বর্তমান বিশ্বে ঐতিহাসিক, আয়তনে বৃহৎ আর নান্দনিক সৌন্দর্যমণ্ডিত চার্চ আছে অনেকই, কিন্তু সাগরাদা ফ্যামিলিয়া সবার থেকে ভিন্ন ও অনন্য। স্পেনের বার্সেলোনায় অবস্থিত ‘দ্য ব্যাসিলিকা অ্যান্ড এক্সপিয়াটরি চার্চ অব দ্য হলি ফ্যামিলি (The Basilica and Expiatory Church of the Holy Family)’ নামেই যার পরিচিতি, যা স্পেনের অন্যতম প্রধান ও বৃহৎ ক্যাথলিক চার্চ। কাতালান স্থপতি অ্যাটনি গুডির নকশাকৃত নয় হাজার আসনবিশিষ্ট চার্চটির নির্মাণকাজ অসমাপ্ত থাকলেও এটি ইউনেসকো ওয়ার্ল্ড হেরিটেজ সাইটের অন্তর্ভুক্ত। ২০১০ সালের নভেম্বরে পোপ ষোড়শ বেনেডিক্ট এটিকে মাইনর ব্যাসিলিকা হিসেবে ঘোষণা করায় এটি ক্যাথাড্রাল থেকে পৃথক চার্চরূপে আত্মপ্রকাশ করে।
শুরুর কথা
‘দ্য ব্যাসিলিকা অব সাগ্রাডা ফ্যামিলিয়া’র প্রতিষ্ঠাতা কাতালান জোসেফ মারিয়া ঝোকাবেল, যিনি Spiritual Association of St. Joseph-এর প্রতিষ্ঠাতা। ১৮৭২ সালে ভ্যাটিক্যান শহরের লোরেটোর আদলে একটি চার্চ নির্মাণের পরিকল্পনা করেন ঝোকাবেল। এরই ভিত্তিতে ১৮৮২ সালের ১৯ মার্চ সম্মিলিত অনুদানের টাকায় স্থপতি ফ্রানসিসকো পল ডেল ভিলার নকশা ও তত্ত্বাবধানে শুরু হয় এর নির্মাণকাজ। কিন্তু ঠিক এক বছর পর ১৮৮৩ সালের ১৮ মার্চ ভিলার পদত্যাগ করলে স্থপতি অ্যাটনি গুডি দায়িত্বভার গ্রহণ করে এর নকশায় আনেন আমূল পরিবর্তন।

নির্মাণশৈলী
১৮৮২ সালে শুরু হওয়া প্রাচীন এ চার্চটির নির্মাণকাজ শেষ হবে ২০২৬ সালে। এত দীর্ঘ সময় ধরে বর্তমানে আর কোনো অবকাঠামো নির্মাণের নজির নেই। নির্মাণের ধীরগতি সম্পর্কে এর প্রধান স্থপতি অ্যাটনি গুডির বক্তব্য ছিল ‘My Client is not in a Hurry. ১৯২৬ সালে গুডি যখন মারা যান তখন এর নির্মাণকাজের মাত্র ১৩ থেকে ২৩ শতাংশ সম্পন্ন হয়েছিল। গুডির মৃত্যুর পর ১৯৩৬ সাল পর্যন্ত অর্থাৎ স্পেনিস সিভিল ওয়ারের আগ পর্যন্ত এটি নির্মাণের সার্বিক তত্ত্বাবধানে ছিলেন স্থপতি ডোমেনসি সুগ্রেনস। যুদ্ধ চলাকালীন কাতালান নৈরাজ্যবাদীদের দ্বারা ব্যাপক ক্ষতি হয় অনন্য এই স্থাপনাটির। যুদ্ধ-উত্তরকালে অ্যাটনি গুডি কর্তৃক প্রণীত নকশার কিছুটা পরিবর্তন ও পরিবর্ধন করে এর বর্তমান নকশা প্রণয়ন করা হয়, যা পায় আধুনিকতার ছোঁয়া। স্থপতি জর্ডি বোনেট আরমোনগাল প্রথমবারের মতো এটির নকশা করে কম্পিউটারে এবং এর নির্মাণকাজ তদারকি করেন ১৯৮০ সাল অবধি। নিউজিল্যান্ডের স্থপতি মার্ক বুরি প্রণয়ন করেন এটির ভাস্কর্য নকশা।
