ভিঅ্যান্ডএ ওয়াটারফ্রন্ট

রোমাঞ্চকর যেকোনো স্থানই প্রকৃতিপ্রেমীদের আকর্ষণ করে। তেমনি এক দর্শনীয় স্থান দক্ষিণ আফ্রিকার ভিঅ্যান্ডএ ওয়াটারফ্রন্ট, যেখানে একাকার হয়ে আছে প্রকৃতি ও মানুষ। ভিঅ্যান্ডএ ওয়াটারফ্রন্টে সারা বছরই থাকে পর্যটকদের আনাগোনা। প্রতিবছর ২ কোটি ৪০ লাখের বেশি দর্শনার্থী এখানে বেড়াতে আসেন।

ভিঅ্যান্ডএ ওয়াটারফ্রন্টের সাত-সতেরো জানাচ্ছেন মোহাম্মদ রবিউল্লাহ

অবস্থান ও নামকরণের ইতিহাস
দক্ষিণ আফ্রিকার অন্যতম দর্শনীয় স্থান ভিঅ্যান্ডএ ওয়াটারফ্রন্টের অবস্থান রাজধানী কেপ টাউনে আটলান্টিক মহাসাগরের মাঝখানে। এর পাশেই রয়েছে আরেক দর্শনীয় ও প্রাচীনতম সমুদ্রবন্দর টেবিল বে হারবার স্পট। এর ঠিক পেছনেই রয়েছে নয়নাভিরাম কেপ টাউন শহর ও টেবিল মাউনটেন পর্যটনকেন্দ্র। ব্রিটেনের রানি ভিক্টোরিয়ার দ্বিতীয় পুত্র প্রিন্স আলফ্রেড ১৬ বছর বয়সে ১৮৬০ সালে রাজকীয় নেভি মিডশিপম্যান হিসেবে দক্ষিণ আফ্রিকার কেপ কলোনি সমুদ্রবন্দর পরিদর্শন করেন। ব্রিটেনের রাজপরিবারের সদস্য হয়েও প্রথম সফরে রাজকুমার আলফ্রেড ঔপনিবেশিকদের সঙ্গে মিলেমিশে একাকার হয়ে গিয়েছিলেন। নতুন নেভি ইয়ার্ডের প্রথম বেসিনের নামকরণ করা হয় আলফ্রেডের নামেই। আর দ্বিতীয়টির নামকরণ করা হয় রানি ভিক্টোরিয়ার নামে। এর পর থেকে এটি রানি ভিক্টোরিয়া ও রাজপুত্র আলফ্রেডের নামের আদ্যাক্ষরে পরিচিতি পায়। ধীরে ধীরে এর বিস্তৃতি বাড়তে থাকে এবং একসময় পুরোটার নাম হয় ভিঅ্যান্ডএ ওয়াটারফ্রন্ট।

সমুদ্র আর দ্বীপের মিতালি
আপনি যদি সূর্যাস্ত অবলোকন কিংবা লোনা বাতাসের ঝাপটা গায়ে শিউরে উঠতে চান, অথবা সমুদ্র আর দ্বীপের মিতালি দেখতে চান, তাহলে আপনার জন্য সেরা গন্তব্য হচ্ছে ভিঅ্যান্ডএ ওয়াটারফ্রন্ট। পাশাপাশি এনে দেবে রোমাঞ্চকর এক অনুভূতি। যদি মাছের সান্নিধ্যে থাকতে চান কিংবা মাছ ধরতে চান, তাহলে এই পর্যটনকেন্দ্র আপনাকে সেই সুযোগ দেবে। সমুদ্র আর দ্বীপের পাশাপাশি বয়ে চলা নৌকায় জলের হাওয়া অনুভব করতে করতে আপনি মাছ ধরতে পারেন আবার সেই মাছের স্বাদ নিতে পারবেন এখানে বসেই।

