বিশ্বখ্যাত ল্যুভর মিউজিয়ামের দাপ্তরিক নাম ‘গ্রেট ল্যুভর’; বিশ্বব্যাপী যা দ্য ল্যুভর নামেই সমধিক পরিচিত। বিশ্বের অন্যতম বৃহৎ ও ঐতিহাসিক স্থাপনা এটি। ফ্রান্সের রাজধানী প্যারিসের কেন্দ্রস্থলে সিন নদীর দক্ষিণ পাড়ে এর অবস্থান। প্রাগৈতিহাসিক যুগ থেকে আজ অবধি পৃথিবীর বিভিন্ন প্রান্তের বিভিন্ন সময়ে বসবাসকারী জাতিগোষ্ঠীর শিল্প, সংস্কৃতি আর ঐতিহ্যের সাক্ষী হয়ে রয়েছে ল্যুভর মিউজিয়াম। প্রায় ৪০ একর জায়গাজুড়ে অবস্থিত স্থাপনাটিতে রয়েছে প্রায় তিন লাখ ৮০ হাজার নিদর্শন, যার মধ্যে প্রায় ৩৫ হাজার নিদর্শন দর্শনার্থীদের জন্য প্রদর্শিত হচ্ছে। প্রতিবছর গড়ে প্রায় ৯ দশমিক ৭ মিলিয়ন (৯৭ লাখ) দর্শনার্থী পরিদর্শন করায় বিশ্বে এটিই সবচেয়ে বেশিবার পরিদর্শিত মিউজিয়াম।
ঐতিহাসিক এ স্থাপনাটির সৌন্দর্যবর্ধন কিংবা আয়তন বৃদ্ধির কারণে বিভিন্ন সময়ে এর পরিবর্তন, পরিবর্ধন ও সংস্কার করা হয়েছে। চারতলাবিশিষ্ট বিশাল ল্যুভর ভবনটি দুটি অংশে বিভক্ত। যার একটি ‘দি ওল্ড ল্যুভর’ ভবনসংলগ্ন ‘Cour Carrer’ অপরটি ‘দ্য নিউ ল্যুভর’ ভবনসংলগ্ন ‘Cour Napoleon’. প্রতি দিকে ১৬০ মিটার দৈর্ঘ্যরে ‘দি ওল্ড ল্যুভর’ ভবনটিতে আছে আটটি উয়িংস (Wings), যা স্ব স্ব নামে আটটি প্যাভিলিয়নে বিভক্ত। ‘দ্য নিউ ল্যুভর’ ভবনের উত্তর ও দক্ষিণ ভবন দুইটির দৈর্ঘ্য ৫০০ মিটার। উত্তরের ভবনটি ‘Pavillion De lo Bibiothque, Pavillion De Rohan’ আর ‘Pavillion De Marron’ নামে তিনটি বিশাল প্যাভিলিয়নে বিভক্ত আর দক্ষিণ দিকের ভবনটি ‘Pavillion Du to Lesdiguieres, Pavillion Des Sessions, Pavillion De to Tremoille, Pavillion Des Etats এবং Pavillion De Flore নামে পাঁচটি বিশাল প্যাভিলিয়নে বিভক্ত। এই প্যাভিলিয়নগুলো আবার বেশ কিছু ছোট প্যাভিলিয়নে বিভক্ত।

ল্যুভর প্যালেসে মিউজিয়ামটি প্রতিষ্ঠিত, যা মূলত দ্বাদশ শতাব্দীতে দ্বিতীয় ফিলিপ কর্তৃক নির্মিত একটি দুর্গ বিশেষ। দুর্গের অবশিষ্টাংশ এখনো জাদুঘরের ভূগর্ভস্থ তলে দৃশ্যমান। বেশ কয়েকবার পরিবর্তন ও পরিবর্ধনের পর ভবনটি বর্তমান আকার ও আকৃতি পেয়েছে। ১৬৮২ খ্রিষ্টাব্দে চতুর্দশ লুই বসবাসের স্থান হিসেবে এটিকে পরিত্যাগ করে রাজকীয় সংগ্রহ প্রদর্শনের স্থান হিসেবে নির্বাচন করেন, যা ১৬৯২ খ্রিষ্টাব্দে তৎকালীন