যেকোনো দেশের সার্বিক উন্নয়নে পরিবহনব্যবস্থার গুরুত্ব অপরিসীম, বাংলাদেশও এর ব্যতিক্রম নয়। মিলেনিয়াম ডেভেলপমেন্ট গোলের (MDGs) প্রথম লক্ষ্যমাত্রা অর্জনে দেশীয় অর্থনীতির প্রবৃদ্ধি বছরে বৃদ্ধি পাওয়া উচিত ৮ শতাংশ হারে। কিন্তু রাজধানী ঢাকাকেন্দ্রিক অর্থনীতির জন্য বড় অভিশাপ অত্যধিক যানজট। যানজটে আটকে থাকা নগরবাসীর মূল্যবান সময় যেভাবে অপচয় হয়, তাতে অচিরেই মেক্সিকো সিটির অভিজ্ঞতাকে টপকে যাওয়া অসম্ভব নয়। ২০ শতাংশ কর্মক্ষম জনশক্তি তিন শ্রমঘণ্টার বেশি সময় কাটায় যানজটে আর জনশক্তির ১০ শতাংশের অপচয় হয় পাঁচ শ্রমঘণ্টারও বেশি। পরিবহন বিশেষজ্ঞরা অকপটে স্বীকার করছেন, ঢাকার রাস্তায় যানজটের অন্যতম কারণ অবাধ ও অনিয়ন্ত্রিত গাড়ি পার্কিং। অননুমোদিত স্থানে প্রাইভেটকারসহ গণপরিবহন দাঁড় করিয়ে রাখা হয় দিনের অনেকটা সময়। আর এতে ভেঙে পড়ছে ট্রাফিক নিয়ন্ত্রণব্যবস্থা, সৃষ্টি হচ্ছে দীর্ঘ ও প্রলম্বিত যানজটের। ফুটপাতেও অনিয়ন্ত্রিত গাড়ি পার্ক করায় নগরবাসী পায়ে হেঁটে চলতেও হচ্ছে বাধার সম্মুখীন।
প্রসঙ্গ পার্কিং
এক সমীক্ষায় দেখা যায়, একটি সচল গাড়ি প্রায় ৯৫ শতাংশ সময়ই থাকে পার্কিংরত অবস্থায়। অর্থাৎ দিনে গড়ে তা কেবল এক ঘণ্টা ২০ মিনিট যাতায়াতে ব্যবহৃত হয়। বাকি সময়টুকু যেভাবে পার্ক করা থাকে, তাতেই ঘটে বিপত্তি! একসময় আমেরিকার লসএঞ্জেলসে শিক্ষার মানোন্নয়নের সারা বছর টানা ক্লাস নেওয়ার উদ্যোগ নেওয়া হয়। কিন্তু চাহিদানুযায়ী ক্লাস নেওয়া সম্ভব হয়নি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলোতে প্রয়োজনীয়সংখ্যক শ্রেণীকক্ষ না থাকায়; সমস্যা মূলত শিক্ষকদের গাড়ি পার্কিংয়ের জায়গা নিয়ে। শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে জায়গার অভাবহেতু শিক্ষার্থীদের খেলাধুলার জন্য মাত্র ১৫ মিনিট সময় দেওয়া হতো। স্কুলের খেলার মাঠে শিক্ষকদের গাড়ি রাখার ব্যবস্থা করায় সমস্যাটি হয়েছে আরও প্রকট। এ রকম পরিস্থিতি থেকে পরিত্রাণে প্রয়োজন ছিল ব্যক্তিগত গাড়ি ব্যবহারকারী শিক্ষকদের কাছ থেকে পার্কিংয়ের জন্য নির্ধারিত পার্কিং ফি নেওয়া। এ ছাড়া যাঁরা বাসে, সাইকেলে কিংবা হেঁটে যাতায়াত করেন, তাঁদের জন্য বিশেষ সুবিধা বা ভাতা প্রদান করা, যাতে শিক্ষকেরা গাড়ি ব্যবহার বাদ দিয়ে গণপরিবহন, সাইকেলে অথবা হেঁটে চলাচলে উৎসাহী হন। পার্কিং সমস্যার জন্য বরাবরই আমেরিকা একটি যথার্থ উদাহরণ। সেখানে যাতায়াতব্যবস্থার উন্নয়ন পরিকল্পনায় মানুষ অপেক্ষা গাড়িকে প্রাধান্য দেওয়া হয়। দুঃখজনক হলেও সত্য যে আমেরিকায় পার্কিং নীতিমালা অনুযায়ী প্রাইভেট গাড়ি গণপরিবহনের ওপর প্রভুত্ব করে। টেকসই যাতায়াতব্যবস্থার জন্য প্রতিবেশী দেশ ভারত নানাভাবে আদর্শ স্থানীয় বলে বিবেচিত। ভারতের জাতীয় নগর পরিবহন নীতিমালায় পার্কিংয়ের ক্ষেত্রে ব্যক্তিগত গাড়ির তুলনায় গণপরিবহন এবং অযান্ত্রিক বাহনকে প্রাধান্য দেওয়া হয়েছে। নীতিমালায় দুটি ধারায় এর সুস্পষ্ট উল্লেখ রয়েছে। প্রথমত, যেহেতু নগর এলাকায় ভূমি অনেক মূল্যবান। তাই পার্কিংয়ের জন্য জায়গা প্রদান বিষয়ে প্রকৃত মূল্য বিবেচনার ওপর গুরুত্বারোপ করা হয়েছে। দ্বিতীয়ত, পার্কিংয়ের জন্য উচ্চমূল্য নির্ধারণ করা হলে, জায়গার যথার্থ ব্যবহার করা