ফ্রান্সের বিশ্বসেরা এ স্থাপত্যের কথা শোনেননি এমন কাউকে খুঁজে পাওয়া দুষ্কর। যুগ যুগ ধরে আপন মহিমায় বিশ্ববাসীর কাছে নিজের অতুলনীয় অপার সৌন্দর্য নিয়ে ঠায় দাঁড়িয়ে আছে এই স্তম্ভটি। নাম তার আইফেল টাওয়ার। এক নামে চেনে সবাই। সৌন্দর্য, খ্যাতি ও নান্দনিকতার বিচারে আইফেল টাওয়ার নির্বাচিত হয়েছে ইউরোপের সব চাইতে সেরা স্থাপত্য হিসেবে। ইতালির মোনজা ও ব্রিয়ানজা চেম্বার অব কমার্সের সাম্প্রতিক জরিপে সৌন্দর্য ও নান্দনিকতা বিচার করে ব্রিটিশ মুদ্রায় এর খ্যাতিমূল্য ধরা হয় ৩৪ হাজার ৪০০ কোটি পাউন্ড। বাংলাদেশি মুদ্রায় হিসেব করলে তা হয় প্রায় ৪৪ লাখ তিন হাজার ২০০ কোটি টাকা! ওই জরিপ আরো বলছে যে, সারা বিশ্বের পর্যটকেরা আইফেল টাওয়ার দর্শনে সবচেয়ে বেশি অর্থ খরচ করেন। চিন্তা করা যায়! প্রতিদিন এই টাওয়ার দেখতে আসেন অসংখ্য পর্যটক। এক অর্থে আইফেল টাওয়ার ফ্রান্সের প্রতীক হয়ে দাঁড়িয়েছে।
কীভাবে এলো আইফেল টাওয়ার
আসুন এবার জেনে নেওয়া যাক কীভাবে এলো এই আইফেল টাওয়ার। ফরাসি বিপ্লবের কথা কম-বেশি সবাই জানে। এই বিপ্লব হয়েছিল ১৭৮৭ সালে। এই ইতিহাসকে স্মরণ করতে চাইল ফ্রান্স এর একশ’ বছর উপলক্ষে। ১৮৮৭ সালে এই বিপ্লবের একশ’ বছরকে স্মরণীয় করে রাখতে নির্মাণ শুরু হয় এই টাওয়ারের। নির্মাণের ভার পড়ে সে সময়ের বিখ্যাত প্রকৌশলী আলেকজান্ডার গুস্তাভ আইফেলের উপর। তিনি এই অসাধারণ টাওয়ারটির নকশা প্রণয়ন করেন এবং সিদ্ধান্ত নেন এটি নির্মাণে ব্যবহার করবেন শুধুই লোহা! যেই ভাবা সেই কাজ! এর পর ১৮৮৭ সালে নির্মাণ শুরু হয়ে কাজ চলে একটানা দুই বছর দুই মাস। এর পর ১৮৮৯ সালের ৩১ মার্চ এই টাওয়ারটি খুলে দেওয়া হয় সর্বসাধারণের জন্য। টাওয়ারের নকশাকার ও প্রকৌশলীর নামেই নাম রাখা হয় আইফেল টাওয়ার। নির্মাণের সময় এই টাওয়ারের আয়ুষ্কাল ধরা হয়েছিল মাত্র বিশ বছর। অথচ সেটি এখন ঠায় দাঁড়িয়ে রয়েছে, যদিও এর বয়স ছাড়িয়ে গেছে ১২০ বছর!

তৈরি হলো যেভাবে
এই টাওয়ারটির উচ্চতা শুনলে ভিরমি খাবেন নিশ্চিত। ৩২৪ মিটার উঁচু লোহার তৈরি এই টাওয়ার। প্রায় দুই একর জুড়ে এই টাওয়ারের ভিত্তিমূল। এই টাওয়ারে রয়েছে অর্ধ বৃত্তাকার চারটি তোরণ। ১৮০৩৮টি লোহার টুকরো জুড়ে তৈরি করা হয়েছে এই টাওয়ার। আর টাওয়ারের নিচের অংশ যুক্ত রয়েছে বিশাল বিশাল কনক্রিট স্লাবের সাথে। নির্মাণ স্থানে এই ১৮০৩৮টি টুকরো শুধু জোড়াই দেওয়া হয়েছিল। আর যদি কোনো টুকরোতে কোনো ধরনের সংস্কার দরকার হয়েছে তো সেটিকে কারখানায় পাঠানো হয়েছিল। নিচের অংশের কাজ এগিয়ে যাওয়ার পর উপরের অংশ জোড়া দিতে গিয়ে সমস্যায় পড়েন নির্মাতারা। তারা বুঝতে পারছিলেন না কীভাবে বাকি অংশগুলো উপরে নিয়ে যাবেন। সে সময় টাওয়ারের চার পায়ের সাথে বিশেষ ধরনের চারটি লিফট সংযুক্ত করা হয়। এভাবেই সমস্যার সমাধান করেন টাওয়ারটির নির্মাতা গুস্তাভ আইফেল।

