পরিবেশ আইনবিদ সৈয়দা রিজওয়ানা হাসানের জন্ম ১৯৬৮ সালের ১৫ জানুয়ারি ঢাকার ধানমন্ডিতে। বাবা সৈয়দ মহিবুল হাসান, মা সুরাইয়া হাসান। ভিকারুননিসা নূন স্কুল অ্যান্ড কলেজ থেকে এসএসসি ও হলিক্রস কলেজ থেকে এইচএসসি পাস করে তিনি ভর্তি হন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আইন বিভাগে। সেখান থেকেই স্নাতক ও স্নাতকোত্তর সম্পন্ন করেন। এর পর যুক্তরাষ্ট্রের আইজেনহাওয়ার ফেলোশিপসহ দেশের বাইরে বেশ কয়েকটি কোর্সে অংশ নেন। ১৯৯৩ সালে বাংলাদেশ পরিবেশ আইনবিদ সমিতিতে (বেলা) যোগ দেন। বেলাতে থেকে গত দুই দশক ধরে তিনি বাংলাদেশে পরিবেশ-সুশাসন নিশ্চিত করতে আইনি লড়াই চালিয়ে যাচ্ছেন। পরিবেশ ও বন মন্ত্রণালয় এ জন্য তাকে ২০০৭ সালে পরিবেশ পদকে ভূষিত করে। ২০০৯ সালে তিনি পরিবেশের জন্য সবচেয়ে সম্মানজনক আন্তর্জাতিক ‘গোল্ডম্যান পুরস্কার’ পান। এ ছাড়া একই বছর যুক্তরাষ্ট্রের সবচেয়ে প্রভাবশালী ‘টাইম’ ম্যাগাজিন তাকে বিশ্বের অন্যতম ‘হিরোজ অব এনভায়রনমেন্ট’ (Heroes of the Environment) অ্যাওয়ার্ডে ভূষিত করে, যা কোনো বাংলাদেশীর প্রথম এ ধরনের সম্মাননাপ্রাপ্তি। তিনি ফ্রেন্ডস অব আর্থ ইন্টারন্যাশনালের নির্বাহী সদস্য; এ ছাড়া এনভায়রনমেন্টাল ল এলায়েন্স ওয়ার্ল্ডওয়াইড এবং এনভায়রনমেন্টাল ল কমিশন অব দ্য আইইউসিএনের সদস্য। এ ছাড়া সম্প্রতি প্রতিষ্ঠিত সাউথ এশিয়ান নেটওয়ার্ক অব এনভায়রনমেন্টাল অ্যাক্টিভিস্টে (SAANS) দিকনির্দেশক হিসেবে কাজ করছেন। তবে জাহাজ-ভাঙা শিল্পের পরিবেশদূষণ ও শ্রমিকদের মৃত্যুঝুঁকির বিষয়টি নিয়ে তার আইনি লড়াই বিশ্ববাসীর দৃষ্টি আকর্ষণ করে। বর্তমানে তিনি বেলার প্রধান নির্বাহী।
প্রতিবছরের মতো সম্প্রতি চট্টগ্রামে আবারো পাহাড় ধসের ঘটনা ঘটেছে। এটি কেন হচ্ছে? এ বিপর্যয় থেকে রক্ষার উপায় কী?