সম্ভব, যা গণপরিবহনের জন্য জায়গার পরিসর বৃদ্ধিতে সহায়ক। গণপরিবহন এবং অযান্ত্রিক বাহনের পার্কিং-সুবিধা বাড়ানোর মাধ্যমে কর্মস্থলে এবং সর্বত্র চলাচল সহজ ও স্বাচ্ছন্দ্য করা হলে টেকসই যাতায়াতব্যবস্থা গড়ে তোলা সম্ভব। নিঃসন্দেহে বলা যায়, অত্যধিক গাড়ির চাপে বর্তমান পৃথিবীতে প্রতিটি দেশই আজ পার্কিং-সমস্যায় জর্জরিত এবং এ থেকে মুক্তি পেতে নিত্যনতুন আইন ও ব্যবস্থাপনা প্রণয়ন করে যাচ্ছে। বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে আমাদেরও উচিত কালক্ষেপণ না করে পার্কিং-সমস্যার আশু সমাধান করা।

পার্কিং সমস্যা : প্রেক্ষিত বাংলাদেশ
আমাদের দেশে গাড়ি পার্কিংয়ের জন্য মূল যে সমস্যাগুলো রয়েছে। তা হলো-
অপর্যাপ্ত পার্কিংয়ের জায়গা বা দুর্বল অবকাঠামোগত সুবিধা।
নগর পরিকল্পনায় পার্কিং বিষয়টি পুরোপুরিভাবে উপেক্ষিত।
বিনা মূল্যে অথবা নামমাত্র মূল্যে গাড়ি পার্কিং।
আইন প্রয়োগকারী সংস্থার অপর্যাপ্ত লোকবল।
সামাজিক সচেতনতার অভাব।
বিনা মূল্যে অথবা নামমাত্র মূল্যে অবৈধ পার্কিং-সুবিধার কারণে দেশে প্রতিদিন অপ্রয়োজনীয়ভাবে ব্যক্তিগত গাড়ি নিয়ে স্বল্প দূরত্বে যাওয়া হচ্ছে যা পায়ে হেঁটেই যাওয়া সম্ভব। এতে ব্যক্তিগত গাড়ির সংখ্যা বাড়ছে দিনকে দিন। বাংলাদশে রোড ট্রান্সপোর্ট অথোরিটির (বিআরটিএ) হিসাবমতে কেবল ঢাকা শহরেই মে, ২০১৩ পর্যন্ত রেজিস্ট্রেশন করা ব্যক্তিগত ছোট গাড়ির সংখ্যা এক লাখ ৮৫ হাজারেরও বেশি। লেন দখল করে অতিরিক্ত গাড়ি পার্ক করার জন্য দিনের বেশির ভাগ সময় অনেক সড়কেই সৃষ্টি হচ্ছে যানজটের। ঢাকার মতিঝিল, দিলকুশা এলাকায় ১০ টাকার বিনিময়ে একটি ব্যক্তিগত গাড়ি সারা দিন পার্ক করা যায়। এখানে পার্কিংয়ের জন্য প্রায় ৭০-৮০টি স্থান বরাদ্দ রয়েছে। একবার টিকিট নিলে যেকোনো পার্কিংস্থলে সারা দিনের জন্য গাড়ি পার্ক করে রাখা যায়। এ ছাড়া সিটি করপোরেশনের সংশ্লিষ্ট বিভাগ থেকে ২৫০ টাকার বিনিময়ে পুরো মাসের জন্য গাড়ি পার্ক করা যায়। এখানে জমির মূল্য কাঠাপ্রতি কোটি টাকার ওপরে। পার্কিং ফি গ্রহণের ক্ষেত্রে জায়গা ও সময়ের মূল্য বিবেচনা করা হয় না। নিউমার্কেট এলাকায় দিনের ব্যস্ততম সময়েও দুই লেন জুড়ে অবৈধ পার্কিংয়ের চিত্র এখন নিত্যদিনের। প্রায় বিনা মূল্যে পার্কিং-সুবিধা থাকায় এখানে চলছে যততত্র পার্কিং, যার চাহিদা বেড়ে চলছে।

সমস্যা সমাধানে বহুতল গাড়ি পার্কিং
বাংলাদেশ প্রকৌশল এবং প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের (বুয়েট) পুরকৌশল বিভাগের অধ্যাপক ও নগর পরিবহন বিশেষজ্ঞ ড. মো. শামসুল হকের মতে, সমস্যার সূত্রপাত নগর পরিকল্পনার সময় পার্কিং-ব্যবস্থাকে সম্পূর্ণরূপে অবহেলা করায়। সড়কজুড়ে অনিয়ন্ত্রিত গাড়ি পার্কিংয়ের কারণে রাস্তায় পার্শ্ব-সংঘর্ষ এবং অন্যান্য কাজ (Non-motor Activity) উৎসাহিত হচ্ছে। ফলে সড়কের ধারণক্ষমতা কমে অবনতি ঘটে নিরাপত্তাব্যবস্থার। তিনি আরও জানান, আমাদের দেশে সড়কেই গাড়ি পার্কিংয়ের প্রবণতা সবচেয়ে বেশি। কারণ, এখানে অফ-স্ট্রিট পার্কিংয়ের সুযোগ অপ্রতুল। রাস্তার ওপরে অবৈধ গাড়ি পার্কিং প্রবণতা বেড়ে যাওয়ার পেছনে অন্যতম কারণ আইন প্রয়োগের দুর্বলতা এবং চালকনির্ভর গাড়ি চালানোর সংস্কৃতি। এটি নিয়ন্ত্রণে আনার জন্য বহির্বিশ্বে