ঢাকার রাজপথে নামছে যাত্রীবান্ধব নতুন নগরপরিবহন আর্টিকুলেটেড বাস। জনপরিবহনের চাহিদা পূরণে ও যানজট নিরসনে নব এ বাহন রাখবে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা। বিটুমিন-অ্যাসফল্টের বদলে সড়ক নির্মাণে আবার আলোচনায় কংক্রিট পেভমেন্ট। সমসাময়িক আলোচিত অনুষঙ্গ দুটি নিয়ে পরিবহন ও ট্রাফিক ব্যবস্থাপনা বিশেষজ্ঞ এবং বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের (বুয়েট) পুরকৌশল বিভাগের অধ্যাপক মোয়াজ্জেম হোসেনের সাথে আলাপচারিতার পর লিখেছেন মেহেদী হাসান।
ঢাকার রাস্তায় আর্টিকুলেটেড বাস
যানজটের নগরী ঢাকা। দিনকে দিন যানজট আরো ভয়াবহ রূপ নিচ্ছে। এই শহরের মধ্যবিত্ত মানুষের ভরসা পাবলিক বাস, হিউম্যান হলার কিংবা রিকশা। আর উচ্চবিত্তের বাহন প্রাইভেট কার, যা রাজধানীর যানজটের অন্যতম কারণ। প্রাইভেট কারে চলাচল করে ঢাকার চার ভাগ মানুষ। তারা দখল করে রাখছে শহরের মোট রাস্তার ৭০ ভাগ। পাবলিক বাস, রিকশা আর হেঁটে যাতায়াত করে ৯৬ ভাগ মানুষ। এই বাহনগুলোর জন্য রয়েছে মাত্র ৩০ ভাগ জায়গা। প্রাইভেট কারের যাতায়াত কমিয়ে এনে যানজট নিরসনের পাশাপাশি নগরবাসীকে আরো বেশি করে জনপরিবহন ব্যবহারে উৎসাহিত করতে বাংলাদেশ সড়ক পরিবহন কর্পোরেশন (বিআরটিসি) রাজধানীতে নামাতে যাচ্ছে ভারত থেকে আমদানিকৃত নগরের নতুন গণপরিবহন আর্টিকুলেটেড বাস। নগরীতে পরিবেশবান্ধব যানবাহন চলাচল নগরবাসীর ভালো থাকার প্রয়োজনেই। রাজধানীর নাগরিক সেবায় এই প্রথম বিশ্বের সঙ্গে তাল মিলিয়ে আর্টিকুলেটেড পরিবহন ব্যবস্থা চালু হচ্ছে। যা অফিসগামী মানুষের দুর্ভোগ অনেকটাই কমিয়ে যানজট নিরসনে সহায়ক হবে।
যানজটের এ নগরীতে গণপরিবহন ব্যবস্থা সম্প্রসারণের লক্ষ্যে ৫০টি আর্টিকুলেটেড বাস আমদানি করা হচ্ছে। নতুন এই গণপরিবহন আসছে সরকারের বিদেশি গাড়ি আমদানি প্রকল্পের আওতায়। বাসগুলো ঢাকার রাস্তায় নামছে এ মাসেই। প্রথম দফায় আসবে ১০টি বাস। ঢাকার ৪টি রুটে এই ১০টি বাস ছাড়া হবে। পরে বাড়ানো হবে রুট। প্রথম দফায় আসা আর্টিকুলেটেড বাসের প্রকল্প মেয়াদ শেষ হবে ২০১৩ সালের ডিসেম্বরে। মেয়াদকাল শেষ হওয়ার আগেই বাকি ৪০টি বাস বিআরটিসির ডিপোতে পৌঁছবে। এদিকে নন-এসি বাসের পাশাপাশি আসছে ৮৮টি সিঙ্গেল ডেকারের আর্টিকুলেটেড বাস। বাসগুলো সরবরাহকারী ঠিকাদার প্রতিষ্ঠান ইফাদ অটোস। এই প্রতিষ্ঠান ১০টি এসিযুক্ত আর্টিকুলেটেড বাস সরবরাহ করবে। ফলে ডিসেম্বরে এসি ও নন-এসি আর্টিকুলেটেড বাস ঢাকার রাজপথে চলবে জানুয়ারি থেকে।

