৯ ইঞ্চি দৈর্ঘ্য, সাড়ে চার ইঞ্চি প্রস্থ ও তিন ইঞ্চি পুরুস্লির একেকটি ইটে মাটি লাগে তিন কেজি থেকে সাড়ে তিন কেজি। গড়ে তিন কেজি ধরলেও সাড়ে চার হাজার কোটি ইটে মাটি লাগে বছরে সাড়ে ১৩ হাজার কোটি কেজি বা সাড়ে ১৩ কোটি টন, যার পুরোটাই পুড়ে লাল হয়ে যায়। কৃষিবিদ ও মৃত্তিকা গবেষকদের হিসাব বলছে, ইটখোলা যে পরিমাণ ফসলি মাটি ধ্বংস করছে, তা বন্ধ হলে বছরে অন্তত ৫০ লাখ টন খাদ্যশস্য উৎপাদন বাড়ত। ছয় হাজার ইটখোলার দখলে রয়েছে (প্রতিটি গড়ে সোয়া আট একর) প্রায় ৫০ হাজার একর আবাদি জমি। ইউএনডিপির আওতাধীন স্টকহোমের এনভায়রনমেন্ট ইনস্টিটিউটের গবেষক ড. প্যাট্রিক ও ড. লিসার তাদের গবেষণাপত্রে উল্লেখ করেছেন, ইটখোলাসহ সংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠানগুলোর বায়ুদূষণের কারণে বাংলাদেশ বছরে দশমিক চার বিলিয়ন ইউএস ডলার (প্রায় ২৮০ কোটি টাকার ধান, গম, সয়াবিন ও আলু) সমমূল্যের কৃষি ফসল উৎপাদন থেকে বঞ্চিত হচ্ছে।
বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের পরিবেশবিজ্ঞান বিভাগের অধ্যাপক ড. এমএ সাত্তারের তত্ত্বাবধানে করা এক গবেষণা প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, ইটখোলার নির্গত ধোঁয়ায় নাইট্রোজেন ও সালফার ডাই-অক্সাইড মিলে ওজোন নামের গ্যাস তৈরি করে, যা পাতাজাতীয় ফসলের সরাসরি ক্ষতি করে। পাতা ফুটো করে দাগ দাগ হওয়াসহ গাছকে রোগাক্রান্ত করে ফেলে। এতে গাছ দুর্বল হয়ে পড়ে ও প্রয়োজনীয় খাবার শোষণে ব্যর্থ হয়। ফলে ফসল আকারে ছোট হয়, উৎপাদন কমে যায় অন্তত ১৫ থেকে ২০ শতাংশ। কৃষি ও পরিবেশের দিক বিবেচনায় নিয়ে পৃথিবীর বহু দেশ মাটি পুড়িয়ে ইট উৎপাদন বন্ধ করেছে। অথচ অবৈজ্ঞানিক প্রযুক্তিতে বাংলাদেশে ইট উৎপাদন বাড়ছেই।
সনাতন পদ্ধতির ইটভাটায় উর্বর মাটি (টপ সয়েল) ইটের কাঁচামাল হিসেবে ব্যবহৃত হচ্ছে। ভাটার মাটি সংগ্রহের ফলে আবাদি জমি ছোট ছোট খালে পরিণত হচ্ছে। ইট পোড়ানোর জন্য ব্যবহৃত চুল্লির জায়গাটুকু সম্পূর্ণ অনাবাদি হয়ে পড়ছে। বিশ্বের অন্যান্য দেশে ইটখোলায় মাটি সংগ্রহের আগে ফসলি জমির ২-৩ ফুট উর্বর মাটি স্থানান্তর করে স্ত‚প করে রাখা হয়। ইট তৈরির জন্য প্রয়োজনীয় মাটি নেওয়া শেষ হলে স্ত‚প দিয়ে পুনরায় সেই জমির মাটি ভরাট করা হয়। ফলে সেই সব দেশে ইট তৈরি