প্রচলিত কয়েক ধরনের অফ-স্ট্রিট পার্কিং-সুবিধার কথা উল্লেখ করেন অধ্যাপক ড. মো. শামসুল হক। ব্যাক স্ট্রিট পার্কিং (Back Street Parking), খোলা জায়গায় গাড়ি পার্কিং (Surface Car Parking), বেজমেন্টে গাড়ি পার্কিং (Basement Car Parking) এবং বহুতল ভবনে গাড়ি পার্কিং (স্বপার্কিং সিস্টেম-র্যাম্প ব্যবহার করে পার্কিং এবং স্বয়ংক্রিয় পার্কিং সিস্টেম- এলিভেটর ব্যবহার করে পার্কিং) এমনই কিছু ব্যবস্থা, যার সাহায্যে মূল সড়ক থেকে দূরে গাড়ি পার্ক করা যায়। এদের মধ্যে বহুতল ভবন গাড়ি পার্কিং-ব্যবস্থায় মূলত একটি অবকাঠামো, যাতে দালানের পুরোটা জুড়ে গাড়ি পার্কিংয়ের সুবিধা রয়েছে। খুব সম্ভবত ১৯১৮ সালে ওয়েস্ট ওয়াশিংটন স্ট্রিটে হোটেল লা সাল-এর জন্য প্রথম এমন সুবিধায় পার্কিং-ব্যবস্থা নির্মিত হয়। বর্তমানে নির্মিত ভবনগুলো পাঁচ-ছয়তলাবিশিষ্ট এবং প্রতি লটে ৫০০ গাড়ি রাখার ব্যবস্থা রয়েছে। এর মাধ্যমে নগর পরিকল্পনাবিদেরা সরাসরি যেমন পার্কিংয়ের জায়গা নির্দিষ্ট করে দিতে পারেন, তেমনি গাড়ি ব্যবহারকারীরাও খুব সহজে এবং নিশ্চিন্তে তাঁদের গাড়ি নির্দিষ্ট সময়ের জন্য পার্ক করতে পারেন। বেজমেন্ট পার্কিং, রুফটপ পার্কিংয়ের তুলনায় এ ব্যবস্থায় অনেক গাড়ির একত্রে স্থানসংকুলান সম্ভব। আমাদের দেশে অধিকাংশ বাণিজ্যিক ভবন নির্মিত হচ্ছে বেজমেন্ট পার্কিংয়ের অনুমোদন নিয়ে, জায়গাস্বল্পতার কথা মাথায় রাখলে এমন সিদ্ধান্ত নেওয়াটা প্রশংসনীয়। কিন্তু অনেক বিপণিবিতানে ওপরের অংশে তৈরি হয় ফ্ল্যাটবাড়ি বা বাণিজ্যিক অফিস। কেনাকাটার জন্য আসা মানুষের ব্যবহৃত গাড়ি ছাড়াও এসব আবাসিক ফ্ল্যাটে বা অফিসে থাকা মানুষদের নিজস্ব গাড়ি ওই একই বেজমেন্টে পার্ক করতে গিয়ে অনেক সময় স্থানসংকুলান হয় না, সড়কে পার্ক করা গাড়ির সংখ্যা তাই দিনকে দিন বাড়ছেই।
বহুতল গাড়ি পার্কিংয়ের খুঁটিনাটি
একটি বহুতল গাড়ি পার্কিং ভবন নির্মাণে বিশেষ কিছু দিক মনে রাখা বাঞ্ছনীয়। আর তা হলো মূল সড়কের নকশার সঙ্গে সামঞ্জস্য, গাড়ির স্বাচ্ছন্দ্যে চলাচল, ন্যূনতম সময়ে পার্কং করার নিশ্চয়তা, মূল সড়কে গাড়ির প্রভাব, গাড়ির নিরাপত্তা, ভবনে পর্যাপ্ত আলো-বাতাসের সুবিধা, পানি নির্গমনব্যবস্থা প্রভৃতি। তথাপি প্রচলিত পদ্ধতিতে নির্মিত বহুতল ভবনে বিভিন্ন অত্যাবশ্যকীয় দিক হলো-
১) র্যাম্পের নকশা
ক) র্যাম্প ব্যবস্থা
ক্লিয়ার ওয়ে (Clear Way) পার্কিং-ব্যবস্থায় এক তলা থেকে অন্য তলায় গাড়ির যাত্রাপথ সম্পূর্ণভাবে আলাদা করা থাকে, যা কি না নিরাপদ চলাচল নিশ্চিত করে।
অ্যাডজাসেন্ট (Adjacent) পার্কিং-ব্যবস্থায় গাড়ির যাত্রাপথে দ্বিমুখী চলাচল দেখা যায়। যদিও এতে চলাচলে সময় নষ্ট হতে পারে জটলা বেধে, তারপরও সীমিত ভূমিতে এ রকম স্থাপনা পার্কিং সমস্যা সমাধানে সহায়ক।
খ) র্যাম্পের ধরন
সরাসরি র্যাম্প নির্মাণে দালানের দীর্ঘতম দিকের সঙ্গে মিল রাখা আবশ্যক। এ ধরনের র্যাম্পের বড় সুবিধা হচ্ছে এটি নির্মাণে কম জায়গা লাগে এবং নির্মাণপ্রক্রিয়া অপেক্ষাকৃত সহজ। আর অসুবিধা হলো পথের শেষে তীক্ষ্ন বাঁক, যেখানে চালককে সর্বদাই সতর্ক থাকতে হয়।