চার্চটির কেন্দ্রীয় অংশের ছাদ সম্পূর্ণ হয় ২০০০ সালে। ২০০৬ সাল পর্যন্ত জিসাস ক্রাইস্ট নামে উৎসর্গকৃত সবচেয়ে উঁচু মিনারের সাপোর্টিং অবকাঠামোর নির্মাণকাজ সম্পূর্ণ হয়। এটির সঙ্গে সম্পৃক্তরা আশা করছেন, ২০২৬ সালের মধ্যে এটির সম্পূর্ণ নির্মাণকাজ সম্পন্ন হওয়ার। তাঁদের ইচ্ছা স্থাপনাটির প্রধান স্থপতি অ্যাটনি গুডির শততম মৃত্যুবার্ষিকীতে সম্পূর্ণরূপে এটিকে ধর্মপ্রাণ খ্রিষ্টানদের সামনে উপস্থাপন করা হবে। যদিও বিশেষজ্ঞদের এ বিষয়ে দ্বিমত রয়েছে। অনেকের মতেই এটি সম্পূর্ণ হতে ২০২৮ সাল পর্যন্ত লেগে যাবে।

নির্মাণে বিশেষত্ব
প্রথম অবস্থায় এটিকে ক্যাথাড্রাল হিসেবে তৈরির কোনো পরিকল্পনা ছিল না। পরিকল্পনা ছিল ক্যাথাড্রাল আকারের একটি ধর্মীয় ভবন নির্মাণের। কাতালান ও ইউরোপিয়ান অনেক ক্যাথাড্রালের তুলনায় এটির প্রস্থ তুলনামূলক কম কিন্তু এর প্রতিটা অংশের জটিলতাপূর্ণ চমৎকার সব নকশা এটিকে দিয়েছে দারুণ বিশেষত্ব। ইউরোপের বড় সব ক্যাথাড্রাল প্রায় একই আদলে তৈরি, যেখানে ক্যাথাড্রালকে ঘিরে থাকে বেশ কিছু Chapels এবং Ecclesiastical ভবন কিন্তু এটি এ ধারা থেকে সম্পূর্ণ ভিন্ন। এটিতে আছে একটি সম্পূর্ণ ঢাকা পথ, যা আয়তক্ষেত্রভাবে সম্পূর্ণ চার্চকে ঘিরে অবস্থিত এবং তিনটি প্রবেশপথের সঙ্গে সংযুক্ত। এর প্রধান স্থপতি অ্যান্টনি গুডির ইচ্ছা ছিল এমন একটি ক্যাথাড্রাল নির্মাণ, যা বার্সেলোনা শহরের সব স্থান থেকেই দেখা যাবে। গুডির নকশায় এটিতে মোট ১৮টি মিনার ছিল, যেগুলোর ভিন্ন নাম এবং ব্যাখ্যা ছিল। ১২টিতে ছিল ১২ জন ধর্মপুত, চারটি ছিল ধর্মীয় বাণী প্রচারক, একটি মাতা মেরির এবং সবচেয়ে উঁচুটি ছিল যিশুখ্রিষ্টে প্রতীক। ২০১০ সাল পর্যন্ত আটটি মিনার নির্মিত হয়েছে, যার চারটি চারজন ধর্মপুত এবং অপর চারটি চারজন ধর্মদূতের প্রতীক। প্রতিটি মিনার ধর্মদূতদের ঐতিহ্যবাহী প্রতীকসংবলিত। এটির কেন্দ্রীয় মিনার যা যিশুখ্রিষ্টকে উৎসর্গকৃত সেটি বিশালাকার ক্রুশের প্রতীকসংবলিত। সব মিনারের মোট উচ্চতা ১৭০ মিটার, যা বার্সেলোনা শহরে অবস্থিত মোনজিউক পাহাড়ের চেয়ে এক মিটার কম। অ্যাটানি গুডি বিশ্বাস করতেন যে তাঁর নির্মিত কোনো স্থাপনা ঈশ্বর কর্তৃক নির্মিত স্থাপনার থেকে উঁচু হতে পারে না। নিচু মিনারগুলো যিশুর শেষ নৈশভোজের চরিত্রগুলোর পারস্পরিক যোগাযোগের নকশাসংবলিত।
