জর্জিয়া অ্যাকুরিয়াম

নীল সাগরের বর্ণিল মাছগুলোকে ঘরের কোণের অ্যাকুরিয়ামে পুরে রাখার শখ অনেকেরই। রং-বেরঙের বর্ণিল ক্ষুদ্রাকৃতির মাছগুলো যখন পানিতে খেলা করে, তখন তা দেখতে বেশ লাগে। কিন্তু এমন যদি হয় অ্যাকুরিয়ামে তিমি, হাঙর, ডলফিন বা ইলেট্রিক রের মতো দানবাকৃতির মাছ ঘুরে বেড়াচ্ছে অবাধে, তখন ব্যাপারটি কেমন হবে! চোখ কপালে তোলার মতো হলেও এটাই সত্য। কিন্তু এই দানবাকৃতির প্রাণীদের জন্য প্রয়োজন বিশালাকৃতির অ্যাকুরিয়াম। জর্জিয়ার নীল ধাতব এবং কাচের মধ্যে সৃষ্ট পানির ঢেউ সৃষ্টি করে অদ্ভুত, মায়াবী ও মোহনীয় এক পরিবেশ। এটাই বিশ্বের সবচেয়ে বড় অ্যাকুরিয়াম। জর্জিয়া অ্যাকুরিয়াম সব বয়সী পর্যটকদের কাছে আনন্দদায়ক ও শিক্ষণীয় অভিজ্ঞান প্রাপ্তির একটি আর্দশ জায়গা। আনন্দ, বিনোদনের মধ্য দিয়ে বহুমুখী বিষয়ে জ্ঞানদানের পাশাপাশি জর্জিয়া অ্যাকুরিয়াম জীবজগতের বৈচিত্র্য তুলে ধরে অর্জন করেছে ভূয়সী প্রশংসা। জর্জিয়া অ্যাকুরিয়াম জর্জিয়ার পর্যটন ব্যবসায় যোগ করেছে ভিন্ন এক মাত্রা। স্থানীয়সহ বিদেশি পর্যটকদের জন্য এটা বিশ্বের অন্যতম সুন্দর বিনোদনকেন্দ্র। প্রতিবছর প্রায় ১১ মিলিয়ন বা এক কোটি ১০ লাখ দর্শনার্থী জর্জিয়া অ্যাকুরিয়াম দেখতে আসে। এখানে কাজ করছে প্রায় ৪০০ কর্মকর্তাসহ দুই হাজারের বেশি স্বেচ্ছাসেবী। জর্জিয়া অ্যাকুরিয়ামে গ্যালারির শতকরা ২৫ ভাগ এলাকা শিক্ষার্থীদের জন্য যার নামকরণ করা হয়েছে Learnong Loop. অ্যাকুরিয়ামের ব্যবস্থা এমন যাতে শিক্ষার্থীরা জ্ঞান অর্জন ও আনন্দ একই সঙ্গে পেতে পারে।