বাঁকাপথের (Curve) র্যাম্প সাধারণত ভবনের বাইরের দিকে নির্মিত হয়, এর নির্মাণও খরচসাপেক্ষ। কিন্তু তুলনামূলকভাবে সহজে গাড়ি চলাচল নিয়ন্ত্রণ করা সম্ভব দেখে অনেক জায়গায় (খেলার স্টেডিয়াম) এ পদ্ধতিতেই র্যাম্প নির্মিত হয়। এ ক্ষেত্রে মনে রাখা প্রয়োজন, বর্তমান বিশ্বে ছয়তলাবিশিষ্ট ভবন পার্কিংয়ের জন্য নির্মিত হচ্ছে। কিন্তু কখনো যদি আরও অধিকসংখ্যক ফ্লোর (আট-নয় তলা) নির্মাণ করার প্রয়োজন পড়ে, তখন ভবনের বাইরে দুই পাশে বক্রাকার পথ বা র্যাম্প সংযুক্ত করে দিলে চালকেরা স্বাচ্ছন্দ্যে গাড়ি পার্ক করতে পারেন।
২) ফ্লোর ব্যবস্থা
বিভক্ত (Split) ফ্লোর ব্যবস্থায় চিত্রের মতো প্রতি ফ্লোরের অর্ধেক ভাগ বাকি অর্ধেক থেকে উল্লম্বভাবে আলাদা থাকে। এতে জায়গার সর্বোচ্চ ব্যবহার নিশ্চিত করা সম্ভব হয়, হোক তা উচ্চমূল্যের ভূমি। যদি প্রতি গাড়ির বিপরীতে বরাদ্দকৃত জায়গার হিসাব করা হয়, তবে নিঃসন্দেহে এ ব্যবস্থা অত্যন্ত কার্যকর।
ঢালবিশিষ্ট (Sloping) র্যাম্পের ক্ষেত্রে পুরো জায়গায় নির্দিষ্ট প্রস্থবিশিষ্ট র্যাম্প থাকে। এতে চালকদের গাড়ি পার্ক করা তুলনামূলকভাবে সহজ হয়, হাতের কাছে ফাঁকা জায়গায়ই গাড়ি পার্ক করে ফেলা যায়। সমস্যার শুরু তখনই, যখন একাধিক গাড়ি একত্রে নামতে গিয়ে জটলা তৈরি হয়।
৩) পার্কিংবিন্যাস
চাহিদা অনুযায়ী বহুতল ভবনে পার্কিংবিন্যাসও বিভিন্ন রকম। বিভিন্ন কৌণিক অবস্থানে পার্ক করার পাশাপাশি সমান্তরালেও গাড়ি পার্ক করা যায়।
সমান্তরাল পার্কিং পদ্ধতিতে যদিও খুব সীমিত জায়গায় অধিক গাড়ি পার্ক করা সম্ভব, কিন্তু যেটা ভাবতে হবে, তা হলো চালককে অত্যন্ত দক্ষতার সঙ্গে ধৈর্যের সঙ্গে গাড়ি পার্ক করতে হবে। নিচের ছবিতে এ রকম পার্কিংয়ের প্রয়োজনীয় জায়গার পরিমাপ দেখানো হয়েছে।
উল্লম্ব বরাবর বা সমকোণে পার্কিংয়ের পদ্ধতিতে প্রতি বর্গমিটার জায়গায় সর্বাধিক গাড়ি পার্ক করা সম্ভব। কিন্তু মনে রাখা জরুরি যে এতে অনেক চালক গাড়ি ঘোরাতে গিয়ে সমস্যায় পড়বেন। এমনকি দুই দিক চলাচলে চালকদের রাস্তা দেখতেও সমস্যা হতে পারে।
বিভিন্ন কৌণিক অবস্থানে গাড়ি পার্ক করার সুবিধা মাথায় রেখে মূলত তিনটি প্রক্রিয়ায় গাড়ি পার্ক করা যায়। ৬০μ, ৪৫μ এবং ৩০। ৬০μ পার্কিংকে ভাবা হয় আদর্শ পার্কিং ব্যবস্থা, যখন খুব অল্প সময়ের জন্য পার্ক করা হয়। কিন্তু এতে ৯০μ-তে পার্ক করা গাড়ির তুলনায় কম গাড়ি পার্ক করে রাখা যায়। ৪৫ এবং ৩০μ পার্কিংয়ের ক্ষেত্রে কেবল গাড়ি পার্কিংয়ের জায়গায় কম প্রস্থে বেশি গাড়ি রাখা যায়, কিন্তু প্রতি বর্গফুটে কম গাড়ির স্থানসংকুলান হয়। মূলত চাহিদার ওপর ভিত্তি করে একেক জায়গায় একেক ব্যবস্থায় পার্কিংয়ের অনুমতি দেওয়া হয়।
সংখ্যাতত্তে আদর্শ কিছু পরিমাপ
র্যাম্পের ঢাল : সর্বোচ্চ ১৫ শতাংশ
র্যাম্পের প্রস্থ : এক দিকে চলাচলে ন্যূনতম ১২ ফুট
দুই দিকে চলাচলে ন্যূনতম ২২ ফুট
র্যাম্পের ব্যাসার্ধ ন্যূনতম ৩২-৩৭ ফুট
র্যাম্প গ্রেড = (দুই ফ্লোরের মধ্যবর্তী উচ্চতা х ১০০/ (র্যাম্প দৈর্ঘ্য)
চালকদের দেখার সুবিধার জন্য দেয়াল রং করা এবং মার্কিংয়ের ব্যবস্থা
র্যাম্প দেয়াল
র্যাম্পে মার্কিং করার জন্য যে রং ব্যবহৃত হবে তা মূল ভবনের দেয়ালে ব্যবহৃত রং থেকে আলাদা হতে হবে।
সাইন চিহ্নগুলো এমনভাবে বসানো উচিত, যাতে করে চালকেরা তা ধারাবাহিকভাবে পড়তে পারেন।
পার্কিং ফি