হলেও কৃষিজমির উপর তেমন কোনো প্রভাব পড়ে না। তা ছাড়া ইছামতীর ওপারে ভারত ৫২টি ইটখোলার জন্য নদী থেকে মাটি তুলে ইট বানাচ্ছে। বাংলাদেশের ইটভাটাগুলোয় যদি (সরকারের অনুমতি সাপেক্ষে) নদী থেকে ড্রেজারের সাহায্যে এঁটেল মাটি তুলে ইট তৈরি করা হয়, তা হলে নদী খননও হবে, আবার প্রস্তুতকৃত ইট রপ্তানির মাধ্যমে বৈদেশিক আয়ও বাড়বে।

আছে আইন, নেই প্রয়োগ
- ইট পোড়ানো (নিয়ন্ত্রণ) আইনটি ১ জুলাই, ১৯৮৯ কার্যকর হয়।
- এই আইন মোতাবেক
- লাইসেন্স ব্যতীত কোনো ব্যক্তি ইটের ভাটা স্থাপন করতে পারবে না বা ইট প্রস্তুত বা ইট পোড়াতে পারবে না।
- জেলা প্রশাসক কর্তৃক মনোনীত একজন প্রতিনিধি, যিনি অতিরিক্ত জেলা প্রশাসকের নিম্নে হবেন না, উপজেলা স্বাস্থ্য প্রশাসক, পরিবেশ অধিদপ্তরের কর্মকর্তা বা যেখানে পরিবেশ অধিদপ্তরের কর্মকর্তা নেই সেখানে বন কর্মকর্তা এবং সংশ্লিষ্ট এলাকার ইউনিয়ন পরিষদ চেয়ারম্যান সমন্বয়ে এই ধারার উদ্দেশ্য পূরণকল্পে একটি তদন্ত কমিটি থাকবে।
- কমিটির প্রতিবেদন প্রাপ্তির পর জেলা প্রশাসক ক্ষেত্রমতো দরখাস্তকারীকে বিধিতে নির্ধারিত পদ্ধতিতে লাইসেন্স প্রদান করবেন।
- ইট পোড়ানোর জন্য প্রদত্ত লাইসেন্স, তা প্রদানের তারিখ হতে ৭ বছরের জন্য বৈধ থাকবে, তবে উক্ত মেয়াদের মধ্যে লাইসেন্সপ্রাপ্ত ব্যক্তি যদি এই আইনের কোনো বিধান বা তদধীন প্রণীত কোনো বিধি বা লাইসেন্সে উল্লিখিত কোনো শর্ত লঙ্ঘন করেন, তা হলে জেলা প্রশাসক উক্ত লাইসেন্স বাতিল করতে পারবেন।
- উপজেলা সদরের সীমানা হতে তিন কিলোমিটার, সংরক্ষিত, রক্ষিত, হুকুম দখল বা অধিগ্রহণকৃত বা সরকারের নিকট ন্যস্ত বনাঞ্চল, সিটি কর্পোরেশন, মিউনিসিপ্যালিটি, আবাসিক এলাকা ও ফলের বাগান হতে তিন কিলোমিটার দূরস্লির মধ্যে কোনো ইটের ভাটা স্থাপন করার লাইসেন্স প্রদান করা যাবে না এবং এই ধারা কার্যকর হওয়ার অব্যবহিত পূর্বে উক্ত সীমানার মধ্যে কোনো ইটের ভাটা স্থাপিত হয়ে থাকলে সংশ্লিষ্ট লাইসেন্সগ্রহীতা, সরকার কর্তৃক সরকারি গেজেটে প্রজ্ঞাপন দ্বারা এতদুদ্দেশ্যে নির্ধারিত সময়সীমার মধ্যে, তা যথাযথ স্থানে স্থানান্তর করবেন, অন্যথায় সংশ্লিষ্ট লাইসেন্স বাতিল হয়ে যাবে৷
- জ্বালানি কাঠ দ্বারা ইট পোড়ানো নিষিদ্ধ। কোনো ব্যক্তি ইট পোড়ানোর জন্য জ্বালানি কাঠ ব্যবহার করবেন না।