সম্প্রতি চট্টগ্রামে পাহাড় ধসের যে ঘটনা ঘটেছে এটাকে একটা মনুষ্য সৃষ্ট দুর্ঘটনা বলা যায়। পাহাড় প্রাকৃতিক ভারসাম্য রক্ষায় গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। আমাদের দেশীয় আইনে পাহাড় কাটা নিষিদ্ধ। ১৯৯৭ সালের আইনে বলা আছে, পাহাড় বা টিলা কাটতে হলে যেসব জেলায় পাহাড় ও টিলা রয়েছে সেখানে জেলা প্রশাসনের নেতৃত্বে একটি দল থাকবে। এই দলের সহায়তা নিয়ে পাহাড় কাটতে হবে। পাহাড় কাটতে হলে পরিবেশ অধিদফতরের মহাপরিচালকের অনুমতি লাগবে। আমার জানা মতে, পাহাড় কাটার যে নীতিমালা রয়েছে তা মেনে জেলা প্রশাসনের অনুমতি নিয়ে আজ পর্যন্ত কোনো পাহাড় কাটা হয়নি। অথচ নির্বিচারে পাহাড় কাটা হচ্ছে। পরিবেশ রক্ষায় আমাদের দেশে যে আইন রয়েছে। সরকার এ আইনের বাস্তবায়নে বলা যায় ব্যর্থ। এ ব্যর্থতার জন্য আমরা সাধারণ মানুুষ নানামুখী সমস্যার সম্মুখীন হচ্ছি প্রতিদিন। কিছু মানুষ সবকিছু গ্রাস করতে চায়। তাদের ব্যক্তিগত স্বার্থের জন্য পরিবেশের অনেক বড় বিপর্যয় তারা করছে। এসব লোকের নদীর মাঝে হোটেল দরকার হয়, সাগর পাড়ে পর্যটন কেন্দ্র তৈরির জন্য বড় বড় মোটেল নির্মাণ করার প্রয়োজন হয়। পারলে এরা পাহাড়টাকেও দখল করে নিতে চায়। এ ধরনের অনেক বড় বড় অনিয়ম আমাদের এখানে হচ্ছে। শুরু হয়েছে দখলের মহোৎসব।
ব্যক্তিমালিকানাধীন যেসব পাহাড় বা টিলা রয়েছে সেগুলো থেকে মাটি কেটে বিক্রি করা হচ্ছে বা পাহাড় কেটে সমতল করে কৃষি জমি তৈরি করা হচ্ছে। তৈরি হচ্ছে আবাসন প্রকল্প। পাহাড় ব্যক্তিমালিকানা হোক আর সরকারি হোক, কাটতে হলে জেলা প্রশাসনের অনুমতির প্রয়োজন। তা না হলে এটি শাস্তিযোগ্য অপরাধ বলে বিবেচিত।
আমাদের দেশের পাহাড়গুলোকে দখলে নেওয়ার জন্য রাজনৈতিক মদদপুষ্ট স্বার্থান্বেষী মহল তৈরি হয়েছে, যারা পাহাড় দখল করছে। রাজনৈতিক ছত্রছায়ায় এটা হওয়ায় প্রশাসন দেখেও না দেখার ভান করে। চট্টগ্রাম এলাকায় পাহাড় দখলে নিয়ে, এর একদম নিচে ঘুপসি ঘর করে ভাড়া দেওয়া হচ্ছে। সারা দেশের বিভিন্ন এলাকা থেকে নদী ভাঙনের শিকার হয়ে বা প্রাকৃতিক কোনো দুর্যোগের শিকার হয়ে শহরে এসেছে এ অসহায় মানুষগুলো। এখানে আশ্রয় নিচ্ছে তারা। আর এ সুযোগে তাদের দু’দিক থেকে লাভ হচ্ছে, ভাড়া পাচ্ছে এবং দখলে থাকছে পাহাড়। ভাড়া পাচ্ছে মাসে মাসে। যারা এখানে থাকে তাদের অসচেতনতা বা তাদের অসহায়ত্বকে দায়ী করা যায়। এই লোকদের আবাসনের নিশ্চয়তা দেওয়ার দায়িত্ব সরকারের। সরকারের আশ্রয়ণ প্রকল্প রয়েছে। কোটি কোটি টাকা খরচ করছে সেখানে। আর সামান্য ১৬০০ পরিবারের বাসস্থানের জায়গা করতে পারেনি। সরকার চাইলেই পারে। সরকার পারে না এ কথা বলাটা যুক্তিযুক্ত নয়। এটাকে আমি বলব এক ধরনের উদাসীনতা। সাধারণ মানুষের জীবন নিয়ে রয়েছে সরকারের উদাসীনতা। যার ফল প্রতিবছর পেতে হচ্ছে এখানে বসবাসকারী মানুষদের। সরকার তাদের পুনর্বাসনের ব্যবস্থা না করে যতই তাদের সরে যেতে বলুক না কেন, তারা সেখান থেকে সরবে না। তারা সরে কোথায় যাবে? তাদের যাওয়ার কোনো জায়গা নেই। মোটামুটি চারটি কারণে এ সমস্যা হচ্ছে বলে আমি মনে করছি। এক. আইন প্রয়োগে আইন প্রয়োগকারী সংস্থার ব্যর্থতা। দুই. সর্বহারা জনগণকে পুনর্বাসন করতে সরকারের ব্যর্থতা। তিন. রাজনৈতিক মদদপুষ্ট লোকদের দখলকে প্রশাসনের দেখেও না দেখার ভান করা এবং চার. সাধারণ মানুষের অসহায়ত্ব।
ভবন নির্মাণের ক্ষেত্রে পরিবেশ আইন মানা হচ্ছে কতটুকু?