টু ওশান অ্যাকুরিয়ামে প্রাণীবৈচিত্র্য উপভোগ করছেন দর্শণার্থীরা

টু ওশান অ্যাকুরিয়াম
ওয়াটারফ্রন্টের আরেকটি আকর্ষণীয় স্থান হচ্ছে টু ওশান অ্যাকুরিয়াম। মহাসাগরীয় প্রাণীর সংগ্রহশালা এটি। ছোট ছোট সামুদ্রিক কাঁকড়া থেকে শুরু করে সামুদ্রিক ঘোড়া নামে পরিচিত চমৎকার নিস্মা, সামুদ্রিক কচ্ছপ ও জেলি ফিশের মতো প্রাণী রয়েছে এখানে, যা অ্যাকুরিয়ামের প্রতিটি কোণকে রাঙিয়ে তুলেছে। ঝিকিমিকি জেলি ফিশ গ্যালারি দর্শনাথীদের মধ্যে মুগ্ধতা ছড়ায়। পাশাপাশি সামুদ্রিক বিশাল মাকড়সা ও কাঁকড়ার মুখোমুখি হওয়ার দুঃসাহসিক দৃশ্য দর্শনার্থীদের স্পর্শকাতর অভিজ্ঞতা দেয়। পুরো অ্যাকুরিয়ামটি ৯ মিটার প্রস্থ ও ১০ মিটার উচ্চতার টানেলে অবস্থিত। আটলান্টিক ও ভারত এই দুই মহাসাগরের মধ্যে অবস্থান হওয়ায় অ্যাকুরিয়ামটির এমন অদ্ভুত নামকরণ করা হয়েছে। প্রায় ৮ হাজারের মতো প্রাণী আছে অ্যাকুরিয়ামটিতে।

চিত্তবিনোদন
ভিঅ্যান্ডএ ওয়াটারফ্রন্টের সবচেয়ে বড় আর্কষণ নাগরদোলা। নাগরদোলায় উঠে আনন্দ উপভোগ করেন পর্যটকেরা। এখানে বিশ্বের নানা প্রান্ত থেকে আসা দর্শনার্থীরা প্রাকৃতিক সৌন্দর্য দেখার পাশাপাশি আফ্রিকানদের স্থানীয় মনোজ্ঞ সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানে মেতে ওঠেন। উপভোগ করেন প্রাকৃতিক সৌন্দর্যে ঘেরা ভিঅ্যান্ডএ ওয়াটারফ্রন্টের ড্রাম, অ্যাকুয়েস্টিক বাদ্যযন্ত্রের মন মাতানো সুর। এ ছাড়া ভ্রমণপিপাসুদের জন্য বছরের ৩৬৫ দিনই থাকে স্থানীয় আফ্রিকানদের সংগীতায়োজন। এ ছাড়া সামুদ্রিক সিল মাছের খেলাধুলার জন্য ভিঅ্যান্ডএ ওয়াটারফ্রন্টে রয়েছে সিল চত্ত¡র। সেখানে সিল পুরুষ ও স্ত্রী সিল মাছেদেও ছোটাছুটির পাশাপাশি তাদের মিলনের বিরল দৃশ্য দেখা যায়, যা দর্শনার্থীদের নতুন অভিজ্ঞতা দেয়। কয়েক ডজন সামুদ্রিক সিল মাছের সংগ্রহ রয়েছে এখানে। এ ছাড়া কিছুক্ষণ পরপর হেলিকপ্টার ফ্লাইট ও আটলান্টিক মহাসাগরের নীল জলরাশির ঢেউয়ের শোঁ শোঁ শব্দ পর্যটকদের মন মাতিয়ে তোলে। বড়দের পাশাপাশি রয়েছে শিশুদের জন্য চিত্তবিনোদনের ব্যবস্থা। শিশুদের সব সময় মজাদার ও দুঃসাহসিক কাজে মেতে থাকার সুযোগ রয়েছে। খেলার জায়গা, থিমযুক্ত বোট রাইড থেকে শুরু করে শিশু বিনোদনের মজাদার অনেক আয়োজন রয়েছে এখানে।