- লাইসেন্স ব্যতীত ইটের ভাটা স্থাপন করা হয়েছে বা হচ্ছে, এমন অবস্থায় জেলা প্রশাসক বা জেলা প্রশাসক কর্তৃক ক্ষমতাপ্রাপ্ত কর্মকর্তা বা বন কর্মকর্তা বা পরিবেশ অধিদপ্তরের কর্মকর্তা ইটের ভাটায় প্রাপ্ত সমুদয় ইট, সরঞ্জামাদি এবং অন্যান্য মালপত্র আটক করতে পারবেন।
কোনো ব্যক্তি এই আইনের কোনো বিধান বা তদধীন প্রণীত কোনো বিধি বা লাইসেন্সের কোনো শর্ত লঙ্ঘন করলে তিনি অনধিক এক বছরের কারাদন্ড বা অনধিক পঞ্চাশ হাজার টাকা অর্থদন্ড বা উভয় দন্ডে দন্ডনীয় হবেন এবং অপরাধ বিচারকালে আদালত যদি এই সিদ্ধান্তে উপনীত হয় যে, আটককৃত ইট ও জ্বালানি কাঠ বাজেয়াপ্তযোগ্য, তা হলে আদালত উক্ত ইট ও জ্বালানি কাঠ বাজেয়াপ্ত করার নির্দেশ দেবে।

ইট পোড়ানো (নিয়ন্ত্রণ) আইনে ইট পোড়াতে কাঠ ব্যবহার সম্পূর্ণ নিষিদ্ধ, এমনকি বায়ুদূষণকারী উচ্চ সালফারযুক্ত কয়লা ব্যবহারের উপরও নিষেধাজ্ঞা রয়েছে। আইন অমান্যকারীদের এক বছরের কারাদন্ড অথবা ৫০ হাজার টাকা জরিমানার বিধান রয়েছে। কিন্তু এসব আইন শুধু কাগজে-কলমেই সীমাবদ্ধ। দেশের অধিকাংশ ইটভাটার প্রধান জ্বালানি কাঠ ও ভারতের মেঘালয় থেকে আমদানি করা সালফারযুক্ত নিম্নমানের কয়লা। এই কয়লা পোড়ালে ৭ থেকে ১০ শতাংশ সালফার নির্গত হয়, যা পরিবেশের জন্য ক্ষতিকর। এ ছাড়া আগুনের তাপমাত্রা বাড়াতে ও ভারতীয় কয়লার পাশাপাশি শত শত মণ টায়ার, প্লাস্টিক ও রাবারের টুকরা পোড়ানো হয়। এ ছাড়া নিয়ম অনুযায়ী ১২০ ফুট উচ্চতাসম্পন্ন স্থায়ী চিমনিও নেই অনেক ভাটায়। এখনও ২৫-৩০ ফুট উচ্চতার ড্রাম চিমনি ব্যবহার করা হচ্ছে।
এ ব্যাপারে বাংলাদেশ পরিবেশ আইনজীবী সমিতির (বেলা) প্রধান নির্বাহী সৈয়দা রিজওয়ানা হাসান জানান, জনবসতির তিন কিলোমিটারের মধ্যে ইটখোলা নির্মাণ নিষিদ্ধ থাকলেও তা মানা হয়নি, এখনো হচ্ছে না। এ ছাড়া নির্ধারিত ১২০ ফুট চিমনিও অনেকে ব্যবহার করছে না। তিনি বলেন, ইটখোলা শুধু বায়ুদূষণই করছে না, সেই সঙ্গে ফসলি জমিকে নিষ্ফলা করছে। তা ছাড়া ভাটায় কয়লা ও কাঠ পোড়ানো হয়। আগুনের তাপমাত্রা বাড়াতে ও দীর্ঘক্ষণ স্থায়ী করতে ভারতীয় (নিম্নমান) কয়লার পাশাপাশি শত শত মণ নিষিদ্ধ টায়ার, প্লাস্টিক ও রাবারের টুকরা পোড়ানো হয়। ঝাঁজ ও দুর্গন্ধযুক্ত এসব পোড়ানোয় পুরো এলাকা ধোঁয়ার কুন্ডলীতে ছেয়ে যায়। নিষিদ্ধ জ্বালানি ব্যবহারসহ নানা দিকে আইন অমান্য করলেও ইটখোলার মালিকদের বিরুদ্ধে আইন প্রয়োগ করা হচ্ছে না।