নির্দিষ্ট বা সময়ের সঙ্গে সঙ্গে পরিবর্তনশীল ফি আরোপ করা যেতে পারে। গাড়ি বের হওয়ার সময় এই ফি সংগ্রহ করা যায়। এ ব্যবস্থা আমাদের দেশের শপিংমলগুলোর (যেমন : বসুন্ধরা শপিংমল) বেজমেন্ট পার্কিংয়ের ক্ষেত্রে লক্ষণীয়।
আলোর ব্যবস্থা
বহুতল পার্কিংয়ের ক্ষেত্রে প্রয়োজনীয় আলোকমাত্রা-
পার্কিংয়ের জায়গা ২০, ড্রাইভওয়ে ৫০, র্যাম্প ৭০, ছাদ ২০, প্রবেশ এবং বাহির পথ ১৫০।
এ ছাড়া পর্যাপ্ত নিরাপত্তাব্যবস্থা (ভিডিও মনিটরিং, ক্যাশ ব্যারিয়ার) আগুন নিয়ন্ত্রণ যন্ত্রপাতিসহ বাকি ব্যবস্থার দিকেও যথাযথ মনোযোগ দিতে হবে।
মেকানিক্যাল পার্কিং বা অটোমেটেড পার্কিং
বর্তমান সময়ের অন্যতম আলোচিত বিষয় স্বয়ংক্রিয় বা অটোমেটেড পার্কিং। এ ব্যবস্থায় সীমিত জায়গায় পর্যাপ্ত নিরাপত্তাসহ পার্কিংয়ের ক্ষমতা অনেক বাড়ানো যায়। কিন্তু যেহেতু অনেক খরচ (নির্মাণ, পরিচালনা ও রক্ষণাবেক্ষণ) দরকার, তাই এখনো আমাদের দেশে এর ব্যবহার যথেষ্ট নয়।

প্রয়োজন নিজস্ব চিন্তাভাবনার
জ্ঞানবিজ্ঞানচর্চার ক্ষেত্রে বিশেষজ্ঞ মহলে একটি প্রচলিত উক্তি হচ্ছে, ‘Think globally, act locally’। এতক্ষণ যে প্রচলিত পদ্ধতিতে বহুতল ভবনে গাড়ি পার্কিং সম্পর্কিত নকশা নিয়ে বলা হলো, তাতে উন্নত বিশ্বে বিদ্যমান বিভিন্ন নকশাই প্রাধান্য পেয়েছে। বুয়েটের পুরকৌশল বিভাগের অধ্যাপক ড. মো. শামসুল হক মনে করেন, হুবহু অন্যান্য উন্নত দেশের নকশার আলোকে বহুতল ভবন নির্মাণ করা হলে তা বিষয় বিবেচনায় অনেক ক্ষেত্রেই ফলপ্রসূ নাও হতে পারে। প্রথমত, উন্নত বিশ্বে গাড়ির মালিক নিজেই গাড়ি চালিয়ে আসেন। এতে মালিকের দ্বারাই গাড়ি নিয়ন্ত্রিত হয়। কর্মক্ষেত্রে প্রবেশের আগে তিনি চান গাড়িটি বহুতল ভবনে পার্কং করে যেতে। ফলে সাত-আট ঘণ্টার একটি বিশাল সময় নিরাপত্তার সঙ্গে গাড়িটি মালিকবিহীন অবস্থায় পার্ক করা থাকে। কিন্তু আমাদের দেশের গাড়ি চালনার সংস্কৃতি পুরোপুরি ভিন্ন। এখানে মালিক নিজে গাড়ি চালান না, সর্বদাই গাড়িচালক গাড়ির সঙ্গে অবস্থান করেন। ফলে উঁচু ভবনে চালক গাড়ি চালিয়ে পার্ক করবেন কি না তার সিদ্ধান্ত অনেকাংশে চালকের মনোভাবের ওপর নির্ভর করবে। উদাহরণস্বরূপ, ঢাকা শহরের বর্তমান পার্কিং অভিজ্ঞতার কথা তুলে ধরেন অধ্যাপক ড. মো. শামসুল হক। তিনি বলেন, অনেক জায়গাতেই রাস্তার ওপরে গাড়ি পার্কিংয়ের সুনির্দিষ্ট জায়গা আছে। অথচ তা কতটুকু নিয়মমাফিক হচ্ছে সেটা দেখার বিষয়। গাড়িচালকেরা ইচ্ছামতো গাড়ি পার্ক করে গাড়িতেই বা কাছাকাছি অবস্থান করেন, ফলে আইন প্রয়োগকারী সংস্থার কোনো সদস্যকে দেখতে পেলে তাঁরা দ্রুত জায়গা পরিবর্তন করে অন্যত্র গাড়ি পার্ক করেন। এ ক্ষেত্রে চালকদের আইন প্রয়োগকারী সংস্থার অপর্যাপ্ত লোকবলের সুবিধা নিয়ে ট্রাফিক পুলিশের সঙ্গে লুকোচুরি খেলতে দেখা যায়। আবার অনেক সময় বাড়তি উপার্জনের আশায় অনেক বিপণিবিতানের সামনে চালকদের অবৈধভাবে পার্কিংয়ের সুবিধা দেওয়া হয়, যেমনটি হয় নিউমার্কেট এলাকায়। অবৈধ পার্কিং সংস্কৃতি এ দেশে এতটাই চালকদের সহজাত অভ্যাসে পরিণত হয়েছে যে দিনের যেকোনো সময়ে নিউমার্কেট এলাকায় গেলে সহজেই দেখা মিলবে দুই অথবা তিন লেন ধরে সারিবদ্ধভাবে পার্ক করা গাড়ির লাইন। এমতাবস্থায় সুযোগসন্ধানী চালকদের মূল সড়ক ছেড়ে বহুতল ভবনে দীর্ঘসময় গাড়ি পার্কিংয়ের জন্য আকৃষ্ট করতে নকশায় অত্যাবশ্যকভাবে কিছু