অ্যাকুরিয়ামের টানেল পথ

জর্জিয়া অ্যাকুরিয়াম বিশ্বের সামনে প্রথম উন্মুক্ত হয় ২০০৫ সালের ২৩ নভেম্বর। বিখ্যাত জর্জিয়া অ্যাকুরিয়াম প্রায় ০.৫ মিলিয়ন (পাঁচ লাখ) বর্গফুট বা ৯ দশমিক ৫ একর জায়গাজুড়ে বিস্তৃত। অ্যাকুরিয়ামটির অবস্থান যুক্তরাষ্ট্রের আটলান্টার সেনটেনিয়াল অলিম্পিক পার্কের কাছে। জর্জিয়া অ্যাকুরিয়াম ৫০০ প্রজাতির প্রায় ১২ হাজার প্রাণীর নিরাপদ আবাসস্থল। অ্যাকুরিয়ামটি সর্বক্ষণ প্রায় ১০ মিলিয়ন বা এক কোটি গ্যালন পানি ধারণ করে। তা ছাড়া প্রাণীগুলোর জন্য এতে রয়েছে প্রায় ৬০টির মতো স্বাভাবিক বিচরণক্ষেত্র। এই আবাসস্থলে প্রায় ১৬ হাজার বর্গফুটের প্রদর্শনী জানালা রয়েছে, যার ওজন প্রায় ৩২৮ টনের মতো। অ্যাকুরিয়ামটির সবচেয়ে বড় যে বিচরণক্ষেত্র বা আবাসস্থল প্রদর্শনীর জন্য রাখা হয়েছে, তার আকৃতি ২৮৪ ফুট লম্বা, ১২৬ ফুট চওড়া ও ৩০ ফুট গভীর। এর পানি ধারণক্ষমতা প্রায় ৬ দশমিক ৩ মিলিয়ন বা ৬৩ লাখ গ্যালন। এটা চারটি বিশালাকৃতির হাঙর তিমি (whale sharks), চারটি মান্টা রে (manta rays) ও আরও কয়েক হাজার প্রাণীর নিরাপদ আবাসস্থল। প্রায় আট লাখ গ্যালন পানি ধারণক্ষম অ্যাকুরিয়ামের দ্বিতীয় বৃহৎ বিচরণক্ষেত্র চারটি বেলুজা তিমির (beluga whales) আবাসস্থল। এ ছাড়া জর্জিয়া অ্যাকুরিয়ামের রয়েছে আরও অনেক আকর্ষণীয় বিষয়; এতে ৪-উ থিয়েটার, শিক্ষানবিশ গ্যালারি এবং বিশ্বের প্রাণী রোগবিষয়ক একটি বিশেষ দল, যারা প্রাণীদের স্বাস্থ্য সুরক্ষায় নিয়োজিত। 

শুরুর কথা

প্রসিদ্ধ ব্যবসায়ী বার্নাড মার্কাস ২০০১ সালের নভেম্বর মাসে ঘোষণা দেন যে আটলান্টায় তিনি একটি অ্যাকুরিয়াম প্রতিষ্ঠা করবেন, যা শিক্ষার্থীদের জানার পাশাপাশি অর্থনৈতিক উন্নয়নে ভূমিকা রাখবে। জেফ সোয়ানগান জর্জিয়া অ্যাকুরিয়ামের প্রতিষ্ঠা চেয়ারম্যান এবং নির্বাহী পরিচালক ছিলেন ২০০৪ সাল পর্যন্ত। মূলত তাঁর দিকনির্দেশনা অনুযায়ী জর্জিয়া অ্যাকুরিয়ামের মূল কাঠামো ও বিভিন্ন প্রাণীর আবাসস্থল নির্মাণ করা হয়। দীর্ঘ ২৭ মাসের অক্লান্ত পরিশ্রম ও নির্মাণের সকল প্রকার চ্যালেঞ্জ উপেক্ষা করে জর্জিয়া অ্যাকুরিয়ামের নির্মাণকাজ শেষ হয়।  ২০০৫ সালের নভেম্বর মাসের ২২ তারিখে দর্শনার্থীর জন্য এটি খুলে দেওয়া হয়।

জীববৈচিত্র্য উপভোগ করছে দর্শনার্থীরা

অ্যাকুরিয়ামের অভ্যন্তরে

জর্জিয়া অ্যাকুরিয়ামটি আটলান্টায় কোকাকোলা (Coca-Cola) কোম্পানির জমিতে নির্মাণ করা হয়েছে। অ্যাকুরিয়ামটি সেন্টিনাল অলিম্পিক (Centennial Olympic) পার্কের দক্ষিণে এবং জর্জিয়া ডোম জর্জিয়া ওয়ার্ল্ড কংগ্রেস সেন্টার, ফিলিপস এরিনা এবং সিএনএস সেন্টারের পাশে অবস্থিত। জর্জিয়া অ্যাকুরিয়ামটি পাঁচ লাখ ৫০ হাজার বর্গফুট এলাকা জুড়ে বিস্তৃত। এখানে অবস্থিত পানির ট্যাঙ্কগুলো ৮০ মিলিয়ন বা ৮০ লাখ গ্যালন (৩০ হাজার ঘনমিটার) পরিষ্কার ও সামুদ্রিক লোনা পানি ধরে রাখতে সক্ষম। জর্জিয়ার ১৬ হাজার ৪০০ বর্গফুটের সামুদ্রিক বলরুমে (Ocean Ballroom) রয়েছে এক হাজার ১০০ দর্শনার্থীর বসার ব্যবস্থা। রাখা হয়েছে দুই হাজার ৬০০ দর্শনার্থীর জন্য whale sharh এবং beluga whale-এর বিচরণক্ষেত্র ও আবাসস্থল দাঁড়িয়ে অবলোকন করার সুযোগ।