সাশ্রয়ী ও পরিবেশবান্ধব ইটভাটা
ভাবুন তো একবার, ইটভাটা কালো ধোঁয়া ছড়াবে না, থাকবে না কোনো শিশু শ্রমিক, জ্বালানি হিসেবে কাঠ ব্যবহৃত হবে না, জমি লাগবে কম, ইটের দামও হবে সাশ্রয়ী। ফলশ্রুতিতে পরিবেশ ও অর্থনীতির উপর পড়বে খুবই ইতিবাচক প্রভাব। এমন সবই সম্ভব উন্নত প্রযুক্তিতে ধোঁয়াবিহীন ইট তৈরি তথা জিগজ্যাগ, হাইব্রিড হফম্যান কিলন/ক্লিন, ভিএসবিকে ও ট্রার্নেল/টানেল ক্লিন পদ্ধতি প্রয়োগের মাধ্যমে। দেশের প্রচলিত ইটভাটাগুলো যেখানে বায়ুমন্ডলে প্রতিদিন বিপুল পরিমাণ কার্বন ডাই-অক্সাইড নিঃসরণ করছে, সেখানে স্বয়ংক্রিয় পদ্ধতিতে ইট তৈরির পরিবেশবান্ধব এ পদ্ধতিগুলো এই হার অর্ধেকে নামিয়ে আনবে। পরিবেশবান্ধব পদ্ধতিতে ইট পোড়ানোর চুল্লিতে যে ধোঁয়া উৎপন্ন হয় না, তা কিন্তু নয়; তবে ওই ধোঁয়াই পুনরায় ব্যবহার করা হয় ড্রায়িং চেম্বার বা শুকানোর স্থানে। অর্থাৎ সংরক্ষণ করা হয় ধোঁয়া। এই ধোঁয়া চেম্বারের বাইরে যেতে পারে না। কেননা ড্রায়িং চেম্বার এবং চুল্লি বায়ু প্রতিরোধক। এভাবে প্রতিসেট ইট তৈরিতে সময় লাগে সর্বোচ্চ ৯ ঘণ্টা। অথচ সনাতনী পদ্ধতিতে একটি ইট তৈরি করতে সময় লাগে প্রায় ১৫ দিন। এ প্রযুক্তিতে ইট তৈরি করতে রোদে শুকানোর ঝামেলা নেই। তাই জায়গা এবং শ্রমিকও কম লাগে, অর্থও সাশ্রয় হয়। শ্রমিকরাও কাজ করে উন্নত পরিবেশে। সনাতনী ইট ভাটার তুলনায় এ পদ্ধতিতে ইট তৈরির মজুরি কিছুটা বেশি। তবে সারা বছরই কাজ থাকে। কিন্তু সনাতনী ইট ভাটাগুলো বিশেষত বর্ষাকালে বন্ধ থাকে। তখন শ্রমিকরা বেকার হয়ে পড়েন। উন্নত প্রযুক্তিতে পরিবেশবান্ধব একটি ইটভাটা তৈরি করতে ব্যয় হয় পাঁচ থেকে আট কোটি টাকা। অথচ প্রচলিত পদ্ধতিতে একটি ইটভাটা তৈরিতে ব্যয় সর্বোচ্চ প্রায় এক কোটি টাকা। নতুন প্রযুক্তির ইটভাটার উৎপাদন ক্ষমতা বেশি এবং অন্যান্য ক্ষেত্রে প্রচুর সুযোগ-সুবিধা থাকায় ওই বাড়তি ব্যয় পুষিয়ে নেওয়া যায়। তা ছাড়া এ প্রযুক্তিতে তৈরি ইট অত্যন্ত উচ্চ চাপ সহনশীল। এই ইট ৮-১০ ভাগ পানি শোষণ করে, ফলে এক্সটারনাল ওয়ালের জন্য অত্যন্ত উপযোগী এবং প্লাস্টারের প্রয়োজন হয় না। আধুনিক পরিবেশবান্ধব উন্নত এই ইটের খোয়া ছাদের ঢালাইয়ের জন্য অত্যন্ত উপযোগী। ইটগুলো ওজনে ভারী, ফলে এগুলো পার্টিশন ওয়ালের জন্য দারুণ কার্যকর। আর তাই সারা দেশে এ প্রযুক্তির প্রসার ঘটলে পরিবেশ সুরক্ষার পাশাপাশি বিরাট অঙ্কের ইট রপ্তানিরও সুযোগ সৃষ্টি হবে।