স্থাপত্য শৈলী
দুই একর জমির উপর দাঁড়িয়ে আছে এই লোহার স্তম্ভটি। এর ওজন ৭৩০০ টন। এটা শুধু লোহার ওজন। আর যদি নিচের কংক্রিটের স্তম্ভসহ ওজন নেওয়া হয় তাহলে এর ওজন হবে প্রায় ১০ হাজার টন। এই টাওয়ারে রয়েছে তিনটি তলা। প্রথম তলায় রয়েছে একটি পানীয় বার আর একটি ২৫০ আসনের থিয়েটার। দ্বিতীয় তলায় রয়েছে ল্য ফিয়েরো নামের পত্রিকার অফিস ও ছাপাখানা। আর একেবারে উপরের তলা অর্থাৎ তিন তলায় রয়েছে উন্মুক্ত এলাকা দর্শনার্থীদের জন্য। আগে এখানে একটি অ্যাপার্টমেন্ট ছিল আইফেল গুস্তাভের জন্য। ১৯০৯ সালে এর চূড়ায় বসানো হয় একটি রেডিও অ্যান্টেনা। এতে আইফেল টাওয়ারের উচ্চতা আরো ২০.৭৫ মিটার অর্থাৎ প্রায় ৬৬ ফুট বেড়ে যায়। তখন থেকে আইফেল টাওয়ারকে বেতার তরঙ্গ প্রেরণের জন্যও ব্যবহার করা হচ্ছে। পর্যায়ক্রমে আইফেল টাওয়ারে একটি টেলিভিশন অ্যান্টেনাও সংযোজন করা হয়েছে। টাওয়ারে খোদাই করা আছে ফ্রান্সের বিশিষ্ট ৭২ ব্যক্তির নাম। টাওয়ার নির্মাণের পর এতে বিভিন্ন সময় সংস্কার করা হয়েছে। সাত বছর পর পর এতে রঙ করা হয়। প্রয়োজন হয় ৬০ থেকে ৭০ টন রঙ। আইফেল টাওয়ারের চূড়ায় ওঠার জন্য লিফট রয়েছে ৯টি। কিন্তু ২য় বিশ্বযুদ্ধের সময় এই লিফটের তার কেটে ফেলা হয়। সে সময় এডলফ হিটলার পায়ে হেঁটে চূড়ায় উঠতে বাধ্য হন। এজন্য ফ্রান্সবাসী মজা করে বলে, হিটলার ফ্রান্স জয় করলেও আইফেল টাওয়ার জয় করতে পারেনি।

বিশ্বসেরা পর্যটন স্থান
১৯৩০ সালে যুক্তরাষ্ট্রের ক্রাইসলার বিল্ডিং নির্মাণের আগ পর্যন্ত এটিই ছিল বিশ্বের সব চাইতে উঁচু স্থাপনা। এই টাওয়ার দর্শনে এখন প্রতিবছর প্রায় ৭০ লাখ করে পর্যটক আসেন প্যারিসে। আর এই সংখ্যা ক্রমশ বেড়েই চলেছে। শুধু গত বছরেই, মানে ২০১১ সালেই পর্যটক এসেছিলেন ৭১ লক্ষ ১০ হাজার জন! ভাবুন তো একবার! আর আগেই বলেছি, জরিপ সংস্থা দাবি করছে বিশ্বের এই স্থাপত্যটি দেখতে এসেই নাকি সবচেয়ে বেশি অর্থ ব্যয় করে থাকেন পর্যটকেরা। শুধু পর্যটন স্থাপনা নয়, এটি যেন ফ্রান্সের সোনালি ইতিহাসের কথা বলে, বলে ফ্রান্সবাসীর রুচিশীলতার কথা। আর সেই সাথে ঘোষণা করে বিশ্বের ইতিহাসে সিভিল ইঞ্জিনিয়ারিংয়ের এক নতুন সূচনার কথা, আর হবেই বা না কেন, শুধু লোহার টুকরো জোড়া দিয়েই যে এমন নান্দনিক শিল্প গড়ে তোলা যায় তা কি গুস্তাভ আইফেলের আগে ভেবেছিল কেউ? যা হোক, শেষ করার আগে একটা মজার তথ্য দিয়ে যাই। যদিও লেখার শুরুতেই বলেছিলাম এর উচ্চতা ৩২৪ মিটার, তবে সেটি কিন্তু স্থায়ী নয়! কারণ পুরোটাই লোহার তৈরি এই টাওয়ার সূর্যের তাপে প্রায় ১৫ সেন্টিমিটার পর্যন্ত সম্প্রসারিত ও সংকুচিত হয় দিনে-রাতে।
ফয়সাল হাসান সন্ধী
প্রকাশকাল: বন্ধন ৩১ তম সংখ্যা, নভেম্বর ২০১২