পর্যটন সম্ভাবনায় পুরান ঢাকা

ইতিহাস, ঐতিহ্য যেখানে হাত ধরে হাঁটে আর নান্দনিক সব স্থাপনা সগর্বে মাথা তুলে জানান দেয় তার শৌর্য-বীর্য; নাম তার পুরান ঢাকা। ইতিহাসের পাশাপাশি যে জায়গাটি হতে পারে পর্যটনের দারুণ উপলক্ষ্য। এরই সলুকসন্ধান করেছে বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয় (বুয়েট)-এর স্থাপত্য বিভাগ। এ বিভাগের অধ্যাপক ড. খন্দকার সাব্বির আহমেদ-এর সঙ্গে এ প্রসঙ্গে আলাপচারিতায় রচিত হয়েছে এবারের মূল রচনা।

ইতিহাস, ঐতিহ্য, সংস্কৃতি, জীবনধারা আর শৈল্পিক স্থাপত্যের মেলবন্ধন পুরান ঢাকা। ৪০০ বছর আগে বুড়িগঙ্গার তীরে গড়ে ওঠা এ শহরটি যেমন ছিল সুপরিকল্পিত, নান্দনিক ও ছিমছাম, তেমন ছিল এর সুশৃঙ্খল শাসনব্যবস্থা। কিন্তু মোগল শাসনের পতনের পর অযত্নœ-অবহেলায় শহরটি ক্রমেই হারিয়েছে এর জৌলুশ। তবে কালের গর্ভে অনেক কিছু হারালেও এখনো এটিই দেশীয় বাণিজ্যের প্রাণকেন্দ্র। ঐতিহ্যবাহী এ শহরে মিশে আছে অভিজাত জীবনধারা; জীবন্ত ইতিহাস আর গৌরবময় ঐতিহ্য। একদিকে যেমন রয়েছে আহসান মঞ্জিল, লালবাগ কেল্লা, তারা মসজিদ, আর্মেনীয় চার্চ, রূপলাল হাউসের মতো অনন্য স্থাপনা, অন্যদিকে বুড়িগঙ্গা নদী, ঐতিহ্যবাহী খাবার যার সবই পর্যটন আকর্ষক। এগুলোকে ঘিরেই রয়েছে পর্যটনের অমিয় সম্ভাবনা। একটু পরিকল্পনা ও উন্নয়নের মাধ্যমে পুরান ঢাকা হয়ে উঠতে পারে বিশ্বের অন্যতম আকর্ষণীয় পর্যটন শহর, উন্মোচিত হতে পারে অর্থনৈতিক উন্নয়নের নব দিগন্ত।

নগরভিত্তিক পর্যটন উন্নয়নে যা কিছু প্রয়োজন তার প্রায় সবই রয়েছে পুরান ঢাকায়। ঐতিহ্যবাহী নান্দনিক স্থাপনা; বিরিয়ানি, বাকরখানি, লাবাংসহ রসনাবিলাসী নানা খাবার; তামা, কাসা, শঙ্খের মতো হস্ত ও কুটিরশিল্প; নদীতে নৌযান, সঙ্গে রয়েছে বিশ্বের অন্যতম জনপ্রিয় বাহন রিকশা। কিন্তু এসব ঐশ্বর্য থাকা সত্তে¡ও পর্যাপ্ত অবকাঠামো ও সুব্যবস্থাপনার অভাবে পুরান ঢাকায় দেশি পর্যটকের তুলনায় বিদেশিদের আগমন একেবারেই নগণ্য। অথচ স্থাপনাগুলোকে সংস্কার, সুশৃঙ্খল যাতায়াতব্যবস্থা, পর্যটকদের জন্য আবাসনসুবিধা এবং নোংরা-আবর্জনা পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন করে সুন্দরভাবে সাজালেই পুরান ঢাকা হতে পারে অনিন্দ্য সম্ভাবনাময় এক পর্যটন নগর। ইতালির ভেনিস বা রোম, স্পেনের বার্সেলোনা শহরের স্থাপনা, খাবার ও জলপথকে পর্যটনবান্ধব করে গড়ে তুলেছে ওখানকার কর্তৃপক্ষ। যেখানে প্রতিনিয়ত ভ্রমণ করছে বিশ্বের নানা প্রান্ত থেকে আগত লাখ লাখ পর্যটক।