খাবারের আয়োজন
স্থানীয় ও আন্তর্জাতিক উভয় খাবারের সংমিশ্রণের ৮০টির বেশি ভোজনশালা রয়েছে এখানে। রয়েছে বিলাসবহুল ১২টি হোটেল। স্যামন, শেলফিশসহ বিভিন্ন সামুদ্রিক মাছ ছাড়াও লবস্টার, শ্রিম্প, মলাস্কস, ওয়েস্টার, ক্লাম, ক্র্যাব, স্কালোপস, স্কুইডের মতো জনপ্রিয় ও বাহারি সি ফুডের পসরা সাজানো থাকে এখানকার রেস্তোরাঁগুলোতে।

ভিঅ্যান্ডএ ওয়াটারফ্রন্টের নৌ বন্দর

শহরের আদল
চারদিকে অবারিত সমুদ্রের জলরাশির মধ্যে অবস্থিত হলেও এই পর্যটন স্পটটি শহরের আদলেই তৈরি করা হয়েছে। যানবাহন চলাচলের জন্যও রয়েছে অভ্যন্তরীণ সরু পথ। পথচারীদের জন্য রয়েছে ল্যান্ডস্কেপ ওয়াকওয়ে ও পাকা ওয়াকওয়ে, বেঞ্চ, ঘাসযুক্ত কৃত্রিম বনাঞ্চল। রয়েছে বিশ্রাম নেওয়ার জন্য কৃত্রিম বাগান। বাগানের সংস্পর্শে এসে মন-প্রাণ জুড়ান অনেক পর্যটক। বাগানের ভেতরে আরও রয়েছে একটি স্কেট পার্ক, বাস্কেটবল কোর্ট, ছোট ছোট ভোজনালয় ও কফি শপ।

নোবেল স্কয়ার
ভিঅ্যান্ডএ ওয়াটারফ্রন্টের অন্যতম আরেকটি আকর্ষণীয় স্থান নোবেল স্কয়ার। এটি ২০০৫ সালের চালু করা হয়। এখানে দক্ষিণ আফ্রিকার আলবার্ট লুটুলি, ডেসমন্ড টুটু, এফ ডব্লিউ ডি ক্লার্ক ও নেলসন ম্যান্ডেলা এই চারজন নোবেল শান্তি পুরস্কার বিজয়ীর ভাস্কর্য রয়েছে। প্রতিটি ভাস্কর্যের বিস্তারিত বর্ণনা সামনে খোদাই করে লেখা আছে। এ ছাড়া বর্ণবাদবিরোধী আন্দোলনে নারী ও শিশুদের ভূমিকাকে উপস্থাপন করেছে আরেকটি ভাস্কর্যে। যার নাম দেওয়া হয়েছে ‘শান্তি ও গণতন্ত্র’। এই পাঁচটি ব্রোঞ্জের ভাস্কর্যই ৩৮৬ বর্গমিটার গ্রানাইটপৃষ্ঠের ওপর দাঁড়িয়ে আছে, যা আফ্রিকার সম্মান ও মর্যাদার প্রতীক হিসেবে মাথা উঁচু করে দাঁড়িয়ে আছে। এখানে এসে শ্রদ্ধায় মাথা অবনত করেন অনেকে।

পতাকা চত্ত¡রে বাংলাদেশও
স্বাধীন সব দেশের পতাকা রয়েছে এই চত্বরে। মজার ব্যাপার হলো, বাংলাদেশের লাল-সবুজের পতাকাও সেখানে পতপত করে উড়তে দেখা যায়। বাংলাদেশি পর্যটকেরা সেখানে গিয়ে আবেগে আপ্লুত হয়ে পড়েন। নিজ দেশের পতাকাসংবলিত এই চত্ত্বরে এলে অনেকে ছবি ও ভিডিও করেন।

সিল চত্ত্বর

স্পা সেন্টারের সমাহার
আফ্রিকার স্থানীয় জনপ্রিয় জিঙ্কগো, মাঙ্গওয়ানি, অ্যাংসানা স্পাসহ নানা ধরনের স্পা সেন্টারের সমাহার রয়েছে এখানে। এ ছাড়া না বুয়া থাই ম্যাসাজ, উবুন্টু, ক্যামলোল ও বাকওয়েনা ডে স্পার মতো বিশ্বের জনপ্রিয় শরীর ম্যাসাজের সুবিধা রয়েছে এই পর্যটন স্পটটিতে। কিছু স্পা আছে ভেষজ ওষুধ দিয়ে পুরো শরীরে মাখানো হয়, আবার কিছু স্পা আছে পানি ছিটানোর মাধ্যমে করা হয়। স্পার ক্ষেত্রে ভিঅ্যান্ডএ ওয়াটারফ্রন্টের জুড়ি মেলা ভার।