জর্জিয়া অ্যাকুরিয়াম যদিও একটি অলাভজনক প্রতিষ্ঠান। তদুপরি এর প্রবেশমূল্য আমেরিকার অন্যান্য দর্শনীয় স্থানের প্রবেশমূল্যের চেয়ে বেশি। অ্যাকুরিয়ামে প্রবেশের টিকিটের মূল্য পরিবর্তিত হয় এবং এটা অনলাইনের মাধ্যমে কেনা যায়। জর্জিয়া অ্যাকুরিয়াম স্থাপনের পর যে পরিমাণ দর্শনার্থী আশা করা হয়েছিল, খুব অল্পদিনের মধ্যে তা প্রত্যাশার মাত্রা ছাড়িয়ে গেল। প্রথম ২০০ দিনের মধ্যেই দর্শনার্থীর সংখ্যা দাঁড়ায় এক মিলিয়ন বা ১০ লাখ, যা ২০০৬ সালের আগস্ট মাস নাগাদ বেড়ে দাঁড়ায় তিন মিলিয়ন বা ৩০ লাখ এবং ২০০৭ সালের মে মাসে তা বেড়ে দাঁড়ায় পাঁচ মিলিয়ন এবং এই দর্শনার্থীর সংখ্যা ২০০৯ সালে ১০ মিলিয়ন বা এক কোটিতে পৌঁছায়। 

ডলফিন শো গ্যালারি

অ্যাকুরিয়ামের সংগ্রহশালা

জর্জিয়া অ্যাকুরিয়ামে প্রায় ৫০০-র অধিক প্রজাতির প্রায় এক লাখ থেকে এক লাখ ২০ হাজার স্বাদু এবং অন্যান্য পানির সামুদ্রিক প্রাণী রয়েছে। অ্যাকুরিয়ামটি এশিয়ার বাইরে একমাত্র প্রতিষ্ঠান, যেখানে রয়েছে whale sharhs-এর বসবাসের ব্যবস্থা। এই whale sharhs-গুলো ৬ দশমিক ৩ মিলিয়ন বা ৬৩ লাখ গ্যালন পানির ট্যাঙ্কে বাস করে। বাস্তবিক পক্ষে পুরো অ্যাকুরিয়ামটিকে whale sharhs-এর বিচরণক্ষেত্র বা আবাসস্থলের চারপাশ দিয়ে অত্যন্ত সুন্দর ও মনোরম নকশা ও নির্মাণশৈলীতে নির্মাণ করা হয়েছে। এসব হাঙর-তিমিকে তাইওয়ান থেকে নৌকা, ট্রাক ও উড়োজাহাজের মাধ্যমে আনা হয়েছে। তিমিগুলোকে নিয়ে যাওয়ার জন্য এ ধরনের প্রয়াস আগে কখনো গ্রহণ করা হয়নি। এই অ্যাকুরিয়ামের সবচেয়ে বিখ্যাত বা মূল্যবান সংগ্রহ হলো কম বয়সের বাচ্চা হাঙর-তিমিগুলো, যাদের নাম রালফ, নরটন, এলিস ও ট্রিনি; প্রাথমিকভাবে জর্জিয়া অ্যাকুরিয়ামে সদ্য বিবাহিতদের জন্য মধুচন্দ্রিমায় হাঙর-তিমির মধ্যে ঘুরে বেড়ানোর অনুমতি দেওয়া হতো। কিন্তু ২০০৭ সালে বাচ্চা তিমি রালফ এবং নরটন মারা যাওয়ার পরে এই ব্যবস্থা বন্ধ করে দেওয়া হয়। কারণ, অনেক বিশেষজ্ঞ মনে করেন, মানুষের সংস্পর্শে আসার কারণে তাদের মৃত্যু হয়েছে। কিন্তু সেই একই বছরে তারোকো ও উসান নামের আরও দুটি বাচ্চা হাঙর তিমি তারোকো জর্জ ন্যাশনাল পার্ক এবং তাইওয়ানের জেইদ্ পাহাড় অঞ্চল থেকে নিয়ে আসা হয়। যদিও এখন আর এ ধরনের কোনো সুযোগ নেই, কেননা এই প্রজাতির তিমি ধরার ওপর এখন নিষেধাজ্ঞা জারি করা হয়েছে।