আর্টিকুলেটেড বাসের যত কথা
১৯২০ সালে ইউরোপের দেশ হাঙ্গেরির বুদাপেস্টে প্রথম যাত্রা শুরু হয়েছিল আর্টিকুলেটেড বাসের। সেই থেকে বিশ্বের উন্নত দেশগুলোতে চলছে জনপ্রিয় এই গণপরিবহন। এই বাসগুলো দেশ ও ডিজাইনভেদে বেন্ডি বাস, ট্যান্ডেম বাস, ব্যানান বাস, ক্যাটারপিলার বাস বা অ্যাকর্ডিয়ন বাস নামে পরিচিত। আর্টিকুলেটেড বাস সাধারণত এক্সক্লুসিভ লেন বা বাস র্যাপিড ট্রানজিট (বিআরটি) সিস্টেমে চলাচল করে। বাস র্যাপিড ট্রানজিট সিস্টেমের বাসগুলি হয় আকারে বড় এবং শুধু এই বাসগুলির জন্য রাস্তার একটি বা দুটি লেন ছেড়ে দিতে হয়। এর ফলে অধিকসংখ্যক যাত্রী দ্রুতগতিতে গন্তব্যে পৌঁছতে পারে। আর্টিকুলেটেড বাসের চলাচল এবং টার্ন করতে তেমন কোনো অসুবিধা হয় না। সাধারণত টার্ন নিতে একটি দ্বিতল বাসের জন্য ১০.০৫ মিটার জায়গার প্রয়োজন। সেখানে আর্টিকুলেটেড বাসের টার্ন নিতে ১০.৪৫ মিটার জায়গার প্রয়োজন। ঢাকায় আর্টিকুলেটেড বাসের নির্দিষ্ট রুটে টার্ন নিতে কোনো ধরনের সমস্যা হবে না। সাধারণ বাসচালক ইচ্ছে করলেই যত্রতত্র টার্ন নিতে পারে। কিন্তু আর্টিকুলেটেড বাসের চালক এভাবে টার্ন নিতে পারবে না। এ ক্ষেত্রে আর্টিকুলেটেড বাস সাধারণ বাসের মতো সোজা ও বাঁকা হয়ে টার্ন নিতে হবে। অন্যান্য বাসের তুলনায় আর্টিকুলেটেড বাসের রয়েছে আলাদা বৈশিষ্ট্য। একতলা বিশিষ্ট কিন্তু সাধারণ বাসের থেকে এটি আকারে বড়। দুটি বাস একসঙ্গে জোড়া দিয়ে তৈরি হয় আর্টিকুলেটেড বাস। প্রতিটি বাসের দৈর্ঘ্য ১৮ থেকে ২২ মিটার। যানজটের এ নগরীতে যাত্রীর চাপ সামলাতে দুটি সংযুক্ত কোচের মধ্যে চলাচলের করিডর রেখে ‘বিশেষভাবে তৈরি’ করা হয়েছে যাত্রীবান্ধব আর্টিকুলেটেড বাস। আসনের বাইরে বিশেষ সুবিধার এ বাসে খুব সহজে অনেক মানুষ দাঁড়িয়ে যাতায়াত করতে পারবে। এতে সিট সংখ্যা ৫৮টি। দাঁড়ানো অবস্থায় মোট যাত্রী ধারণ ক্ষমতা ১৩০ জন।
বাংলাদেশে আর্টিকুলেটেড বাস আমদানি করছে বিআরটিসি। বাসগুলো রক্ষণাবেক্ষণসহ সকল দায়িত্বে থাকছে তারা। ভারতের কাছ থেকে ঋণচুক্তির আওতায় এই আটিকুলেটেড বাসগুলো আমদানি করা হচ্ছে। প্রতিটি বাসের দাম ৮০ লাখ ১৯ হাজার টাকা (সরকার নির্ধারিত)। আর্টিকুলেটেড বাস বিশেষভাবে তৈরি করছে ভারতের প্রথম শ্রেণীর গাড়ি রপ্তানিকারক প্রতিষ্ঠান অশোক লেল্যান্ড। বাংলাদেশে অশোক লেল্যান্ডের এজেন্ট ইফাদ অটোসের মাধ্যমে আটিকুলেটেড এ বাসগুলো ঢাকায় আসছে।