নব ডিজাইনকৃত পুরান ঢাকার উন্নয়ন মডেল ও আধুনিক রেস্টুরেন্ট ডিজাইন

সম্প্রতি আর্থিক সেবাদানকারী প্রতিষ্ঠান মাস্টারকার্ড তাদের পরিচালিত জরিপে পৃথিবীর সেরা ১০টি পর্যটনপ্রিয় ভ্রমণ শহর নির্বাচন করেছে। ‘গেøাবাল ডেস্টিনেশন সিটি’ শীর্ষক জরিপে ১৩২ শহরের মধ্যে প্রথম স্থান লন্ডনের। শহরটি পর্যটকদের কাছে ভালো লাগার অন্যতম কারণ এর ঐতিহাসিক, নান্দনিক ও শৈল্পিক সব স্থাপনা। ২০১৫ সালে এই নগরী ভ্রমণ করেছে ১৮ দশমিক ৮২ মিলিয়ন পর্যটক। এ ছাড়া বাকি নয়টি শহরের মধ্যে ব্যাংকক, দুবাই, সিঙ্গাপুর, কুয়ালালামপুর, সিউল ও হংকং এই ছয়টি শহরের অবস্থানই এশিয়ায়। ফ্রান্স, মিসর, চীন, ভারতসহ বিশ্বের অসংখ্য দেশ তাদের ইতিহাস-ঐতিহ্যকে সংরক্ষণ করে গড়ে তুলেছে শক্তিশালী পর্যটন খাত, যা তাদের অর্থনীতিকে করছে চাঙ্গা। জাতীয় আয়ে বিপুল রাজস্ব জোগান দিচ্ছে খাতটি। তারা ইতিহাসকে মুছে না ফেলে তা সংরক্ষণ ও সংস্কারের মাধ্যমেই বিশ্বের বুকে ইতিহাস-সচেতন জাতি হিসেবে নিজেদের স্বকীয়তার জানান দিচ্ছে। অথচ সবকিছু থাকতেও শুধু ব্যবস্থাপনার অভাবে আমরা আমাদের সম্পদগুলোকে কাজে লাগাতে পারছি না। দেশের পর্যটনশিল্পের উন্নয়নে পুরান ঢাকাকে যুক্ত করলে প্রাকৃতিক পর্যটনের পাশাপাশি নগরকেন্দ্রিক পর্যটনেও এগিয়ে যাব আমরা। এতে সবচেয়ে বেশি উপকৃত হবে পুরান ঢাকার বাসিন্দারা। কারণ, পর্যটকেরা স্থাপনা দর্শনের পাশাপাশি নেবে স্থানীয় সেবা, কিনবে খাবার ও আনুষঙ্গিক উপকরণ। এতে একজন রিকশাওয়ালা, মুদি দোকানি, রেস্টুরেন্ট ব্যবসায়ী, কুটিরশিল্পের কারিগরসহ লাভবান হবে সবাই। এখানে পর্যটকের পাশাপাশি আসবে বণিকশ্রেণিরাও, যাদের মাধ্যমে পুরান ঢাকার ঐতিহ্যবাহী নানা পণ্য বিশ্বের বাজারে প্রবেশের সুযোগ পাবে সহজেই। পর্যটনের এই সুফল দেশ তো পাবেই, লোকাল অর্থনীতিতেও যা রাখবে বিরাট অবদান।

কিন্তু এসব বাস্তবায়নে দরকার পুরান ঢাকার পুনর্বিন্যাস। তার অর্থ এই নয় যে পুরোনো সবকিছু ভেঙে নতুন করে করা, প্রাচীন ধ্যানধারণা ভেঙে আধুনিক হওয়া, ঝকমকে নগর গড়ে তোলা। বরং শত বছরের ইতিহাস, ঐতিহ্য ও স্থাপনাকে কিছুটা হলেও নতুন অবয়ব দেওয়া। পুরান ঢাকা শুধু বাড়িঘর নয়, এ যেন জীবন্ত এক ইতিহাস। এই ইতিহাসের সঙ্গেই মানুষের নিত্যদিনের বসবাস। এখানকার প্রতিটি ইটে লেগে রয়েছে জীবনধারার গভীর বুনট। তাই স্থাপনার অবয়ব যদি ভাঙা হয়, তাহলে জীবনের পুরো ছান্দিক ধারাই ভেঙে যাবে, নষ্ট হবে জীবনপ্রবাহের এমনই বুনট, এমনকি গোটা সমাজব্যবস্থাই হয়ে পড়বে ভারসাম্যহীন। তা ছাড়া প্রথাগত আচার, ব্যবহার, ভাষা, সংস্কৃতি স্থাপত্যের সঙ্গে অঙ্গাঙ্গিভাবে জড়িত। জনগোষ্ঠী ও সংস্কৃতির দিক থেকে পুরান ঢাকার স্থানীয় বাসিন্দাদের অধিকাংশই আদি ঢাকাইয়া। স্বভাবে বেশ রক্ষণশীল। তাদের জীবনযাত্রার মান ও ধরন কিছুটা ভিন্ন। তাই পুরান ঢাকাকে ঘিরে উন্নয়ন করতে হলে প্রাধান্য দিতে হবে তাদের চাওয়া-পাওয়াকেই। স্থাপত্য, সড়ক, অবকাঠামো, সংস্কৃতি এবং মানুষের জীবনমানের উন্নয়নের আগে বুঝতে হবে স্থানীয় বাসিন্দারা কী চায়। অর্থাৎ বর্তমান জীবনযাত্রা নিয়ে তারা কি আদৌও সন্তুষ্ট, কোন কোন বিষয়ে তারা পরিবর্তন চায় আর কোন পরিবর্তনে তাদের রয়েছে আপত্তি। তাদের জীবনযাত্রা ও সংস্কৃতির সঙ্গে খাপ খায় না এমন কিছু তাদের ওপর চাপিয়ে দেওয়া ঠিক কি না!