জর্জিয়া অ্যাকুরিয়াম পৃথিবীর চারটি অ্যাকুরিয়ামের একটি, যেখানে মানটা রে (Manta Ray)-এর প্রদর্শনী হয়ে থাকে। দ্বিতীয় Manta Ray, যার নাম তাল্লালুহা (Tallulah), ২০০৯ সালের সেপ্টেম্বর মাসে জর্জিয়া অ্যাকুরিয়ামে যুক্ত করা হয়।

জর্জিয়া অ্যাকুরিয়ামে প্রদর্শিত গ্যালারি

অ্যাকুরিয়ামের প্রাণীগুলোকে ছয়টি ভিন্ন ভিন্ন গ্যালারিতে প্রদর্শন করা হয়। এগুলো হলো ট্রপিক্যাল ডাইভার (Tropical Diver), জর্জিয়া এক্সপ্লোরার (Georgia Explorer), ওশান ভয়েজার (Ocean Voyager), কোল্ড ওয়াটার কুয়েস্ট (Cold Water Quest), রিভার স্কাউট (River Scout) এবং ডলফিন টেলস (Dolphin Tales)। প্রতিটি গ্যালারিতে রয়েছে একটি নির্দিষ্ট পরিবেশ। বাঁ দিক থেকে যদি কেউ জর্জিয়া অ্যাকুরিয়ামে প্রবেশ করে, তাহলে প্রথমে যে গ্যালারিটি পড়বে তা হলো জর্জিয়া এক্সপ্লোরার (Georgia Explorer)। এই গ্যালারিটি বাচ্চাদের খুবই প্রিয়। কারণ, এই গ্যালারিতে বেশ কিছুসংখ্যক টার্চ টাভেক রে ও হাঙর রয়েছে। তা ছাড়া এই গ্যালারিতে রয়েছে সামুদ্রিক কচ্ছপের বিচরণক্ষেত্র ও আবাসস্থলসহ সামুদ্রিক নানা প্রাণীর বৈচিত্র্যময় বিচরণ। 

থ্রিডি অ্যাকুরিয়াম

জর্জিয়া অ্যাকুরিয়ামের দ্বিতীয় প্রদর্শনী গ্যালারি রিভার স্কাউট। এই প্রদর্শনীটিও বেশ ব্যতিক্রম। গ্যালারির মাথার ওপরে বিশেষভাবে নির্মিত কৃত্রিম নদী রয়েছে, যেখানে মূলত উত্তর আমেরিকার মাছগুলোকে মাথার ওপরে চলতে দেখা যায়। স্থানীয়ভাবে প্রাপ্ত প্রজাতিদের সঙ্গে পিরানহা, ইলেকট্রিক ফিশসহ মিঠা পানির কিছু দুর্লভ প্রাণী এখানে প্রদর্শিত হয়।