জিগজ্যাগ
দেশে এখন সবচেয়ে বেশি ব্যবহৃত আধুনিক ইট তৈরির পদ্ধতি জিগজ্যাগ। দেশে বেশির ভাগ ইটভাটাতে এই পদ্ধতিতে ইট পোড়ানো হয়। প্রাচীন পদ্ধতিতে ইট তৈরি ও পোড়ানোর প্রযুক্তি বহাল থাকলেও অধিকাংশ ইটভাটা স্থায়ী ও প্রায় ১২০ ফুট উঁচু চিমনির ভাটা। এ জাতীয় এক ইউনিটের একটি ইটভাটা তৈরিতে প্রায় এক লাখ আট হাজার বর্গফুট জায়গা দরকার। তা ছাড়া ইট তৈরির জন্য মাটি, জ্বালানি রাখা, কাঁচা ইট তৈরি ও রোদে শুকানো, তৈরি ইট স্ত‚প করে রাখা ও পরিবহনের সুবিধা মিলিয়ে একটি ইটভাটার জন্য পাঁচ-ছয় একর জায়গা প্রয়োজন। এক একটি ইটভাটাতে প্রায় ২৫০ শ্রমিক দিন-রাত কাজ করে এক মৌসুমে তৈরি করে ৩০-৩২ লাখ ইট। পোড়ানোর মানভেদে ইটভাটাতে প্রথম, দ্বিতীয় ও তৃতীয় শ্রেণীর ইট তৈরি হয়। প্রচলিত স্থায়ী চিমনির ইটভাটাতে প্রতি এক লাখ ইট তৈরি করতে প্রায় ১০ হাজার ঘনফুট মাটি এবং ২২-২৪ টন কয়লার প্রয়োজন হয়। তবে বিশেষজ্ঞদের মতে, স্থায়ী চিমনির ইটভাটার চেয়ে জিগজ্যাগ পদ্ধতির ইটভাটাতে জ্বালানি কয়লার কম প্রয়োজন হয়। ফলে দূষণ কিছু কমে। তবে এ পদ্ধতিও পুরোপুরি পরিবেশবান্ধব নয়। স্থায়ী চিমনির ও জিগজ্যাগ প্রযুক্তির ইটভাটাতে তাপনিরোধক ব্যবস্থা অনুপস্থিত। ফলে উভয় পদ্ধতিতেই জ্বালানি পোড়ানোয় তাপের অনেক অপচয় হয়। কিন্তু একটি স্থায়ী চিমনির ইটভাটা নির্মাণে প্রায় ৩০ লাখ টাকা এবং জিগজ্যাগ ভাটা নির্মাণে প্রায় এক কোটি টাকা প্রয়োজন।
হাইব্রিড হফম্যান কিলন/ক্লিন
কয়লা অর্ধেক ব্যবহার বা বায়ুমন্ডলে কার্বন প্রায় নির্গত না করে ইট তৈরির প্রযুক্তিই হাইব্রিড হফম্যান কিলন। কার্বন নিঃসরণে সাশ্রয়ী এ পদ্ধতিতে ইট তৈরি করছে বাংলাদেশের ২০টি ইট প্রস্তুতকারী প্রতিষ্ঠান। হফম্যান জার্মানির প্রযুক্তি। বছর দশেক আগে চীন এই পদ্ধতি প্রয়োগ ও একে আরও আধুনিকায়ন করে। বাংলাদেশে এই পদ্ধতি আসে চীন থেকে। এ প্রযুক্তির মেশিন বা যন্ত্রপাতি তৈরি করেছে চীনের জিয়াং রিসার্চ অ্যান্ড ডিভাইজ/ ডিভাইস ইনস্টিটিউট অব ওরাল অ্যান্ড ম্যাটেরিয়ালস। এতে সনাতনী ইটভাটার চেয়ে ৫০ ভাগ কম কয়লা ব্যবহার করে ইট তৈরি করা হচ্ছে। ফলে বছরে এক