পুরান ঢাকার অবকাঠামো উন্নয়ন মডেল

আহসান মঞ্জিল পুরান ঢাকার অনন্য এক স্থাপনা। বুড়িগঙ্গা নদীতীরের এই স্থাপনাটিকে ঘিরেই গড়ে উঠতে পারে উন্নয়নের বলয়। বিকে দাস রোড, শাঁখারী বাজার, পিয়ারী দাস রোড পুরান ঢাকার ঐতিহাসিক এলাকার মধ্যে অন্যতম। দেশের প্রকাশনা ও মুদ্রণশিল্পের প্রাণকেন্দ্র বাংলাবাজারের গুরুত্বপূর্ণ অংশ প্যারীদাস রোড। ঘরের সামনে বা ভেতরে খোলা প্রাঙ্গণ ছেড়ে অনেকটা বাংলো ধাঁচে তৈরি এখানকার বাড়িগুলো। স্থাপত্যশৈলীতে ব্রিটিশ ঔপনিবেশিক ধারা সুস্পষ্ট; মোগল প্রভাবও দেখা যায় কিছু কিছু ভবনে। সুচারু নকশা, অলংকরণ আর আভিজাত্যিক স্থাপত্য-ভাবনায় বৈশিষ্ট্যপূর্ণ এ বাড়িগুলোর অনেকটাই এখন অতীত।

শাঁখারী বাজারের রয়েছে শত বছরের পুরোনো ঐতিহ্য। কোর্ট বেইজড স্থাপনা বা উঠানভিত্তিক আবাসনব্যবস্থা এলাকাটির মৌলিকত্ব। বি কে দাস রোডে রয়েছে প্রায় পাঁচটি জমিদারবাড়ি। এখানে আরও রয়েছে বড়বাড়ি, বাইজিবাড়ি, মঙ্গলালয়, বিবি কারউজা, বঙ্কুবিহারি জেউ মন্দিরসহ অনেক প্রাচীন স্থাপত্য। এ ছাড়া পুরান ঢাকাজুড়েই রয়েছে ঐতিহাসিক নিদর্শন। তাই এসব স্থাপনার ডিজাইন পরিবর্তন করলে এগুলো হারাবে তার নিজস্ব স্বকীয়তা। তাই স্থাপনার কাঠামো, নকশা অপরিবর্তিত রেখে করতে হবে নতুন অলংকরণ। বাইরের ডিজাইন পুরোনো আদলের মনে হলেও ভেতরে থাকবে আধুনিক সব সুযোগ-সুবিধা। জানালায় কাচ বা কাঠের ব্যবহার, শেডিং ডিভাইস, বারান্দা, বাড়ির রং, দরজা-জানালার মাপের অনুপাত ও উচ্চতা, ঘরের ভেন্টিলেশন সিস্টেম ইত্যাদি এমনভাবে করতে হবে যেন তা ভবনের সৌন্দর্য বাধাগ্রস্ত কিংবা বৈরিতা সৃষ্টি না করে। কিছু বাড়ি আছে, যেগুলো ঐতিহাসিক নয় কিন্তু পাশের বাড়িটি ঐতিহাসিক, সে ক্ষেত্রে এ বাড়িটিকেও ঐতিহাসিক বাড়িটির সঙ্গে মিল রাখা উচিত। একটি ভবনের কারণে আরেকটি ভবন যেন আলো-বাতাস থেকে বঞ্চিত না হয় সেটাও বিবেচনায় থাকবে ডিজাইনে।