গ্রিক ও রোমান ঐতিহ্যের শিল্প-ভাস্কর্য প্রদর্শনের প্রধান স্থান হিসেবে পরিচিতি পায়। ১০০ বছরেরও বেশি সময় এটি এভাবেই ছিল। ফ্রান্স বিপ্লবের সময় এটিকে পরিপূর্ণ জাদুঘর হিসেবে ঘোষণা করা হয়। ১৭৯৩ খ্রিষ্টাব্দের ১০ আগস্ট জাদুঘর হিসেবে এটি আত্মপ্রকাশ করে। প্রথম প্রদর্শনীতে এখানে স্থান পায় ৫৩৭টি শিল্পকর্ম, যেগুলো ছিল রাজকীয় আর বাজেয়াপ্ত চার্চের সম্পদ। ভবনটির কাঠামোগত ত্রুটির কারণে ১৭৯৬ থেকে ১৮০১ সাল পর্যন্ত এটি বন্ধ ছিল। বিশ্বজয়ী বীর নেপোলিয়নের সময়ে এটি সংগ্রহে সবচেয়ে সমৃদ্ধ হয়। তখন এর নামকরণ করা হয় ‘Musee Napoteon’. ওয়াটারলু যুদ্ধে নেপোলিয়নের পরাজয়ের পর নেপোলিয়ন সেনাবাহিনী কর্তৃক লুটকৃত অনেক শিল্পকর্মই তাদের প্রকৃত মালিককে ফেরত দেওয়া হয়। পরবর্তীকালে এর সংগ্রহশালা সমৃদ্ধ করেন অষ্টাদশ লুই ও দশম চার্লস।
২০০৮ সালে মিউজিয়ামটির সম্পূর্ণ সংগ্রহশালাকে আটটি বিভাগে ভাগ করা হয়। যেগুলো- মিসরীয় অ্যান্টিকুইটিস; নেয়ার ইস্টার্ন অ্যান্টিকুইটিস; গ্রিক, ইট্রাসকান ও রোমান অ্যান্টিুকুইটিস; ইসলামিক আর্ট; ভাস্কর্য; ডেকোরেটিভ আর্ট; পেইন্টিংস, পেইন্টস ও ড্রয়িংস।

মিসরীয় অ্যান্টিকুইটিস
খ্রিষ্টপূর্ব ৪০০০ থেকে চতুর্থ শতাব্দী পর্যন্ত সময়কাল এই বিভাগের অন্তর্ভুক্ত। এই সময়কালে ৫০ হাজারেরও বেশি নিদর্শন ও শিল্পকর্ম এখানে প্রদর্শিত হচ্ছে; যেগুলো প্রদর্শন করতে এর ২০টিরও বেশি ঘর ব্যবহৃত হয়। প্রদর্শিত বস্তুগুলোর মধ্যে উল্লেখযোগ্য- ওই সময়কালের ইজিপশিয়ান, বাইজেনটাইন ও প্লোটোমক সভ্যতা বহনকারী চিত্রকর্ম, প্যাপিরাস স্ক্রল মমি, যন্ত্রপাতি, পোশাক-পরিচ্ছদ, অলংকার, খেলাধুলার সামগ্রী, যন্ত্রসংগীত সামগ্রী ও অস্ত্রসামগ্রী।
নিয়ার ইস্টার্ন অ্যান্টিকুইটিস
প্রাচ্যে ইসলামি যুগের পূর্ব পর্যন্ত সময়কাল এই বিভাগের অন্তর্ভুক্ত। ভৌগোলিক দিক থেকে এই বিভাগকে আবার তিনটি উপবিভাগে ভাগ করা হয়েছে। যেগুলোকে লেভান্ট, মেসোপটেমিয়া ও পার্শিয়া নামে নামকরণ করা হয়েছে। যেখানে পৃথকভাবে তুলে ধরা হয়েছে এই সভ্যতাগুলোকে।
গ্রিক, ইট্রাসকান ও রোমান অ্যান্টিকুইটিস