রাজধানীর ভয়াবহ যানজটের প্রেক্ষাপট বিবেচনায় নির্দিষ্ট রুটে আর্টিকুলেটেড বাস চলাচলের ব্যবস্থা নেওয়া হচ্ছে। প্রতিদিন জয়দেবপুর বাস ডিপোতে বাসগুলো রাখা হবে। ডিপো থেকে তেল নিয়ে বাসগুলো নির্ধারিত রুটে যাতায়াত করবে। সহজে যাতে বাস টার্ন নিতে পারে সে জন্য মিরপুর-মতিঝিল, মতিঝিল-উত্তরা রুট নির্ধারণ করা হয়েছে। যাত্রীদের জন্য টিকেট কাউন্টারসহ ই-টিকেটিং ব্যবস্থা থাকছে। টিকেট স্পর্শ করলে দরজা খুলে যাবে। আর্টিকুলেটেড বাসগুলো সাধারণ বাসের চেয়ে একটু বেশি লম্বা হওয়ার কারণে এ বাসের চালকদের বেশি সচেতনতা প্রয়োজন। এ কারণে ভারতের অশোক লেল্যান্ড কোম্পানি তাদের অভিজ্ঞ ট্রেইনার দিয়ে চালকদের প্রশিক্ষণ দিয়েছে।

মহানগরী ঢাকার যাত্রী চাপ সামলাতে এসব বাস রাস্তায় নামছে। নতুন ধারার এ বাসগুলো ঢাকার নাগরিক জীবনে গণপরিবহনের বিশেষ চাহিদা পূরণে সক্ষম হবে।
সড়ক নির্মাণে কংক্রিট পেভমেন্ট
দেশের যোগাযোগব্যবস্থা আমূল পাল্টে যেতে পারে কংক্রিট পেভমেন্টের সড়ক নির্মাণে। সম্প্রতি সিমেন্ট শিল্পের অভাবনীয় বিকাশে এ ধরনের সড়ক নির্মাণ এখন প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে সুবিধাজনক। প্রাকৃতিক দুর্যোগ, বেশি বৃষ্টিপাত ও জলবায়ু পরিবর্তনের ফলে পরিবর্তিত নতুন পরিবেশে কয়েক গুণ বেশি টেকসই কংক্রিটের সড়ক দীর্ঘ মেয়াদে অর্থনৈতিকভাবে সাশ্রয়ী। এ সড়কের রক্ষণাবেক্ষণ খরচ যেমন কম, তেমনি ভারী ও বেশি যানবাহন চলাচলের জন্য দারুণ উপযোগী। দেশীয় ও আন্তর্জাতিক একাধিক গবেষণা প্রতিবেদনেও এমন সুপারিশ করে বাংলাদেশসহ উন্নয়নশীল দেশগুলোকে কংক্রিটের সড়ক নির্মাণে গুরুত্ব আরোপ করা হয়েছে।
সড়ক পর্যবেক্ষণ ও জরিপ
সড়ক ও জনপথ অধিদপ্তর (সওজ) সর্বশেষ ২০১২ সালের মার্চ মাসে সড়ক পর্যবেক্ষণ ও জরিপ চালায় ২১ হাজার ২৬৯ কিলোমিটারের মধ্যে ১৪ হাজার ৬৫২ কিলোমিটার সড়কে। রাফোমিটার দিয়ে চালানো পর্যবেক্ষণে এসব সড়কে বড় বড় গর্ত, ফেটে যাওয়া, পাথরসহ বিভিন্ন উপাদানের স্থানচ্যুতি, সরু সড়কে একই স্থান দিয়ে বার বার যান চলাচলে চাকার চাপে মাটি দেবে যাওয়ার বিষয়টা ধরা পড়ে। এতে দেখা যায়, তিন হাজার ৫৩৩ কিলোমিটার সড়কই যান চলাচলের একেবারে অনুপযোগী। এরপর বর্ষা কিংবা জলাবদ্ধতার কারণে সড়কের একাংশের অবস্থা আরো সঙ্গিন। এ ছাড়াও সওজের আরো সাত হাজার কিলোমিটার সড়ক চলাচলের অনুপযোগী। সড়ক পথের ২১ হাজার ২৬৯ কিলোমিটারের মধ্যে প্রায় ১৮ হাজার কিলোমিটার পাকা অংশই রয়েছে ঝুঁকির মধ্যে। মহাসড়কের মান বিপর্যয়ের কারণে বাড়ছে সড়ক দুর্ঘটনাও।