পুরান ঢাকার সড়কগুলো সরু, তাই পুরান ঢাকায় সব সময় লেগেই থাকে যানজট। এ জন্য পুরো এলাকাকে সময়ভিত্তিক নিয়ন্ত্রণ বা টাইম জোনিংয়ের মাধ্যমে সমস্যাটির সমাধান করতে হবে। এলাকাটি গুরুত্বপূর্ণ বাণিজ্যিক এলাকা হওয়ায় দিনের বদলে রাতে মালামাল পরিবহন করতে হবে। পর্যটকদের নির্বিঘেœ চলাচল নিশ্চিত করতে দরকার আলাদা লেন। যেহেতু রিকশা এখানকার প্রধান বাহন এবং পর্যটন-সহায়ক যান, তাই দিনের সময়কে কয়েক ভাগে ভাগ করে একমুখী রিকশা চলাচলের ব্যবস্থা করেও যানজট নিরসন করা যেতে পারে। তা ছাড়া অন্যান্য প্রতিবন্ধকতা যেমন বিদ্যুৎ, টেলিফোন, গ্যাস এবং পানির লাইন রাস্তার নিচে স্থাপন করতে হবে আর রাস্তার ওপর থাকবে না কোনো বৈদ্যুতিক খুঁটি। এখানকার নাগরিকদের নিত্যনৈমত্তিক সমস্যা, যেমন- ময়লা ব্যবস্থাপনা, বৃষ্টির পানি, আগুন সমস্যাÑ এ সবকিছুই সমাধানযোগ্য। যেমন যেসব সরু রাস্তায় আগুন নিয়ন্ত্রণে গাড়ি ঢুকতে পারে না, সেখানে হাইড্রেন ব্যবস্থা অর্থাৎ পানির পাইপের ব্যবস্থা নিশ্চিত করতে হবে। কিছুদূর পরপর মুখ খোলা থাকবে, যেখান থেকে সহজেই পানি নিয়ে আগুন নিয়ন্ত্রণ করা যাবে। তবে সামগ্রিক উন্নয়নে শুধু ভবন ও অবকাঠামো ছাড়াও প্রবহমান জীবনধারার সঙ্গে সামঞ্জস্য রেখে সবকিছুকে সমন্বয় করতে হবে। যেমন- মানুষের চলাফেরা, আড্ডাবাজির ধরন, বসার জায়গা, ঘুড়ি ওড়ানো, উৎসব ও খেলা আয়োজন প্রভৃতি। এ ছাড়া সড়কবাতি, দোকানের সাইনবোর্ড, ফুল ও ফলের গাছ কোনো কিছুই উন্নয়নের বাইরে থাকবে না।

লালবাগ কেল্লা, ছবিতে আঁকা বুড়িগঙ্গার পুরাতন রূপ, আহসান মঞ্জিল ও আর্মেনীয়া চার্চ (উপরে বা থেকে)

২০০৮ সালে ঢাকা মহানগর ইমারত নির্মাণ, উন্নয়ন, সংরক্ষণ ও উন্নয়ন বিধিমালা গেজেট আকারে প্রকাশ করা হয়। গেজেটে বিভিন্ন পুরাকীর্তি ছাড়া ব্যক্তিগত বাড়িঘর, স্থাপনা, ধর্মীয় ও শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের পাশাপাশি পুরান ঢাকার কয়েকটি এলাকা অন্তর্ভুক্ত করার কথা ছিল। যার মধ্যে রয়েছে- শাঁখারী বাজার, তাঁতি বাজার, ফরাশগঞ্জের ঋষিকেশ দাস রোড, রেবতীমোহন দাস রোড, বি কে দাস রোড ও ফরাশগঞ্জ রোড, পানিতলা, সূত্রাপুরের প্যারীদাস রোড ও হেমেন্দ্র দাস রোড এবং রমনার বেইলি রোড, মিন্টো রোড, হেয়ার রোড ও পার্ক অ্যাভিনিউ। তালিকাভুক্ত এসব ভবন, স্থাপনা ও এলাকায় বিদ্যমান ভবন ও কাঠামো নগর উন্নয়ন কমিটির অনুমোদন ব্যতীত আংশিক বা সম্পূর্ণ অপসারণ, পুনর্নির্মাণ, পরিবর্তন, পরিবর্ধন, পরিমার্জন ও সংযোজন করা যাবে না। পুরাকীর্তি সংরক্ষণ-বিষয়ক এই কমিটিতে যুক্ত ছিল স্থাপত্য অধিদপ্তর, প্রত্নতত্ত্ব অধিদপ্তর, বাংলাদেশ প্রকৌশল ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয় (বুয়েট), ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইতিহাস বিভাগ, চারুকলা ইনস্টিটিউট, ইনস্টিটিউট অব আর্কিটেক্ট, ইনস্টিটিউট অব প্ল্যানার্স, এশিয়াটিক সোসাইটি অব বাংলাদেশ, গণপূর্ত অধিদপ্তর, ঢাকা সিটি করপোরেশন ও আরবান স্টাডি গ্রুপের প্রতিনিধিরা।