সাইক্লেডিক যুগ থেকে রোমান সাম্রাজ্যের অবসান এই সময়কাল এই বিভাগের অন্তর্ভুক্ত। এটি এই জাদুঘরের প্রাচীনতম শাখা, যার সূত্রপাত হয়েছিল প্রথম ফ্রান্সিসের মাধ্যমে, যিনি ছিলেন চিত্র ও শিল্পকর্মের একজন বড় সংগ্রাহক। এই সময়কালের নিদর্শনগুলোর মধ্যে বেশির ভাগই দেখা যায় মার্বেল পাথর ও তামার তৈরি ভাস্কর্য। এগুলোর মধ্যে অন্যতম, মার্বেল পাথরের তৈরি ‘Venus de Mile যা ক্লাসিক্যাল আর্টের একটি অনন্য উদাহরণ এবং তামার তৈরি ‘Borghese Vore’. এ ছাড়া এখানে আছে গ্রিক সাম্রাজ্যের এক হাজারেরও বেশি অসাধারণ চিত্রকর্ম, যেগুলো ‘Galerie Campana’-তে প্রদর্শিত হয়। নেপোলিয়নের সময়ে এই সময়কালের আরও অনেক গুরুত্বপূর্ণ ও ঐতিহাসিক চিত্রকর্ম ও শিল্পকর্ম নেপোলিয়নের সেনাবাহিনী কর্তৃক সংগৃহীত হয়েছিল, যেগুলো নেপোলিয়নের পরাজয়ের পরবর্তী সময়ে প্রকৃত মালিকদের ফেরত দেওয়া হয়, যার মধ্যে অন্যতম ছিল ‘Apollo Belvedese’, যা বিশ্বখ্যাত একটি ভাস্কর্য।

ইসলামিক আর্ট
এটি মূলত ডেপোরেটিভ আর্ট বিভাগের একটি শাখা। ২০০৩ সালে এটিকে পৃথক বিভাগে ভাগ করা হয়। এটি ত্রয়োদশ শতকের ইসলামি ইতিহাস ও ঐতিহ্যের পরিচয় বহন করে। ওই সময়কালের পাঁচ হাজারেরও বেশি নিদর্শন এখানে সংরক্ষিত আছে, যেগুলোর মধ্যে অন্যতম পারস্যের বিখ্যাত কবি ফেরদৌসীর নিজ হাতে লেখা আলোচিত মহাকাব্য শাহনামা। এটির সংগ্রহে আছে ইসলামি ঐতিহ্যের সিরামিক, গ্লাস, ধাতব ও কাঠের নির্মিত বিভিন্ন শৈল্পিক কারুকার্য খচিত দ্রব্যাদি।
ভাস্কর্য
এই বিভাগটি মূলত ১৮৫০ খ্রিষ্টাব্দের আগের গ্রিক, ইটসকাম ও রোমান সভ্যতা ছাড়া অন্যান্য সভ্যতার ভাস্কর্যের প্রদর্শক। আগে এই বিভাগটি ছিল সবচেয়ে ছোট পরিসরে এবং এর সংগ্রহশালাও খুব সমৃদ্ধ ছিল না। কিন্তু ১৮৪৭ সালে লিওন লেবোরডের দায়িত্ব নেওয়ার পর এটিকে সমৃদ্ধশালী করেন। যার মধ্যে আছে একাদশ শতকের ‘Danil in the Lions Den’ দ্বাদশ শতকের ‘Virgin of Auvergne’ ছাড়া অনেক বিশ্বখ্যাত ও ঐতিহাসিক ভাস্কর্য।
ডেকোরেটিভ আর্ট
ডেকোরেটিভ আর্ট বিভাগটি স্কাল্পতার বিভাগের সঙ্গে অতিমাত্রায় সম্পৃক্ত। যে কারণে এই বিভাগ দুটি দীর্ঘ সময় একসঙ্গে ছিল। এখানেও আছ ধাতু, সিরামিক, এনামেল ও কাচের তৈরি বিভিন্ন জাতির নিত্যপ্রয়োজনীয় তৈজসপত্র। এই বিভাগের সংগ্রহশালা মূলত সমৃদ্ধ হয়েছে বিভিন্ন ব্যক্তি ও পরিবারের দানে। এই বিভাগের নিদর্শনগুলো প্রথম তলার ‘Richelieo Wings’ ও ‘Apollo Gellery’-তে প্রদর্শিত হয়।

পেইন্টিং