লাখ টন কার্বন কম নিঃসরণ হচ্ছে। যাকে বলা হচ্ছে কার্বন সাশ্রয়। এ প্রযুক্তিটি আসলে কারখানা তৈরির ডিজাইনের মধ্যেই থাকে। এই পদ্ধতিতে এমনভাবে কারখানা তৈরি করা হয় যাতে কয়লা দিয়ে ইট পোড়ানো হলেও কোনো ধোঁয়া বায়ুমন্ডলে যায় না। ঘুরিয়ে তা আবার কারখানাতেই নরম মাটির তৈরি ইট শুকাতে ব্যবহার হয়। আর স্বয়ংক্রিয় ব্যবস্থায় ইটের মধ্যেও কার্বন ঢুকে পড়ায় কয়লা দিয়ে পোড়ানোর সময় ইটের ভেতরে থাকা কয়লা প্রজ্বলিত হয়ে দ্রুত ইট পুড়ে যায়। ফলে কয়লা লাগে অর্ধেক। একই সঙ্গে ইটগুলো হয় অধিক শক্তিশালী ও মানসম্মত। এই ইটের রয়েছে বিপুল চাহিদা।

যেভাবে ইট তৈরি হয়
হাইব্রিড হফম্যান কিলন প্রক্রিয়ায় মাটি থেকে স্বয়ংক্রিয় ব্যবস্থায় ইট তৈরি হয়। প্রথমে মাটি মেশিনের বেল্টে ফেলে দেয় শ্রমিকেরা। এই মাটি ভেঙে চলে যায় আরেক বেল্টে। সেখান থেকে নির্দিষ্ট পরিমাণ কয়লা মাটির সঙ্গে এসে মেশে। তারপর বেল্টের মাধ্যমে চলে যায় একটি পাত্রে। সেখানে কয়লা ও মাটির ভালোমতো মিশ্রণ হয়।
এর পর আবার বেল্টের মাধ্যমে চলে যায় আরেকটি পাত্রে। সেখানে মাটি ও পানির মিশ্রণ শেষে নরম কাদামাটি নির্দিষ্ট আকৃতিতে বের হয়ে আসে। আসার পথেই গোটা দশেক ইটে তা বিভক্ত হয়ে যায়। পরে এই নরম ইট ট্রলিতে চলে যায় বাষ্পকক্ষে।
চিমনিগুলো যেহেতু সমান্তরালভাবে ড্রায়িং টানেলে প্রবেশ করিয়ে ইট শুকানো হয়, তাই ইটগুলোর গায়ে আবার কার্বন এসে জমা হয়। ফলে এই ইটের ভেতরে এবং বাইরে প্রচুর কয়লা ও কার্বন লেগে যায়। এ কারণে আগুনে পোড়ানো সাধারণ ইটের চেয়ে এই ইটের শক্তি অনেক বেশি হয়। সাধারণ ইটের শক্তি যেখানে ২৮০০ পিএসআই (পাউন্ড পার স্কয়ার ইঞ্চি), সেখানে এই ইটের শক্তি ৬০০০ পিএসআই।
বাষ্পকক্ষ থেকে শুষ্ক ইট বের হলে সেই ইট আবার ট্রলিতে করে নিয়ে রাখা হয় বড় চুল্লির মধ্যে। থরে থরে সাজানো হয় এই ইট। তারপর চুল্লির উপর থেকে সরু হয়ে নিচে নেমে যাওয়া চুল্লির মধ্যে নির্দিষ্ট পরিমাণ কয়লা ফেলা হয়। জ্বলতে থাকে চুল্লি। চার ঘণ্টা ধরে ইটগুলো পোড়ে, আর ঠান্ডা হতে লাগে ১২ ঘণ্টা। তারপর বের করে আনা হয় এই মান ও টেকসই ইট। এতে প্রতি হাজার ইটের দাম পড়ে ছয় হাজার টাকা। সনাতনী ব্যবস্থায় এ খরচ সাড়ে পাঁচ হাজার টাকা। কিন্তু সনাতনীভাবে তৈরি ইটের আকার সাড়ে নয় বাই সাড়ে চার ও পৌনে তিন ইঞ্চি, আর হাইব্রিড হফম্যান কিলন পদ্ধতির তৈরি ইটের আকার ১০ বাই ৫ ও তিন ইঞ্চি মাপের, যেটি পিডব্লিউডির মান অনুসারে তৈরি।