সংযোজন করা প্রয়োজন। উন্নত বিশ্বের পার্কিং ভবনগুলো কেবল গাড়ি থাকার কথা বিবেচনা করে তৈরি, তাই প্রতিতলার ক্লিয়ার হাইট সাত-আট ফুট থাকে। কিন্তু আমাদের দেশে গাড়ির পাশাপাশি চালকের কথাও ভাবতে হবে, প্রতি তলার উচ্চতা এবং আলো-বাতাসের চলাচল একটি ন্যূনতম সহনযোগ্য অবস্থায় রেখে চালকদের জন্য ওয়েটিংরুম, ওয়াশরুম, খাবার স্টল প্রভৃতির ব্যবস্থাও করতে হবে। তবেই গাড়িচালকেরা পার্কিংয়ের জন্য বহুতল ভবন ব্যবহারে আকৃষ্ট হবেন।
বহুতল গাড়ি পার্কিং ভবন নির্মাণে উপযুক্ত জায়গা
উপরিউক্ত বিষয় বিবেচনায় আমাদের বহুতল ভবনে গাড়ি পার্কিংয়ের ক্ষেত্রে কী কী বিষয় বিবেচ্য তা নিয়ে ধারণা তৈরি হলেও এখন আরেকটি ব্যাপার নিয়ে ভাবার সময় এসেছে। ঢাকার রাস্তায় এমন পার্কিংয়ের জন্য ভবন নির্মাণের জায়গা কোথায়? যেখানে গাড়ি পার্ক করে কেউ যাবেন অফিসে, অথবা কেউ দীর্ঘসময়ের জন্য ব্যস্ত হয়ে পড়বেন শপিংয়ে? তাই এ রকম ভবন নির্মাণে অবশ্যই জায়গার প্রাপ্যতা, দূরত্ব, পার্কিংয়ের জন্য মূল সড়কে এর প্রভাব এ রকম বিষয় বিবেচনায় আনা জরুরি। এ রকম আরও জরুরি কিছু বিষয়, যা মেনে ভবনগুলো নির্মাণ করা উচিত। যেমন-
যেকোনো বাণিজ্যিক প্রতিষ্ঠানের অবস্থান, যেখানে আসতে ব্যক্তিগত গাড়ি প্রয়োজন
ব্যক্তিগত গাড়ি ব্যবহারকারীর উৎস
প্রবেশ বা নির্গমন রাস্তার পর্যাপ্ততা
রাস্তা পারাপার বা হাঁটার সুবিধাজনক উপস্থিতি
সুনির্দিষ্ট সময়ের জন্য পার্কিং (দীর্ঘসময়/স্বল্পসময়)
সড়কে গাড়ি পার্কিংয়ের ওপর নিয়ন্ত্রণের মাত্রা
গাড়ি পার্কিংয়ের খরচ
গাড়ি পার্ক করে রাখার জন্য প্রদত্ত সুবিধা (স্বয়ংক্রিয় পার্কিং বা স্বপার্কিং) ইত্যাদি।
এখন আমাদের দেশের অনেক ভবনেই বেজমেন্ট পার্কিংয়ের ব্যবস্থা রয়েছে, যা দিয়ে স্বল্প সময়ের জন্য অনেকে তাঁদের চাহিদা মেটাতে পারছেন। আবার অনেক ব্যবসায়িক প্রতিষ্ঠান ভবনের বেজমেন্ট পার্কিংয়ের জন্য বরাদ্দকৃত জায়গা ব্যবসার কাজে ব্যবহার করছে, যেমনটি হচ্ছে গুলশানের পিংক সিটি শপিংমলে। তাই সহজেই নগরের রাস্তাগুলো ক্রমেই যানবাহনের কাছে বেদখল হয়ে যাচ্ছে। শহরজুড়ে বাড়ছে যানজটসহ বহুমুখী সমস্যা। এমতাবস্থায় বহুতল ভবন পার্কিং নির্মাণের জন্য আমাদের কিছু গুরুত্বপূর্ণ জায়গা বা ‘Strategic Location’-এর কথা মনে রাখতে হবে, এমনটাই মনে করেন বুয়েটের অধ্যাপক ড. মো. শামসুল হক। তাঁর মতে, পার্কিংয়ের জন্য নির্মিত ভবনগুলো কখনোই সংখ্যায় কম কিংবা বিশাল আকার বা ‘Megasize’ হওয়া উচিত নয়, বরং গুরুত্বপূর্ণ সব জায়গায় সংখ্যায় বেশি এবং কম ক্ষমতাবিশিষ্ট ভবন নির্মাণ করাই শ্রেয়। জংশন থেকে দূরে মিড ব্লকে এগুলো নির্মিত হলে সুবিধাজনক ফল পাওয়া সম্ভব। পার্কিংয়ের জন্য ভবন নির্মিত হলে তাতে বিভিন্ন দিক থেকে গাড়ি একত্র হবে, মানে তা নিজেই ট্রিপ উৎপাদক (Trip Generator) হিসেবে আচরণ করবে। আবার যদি অধিকাংশ ব্যবহারকারী চাকরিজীবী হন, তবে গাড়ির যাত্রাগুলোর মধ্যে সমবৈশিষ্ট্য থাকবে। যেমন- দিনের বেলায় অধিকাংশ গাড়ি একমুখী চলবে আর বিকেলে বিপরীতমুখে। এসব দিক বিবেচনায় নগর পরিকল্পনায় আগে থেকেই কৌশলগত অবস্থান নির্ধারণ করা উচিত। পার্কিংয়ের জন্য তৈরি বহুতল ভবনগুলো জংশন থেকে ন্যূনতম ৫০ মিটার দূরে রাস্তার মাঝামাঝি অংশে নির্মিত হওয়াটাই শ্রেয়। আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ দিকের উল্লেখ করে তিনি বলেন, নির্মিত ভবন সর্বদা চলাচলের অভিমুখের বাঁ দিকে নির্মাণ করতে হবে। নতুবা চালকদের বিশাল দূরত্ব পার হয়ে ইউ-টার্নের মাধ্যমে গাড়ি পার্ক করতে হবে। যদি এসব নীতিমালা অগ্রাহ্য করা হয়, তবে ভবন নির্মিত হওয়ার পরে তা সমস্যা সমাধানের চেয়ে সমস্যাকে আরও জটিল করে তুলবে।