রিভার স্কাউট গ্যালারির পরের প্রদর্শনী গ্যালারিটিই ডলফিন টেলস। এই প্রদর্শনী গ্যালরিটি ২০১২ সালের এপ্রিলে দর্শনার্থীদের জন্য খোলা হয়। এটা ডলফিনদের ইনডোর স্টেডিয়াম নামে পরিচিত। এই ডলফিন হাউসে ১১টি বোতলনাক ডলফিন রয়েছে। যদিও এদের সংখ্যা বিভিন্ন সময়ে বিভিন্ন রকম হয়ে থাকে। বর্তমানে সেখানে প্রতিদিন শুধু তিনটি ডলফিনকেই প্রদর্শনের জন্য রাখা হয়। ডলফিনদের এই প্রদর্শনী সাধারণত ২০-৩০ মিনিট ধরে চলে এবং এর পরপরই ডলফিন সম্পর্কিত তথ্যনির্ভর ও শিক্ষণীয় ৩০ মিনিটের একটি ভিডিও প্রদর্শন করা হয়। AT এবং T ডলফিন Tales-প্রদর্শনী দেখার জন্য একটি অতিরিক্ত টিকিট কেনার প্রয়োজন হয়। যা-ই হোক, দর্শনাথীরা স্বাভাবিক সময়ে ডলফিনগুলোকে দেখতে পারে এবং এর জন্য তাদের কোনো প্রকার অতিরিক্ত মূল্য দিতে হয় না।

পরের প্রদর্শনী গ্যালারি কোল্ড ওয়াটার কুয়েস্ট। এই গ্যালারিতে সাধারণত বিশ্বের শীতপ্রধান অঞ্চল বা মেরু অঞ্চলের প্রাণীদের প্রদর্শন করা হয়ে থাকে। এখানকার সব প্রাণীই স্তন্যপায়ী। এই গ্যালারিতে আরও রয়েছে বেলুজা তিমি। এ ছাড়া রয়েছে জাপানের মাকড়সা, কাঁকড়া এবং আফ্রিকার কালো পাবিশিষ্ট পেঙ্গুইন।

ওশান ভয়েজার এর অবস্থান এর পরেই। অ্যাকুরিয়ামের মোট পানির অধিকাংশই এই গ্যালারিতে। এখানে রয়েছে বিভিন্ন প্রজাতির প্রায় এক লাখ মাছ। এই গ্যালারিটা বিশেষভাবে করা নকশায় নির্মিত Mesoamerican Burrier Reef সিস্টেমের জীবনবৃত্তান্ত প্রদর্শনের জন্য, হাঙর তিমি প্রদর্শনীর জন্য। এই গ্যালারিতে পানির নিচে একটি ১০০ ফুট গভীর টানেল এবং পৃথিবীর দ্বিতীয় বৃহত্তম প্রদর্শনীর জানালা রয়েছে, যা একসঙ্গে অনেক দর্শনার্থীকে এমন সব প্রাণীর বিচরণ দেখতে সাহায্য করে।

অ্যাকুরিয়ামের সবশেষ গ্যালারি ট্রাপিক্যাল ডাইভার। এতে ভারতীয় সাগরের মাছ এবং গরম পানির অমেরুদণ্ডী প্রাণীর প্রদর্শন করা হয়। এই গ্যালারির প্রদর্শনী ট্যাঙ্কে প্রায় এক লাখ ৬৪ হাজার গ্যালন বা ছয় লাখ ২০ হাজার লিটার পানি রয়েছে। এখানে প্রায় ৯০টি ভিন্ন প্রজাতির মাছের বাস। জর্জিয়া অ্যাকুরিয়ামের নিজস্ব তত্ত্বাবধানে এই গ্যালারিতে জীবন্ত প্রবাল তৈরি করে, যা অ্যাকুরিয়ামের সমুদ্রেপৃষ্ঠে (Reef)-এর বিস্তৃত অঞ্চলে দেখা যায়। এই প্রদর্শনী গ্যালারির অন্য প্রাণীরা হলো সমুদ্র উপকূলীয় অঞ্চলের ঘোড়া, বাইন মাছ, জেলি ফিশ, ক্লাউন মাছ, চিংড়ি, লবস্টারসহ অন্যান্য গ্রীষ্মমণ্ডলীয় অঞ্চলের মাছ।