ভিএসবিকে
প্রচলিত ইটভাটার তুলনায় এ পদ্ধতিতে দূষণ ৭০ শতাংশ কম। উৎপাদনের খরচ কম। কোনো প্রকার কালো ধোঁয়া বের হয় না। কয়লাভিত্তিক এই প্রযুক্তির মাধ্যমে সারা বছর নিরবচ্ছিন্নভাবে ইট তৈরি করা যায়। বাংলাদেশে ছোট উদ্যোক্তাদের জন্য অত্যন্ত সম্ভাবনাময় ও আকর্ষণীয় এ প্রযুক্তির নাম ভার্টিকেল শাফট ব্রিক কিলন বা ভিএসবিকে। এ পদ্ধতিতে প্রতিদিন ৯ থেকে ১০ হাজার এবং মাসে প্রায় ৩ লাখ ইট প্রস্তুত করা যায়। স্বয়ংক্রিয়ভাবে কয়লার তাপকে বেশি সময় কাজে লাগিয়ে ইট প্রস্তুত করা যায়। একটি ইট তৈরিতে ভিএসবিকে প্রযুক্তিতে প্রায় ৪ টাকা খরচ পড়ে। আর হফম্যান প্রযুক্তিতে পড়ে প্রায় ৫ টাকা। অন্যদিকে প্রচলিত ইট ভাটায় এ খরচ সাড়ে ৩ থেকে ৪ টাকা। ভিএসবিকে প্রযুক্তির প্রয়োগে বছরে প্রায় ৫ লাখ টন কয়লা সাশ্রয়, ১৫ লাখ টন কার্বন ডাই-অক্সাইড নির্গমন রোধ, প্রায় ৫ কোটি ডলারের বৈদেশিক মুদ্রার সাশ্রয় এবং বছরে ৪ লাখ গাছ ধ্বংসের হাত থেকে রক্ষা পাবে। পরিবেশবান্ধব ইটভাটা নির্মাণ ও জ্বালানি সাশ্রয়ী মানসম্পন্ন ইট প্রস্তুতের ক্ষেত্রে ভিএসবিকে প্রযুক্তি দারুণ কার্যকর।
সাশ্রয়ী কার্বন বিক্রি
কার্বন নিঃসরণে সাশ্রয়ী পদ্ধতিতে পরিবেশবান্ধব উপায়ে বাংলাদেশের যে সব ইটভাটায় ইট তৈরি হচ্ছে, তাদের সাশ্রয় করা কার্বন ডেনমার্কের সঙ্গে সমন্বয় করার চুক্তি হয় ২০০৯ সালে কোপেনহেগেন জলবায়ু পরিবর্তন সম্মেলন বা (কোপ-১৫)-এ। এই চুক্তি অনুসারে প্রতি ইউনিট (এক টন) সাশ্রয় করা কার্বনের (দূষণ) জন্য কোপেনহেগেন দেবে ১৫ দশমিক ২০ ডলারের সনদ, যা এক ধরনের আর্থিক উপকরণ। এই সনদ পরবর্তী সময়ে উন্নত দেশগুলোতে বিক্রি করা হবে। ২০১২ সালের পর মোট সাশ্রয় হিসাব করে সার্টিফিকেট বা আর্থিক উপকরণটি দেওয়া হবে। ৬০ হাজার টন কার্বন কম নিঃসরণের সাশ্রয়কৃত (সিইআর বা কার্বন এমিশেন রিডাকশন) অংশ কেনা হবে বাংলাদেশের পরিবেশবান্ধব ইট প্রস্তুতকারক কোম্পানি থেকে। পরিবেশবান্ধব প্রযুক্তিতে ইট তৈরি করলে এ কার্বন নির্গমন কমিয়ে বছরে কার্বন ক্রেডিট হিসেবে ৮০ মিলিয়ন মার্কিন ডলার আয় করা সম্ভব।
ভারতে ইট রপ্তানি