ভবন নির্মাণের ক্ষেত্রে পরিবেশ আইন মানা হচ্ছে না এটা ঠিক বলেছেন। আমাদের রাজউকের কাছ থেকে কোনো পরিকল্পনা পাস করাতে হলে এখন কিছু নীতিমালা রয়েছে যেগুলোকে আপনাকে অনুসরণ করতে হবে। তা না হলে আপনি ভবন নির্মাণ করতে পারবেন না। আর করলেও সেটা রাজউক বা পরিবেশের জন্য হুমকি মনে হলে পরিবেশ অধিদফতর চাইলে ভেঙে দিতে পারে। আমাদের ভবন নির্মাণে যে বিধিমালা রয়েছে সেখানে স্পষ্টভাবে উল্লেখ করা হয়েছে একটি ভবন নির্মাণের ক্ষেত্রে একটি নির্দিষ্ট পরিমাণ খোলা জায়গা থাকতে হবে। বাসার ছাদে সোলার প্যানেল বসাতে হবে। পানির লাইন আর গ্যাসের ব্যবস্থা নিয়ে আইন রয়েছে। প্রতিবেশীর সমস্যা না হয় এমন অনেক বিষয়ে সচেতন করেও রয়েছে আইন। ভবন নির্মাণের সময় যে দুর্ঘটনা ঘটে সেটা রোধে আইন করা হয়েছে। অনেকে আবার এসব আইন মানছেন না। যারা মানছেন না রাজউকের পক্ষ থেকে মাঝে মাঝে বিভিন্ন উদ্যোগ নেওয়া হচ্ছে। এগুলো ভাঙা বা জরিমানা করার বিধান আছে। এটা মানার বিষয়। আর শুধু আইন করলে হবে না, জনসচেতনতা তৈরি করতে হবে আইন মানতে।
বাড়ির ছাদে সোলার প্যানেল থাকা বাধ্যতামূলক কিন্তু ক’জন এটা করছে! খোলা স্থান রাখার কথা আছে, অনেকে রাখছে না। বর্তমানে নতুন যারা বাড়ি করছেন অনেকের মাঝে আইনের প্রতি শ্রদ্ধা দেখানোর মনোভাব লক্ষ করা যাচ্ছে। এটা আশার দিক। অনেকে বাড়িতে খোলা স্থান রাখছেন, কিন্তু সেখানে বাচ্চাদের খেলতে দেওয়া হচ্ছে না। কিছু সুন্দর সুন্দর ঘাস লাগানো হচ্ছে সেখানে। স্থানটি তা হলে সৌন্দর্যের প্রয়োজনে ব্যবহার হচ্ছে, অন্য কোনো কাজে আসছে না।
যারা আইন মানছে না তাদের কী করা যেতে পারে?
অনেকে আইন মানছে না। রাজউক চাইলেও অনেকের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে পারে না। তার জলজ্যান্ত উদাহরণ বিজিএমইএ ভবন। আর ঢাকার বাইরে ভবন নির্মাণের কথা বলতে গেলে এখনো বাধ্যবাধকতা আসেনি এখনও। আসলে এমন অবস্থা হয়েছে আমাদের দেশে যে, অনিয়মকে নিয়ম করে ফেলার প্রবণতা বৃদ্ধি পাচ্ছে। পরিবেশ আইন মেনে ভবন নির্মাণের প্রবণতা আমাদের দেশে এখনো চালু হয়নি। তবে যে আইন আছে তা মেনে চললে অনেক ভালো হবে।
সাধারণ মানুষ কিভাবে পরিবেশ বিপর্যয়কারী বা অন্যায়কারীর বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে পারে?