এ দেশের মহাসড়কের আয়ু সাধারণত ২০ বছর। এসব সড়কের উপর দিয়ে সর্বোচ্চ ১৫ টন ওজনের পণ্য বা যাত্রীবাহী যান চলাচল করতে পারে। কিন্তু বাস্তবে দ্বিগুণ বা তারও বেশি ওজনের পণ্যবাহী যান চলাচল করছে। এ কারণে কোনো কোনো সড়ক এক বছরের মধ্যে আর বেশির ভাগ সড়ক পাঁচ বছরের মধ্যেই যান চলাচলের অনুপযোগী হয়ে পড়ছে। বঙ্গবন্ধু সেতু দিয়ে ১৫ টনের বেশি পণ্যবাহী যান চলাচল নিষিদ্ধ। কিন্তু এখন গড়ে ১৬ টনের বেশি পণ্যবাহী যান চলাচল করছে। এতে ওই সেতুও রয়েছে ঝুঁকিতে। এরই মধ্যে ফাটল ধরেছে সেতুটিতে।
জলাবদ্ধতার জন্য সড়ক-মহাসড়কের অনেকাংশই নষ্ট হয়ে যাচ্ছে। শুধু ঢাকা-ময়মনসিংহ মহাসড়কেই বাজার রয়েছে ১২টি। জলাবদ্ধতার কারণে বাজার সড়কের পেভমেন্ট উঠে গিয়ে এটি যান চলাচলের অনুপযোগী হয়ে পড়েছে। জরুরি ভিত্তিতে বিটুমিনের বদলে কংক্রিটের পেভমেন্ট নির্মাণ করে এই বিপর্যয় রোধ করা সম্ভব।
আমাদের দেশে সনাতনী ধারায় সড়ক নির্মিত হচ্ছে। ফ্লেক্সিবল পেভমেন্ট নির্মাণের সংস্কৃতি থেকে বের হয়ে রিজিড পেভমেন্ট নির্মাণের দিকে ফিরতে হবে। আগে ঢাকার সচিবালয়ের সামনের সড়কসহ বিভিন্ন সড়ক কংক্রিট দিয়েই নির্মিত ছিল। ওগুলো ছিল রিজিড পেভমেন্ট। কিন্তু হঠাৎ করেই বিটুমিন ব্যবহার করে ফ্লেক্সিবল পেভমেন্ট নির্মাণ শুরু হয়। ফ্লেক্সিবল পেভমেন্টের চারটি স্তর থাকে। একেবারে উপরের স্তরে পাথরকে আঁকড়ে ধরে রাখে বিটুমিন। তদারকি ব্যবস্থা না থাকা ও বার বার রক্ষণাবেক্ষণের কারণে ফ্লেক্সিবল পেভমেন্টের ক্ষেত্রে ব্যয় হয় বেশি। দুর্নীতি ও অপচয় হয়। এ কারণে এগুলো নির্মাণের কিছুদিনের মধ্যেই বেশিরভাগ ক্ষেত্রে দেবে যায়। ভারত ও শ্রীলঙ্কায় নতুন উড়াল সড়ক নির্মাণসহ বিভিন্ন প্রকল্পে রিজিড পেভমেন্টকেই গুরুত্ব দিচ্ছেন প্রকৌশলীরা। আমাদের দেশের নগর এলাকার অলিগলিতে এখন নির্মাণ হচ্ছে কংক্রিট ব্যবহারের মাধ্যমে রিজিড পেভমেন্ট। ২০০৯ সালে বুয়েটের ‘ইভালুয়েশন অব ফ্লেক্সিবল অ্যান্ড রিজিড পেভমেন্ট কন্সট্রাকশন ইন বাংলাদেশ’ শীর্ষক গবেষণাপত্রে দেখা গেছে, ফ্লেক্সিবল পেভমেন্টের চেয়ে রিজিড পেভমেন্টই সময়োপযোগী ও সাশ্রয়ী।
আসছে সাফল্য