এ ধরনের আইন হলেও পুরান ঢাকার নির্মাণ-বিষয়ক সঠিক কোনো দিকনির্দেশনা না থাকায় এখানে উন্নয়ন হয়েছে অসমভাবে। রাজধানীর অন্যান্য এলাকায় উন্নয়নের ছোঁয়া লাগলেও পুরান ঢাকা অবহেলিতই থেকে গেছে। সরকার নতুন বিধিমালা প্রণয়ন, ঐতিহাসিক নিদর্শনের তালিকা তৈরি এবং নগর উন্নয়ন কমিটি করেই দায়িত্ব শেষ করেছে। এসব নিয়মকানুন আজও খাতাপত্রেই সীমাবদ্ধ। ফলে আইনটি পারছে না পুরান ঢাকার ঐতিহ্য রক্ষা করতে। পুরান ঢাকায় গত কয়েক দশকে জনসংখ্যা বেড়েছে কয়েক গুণ। বাধ্য হয়েই অথবা প্রয়োজনের তাগিদে অথবা আইন না মেনেই অনেকে পুরোনো স্থাপনা ভেঙে গড়েছে নতুন স্থাপনা। এসব ভবন কোনো ভালো স্থপতি বা প্রকৌশলীর সাহায্যে করা হয়নি। ফলে চরম অসামঞ্জস্যে বাড়িঘর গড়ে উঠেছে সেখানে, যা পুরোনো শৈল্পিক স্থাপনার পাশাপাশি একেবারেই বেমানান। আবার আইনের জটিলতায় পূর্বপুরুষের ভিটেমাটি ছেড়ে এখন অনেকেই পুরান ঢাকা ছাড়তে বাধ্য হচ্ছে। এসব বাড়ির মালিকদের কাছে অর্থনৈতিকভাবে লাভজনক না হওয়ায় তারা বাণিজ্যিক প্রতিষ্ঠানের কাছে ভাড়া দিচ্ছে। বাড়ি বাড়ি গড়ে উঠছে কেমিক্যাল, প্লাস্টিক, কসমেটিকস, ইলেকট্রনিকস যন্ত্রাংশসহ উৎপাদন পণ্যের কারখানা ও গুদাম। এসব কারখানায় প্রায়ই ঘটছে ভয়াবহ অগ্নিকান্ড। বিদ্যুতের পোল ও ঝুলন্ত তারের জঞ্জাল সব রাস্তা, অলিগলি এমনকি প্রতিটি বাড়িকে আষ্টেপৃষ্টে জড়িয়ে রেখেছে। যেখান থেকে দুর্ঘটনা ঘটা সময়ের ব্যাপার মাত্র।

সম্প্রতি এখানে ঘটেছে বেশ কটি ভূমিকম্পের ঘটনা। বিশেষজ্ঞদের মতে, রাজধানীর সবচেয়ে ঝুঁকিপূর্ণ এলাকা পুরান ঢাকা। শত বছরের পুরোনো জরাজীর্ণ ভবনে বাস করছে এখানকার বাসিন্দারা। এসব ভবন দ্রæত সংস্কার করা না গেলে ক্ষয়ক্ষতি ও জীবনহানির হার হবে মারাত্মক। তাই বিশালসংখ্যক এই জনগোষ্ঠী ও ঐতিহ্যবাহী ভবনগুলো রক্ষায় প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ নেওয়া সময়ের দাবি।