পরিবেশ-সুশাসন নিশ্চিত করতে আইনি লড়াই চালাতে হবে। তবে পরিবেশ-দুর্বৃত্তরা অনেক শক্তিশালী। তাদের বিরুদ্ধে আইনি লড়াইয়ে জয়ী হওয়ার সুযোগ কম। তাই কমিউনিটিকে নিজের অধিকারের ব্যাপারে মোবিলাইজ করতে হবে। সবচেয়ে বড় কথা, অধিকার-চর্চার ক্ষেত্রটা তৈরি করে দিতে হবে। ফুলবাড়ী, রূপগঞ্জ এবং আড়িয়াল বিলে যেভাবে প্রতিরোধ করা গেছে, সেভাবে এদের প্রতিরোধ করতে হবে। ওদিকে সাধারণ মানুষ কিন্তু পরিবেশ আদালতে যায় না। কারণ পরিবেশ-অন্যায়কারীরা খুব শক্তিশালী। আর উচ্চতর আদালত থেকে আমরা পরিবেশ-অন্যায়কারীদের বিরুদ্ধে যে সব মামলার রায় নিয়ে আসছি সেগুলোর বাস্তবায়নের জন্য আমাদের অনেক কাঠখড় পোড়াতে হয়। এই যেমন জাহাজ-ভাঙা শিল্পের কথাই ধরা যাক। এ নিয়ে একটি নাটক চলছে প্রায় আড়াই বছর ধরে। আমাদের আবেদনের প্রেক্ষিতে আদালত সে শিল্পের জন্য সরকারকে একটি বিধিমালা তৈরির কথা বলেছিল। এ আদেশের প্রেক্ষিতে দুটো মন্ত্রণালয় থেকে দুটো আলাদা বিধিমালা পাঠানো হয়েছে। এতে আরও কনফিউশন তৈরির সুযোগ হলো। কারণ বিধিমালা দুটো সম্পূর্ণ ভিন্ন। প্রাতিষ্ঠানিক কাঠামো, অনুমোদন দেওয়ার নীতি, আন্তর্জাতিক আইন কোনো দিক থেকেই মিল নেই। তাই হাইকোর্ট বিভাগ থেকে আপিল বিভাগে বিধি দুটো পাঠানো হয়েছে কোন্টি আদালতের আদেশের সঙ্গে সঙ্গতিপূর্ণ তা জানানোর জন্য।
দেশীয় ঐতিহ্যবাহী স্থাপনা রক্ষায় কোনো উদ্যোগ নেওয়ার প্রয়োজন আছে কিনা? এ ব্যাপারে সরকারের কোনো দুর্বলতা রয়েছে কি?
এগুলো রক্ষা করা আমাদের খুবই গুরুত্বপূর্ণ। ইতিহাস ও ঐতিহ্য মানুষের অনেক গুরুত্বপূর্ণ সম্পদ। সরকার এগুলো রক্ষায় এখন পর্যন্ত সুনির্দিষ্ট কোনো পরিকল্পনা করেনি। সরকার তার কাজকে বাস্তবায়নের জন্য একটি নীতিমালা প্রণয়ন করবে। এটিকে একটি নির্দিষ্ট ফরম্যাটে নিয়ে কাজ শুরু করলে সংস্কার করা সম্ভব। আমরা জানি না কত বছরের পুরনো ভবন হলে বা কী কী নির্মাণশৈলী থাকলে তাকে ঐতিহ্যবাহী হিসেবে নির্ধারিত করব। এ ধরনের সুনির্দিষ্ট নিয়ম বা আইন না থাকায় এটি নির্ধারণে কষ্ট হচ্ছে। সিদ্ধান্ত নিতে দেরি হওয়ায় নষ্ট হচ্ছে এসব স্থাপনা। এটিকে রক্ষার জন্য আমাদের দ্রুত পদক্ষেপ নিতে হবে।
ঢাকার খেলার মাঠ দখল হয়ে যাচ্ছে, আইনি জটিলতা নিয়ে এ বিষয়ে কিছু বলবেন?
এসব ব্যাপারে আমাদের হতাশা ছাড়া আর কিছু নেই। মাঠ দখল ঠেকাতে আমরাসহ নানা সংগঠন অনুরোধ করে আসছি। আদালত ঢাকা শহরের ১০টি খেলার মাঠ, ৬১টি পার্ক ও উদ্যানকে রক্ষার নির্দেশ দিয়েছে। এসব স্থাপনা যারা দখল করেছে তাদের উচ্ছেদ করে বা কোনো স্থাপনা থাকলে তা ভেঙে মাঠ বা পার্ক উদ্ধারের নির্দেশ দেয় আদালত। কিন্তু তা করা হয়নি। উল্টো খেলার মাঠে গ্যারেজ তৈরি হয়েছে। তৈরি করা হয়েছে দোকান। আমাদের পক্ষ থেকে আরো একটি দাবি ছিল আর তা হলো এসব মাঠকে দেখভাল করতে স্থানীয় লোকজনকে নিয়ে গঠিত কমিটি। আমরা বলেছি, সিটি কর্পোরেশনের আওতায় এটি রাখা যাবে না। তারা এ এটি মানেনি। সিটি কর্পোরেশন আদালতের রায়ও মানেনি। সিটি কর্পোরেশনের বিরুদ্ধে আমরা আদালত অবমাননার মামলা করেছি। মাঠগুলো উদ্ধারের জন্য আমরা আন্দোলন চালিয়ে যাচ্ছি। অব্যাহত রেখেছি আমাদের কার্যক্রম।
ঢাকার অদূরে স্যাটেলাইট সিটির প্রয়োজনীয়তা কতটুকু বলে আপনি মনে করেন?