দ্রুতই সাফল্য পাওয়া যাচ্ছে কংক্রিটের পেভমেন্ট নির্মাণ করে। শেরপুর শহরে জলাবদ্ধতার কারণে সড়কের বিভিন্ন অংশ যান চলাচলের অনুপযোগী হয়ে পড়েছে। বিটুমিন দিয়ে তৈরি সড়কের পেভমেন্ট পানিতে ক্ষয় হচ্ছে। তাই শেরপুর শহরের শ্রীবরদী-বকশীবাজার সড়কের ২০০ ফুট অংশের পেভমেন্ট দুই বছর আগে কংক্রিট দিয়ে নির্মাণ করায় সড়কের এই অংশ এর পর আর জলাবদ্ধতায় নষ্ট হয়নি। এ কারণে শুধু এই অংশের রক্ষণাবেক্ষণ বাবদ বছরে সাশ্রয় হচ্ছে প্রায় পাঁচ লাখ টাকা।

একসময় ইন্দোনেশিয়া থেকে সিমেন্ট আমদানি হতো। সিমেন্ট সঙ্কট ও পশ্চিমা দেশগুলোর চাপে পড়ে বিটুমিন ব্যবহার শুরু হয়। কিন্তু এখন এই অবস্থা আর নেই। দেশেই তৈরি হচ্ছে সিমেন্ট, হচ্ছে রপ্তানিও। সড়কের দীর্ঘস্থায়িত্বের জন্য রিজিড পেভমেন্ট নির্মাণের কোনো বিকল্প নেই। কারণ বিটুমিন পানিতে ক্ষয় হয়, কিন্তু কংক্রিট পানিতে শক্তি পায়। তিন-চার বছর আগে সড়ক রক্ষণাবেক্ষণ ও উন্নয়ন প্রকল্পের আওতায় ঢাকা-সিলেট মহাসড়কের কিছু অংশ, সিলেট শহরে সড়কের কিছু অংশ, ঢাকা-চট্টগ্রাম মহাসড়কের কুমিল্লা অংশের কিছু অংশের পেভমেন্ট তৈরি করা হয়েছিল কংক্রিট দিয়ে। এগুলো এখনো অক্ষত আছে।
৩০-৩৫ বছর আগে আমাদের সড়ক তৈরির ক্ষেত্রে বিটুমিন ও পাথর দিয়েই পেভমেন্ট নির্মাণ করা হয়েছে। কিন্তু এখন বাস্তবতার কারণে আমাদের কংক্রিটের রিজিড পেভমেন্টের দিকে যেতে হবে। দেশের নদীগুলোর তলদেশ ক্রমেই ভরাট হয়ে উঁচু হয়ে যাচ্ছে। এ কারণে পানির স্তরের উচ্চতা বাড়ছে। মহাসড়কগুলোর বেশির ভাগের ভিত আরো উঁচু করতে হবে। কিন্তু মহাসড়কের অবকাঠামো পরিবর্তন করতে হলে ব্যয় হবে অনেক অর্থ। তাই রিজিড পেভমেন্টই যথাযথ। অনেক দেশেই কংক্রিটের তৈরি পেভমেন্ট আছে। এ ক্ষেত্রে ঢাকা-চট্টগ্রাম চার লেন প্রকল্পের মধ্যে দুই লেন ফ্লেক্সিবল ও দুই লেন রিজিড পেভমেন্ট নির্মাণ করে পরীক্ষা করা যেতে পারে। কোন্টি সাশ্রয়ী ও দীর্ঘস্থায়ী তা প্রয়োগের পরই বোঝা যাবে। এই মুহূর্তে জরুরি ভিত্তিতে দেশের বিভিন্ন জাতীয়, আঞ্চলিক ও জেলা সড়কে পানি জমে থাকে এমন অংশগুলোয় কংক্রিট দিয়ে রিজিড পেভমেন্ট তৈরি করা প্রয়োজন।
এ ছাড়া সড়ক নির্মাণের ক্ষেত্রে নানা ধরনের ত্রুটি রয়েছে। প্রকৌশলী ও ঠিকাদাররা যথাযথ নির্দেশনাও মেনে চলেন না। ফ্লেক্সিবল পেভমেন্ট তৈরির ক্ষেত্রে বিটুমিনের সঙ্গে পাথর দেওয়া হয়। কিন্তু এই পাথর ছোট ছোট করে ভেঙে দিলে বেশি স্থায়ী হয়। আমাদের দেশে বেশির ভাগ ক্ষেত্রেই এটি করা হয় না। রিজিড পেভমেন্ট সড়কের জলাবদ্ধ অংশকে রক্ষা করতে পারে।

বিটুমিন-অ্যাসফল্টে যত অসুবিধা