চার্চটিতে আছে তিনটি বিশালাকার সম্মুখভাগ যেগুলোকে পরস্পর থেকে সম্পূর্ণ পৃথকভাবে উপস্থাপন করা হয়েছে। পূর্বদিকের সম্মুখভাগটির নাম নেটিভিটি ফ্যাকেড, পশ্চিম দিকে প্যাশন ফ্যাকেড এবং দক্ষিণ দিকে গ্লোরি ফ্যাকেড, যা এখনো অসম্পূর্ণ।
নেটিভিটি ফ্যাকেড (Nativity Façade)
নির্মাণকাজ শুরু হয় ১৮৯৪ সালে শেষ হয় ১৯৩০ সালে। যিশুর জন্মসত্তাকে এটি উৎসর্গ করা হয়েছে। এটিতেই গুডির নকশা সম্পূর্ণভাবে অনুসরণ করা হয়েছে। এর প্রতিটি নকশা, ছবি এবং ভাস্কর্যের আছে পৃথক সত্তা। তিনটি গাড়ি বারান্দায় বিভক্ত এটিতে আছে পৃথক দুটি থাম। থাম দুটির একটি ভূমি অন্যটি সাগরের প্রতীক। গাড়িবারান্দা তিনটি Hope, Faith এবং Charity-এর প্রতীক। এটিতে আছে চারটি মিনার, যা চারজন ধর্মদূতের প্রতীক, যাঁরা হলেন Saint Matthias the Apostle, Saint Barnabas, Saint Jude the Apostle Ges Saint Simon the Zeabot।

প্যাশন ফ্যাকেড (Passion Façade)
১৯৩৪ সালে শুরু হয়ে ১৯৮৭ সালে এটির নির্মাণকাজ শেষ হয়। এটি নেটিভিটি ফ্যাকেডের ঠিক উল্টো। নেটিভিটি ফ্যাকেড যেখানে জমকালো, সেখানে নকশায় এটি একদমই সাধারণ এবং সাদামাটা। বিশালাকৃতির পাথরের তৈরি। মানুষের কঙ্কালের হাড়ের আদলে নকশাকৃত। এটিকে যিশুখ্রিষ্টের ক্রুশবিদ্ধতার প্রতি উৎসর্গকৃত। এটিতেও আছে তিনটি গাড়িবারান্দা, যেগুলোর রয়েছে পৃথক ধর্মীয় ব্যাখ্যা। এগুলো ছয়টি বিশালাকার থাম দ্বারা বেষ্টিত। এটিতেও চারটি মিনার আছে, যা চারজন ধর্মদূতের প্রতীক। তাঁরা হলেন- Saint James, Saint Tomas, Saint Philip এবং Saint Bartholomew. সুর্যাস্তের দিকে মুখ করে অবস্থিত প্যাশন ফ্যাকেড যিশুখ্রিষ্টের মৃত্যুবরণের প্রতীকী রূপ।
গ্লোরি ফ্যাকেড (Glory Façade)