জর্জিয়া অ্যাকুরিয়ামে আরও রয়েছে ডিপইস নামের ফোরডি সিনেমা এবং সমুদ্রের তলদেশে থ্রিডি ওয়ান্ডার শো উপভোগের ব্যবস্থা। এখানে একটি সম্পূর্ণ পৃথক ব্যবস্থা  রয়েছে শুধু বিভিন্ন প্রজাতির ব্যাঙের জন্য। অন্যান্য আকর্ষণীয় বিষয়ের মধ্যে অন্যতম হলো সমুদ্রযাত্রা। এটি বিশেষভাবে নির্মিত হলঘরের মধ্য দিয়ে বিভিন্ন প্রাণীর আবাসস্থল ভ্রমণ। যেখানে Chedd-Angier-Lewis কোম্পানি ইলেকট্রোসনিক Inc-এর সঙ্গে মিলিতভাবে বিশেষ স্পর্শ দেয়াল (Touch wall) নির্মাণ করেছে, যার দ্বারা প্রত্যেক সমুদ্রযাত্রী প্রতিটি প্রাণীকে আলাদা আলাদা চিনতে ও জানতে পারে। অ্যাকুরিয়ামটি একটা ভার্চুয়াল অ্যাকুরিয়াম, যা জীবনের চেয়ে  বড়। যার দ্বারা সমুদ্রের সব প্রাণী বা মাছের জীবনাচরণকে ট্যাঙ্কের মধ্যে সুন্দরভাবে সুসজ্জিত করে রাখা হয়।

এ ছাড়া ২০০৯ সালের টাইটানিক অ্যাকুয়েটিক (Titanic Aquatic) নামের একটি প্রদর্শনী গ্যালারি খোলা হয়, যার মধ্যে দিয়ে হাঁটলে জাহাজের মধ্যে হাঁটার অনুভূতি হয়। অ্যাকুরিয়ামে এটা ছিল ২০০৯ সালের ৭ সেপ্টেম্বর পর্যন্ত। হাঙরের জীবনাচরণ ভালোভাবে বোঝা ও এ নিয়ে গবেষণার জন্য ২০১১ সালের এপ্রিল মাসে নতুন একটা সেকশন খোলা হয়।

গবেষণা ও সংরক্ষণ

জর্জিয়া অ্যাকুরিয়াম সামুদ্রিক প্রাণী গবেষণার এক জীবন্ত ল্যাবরেটরি। পেনিনসুলার হাঙর তিমি, আলাস্কার বেলুজা তিমি, সাউথ আফ্রিকার পেঙ্গুইন, কুইনটানা রো এর ম্যানাতিজ, জর্জিয়ার উপকূলীয় অঞ্চলের সামুদ্রিক কচ্ছপ, ফ্লোরিডার ঈগল রের মতো প্রাণীদের নিয়ে এখানে চলে গবেষণা। জর্জিয়া অ্যাকুরিয়াম ফ্লোরিডা আটলান্টা বিশ্ববিদ্যালয় ও সরকার যৌথভাবে এসব প্রাণীর স্বাস্থ্য পরীক্ষা ও সার্বক্ষণিক নজরদারির কাজটি করে, যাতে তারা খুব দ্রুত যেকোনো ধরনের দূষণ বা রোগ-জীবাণুর আক্রমণ খুব দ্রুত চিহ্নিত করে সে অনুযায়ী যথাযথ ব্যবস্থা নিতে পারে। অ্যাকুরিয়ামটির অন্যতম উদ্দেশ্য বিলুপ্তপ্রায় ও অন্যান্য প্রাণীর সংরক্ষণ ও এদের নিয়ে গবেষণা করা। যার জন্য অ্যাকুরিয়ামে ১০ হাজার বর্গফুটের একটা section রাখা হয়েছে, যেটা বিশ্বের অন্যতম প্রতিষ্ঠিত পশু চিকিৎসক ও সংরক্ষক organization দ্বারা নকশা করে নির্মাণ করা হয়েছে। যেখানে সব প্রাণীর চিকিৎসা প্রদান সম্ভব।