সুন্দর ভবিষ্যতের হাতছানি
রাজউক ১৯৮৪ সালে বাড়ি বানানোর সময় গাড়ির জায়গা রাখার বিধান চালুর আগ পর্যন্ত যাঁরা বাড়ি বানিয়েছেন, তাঁরা বিষয়টিকে বাহুল্য মনে করেছেন। অবশ্য সে সময় গাড়ি নিয়ে নগরে এত সমস্যাও ছিল না। মতিঝিলের ভবনগুলোর অধিকাংশই ১৯৮৪ সালের আগে নির্মিত। নব্বইয়ের দশকেও যাঁরা মতিঝিলে ভবন তৈরি করেছেন, সেগুলোতেও পার্কিংয়ের জন্য আলাদা জায়গা রাখেননি। তারপরও কিন্তু রাস্তায় পার্ক করা গাড়ির সংখ্যা কমছে না। কারণ, রাস্তায় গাড়ি পার্ক করতে কোনো ফি দিতে হচ্ছে না এবং কর্মস্থলের একদম কাছে গাড়ি রেখে হেঁটে যাওয়া যাচ্ছে। বহুতল পার্কিং-ব্যবস্থার অভাবে একেক প্রতিস্থানে একেক পদ্ধতিতে পার্কিংয়ের সমস্যা মেটাতে হচ্ছে। মতিঝিলে বাংলাদেশ ও সোনালী ব্যাংকের নিজস্ব ভবনে গাড়ি পার্কিংয়ের ব্যবস্থা রয়েছে। নিজেদের গাড়ি ছাড়া এখানেও অন্য কোনো গাড়ি পার্ক করতে দেওয়া হয় না। কোনো গ্রাহক ব্যাংকে গাড়ি নিয়ে এলে কাজ শেষ করে দ্রুত জায়গা ত্যাগ করতে হয়। বাইরের কোনো গাড়ি এখানে পার্ক করা যায় না। আল্পনা প্লাজায় গাড়িভেদে পার্কিংয়ের জন্য বিভিন্ন রকম পার্কিং চার্জ নির্ধারিত রয়েছে। যেমন- ট্যাক্সি ক্যাব প্রতি প্রথম ঘণ্টা পাঁচ টাকা, প্রাইভেট গাড়ি ছয় টাকা, মোটরসাইকেলের জন্য চার টাকা হারে পার্কিং চার্জ দিতে হয়। প্রথম ঘণ্টার পর পরবর্তী ঘণ্টায় দুই টাকা করে দিতে হয়। এখানে যে কেউ পার্ক করতে পারবেন। মাল্টিপ্ল্যান সেন্টারে পার্কিংয়ে প্রথম ঘণ্টা গাড়িপ্রতি ১০ টাকা এবং মোটরসাইকেলের জন্য পাঁচ টাকা করে দিতে হয়। প্রথম ঘণ্টা পর ঘন্টায় প্রতি গাড়িকে পাঁচ টাকা করে চার্জ করা হয়। এ ছাড়া দোকানমালিকদের প্রতি মাসের ভাড়ার সঙ্গে ২০০ টাকা করে পার্কিং চার্জ দিতে হয়। এখানে ৭৫টি গাড়ি পার্ক করার মতো জায়গা রয়েছে। কিন্তু এত ভিন্নতার ভিড়ে একটি মাত্র সমাধান নিয়ে এগোনো জরুরি। সম্প্রতি ঢাকা ট্রান্সপোর্ট কো-অর্ডিনেশন অথোরিটি (ডিটিসিএ) পার্কিং মহাপরিকল্পনা হাতে নিয়েছে, যার দ্বারা পার্কিংয়ের জায়গা সুনির্দিষ্ট করার পরেও সার্বক্ষণিক মনিটরিং ও পার্কিং ফি সংগ্রহ করার পরিকল্পনা বাস্তবায়ন করা যাবে। রাস্তার ওপর পার্ক করার পাশাপাশি এসব জায়গা থেকে অদূরে বহুতল গাড়ি পার্কিং ভবন নির্মাণ করা যায়, তবে গাড়ি পার্কিং-সমস্যা অনেকাংশেই সমাধান করা সম্ভব।

কিন্তু এ ক্ষেত্রে আরও যা বলা প্রয়োজন, পার্কিং সমস্যার সমাধানে বেজমেন্ট পার্কিং বা বহুতল ভবন নির্মাণ আংশিক সমাধান এনে দিলেও তা পুরো যাতায়াতব্যবস্থার উন্নয়নে সহযোগী হতে পারে না। বহুতল পার্কিং ভবন নির্মাণ একটি ব্যক্তিগত গাড়িকেন্দ্রিক চিন্তা, এ ধারণার উৎপত্তি হয়েছিল যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্যের মতো উন্নত দেশে। পরিসংখ্যান লক্ষ করলে দেখা যাবে, যুক্তরাষ্ট্রে প্রতি হাজার মানুষের বিপরীতে গাড়ির সংখ্যা ৭৯৭ এবং যুক্তরাজ্যে এ সংখ্যা ৫১৯ (২০১০ সাল)। বিপরীতে একই বছরে বাংলাদেশের চিত্র দেখলে দেখব প্রতি হাজার মানুষের বিপরীতে গাড়ির সংখ্যা মাত্র ৩। আবার ব্যক্তিগত গাড়ির সংখ্যা রাজধানী ঢাকাতেই সবচেয়ে বেশি। বিআরটিএর হিসাব অনুযায়ী, জুন ২০১২ পর্যন্ত বাংলাদেশে রেজিস্ট্রিকৃত যানবাহনের মধ্য কেবল ১২.