গ্লোরি ফ্যাকেড হবে সবচেয়ে বড় এবং বিশেষত্বপূর্ণ ফ্যাকেড। ২০০২ সালে এটির নির্মাণকাজ শুরু হয়েছে। গুডি ফ্যাকেডের যে নকশা প্রণয়ন করেছিলেন, তা ১৯৩৬ সালের যুদ্ধে সম্পূর্ণভাবে ধ্বংসপ্রাপ্ত হয়। এখন যে নকশা অনুসারে গ্লোরি ফ্যাকেড নির্মিত হচ্ছে, তা গুডির নকশা থেকে অনেকটাই ভিন্ন। তবে গুডির নকশাকে কেন্দ্র করেই এটি প্রণীত। এটিই হবে সাগরাদা ফ্যামিলিয়ার প্রধান ফ্যাকেড এবং এটি কেন্দ্রীয় কক্ষের সঙ্গে হবে সরাসরি সংযুক্ত। এটি যিশুখ্রিষ্টের ধর্মীয় বিজয়কে উৎসর্গ করা হয়েছে। এটিতে থাকবে একটি বিশাল গাড়িবারান্দা, যার নাম গ্লোরি ফ্যাকেড। এটিতে থাকবে বিশালাকার সিঁড়ি, যার এক প্রান্ত থাকবে কেন্দ্রীয় প্রার্থনাকক্ষের দিকে, যা স্বর্গের প্রতীক এবং অপর প্রান্ত থাকবে ভূগর্ভস্থের দিকে, যা নরকের প্রতীক। এটির অন্দরসজ্জায় থাকবে দেবতা, শয়তান, নকল দেবতা, ধর্মদ্রোহী ও ষড়যন্ত্রকারীদের ভাস্কর্য। এটিতে থাকবে সাতটি থাম, যা সাতটি পাপ ও পুণ্যের প্রতীক।

ভিন্নতা যেখানে
চার্চটিকে মোট চারটি অলিন্দে ভাগ করা হয়েছে, যার মধ্যে কেন্দ্রীয় প্রার্থনাকক্ষের দৈর্ঘ্য ৪৫ মিটার এবং প্রস্থ ৩০ মিটার। এ ছাড়া আছে তিন প্রবেশপথে তিনটি অলিন্দ। এর প্রতিটি থামের দৈর্ঘ্য ৭ দশমিক ৫ মিটার। এর থামগুলোর অবস্থান প্রকাশ করে গুডির অনন্য স্থাপত্যশৈলীকে। এর প্রতিটি পরতে পরতে রয়েছে স্থাপত্যশৈলীর অনন্য নিদর্শন। ধর্মীয় প্রতীকগুলোকে এমনভাবে প্রকাশ করা হয়েছে, যা এককথায় অসাধারণ। এর মিনারগুলো বিভিন্ন বাণী দ্বারা অলংকৃত, যেমন- Hosarna, Excelsis ও Sanclus। প্যাশন ফ্যাকাডের প্রধান দরজায় বিভিন্ন ভাষায় বাইবেলের বাণী খোদাই করে লেখা। এর তিনটি প্রবেশপথ বিশ্বাস, আশা আর ভালোবাসার প্রতীক। বর্তমানে দর্শনার্থীরা এর প্রার্থনাকক্ষ, জাদুঘর, দোকান, ভূগর্ভস্থ কক্ষ, প্যাশন এবং নেটিভিটি টাওয়ার দর্শন করতে পারছেন।
বর্তমানে বিশ্বে একই সঙ্গে স্থাপত্যশৈলী, সৌন্দর্য আর ধর্মীয় মূল্যবোধবিশিষ্ট চার্চের মধ্যে সাগরাদা ফ্যামিলিয়া অন্যতম শ্রেষ্ঠত্বের দাবিদার।
ফ্যাক্ট ফাইল
অবস্থান : বার্সেলোনা, স্পেন
স্থপতি : অ্যান্টনি গুডি
নির্মাতা : Construction Board of La Sagrada Familia Foundation
সময়কাল : ১৮৮২-চলমান (২০২৬-২০২৮ সালে সমাপ্ত হবে)
ধারণক্ষমতা : ৯,০০০
দৈর্ঘ্য : ৯০ মিটার (৩০০ ফুট)
প্রস্থ : ৬০ মিটার (২০০ ফুট)
মিনার : ১৮টি (আটটি সম্পন্ন)
মিনারের উচ্চতা : ১৭০ মিটার।
আশিক মাহমুদ
প্রকাশকাল: বন্ধন ৪৯ তম সংখ্যা, মে ২০১৪