পুরান ঢাকার ভূমিবিন্যাস ও ভবন নির্মাণ-বিষয়ক অনেক জটিলতা রয়েছে, যা সমাধান না করলে কখনোই অঞ্চলটিকে পর্যটন শহরে রূপায়িত করা যাবে না। বিভিন্ন সময়ে গড়ে ওঠা ভবনগুলোর কাঠামো, নকশা, কারুকাজ, টেকনিক ইত্যাদি ন্যাশনাল বিল্ডিং কোড এবং রাজউকের ডিটেইল এরিয়া প্ল্যানে সম্পূর্ণভাবে স্থান পায়নি। ঐতিহ্যবাহী স্থাপনা সংরক্ষণ এবং নতুন ভবন নির্মাণে নেই সরকারের পূর্ণাঙ্গ দিকনির্দেশনাও। স্থাপনা সংরক্ষণে সরকারের সংশ্লিষ্ট মহল কিছু পদক্ষেপ নিলেও এলাকার বাসিন্দাদের মতামত নেওয়া হয়নি। ফলে সরকার ও জনগণের মাঝে রয়ে গেছে ভুল-বোঝাবুঝি। ভবনের মালিকেরা পুরোনো ভবন ভেঙে নতুন ভবন গড়েছে আবার বিভিন্ন সময়ে জারিকৃত নিষেধাজ্ঞার কারণে ঝুঁকিপূর্ণ ভবনে বসবাস করছে অনেকেই। এসব সমস্যা সমাধানে বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের স্থাপত্য বিভাগ দীর্ঘদিন থেকে মাঠপর্যায়ে গবেষণা করে আসছে। প্রতিটি বিষয়কে খুব নিবিড়ভাবে পর্যবেক্ষণ করে প্রতিটি সমস্যারই আলাদা আলাদা সমাধান বের করেছে তারা। এ প্রক্রিয়ায় পুরান ঢাকাকে ‘এফএআর (ফ্লোর এরিয়া রেশিও)’ ট্রেডিংয়ের আওতায় আনতে হবে অর্থাৎ ঐতিহাসিক স্থাপনা সংরক্ষণ করে ভবনের মালিক যে ক্ষতি মেনে নেবে, এ জন্য সরকার থেকে তাকে আর্থিক সহযোগিতা দিতে হবে, যাতে সে অন্য কোথাও জমি কিনে ভবন নির্মাণ করে তার ক্ষতি পুষিয়ে নিতে পারে। আবার যাদের ভবন ঐতিহ্যবাহী নয়, সে ক্ষেত্রে তারা তাদের প্রয়োজনাতিরিক্ত ফ্লোরগুলো বিক্রি করতে পারবে। প্রয়োজনে বাড়ি তৈরি ও বিক্রির বিষয়টি দেখভাল করবে রাজউক। এতে একদিকে যেমন রক্ষা পাবে ইতিহাস, অন্যদিকে ভবনের মালিকেরাও আর্থিকভাবে লাভবান হবে। এভাবেই যাবতীয় সমস্যার সমাধান করে পর্যটনের পথ সুগম করা যায় তার জন্য সর্বাগ্রে এগিয়ে আসতে হবে সরকারকে। সরকারের আন্তরিকতা আর সবার প্রচেষ্টাই পারে পুরান ঢাকাকে তিলোত্তমা পর্যটন শহরে রূপায়ণ করতে, যেখানে মানুষ বাস করবে ইতিহাস-ঐতিহ্যের সঙ্গে।

হুমকির মুখে পুরান ঢাকার ঐতিহ্যবাহী স্থাপনা

পর্যটনশিল্প বিশ্বব্যাপী রাজস্ব আয়ের অন্যতম একটি খাত। পর্যটকদের আকর্ষণ করতে বিশ্বের প্রায় প্রতিটি দেশ তাদের সম্পদকে তুলে ধরছে পর্যটকদের সামনে। পর্যটনশিল্পের সঙ্গে জড়িত বিভিন্ন সেক্টর, যেমন- পরিবহন, হোটেল, মোটেল, রেস্তোরাঁ, রিসোর্ট, এয়ারলাইনস ও অন্যান্য মাধ্যম থেকে প্রতিবছর যে পরিমাণ রাজস্ব আয় হয়, তা অন্য যেকোনো বড় শিল্পের আয়ের চেয়ে বেশি। কিন্তু এ দেশে পর্যটনের নানা সম্ভাবনা থাকা সত্তে¡ও আমরা তা কাজে লাগাতে পারছি না। পর্যটনশিল্পের জিডিপিতে প্রত্যক্ষ অবদানের ভিত্তিতে ১৭৬টি দেশের মধ্যে বাংলাদেশের অবস্থান ১৪২তম, যা অত্যন্ত হতাশাজনক। অবকাঠামোগত অসুবিধা, নিরাপত্তাহীনতা, প্রচারের অভাব, বিনিয়োগ হীনতাসহ নানা সমস্যায় জর্জরিত এ খাতটি। পর্যটনকে এগিয়ে নিতে ১৯৯২ সালে প্রথম জাতীয় পর্যটন নীতিমালা প্রণীত হয়। এতে উল্লেখ ছিল, বিদেশি পর্যটকদের আধুনিক ও চিত্তবিনোদনের সব সুযোগ-সুবিধা সৃষ্টি করার। পর্যটন খাত বিকাশে বার্ষিক ও পঞ্চবার্ষিক পরিকল্পনায় বিশেষ গুরুত্ব দেওয়া হবে। কিন্তু বাস্তবে এগুলোর কিছুই হয়নি। প্রথম জাতীয় পর্যটন নীতিমালা তৈরির ১৮ বছর পর ২০১০ সালে তা হালনাগাদ করা হয়। আগের নীতিমালায় যা ছিল, তার সবই স্থান পেয়েছে নতুন নীতিমালায়। কক্সবাজার, টেকনাফ, সোনাদিয়া, জাফলং, মাধবকুন্ড, শ্রীমঙ্গল, লাউয়াছড়া, সীতাকুন্ড, সুনামগঞ্জ, বিরিশিরি, পদ্মা, মেঘনা ও যমুনা তীরবর্তী আকর্ষণীয় স্পট ও পার্বত্য চট্টগ্রামে পর্যটনের জন্য নানা উদ্যোগের বিষয় উল্লেখ থাকলেও নগরকেন্দ্রিক পর্যটন বিশেষ করে পুরান ঢাকার পর্যটন বিষয়ে নেই তেমন কোনো উদ্যোগ বা সুস্পষ্ট নীতিমালা। নগরকেন্দ্রিক পর্যটনকে এগিয়ে নিতে এবং পুরান ঢাকাকে পর্যটনবান্ধব রূপ দিতে কতগুলো পদক্ষেপ নেওয়া অতীব জরুরি। যার মধ্যে রয়েছে-