কমপ্লেক্স ও আউটলেট
শুরুতে নৌবাহিনীর ঘাঁটি হিসেবে ব্যবহৃত হলেও এখন এটি আধুনিক নগরের রূপ পেয়েছে। আদ্রিয়ান ভ্যান ডের ভাইভার ভিএনএ ওয়াটারফ্রন্ট কমপ্লেক্সটির নকশা করেন। দক্ষিণ আফ্রিকার প্রাচীনতম সমুদ্র বন্দরের নিকটবর্তী এই কমপ্লেক্সটির আয়তন ১২৩ হেক্টর বা ৩০০ একর। আবাসিক ও বাণিজ্যিক উভয়ের মিশেলে তৈরি করা হয়েছে কমপ্লেক্সটি। কমপ্লেক্সটিতে ফ্যাশন, হোমওয়্যার ও কিউরিওস, জুয়েলারি, শপিং সেন্টার, মুদিদোকান, রেস্তোরাঁর পাশাপাশি রয়েছে একটি আইম্যাক্স লেজারসহ মোট ১৩টি স্ক্রিন স্টার-কিনেকর সিনেমা কমপ্লেক্স। চামড়ার পণ্যের বিপুল সমাহার রয়েছে এখানে। অডিও-ভিডিও ভিজ্যুয়াল সরঞ্জামাদিসহ ৪৫০টির বেশি খুচরা আউটলেটে বিকিনিকি চলে। মাছ ধরার ট্রলারগুলো এখানে প্রতিনিয়ত তাজা মাছ সরবরাহ করে।

নেলসন ম্যান্ডেলা গেটওয়ে
কেপ টাউন শহরের অদূরে আটলান্টিক মহাসাগরের গভীর সমুদ্রে রোবেন আইল্যান্ড নামে একটি ঐতিহাসিক দ্বীপ রয়েছে। এই নির্জন দ্বীপেই আফ্রিকার অবিসংবাধিত নেতা নেলসন ম্যান্ডেলা ১৮ বছর কারাবন্দী ছিলেন। তিনি ছাড়াও রবার্ট সোবুকে ও জ্যাকব জুমাসহ বর্ণবাদবিরোধী ও মুক্তিসংগ্রামের অনেক নেতাও ছিলেন বন্দী। পরবর্তী সময়ে নেলসন ম্যান্ডেলা ও জ্যাকব জুমা দক্ষিণ আফ্রিকার প্রেসিডেন্ট হয়েছিলেন। রোবেন দ্বীপের এই কারাগার পরিদর্শনে যাওয়া যায় ভিঅ্যান্ডএ ওয়াটারফ্রন্ট থেকে।

ভিএনএ ওয়াটারফ্রন্টের নানা খন্ডচিত্র

যাতায়াতব্যবস্থা
ভিঅ্যান্ডএ ওয়াটারফ্রন্ট ও কেপ টাউন কনভেশন সেন্টারের মধ্যে চলাচলের জন্য রয়েছে ওয়াটার ট্যাক্সি, ইয়াট ও ত্রুজ শিপ। যাঁরা ইয়াটে বা ওয়াটার ট্যাক্সিতে আটলান্টিকের অট্টালিকা সমান ঢেউয়ের বুক চিরে যেতে ভয় পান, তাঁরা বড় ত্রজ শিপ দিয়ে এই বিনোদনকেন্দ্রে যেতে পারেন। এ ছাড়া যাঁদের সি সিকনেস রয়েছে, তাঁদের জন্য আছে হেলিকপ্টারের ব্যবস্থা।

প্রকাশকাল: বন্ধন ১৬৬ তম সংখ্যা, জুন ২০২৪

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Scroll to Top