সওজের ২২ হাজার কিলোমিটার সড়কের মধ্যে ১৮ হাজার কিলোমিটারের একটা বড় অংশই এখন ঝুঁঁকির মুখে। সঠিক পদ্ধতি অনুসরণ না করে নির্মাণ, রক্ষণাবেক্ষণের অভাব, অতিরিক্ত ওজন বহনসহ নানা কারণে সড়কগুলো এখন বেহাল। সর্বোচ্চ ১০ বছর স্থায়িত্বের আশা করা হলেও অতিরিক্ত যান চলাচল আর সঠিক রক্ষণাবেক্ষণের অভাবে এক-দুই বছর যেতে না যেতেই বিটুমিন-অ্যাসফল্টের পেভমেন্ট ব্যবহারের অনুপযোগী হয়ে পড়ে। বিটুমিন পানিতে ক্ষয় হলেও কংক্রিট হয় আরো শক্ত। কয়েক বছর আগে দেশের একাধিক মহাসড়কের কিছু অংশের পেভমেন্ট কংক্রিট দিয়ে নির্মাণ করা হয়। সেগুলো এখনো প্রায় অক্ষত রয়েছে। ফ্লেক্সিবল পেভমেন্টের চারটি স্তর থাকে। তদারকি ব্যবস্থা না থাকা ও বার বার রক্ষণাবেক্ষণের কারণে দীর্ঘ মেয়াদে এতে খরচ হয় বেশি। দুর্নীতি এবং অপচয়েরও মাত্রা ছাড়িয়ে যায়। ফলে নির্মাণের কিছুদিনের মধ্যেই বিভিন্ন স্থানে দেবে যায়, সামান্য বৃষ্টিতেই সৃষ্টি হয় ছোট-বড় গর্তসহ ঝুঁকিপূর্ণ অবস্থার। আর এর মাসুল দিতে হয় সড়ক দুর্ঘটনায়। তিন দশক আগেও বিটুমিন-অ্যাসফল্টের পেভমেন্ট নির্মাণ সঠিক বলে মনে করা হতো। এখন সময় এসেছে কংক্রিটের সড়কের দিকে নজর দেওয়ার।
কংক্রিট সড়কের যত সুবিধা
সড়কের উপরের স্তরকে পেভমেন্ট বলা হয়। এটি সাধারণত দুই ধরনের- ফ্লেক্সিবল ও রিজিড। ফ্লেক্সিবল পেভমেন্ট নির্মাণে বিটুমিন-অ্যাসফল্ট আর রিজিড পেভমেন্টের ক্ষেত্রে সিমেন্টের সঙ্গে ইট বা পাথর ও বালু ব্যবহার করা হয়। সঙ্গে লাগে রডও। কংক্রিটের এমন সড়কের নির্মাণ ব্যয় বিটুমিন-অ্যাসফল্টের চেয়ে কিছুটা বেশি। কিন্তু দীর্ঘ মেয়াদে অনেক বেশি লাভজনক। ক্রমাগতভাবে জ্বালানির দাম বেড়ে যাওয়ায় কংক্রিটের সড়কের প্রয়োজনীয়তা আরো বেড়েছে। কারণ গবেষণায় দেখা গেছে, কংক্রিটের সড়কে গাড়ির জ্বালানি খরচ হয় কম। কংক্রিটের সড়কের স্থায়িত্ব বিটুমিন-অ্যাসফল্টের সড়কের চেয়ে প্রায় চার গুণ বেশি। ন্যূনতম ৩০ থেকে ৪০ বছর পর্যন্ত স্থায়িত্ব পায় এ সড়ক। নিয়মিত রক্ষণাবেক্ষণ করলে আরো বহু বছর নির্বিঘ্নে ব্যবহার করা যায়। অন্যদিকে পুঙ্খানুপুঙ্খ মান বজায় রেখে নির্মাণ করলেও বিটুমিন-অ্যাসফল্টের সড়কের আয়ুষ্কাল সর্বোচ্চ ১০ বছর। অনেক বিশেষজ্ঞ অবশ্য, পাঁচ-ছয় বছরের বেশি স্থায়িত্বের কথা বলেন না। আর ঘন ঘন সংস্কারের ঝক্কি তো আছেই। এ অবস্থায় প্রতিবেশী ভারতসহ বহু উন্নয়নশীল ও উন্নত দেশ কংক্রিটের দিকে ঝুঁঁকছে। ভারত ও শ্রীলঙ্কা মহাসড়কের পাশাপাশি এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়ে নির্মাণেও সময় সাশ্রয় ও স্থায়িত্বের কথা বিবেচনা করে রিজিড পেভমেন্ট পদ্ধতি বেছে নিয়েছে।