এপিঠ-ওপিঠ

ডলফিন টেলস গ্যালারির নির্মাণকাজ শুরু হয় ২০০৮ সালের শেষের দিকে এবং নির্মাণকাজ সম্পন্ন হয় ২০১০ সালের শেষের দিকে। এরপর ডলফিন টেলসের গ্যালারিটি জনসাধারণের জন্য অবমুক্ত করে দেওয়া হয় ২০১১ সালের ২ এপ্রিল। এর নির্মাণকাজ চলাকালীন অ্যাকুরিয়ামের তিনটি বেলুজা তিমিকে সাময়িকভাবে সি ওয়ার্ল্ড স্যান অ্যানটনিওতে সরিয়ে নেওয়া হয়। কারণ, বেলুজা তিমি তিনটি শব্দের ব্যাপারে খুবই স্পর্শকাতর এবং এখানকার কর্মকর্তারা অতিরিক্ত কোনো চাপের সম্মুখীন হতে চাচ্ছিলেন না। যা-ই হোক, পরবর্তী সময়ে তাদের সরিয়ে নেওয়া হয় যেকোনো ধরনের অপ্রত্যাশিত কিছু ঘটার থেকে বিরত থাকতে। কিন্তু অপ্রত্যাশিতভাবে তিন-তিনটি বেলুজা তিমির একটি নিকো সি ওয়ার্ল্ড-এ ২০০৯ সনের ৩১ অক্টোবর মারা যায়। 

অ্যাকুরিয়ামের লে-আউট প্ল্যান

২০১২ সালে অ্যাকুরিয়ামের কর্মকর্তারা আরো ১৮টি তিনটি বেলুজা তিমি রাশিয়া থেকে নিয়ে আসেন। যদিও তাদের আনা হয়েছিল একটি বিশেষ কারণে। পরিকল্পনা করা হয়েছিল, এই তিনটি বেলুজা তিমিকে সহযোগী বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানে পাঠানো হবে। অতঃপর ২০০৮ সালের জুন মাসে “Swim with Gentle Giants” নামের একটি বিশেষ অনুষ্ঠানের ঘোষণা দেওয়া হয়। যার ফলে অতিথিগণ হাঙর তিমির সঙ্গে সাঁতার কাটতে পারবেন। যদিও এই প্রোগ্রাম নিয়ে কিছু মতপার্থক্য রয়েছে। কারণ, ২০০৭ সালে দু-তিনটি বেলুজা তিমি জর্জিয়া অ্যাকুরিয়ামে মারা যায়। কিছু বিশেষজ্ঞ মনে করেন যে মানুষের শরীরের ব্যাকটেরিয়া থেকে এই তিমির মৃত্যু ঘটেছে।

জর্জিয়া অ্যাকুরিয়ামে আগত দর্শনার্থীদের জন্য বাড়তি পাওয়া হাত দিয়ে মাছগুলোকে স্পর্শ করার সুযোগ। যখনই কেউ পছন্দের কোনো মাছকে স্পর্শ করে, সঙ্গে সঙ্গে তথ্যভিত্তিক এবং মজার মজার কিছু বাবল্স তাদের সামনে ভেসে ওঠে, যা থেকে দর্শনার্থীরা তাদের পছন্দকৃত মাছ সম্বন্ধে যাবতীয় তথ্য ও এদের শনাক্তকারী বৈশিষ্ট্যসমূহ জানতে পারে। জর্জিয়া অ্যাকুরিয়াম বছরের ৩৬৫ দিনই খোলা থাকে। সব ধরনের পর্যটকের কাছে তো বটেই, বিশেষ করে ভ্রমণ ও জ্ঞানপিপাসু দর্শনার্থীর কাছে এর অবেদন অনন্য।

সনজিত কুমার সাহা

প্রকাশকাল: বন্ধন ৪১ তম সংখ্যা, সেপ্টেম্বর ২০১৩

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Scroll to Top