  • পর্যটনশিল্পকে বিশেষ গুরুত্ব প্রদান
  • যুগোপযোগী পর্যটন নীতিমালা তৈরি
  • পর্যটনবান্ধব যোগাযোগ ও স্থাপনা তৈরি
  • পর্যটনশিল্পের জন্য ব্যবসা সহজীকরণ
  • সরকারি-বেসরকারিভাবে দেশে-বিদেশে ব্যাপক প্রচার-প্রচারণা চালানো
  • পর্যটন-সহায়ক দক্ষ গাইড ও জনবল তৈরি করা
  • পর্যটকদের জন্য সঠিক ও বিস্তারিত তথ্যভান্ডার তৈরি, বিশেষ করে প্রশিক্ষণের মাধ্যমে সরকারি ও বেসরকারিভাবে গাইড, স্বেচ্ছাসেবক ও খÐকালীন কর্মী তৈরি করা
  • হোটেল ও যানবাহন বুকিং এবং মূল্য পরিশোধ বিষয়গুলো সহজ ও নির্ঝঞ্ঝাট করা
  • পর্যটকদের জন্য কার্যকরী পর্যটক নিরাপত্তা বিধান ও ট্যুরিস্ট পুলিশের জনবল ও সেবার মান বাড়ানো
  • রাস্তায় ভিক্ষুকদের উৎপাত কমানো
  • বিদেশি পর্যটকদের সঙ্গে জাল ডলারসহ নানা রকম প্রতারণা রোধ করা
  • পর্যটকদের এয়ারপোর্টে সব ধরনের হয়রানি ও চুরি বন্ধ করা
  • পর্যটনকেন্দ্রে বিদেশি পর্যটকদের সঙ্গে সব ধরনের প্রতারণা রোধ ও হয়রানি বন্ধে ত্বরিত ব্যবস্থা নেওয়া।

পর্যটন মানেই প্রকৃতি ও স্থাপত্য দর্শন নয়। কাজের ব্যস্ততা থেকে মুক্তি পেয়ে অনেকেই ছোটেন দেশ থেকে দেশান্তরে একটু অবসর কাটাতে; চিত্তবিনোদনের আশায়। তাই এ বিষয়টিকেও গুরুত্বসহকারে বিবেচনায় নিতে হবে। প্রতিটি দেশ পর্যটকদের চাহিদাকে প্রাধান্য দিয়েই সাজায় তাদের পর্যটন কাঠামো। আমাদের রয়েছে সমৃৃদ্ধ লোককৃত্য, গৌরবময় ইতিহাস, বর্ণিল সংস্কৃতি। এসব বিষয়গুলো পর্যটনে বিশেষ করে নগরকেন্দ্রিক পর্যটনে অন্তর্ভুক্ত করা গেলে তা পর্যটকদের কাছে হবে অত্যন্ত আকর্ষণীয়। যেমন-