বালু, ইট, পাথর আর বিটুমিন-অ্যাসফল্টের পরিবর্তে কংক্রিটের সড়ক করলেই এখন বেশি সুবিধা। গ্রামাঞ্চলে স্থানীয় সরকার প্রকৌশল বিভাগের (এলজিইডি) সড়কগুলোর কোনো কোনোটি ছয় টন, কোনোটি আবার সর্বোচ্চ ১০ টনের সহ্য ক্ষমতার। কিন্তু এগুলোর উপর দিয়ে ১০-১৫ টনের গাড়িও চলে। সড়ক ও জনপথের সড়কের ক্ষমতাও সব মিলিয়ে ১৫-২০ টন। সেখানে দেড় টনের গাড়ি থেকে ৫০ টন বা তারও বেশি ভারী গাড়ি চলে। এ অবস্থায় বেশি মজবুত কংক্রিটের সড়ক নির্মাণই হবে যুক্তিযুক্ত।

রাজধানীর অধিকাংশ এলাকাই অপরিকল্পিত। এসব এলাকার রাস্তাগুলোয় যথাযথ পানি ও পয়ঃনিষ্কাশন ব্যবস্থা নেই। চালু থাকলেও রক্ষণাবেক্ষণ করা হয় না। বর্ষাকালে বৃষ্টিতে এগুলো দীর্ঘ সময় নিমজ্জিত থাকে। শুষ্ক মৌসুমেও নিস্তার নেই। ডিসিসির নর্দমা আর ওয়াসার পয়ঃপ্রণালীর উপচানো দুর্গন্ধময় ময়লা পানিতে সয়লাব থাকে রাস্তাগুলো। ফলে এলাকার বিটুমিনের রাস্তাগুলো দ্রুত নষ্ট হয়ে যায়। নির্মাণ বা রক্ষণাবেক্ষণের প্রায় সাথে সাথেই এসব রাস্তা ক্ষতবিক্ষত হয়ে চলাচল অনুপযোগী হয়ে পড়ে। বছরব্যাপী এলাকাবাসীর দুর্দশাও চলতে থাকে সমানে। কংক্রিটের পেভমেন্ট এই ক্ষেত্রে অধিক কার্যকর। এর প্রকৃতি বিটুমিনের বিপরীত। জমে থাকা পানি এর কোনো ক্ষতি করতে পারে না। অধিকন্তু এর নির্মাণ ব্যয়ও বিটুমিনাস পেভমেন্টের চেয়ে কম। ডিসিসির প্রাক্কলন অনুযায়ী প্রতিবর্গমিটার বিটুমিনাস পেভমেন্টের নির্মাণ ব্যয় ৩১৯০ টাকা আর কংক্রিট পেভমেন্টের ক্ষেত্রে এটি ১৮২৪ টাকা। তা ছাড়া একবার নির্মাণ করা হলে এটা দীর্ঘদিন অক্ষত থাকে। বিগত বছরগুলোতে ডিসিসি অল্প কিছু রাস্তায় কংক্রিট পেভমেন্ট নির্মাণ করেছে। যা বহুদিন যাবত অটুট আছে। তাই রাষ্ট্রীয় অর্থ সাশ্রয় ও জনভোগান্তি হ্রাসে ঢাকা মহানগরীর কলাবাগান, জিগাতলা, রাজাবাজার, শেওড়াপাড়া, নাখালপাড়া, মগবাজার, বাড্ডা ইত্যাদি অপরিকল্পিত এলাকাসমূহে বিটুমিনাস পেভমেন্টের পরিবর্তে কংক্রিটের পেভমেন্ট নির্মাণ যুক্তিযুক্ত। তাছাড়া কংক্রিট পেভমেন্টের ব্যবহৃত সড়কের উল্লেখযোগ্য সুবিধা হলো, এটি সম্পূর্ণ পরিবেশবান্ধব এবং প্রক্রিয়াজাত করে পুনরায় ব্যবহার করা যায়।
প্রকাশকাল: বন্ধন ৩৩ তম সংখ্যা, জানুয়ারি ২০১৩