৮ শতাংশই ব্যক্তিগত গাড়ি। আর রাজধানী ঢাকার ক্ষেত্রে এই হার ২৫.৭ শতাংশ। অধ্যাপক ড. মো. শামসুল হকের মতে, এখন সবার আগে বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে সিদ্ধান্ত নিতে হবে যে ব্যক্তিগত গাড়ির ব্যবহারে কতটুকু প্রাধান্য দেব আমরা। বর্তমান বিশ্বে দীর্ঘস্থায়ী বা টেকসই এবং পরিবেশবান্ধব যাতায়াতব্যবস্থার (Sustainable and environment friendly transportation system) ধারণা অনুযায়ী, একটি দেশে সুষ্ঠু গণপরিবহন (Public Transportation) বা ট্রানজিট নেটওয়ার্ক (Transit Network) গড়ে তোলা জরুরি। যুক্তরাজ্যের উদাহরণ টেনে অধ্যাপক শামসুল হক বলেন, ওই সব দেশে পার্কিং নিয়মকানুন ব্যক্তিগত গাড়িবান্ধব হওয়ায় ব্যক্তিগত গাড়ির সংখ্যা ক্রমাগত বেড়ে গিয়ে তা নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে যাচ্ছে। অর্থনীতির চাকা থমকে দাঁড়ানোর পেছনে ছোট গাড়ির সংখ্যা বৃদ্ধিকে দায়ী করা যায়। কারণ, যত বেশিসংখ্যক ব্যক্তিগত গাড়ির সংখ্যা বাড়বে তত যানজট বাড়বে, ব্যাহত হবে মানুষের কর্মজীবন। অধ্যাপক ড. মো. শামসুল হকের মনে করেন, ঢাকার পরিবহনের চাহিদা অনেকাংশে মেটাচ্ছে ট্রানজিট বাসসহ সব গণপরিবহন। যানজটের অভিশাপে অভিশপ্ত এবং মিশ্র যানবাহনের ভিড়ে ধুঁকতে থাকা বর্তমান যাতায়াতব্যবস্থা নিরীক্ষা করে সহজেই বলা যায়, এখানে গণপরিবহনের ব্যবস্থা তার স্বরূপে নেই। ট্রানজিট বাসের অপেক্ষাকৃত বেশি যাত্রী পরিবহনের সক্ষমতা রয়েছে যদি তাকে গুরুত্ব দিয়ে তার সুবিধাজনক পরিবেশ দেওয়া হয় (যেমন- আলাদা লেন বা Dedicated Lane, বাসস্টেশনে যাত্রী আসা-যাওয়ার সংযোগ রক্ষাকারী সড়ক, বাস থেকে নামামাত্র রিকশা, সিএনজিচালিত অটোরিকশাসহ অন্য মোডে চলে যাওয়া বা Transfer Facility প্রভৃতি নিশ্চিত করা)। তাই ব্যক্তিগত গাড়ির পার্কিংয়ের চেয়ে বেশি জরুরি হলো বিভিন্ন জায়গায় (বিপণিবিতান, অফিস, স্কুল-কলেজ প্রভৃতি) বাস, হিউম্যান হলার, অটোরিকশা প্রভৃতির যাত্রী নামানোর এবং অপেক্ষা করার জায়গা (Frontal area and waiting area) নির্ধারণ করে দেওয়া। উদাহরণ হিসেবে আমরা ঢাকায় অবস্থিত বসুন্ধরা শপিংমলের দিকে তাকাতে পারি, যেখানে মার্কেটের সামনে দুই লেন জায়গা খালি আছে যাত্রী ওঠানামার জন্য।
ব্যক্তিগত গাড়ি পার্কিংয়ের জন্য সুষ্ঠুভাবে নির্মিত বহুতল গাড়ি পার্কিং-ব্যবস্থা তাৎক্ষণিক সমাধান দিতে পারে, কিন্তু আমরা যদি দীর্ঘমেয়াদি যাতায়াতব্যবস্থা এবং পরিবেশবান্ধব শহর নিশ্চিত করতে চাই, অবশ্যই দেশীয় প্রেক্ষাপট বিবেচনায় এনে ব্যক্তিগত গাড়ির পাশাপাশি গণপরিবহন এবং প্যারা-ট্রানজিটের (হিউম্যান হলার, অটোরিকশা) জন্য চিন্তাভাবনা করা উচিত সময়ের প্রয়োজনেই।
সাকিব মাহমুদ খান
সাবাবা ইসলাম
শিক্ষার্থী, বাংলাদেশ প্রকৌশল এবং প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয় (বুয়েট)
প্রকাশকাল: বন্ধন ৪১ তম সংখ্যা, সেপ্টেম্বর ২০১৩