ভাসমান হোটেল, ওয়াইজঘাট, সদরঘাট
  • পুরান ঢাকার বিভিন্ন স্থানে বছরজুড়ে ঐতিহ্যবাহী লোক গান, লোকনাচ, যাত্রা, নাটক, অপেরা, আদিবাসী নৃত্য, লাঠিখেলা, সাপখেলাসহ প্রভৃতি সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানের আয়োজন
  • দেশীয় শিল্পীদের আঁকা ছবি, আলোকচিত্র, নকশি কাঁথা, মাটির কাজ, ভাস্কর্য প্রদর্শনী
  • অবসরে পর্যটকেরা যেন সিনেমা দেখতে পারে সে জন্য আধুনিক ডিজিটাল সিনেমা হল নির্মাণ এবং সেখানে আন্তর্জাতিক মানের সিনেমা প্রদর্শন
  • পুরান ঢাকার সব স্থাপনা, রাস্তা, নদী প্রভৃতি নিয়ে একটি স্থাপত্য পার্ক স্থাপন, যেখানে শহরের নকশা ও বিখ্যাত স্থাপনার ডামি থাকবে
  • পুরান ঢাকার ইতিহাস-ঐতিহ্য, ব্যবহৃত সরঞ্জাম নিয়ে একটি নগর জাদুঘর গড়ে তোলা
  • বুড়িগঙ্গা নদীর ময়লা পরিষ্কার করে সেখানে আধুনিক নৌযানের মাধ্যমে পর্যটকদের প্রমোদ ভ্রমণের ব্যবস্থা করা
  • নদীর জীববৈচিত্র্য ও নৌযান নিয়ে একটি ‘রিভার মিউজিয়াম’ পর্যটকদের আকর্ষণের কেন্দ্রবিন্দু হতে পারে
  • পুরান ঢাকার ওয়াইজ ঘাটে বুড়িগঙ্গা নদীতে কয়েক দশক ধরে নিম্ন আয়ের মানুষদের থাকার জন্য কয়েকটি ভাসমান হোটেল এখনো চালু রয়েছে। এ ধারণাটিকে নতুনভাবে ভাবা যেতে পারে। কিছু আধুনিক ইয়োট (প্রমোদতরি) ব্যবস্থা করে পর্যটকদের চিত্তবিনোদনে ভাসমান হোটেল চালু করা গেলে তা হবে বেশ আকর্ষণীয়
  • স্থানীয় বাসিন্দাদের তৈরি নানা উপকরণ বিক্রির জন্য আলাদা বাজার প্রতিষ্ঠা
  • এ ছাড়া পুরান ঢাকার সাকরাইন, হোলি, দোল, পূজা-পার্বণ, চৈত্রসংক্রান্তিসহ বিভিন্ন আয়োজন ফলাওভাবে দেশে-বিদেশে প্রচার করাসহ পর্যটন-সহায়ক যাবতীয় পদক্ষেপ গ্রহণ করা।

নয়নাভিরাম প্রাকৃতিক সৌন্দর্যের আধার বাংলাদেশ। এ দেশের প্রাকৃতিক সৌন্দর্য ভান্ডার, সমৃদ্ধ ইতিহাস ও ঐতিহ্য, বৈচিত্র্যপূর্ণ সংস্কৃতি, বর্ণিল জীবনাচার বহুমাত্রিক পর্যটনের পাথেয়। এসব সৌন্দর্যে মুগ্ধ হয়ে এবং বাণিজ্য করতে যুগে যুগে এখানে এসেছে নামকরা সব পর্যটক। বিশ্বের দীর্ঘতম সমুদ্রসৈকত কক্সবাজার, একক বৃহত্তম ম্যানগ্রোভ বন সুন্দরবন, একই সৈকতে সূর্যোদয় ও সূর্যাস্ত উপভোগের স্থান সমুদ্রকন্যা কুয়াকাটা, আদিবাসীদের বৈচিত্র্যপূর্ণ সংস্কৃতি ও কৃষ্টি আচার-অনুষ্ঠানসমৃদ্ধ সবুজঘেরা পার্বত্য চট্টগ্রাম, চায়ের দেশ সিলেট, প্রতœতাত্তি¡ক নিদর্শনের সবই হতে পারে এ দেশের পর্যটনে দারুণ সম্ভাবনাময়। এসব সম্ভাবনা কাজে লাগিয়ে বাংলাদেশ হতে পারে দক্ষিণ এশিয়ার পর্যটনে আগামীর রোল মডেল।

মাহফুজ ফারুক

তথ্য, গবেষণা ও স্থাপত্য মডেল ডিজাইন: স্থাপত্য বিভাগ, বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয় (বুয়েট)

প্রকাশকাল: বন্ধন ৭২ তম সংখ্যা, এপ্রিল ২০১৬

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Scroll to Top