স্যাটেলাইট সিটি সম্পর্কে আমাদের কাছে এখন পর্যন্ত কিছু স্পষ্ট নয়। আমরা জানি না এটি কাদের জন্য নির্মিত হচ্ছে বা কোথায় নির্মিত হচ্ছে। কাদের জায়গা নিয়ে এগুলো করা হবে। আর এগুলো কারা কিনবে তাও জানি না। এ বিষয়ে তেমন কিছু আমরা জানতে পারিনি। তবে একটি কথা বলা যায়, আপনি কখনো ঢাকা শহরে কোনো উচ্চবিত্ত, মধ্যবিত্তকে দেখেছেন যে রাস্তায় ঘুমায়। হয় তার প্লট বা ফ্ল্যাট আছে অথবা সে ভাড়া বাড়িতে থাকে। তা হলে এই ফসলি জমি নষ্ট করে কেন এত প্লট বা ফ্ল্যাট নির্মাণ। একটি কথা বলি, ঢাকা থেকে লোক কমাতে হবে। শহরের বাইরে নিতে হবে শিল্পকারখানা। সবচেয়ে বড় কথা, গোটা দেশটাই এমন কিছু গোষ্ঠীর হাতে জিম্মি। এখন ঢাকা শহরে আবাসনের নামে কী হচ্ছে? জলাশয় ভরাট করেও আবাসন হচ্ছে। এখানে যে সব ফ্ল্যাট তৈরি হচ্ছে তার বেনিফিশিয়ারি কারা? বেসরকারি বড়জোর তিন-চারটি আবাসন কোম্পানি। মূলত উচ্চবিত্ত, বড়জোর উচ্চ মধ্যবিত্তদের জন্য এ সব ফ্ল্যাট তৈরি হচ্ছে। আমি তো ঢাকা শহরে এমন কোনো উচ্চবিত্ত বা উচ্চ মধ্যবিত্তের কথা শুনিনি যার কোনো ফ্ল্যাট নেই বলে তিনি রাস্তায় থাকছেন। বরং দরিদ্ররা পথে পথে জীবন কাটাচ্ছেন। নিম্নবিত্ত বা নিম্ন-মধ্যবিত্তরা ঢাকায় থাকতে না পারলে পরিবার-পরিজনকে গ্রামে পাঠিয়ে দিচ্ছেন। তাদের জন্য তো কোনো আবাসন ব্যবস্থা হচ্ছে না। তার মানে, এখানে সম্পদের সুষম বণ্টন হচ্ছে না। এটা পরিবেশ ন্যায়বিচারের একটা বড় দিক। এই ন্যায়বিচারের মূল বক্তব্য হলো সম্পদের সুষম বণ্টন করতে হবে এবং উন্নয়নটা টেকসই হতে হবে। সবচেয়ে বড় কথা, উন্নয়নকে সঙ্গে নিয়েই আমাদের এগিয়ে যেতে হবে। আমাদের দেশের এই দ্বৈত নীতি পরিহার করতে হবে। আমাদের দেশের সরকারের কর্মকাÐ দেখলে মনে হয় দেশে, আবাসন, ট্যানারি আর জাহাজ-ভাঙা শিল্প ছাড়া আর কোনো শিল্প নেই। সরকার কেন এদের পক্ষে এত কথা বলে, কার স্বার্থে বলে কিছুই আমরা বুঝি না।
বন রক্ষায় বন আইন হয়েছে। এ সম্পর্কে কি কিছু বলবেন?