ল্যুভর মিউজিয়ামের আজকের এই বিশ্বজোড়া খ্যাতির অন্যতম কারণ এর পেইন্টিং সংগ্রহশালা। ত্রয়োদশ শতক থেকে ঊনবিংশ শতক পর্যন্ত সময়কালে আঁকা চিত্রকর্মগুলো মোট ১২ কিউরেটর বিভিন্ন সময়ে সংগ্রহ করেছেন। এখানকার মোট চিত্রকর্মের দুই-তৃতীয়াংশই ফ্রেঞ্জ আর্টিস্টদের আঁকা আর বাকিগুলো এক হাজার ২০০-রও বেশি শিল্পীর আঁকা। এই বিভাগের চিত্রকর্মগুলোর বেশির ভাগই প্রথম ফ্রান্সিস এবং চতুর্দশ লুই কর্তৃক সংগৃহীত। আর একটি বড় অংশ নেপোলিয়ন কর্তৃক সংগৃহীত যে চিত্রকর্মগুলো পরবর্তী সময়ে আর ফেরত দেওয়া হয়নি; এগুলোসহ বাকিগুলো বিভিন্ন সময়ে কেনা। এর সংগ্রহে আছে বিশ্বখ্যাত শিল্পী লিওনার্দো দ্য ভিঞ্জির আঁকা বিশ্ববিখ্যাত মোনালিসা, Virgin and Child with St. Anne, St. John the Baptist’ এবং ‘Madonna of the Rocks’ এ ছাড়া এখানে আছে ক্যারাভাঞ্জিও (Corouvaggio)র ‘The Fortuen Teller’ ‘Death of the Virgin, Hyacinthe Rigaud’-এর ‘Louis xiv, Jacques Louis David’-এর ‘The Coronation of Napoleon’ ছাড়াও অনেক বিখ্যাত চিত্রকর্ম।
প্রিন্টস অ্যান্ড ড্রয়িংস
রাজকীয় সংগ্রহশালার আট হাজার ৬০০টি শিল্পকর্ম নিয়ে এ বিভাগের যাত্রা শুরু হলেও পরবর্তী সময়ে বিভিন্ন ব্যক্তি ও প্রতিষ্ঠানের দানে এবং ক্রয়ে এই বিভাগ অনেক সমৃদ্ধ হয়। এর সংগ্রহে বর্তমানে আছে প্রায় ৫০ হাজারের বেশি প্রিন্টস, পাঁচ হাজারের বেশি ড্রয়িংস এবং পাঁচ হাজারের বেশি সচিত্র বই। ‘Pavillion de Flore’-এ এর সংগ্রহশালা প্রদর্শিত হয়। স্থান সংকুলনের কারণে এর সব শিল্পকর্ম একত্রে প্রদর্শন করা সম্ভব হয়নি।

ল্যুভর জাদুঘর যদিও ফ্রান্স সরকারের সম্পত্তি, তার পরও ১৯৯০ সাল থেকে এটি প্রায় স্বায়ত্তশাসিত প্রতিষ্ঠান হিসেবে এর কর্মকান্ড পরিচালনা করে আসছে। বর্তমানে পরিচালক ‘Jean-Lue Martinez’ যিনি ২০১৩ সালের এপ্রিলে দায়িত্ব নিয়েছেন। বর্তমানে এখানে মোট কর্মকর্তা ও কর্মচারীর সংখ্যা প্রায় দুই হাজার।
শিল্প সুষমার পাশাপাশি এখানে দর্শনার্থীদের জন্যও রয়েছে প্রায় সব ধরনের সুযোগ-সুবিধার সুব্যবস্থা। এর বিশাল ভূগর্ভস্থ তলে আছে অফিস, দোকান, প্রদর্শনীর স্থান, সংরক্ষণ স্থান, পার্কিং, মিলনায়তন কেন্দ্রসহ পর্যটক বাসস্ট্যান্ডও।
আশিক মাহমুদ
ashick.iak@gmail.com
প্রকাশকাল: বন্ধন ৫১ তম সংখ্যা, জুলাই ২০১৪