ত্রিপুরার দুর্গম পাহাড়ি এলাকায় ইট উৎপাদনে খরচ বেশি পড়ায় সেখানে বাংলাদেশি ইটের ব্যাপক চাহিদা রয়েছে। ত্রিপুরা সীমান্ত-সংলগ্ন বাংলাদেশের ব্রাহ্মণবাড়িয়া, কুমিল্লা ও সিলেটে প্রচুর ইটভাটা আছে। ত্রিপুরার ব্যবসায়ীরা এসব এলাকা থেকে ইট কিনছে। তারা প্রতিটি ইটের দাম সাত টাকা করে বছরে প্রায় ২৮০ কোটি টাকা মূল্যের ৪০ কোটি পিস ইট কিনতে চায়। বাংলাদেশি যেসব ইটখোলার মালিক পরিবেশসম্মতভাবে ইট তৈরি করছেন, কেবল তারাই ভারতে ইট রপ্তানির সুযোগ পাচ্ছেন।

আবারও বাড়ল সময়
সরকার সারাদেশের সনাতনী ইটভাটাগুলোকে পরিবেশবান্ধব আধুনিক পদ্ধতিতে রূপান্তরের জন্য গণবিজ্ঞপ্তি দিয়ে ২০১২ সালের ৩০ সেপ্টেম্বরের মধ্যে সব ইটভাটাকে পরিবেশবান্ধব পদ্ধতি গ্রহণের সময়সীমা বেঁধে দিয়েছিল। এর পর যেসব ইটভাটা আধুনিক পদ্ধতি গ্রহণ করবে না তাদের অবৈধ ঘোষণা করে উৎপাদন কার্যক্রম বন্ধ করে দেওয়ার কথা ছিল। কিন্তু ইটভাটা মালিক সমিতির পক্ষ থেকে আরো ১ বছর সময় বাড়ানোর আবেদনের প্রেক্ষিতে পরিবেশ মন্ত্রণালয় ১ লক্ষ টাকা ক্ষতিপূরণ আদায় সাপেক্ষে সম্প্রতি সময় বাড়িয়ে ৩১ মার্চ ২০১৩ সাল পর্যন্ত করেছে।
রয়েছে ভিন্নমতও
ইট তৈরিতে আধুনিক পদ্ধতি গ্রহণ প্রসঙ্গে ইটভাটা মালিক সমিতির মহাসচিব আলী আশরাফ ইফতেখার বলেন, উন্নত প্রযুক্তির ইটভাটা তৈরি করতে হলে এভাবে সময় বেঁধে দিলে হবে না। এর জন্য প্রয়োজন যে দক্ষ জনশক্তি, তা আগে নিশ্চিত করতে হবে। তা ছাড়া ইটভাটা চালু অবস্থায় উন্নত প্রযুক্তির জিগজ্যাগ পদ্ধতির জন্য কাজ করা সম্ভব হয় না। আবার বন্ধ রেখেও কাজ করা যাবে না। ভাটা বন্ধ রেখে কাজ করলে সরকারকেই বিপদে পড়তে হবে। কারণ প্রতিবছর সরকারি কাজে ৫ থেকে ৬ হাজার কোটি ইটের প্রয়োজন। ভাটা বন্ধ থাকলে সরকারের এই উন্নয়ন কাজ ব্যাহত হবে। তা ছাড়া আমাদের দেশের অধিকাংশ ইটভাটা নিচু জায়গায় হওয়ায় নভেম্বর মাসের পর পানি জমে থাকে। যে কারণে ওই সময়ও কাজ করা যায় না। তিনি আরো জানান, গত দুই বছরে ২০০ থেকে ৩০০টি ইটভাটা পরিবেশবান্ধব পদ্ধতির আওতায় এসেছে। এ ছাড়া আরও কয়েক শ’ ইটভাটা আধুনিক পদ্ধতি গ্রহণের চূড়ান্ত পর্যায়ে রয়েছে। তার আশা, ২০১৩ সালের মধ্যে বেশিরভাগ ইটভাটা আধুনিক পদ্ধতি গ্রহণ করবে। তবে ব্যাংক থেকে ঋণের অর্থ ছাড়ে সরকারকে আরো বেশি নমনীয় হওয়ার দাবি তার।
প্রকাশকাল: বন্ধন ৩১ তম সংখ্যা, নভেম্বর ২০১২