বন রক্ষায় আমরা সরকারের কাছে সুনির্দিষ্ট কিছু প্রস্তাবনা রেখেছি। প্রথমত, সকল প্রাকৃতিক বনের সীমানা নির্ধারণ করে দেওয়া। দ্বিতীয়ত, বনের যে অংশ দখল হয়ে গেছে তা ফিরিয়ে আনা এবং বননির্ভর জনগোষ্ঠীকে সাথে নিয়ে বন থেকে সামাজিক বনায়ন উঠিয়ে দিয়ে বনগ্রাম তৈরি করা। যেখানে লাগানো হবে ঐ বনের প্রাকৃতিক গাছগুলোকে। আবার আমরা যদি গাছপালা না লাগিয়ে বনকে নিরাপত্তা দেই, কোনো ধরনের অসুবিধা না করি বন এমনিতেই ফিরে আসবে। আমরা যদি বনকে বনের মতো থাকতে দেই, সেটা হবে মঙ্গলজনক।
সরকারকে আমরা বন ও বন্য প্রাণী সংরক্ষণ আইন সংস্কারের কথা বলেছি। পরিবেশ বিষেশজ্ঞ, আমরা এবং অন্যান্য সংগঠন মিলে যে সুপারিশগুলো করেছিলাম সম্প্রতি সেই উপদেশগুলোর/সুপারিশগুলোর ঠিক বিপরীত দিক ভেবে একটি বন আইন পাস করেছে সরকার। এই আইনের প্রতি আমরা আপত্তি জানিয়েছি।
পরিবেশের উপর ইটভাটার প্রভাব নিয়ে অনেক কথা হচ্ছে। বাড়ছে ইটভাটার সংখ্যা। এ বিষয়ে আপনার অভিমত কী?
হ্যাঁ। আমাদের অনেক কিছু করার আছে। নদীর পাশে ছাড়া বাংলাদেশের কোথাও ইটভাটা স্থাপন করা যাবে না। এক ফসলি জমি বলুন আর দুই ফসলি জমি বলুন, কোনো আবাদি জমিতে ইটের ভাটা স্থাপন করা যাবে না। প্রয়োজনে আমরা ইট আমদানি করব, তবুও ইটভাটার সংখ্যা বৃদ্ধি করা ঠিক হবে না। কারণ ইটভাটার জন্য ক্ষতিগ্রস্ত হয় জমি ও পরিবেশ। আর ইট আমদানি করে যে বাড়তি খরচ হবে তা আবার কৃষি থেকে উঠে আসবে।
পরিবেশ অন্দোলনের সাথে তরুণ প্রজন্মকে কিভাবে সম্পৃক্ত করা যায়?
তরুণ প্রজন্মকে কাজে লাগানোর বিষয়ে আমি একমত। এদের দিয়ে অনেক কিছু করা সম্ভব। সঠিক গাইডলাইন দিয়ে এদের সামনে এগিয়ে নিয়ে যাওয়া গেলে সব কিছু সহজ হয়ে যাবে। আর সবচেয়ে বড় কথা এদের মাঝে বোঝানোর প্রয়োজন রয়েছে পরিবেশ বিপর্যয় থেকে রক্ষার বিষয়ে। যদি আমরা এই বিষয়টি ছোটবেলা থেকে শিক্ষার্থীদের মাঝে ছড়িয়ে দিতে পারি তবে তাদের উন্নয়নের সাথে সম্পৃক্ত করা সহজ হবে। আমাদের বাচ্চাদের পরিবেশের সাথে পরিচয় করানো দরকার। প্রয়োজন পাঠ্যসূচিতে এটির অন্তর্ভুক্তি। চতুর্থ শ্রেণী থেকে অনার্স পর্যন্ত পরিবেশ বিষয়ে পড়াশোনা বাধ্যতামূলক করা। তা হলে সচেতনতা বাড়বে। আমাদের ছেলেমেয়েরা এগিয়ে এলে যারা এর বিরুদ্ধে কাজ করছে তারা আর পার পাবে না। আমাদের কাজ করতে সুবিধা হবে। মানুষকে বোঝানোর কাজটা কঠিন। আর এই কাজটি যদি তরুণ প্রজন্মের মাঝে করা যায় তা হলে আমাদের কাজ হবে অনেক সহজ।
দেশীয় পরিবেশ আইনের ভালো-মন্দ ও সম্ভাবনা নিয়ে যদি কিছু বলেন?
আমাদের দেশের পরিবেশ আইনের সবচেয়ে ভালো দিক সাংবিধানিকভাবে পরিবেশ রক্ষায় গুরুত্ব রয়েছে। আমাদের পরিবেশ আইনের ১৮(ক) অনুচ্ছেদে স্পষ্টভাবে উল্লেখ রয়েছে পরিবেশ বিষয়ে। এ আইনটি আমাদের জন্য পর্যাপ্ত বলা যায়। পরিবেশ বিপর্যয় নিয়ে অনেক কিছু বলা আছে এখানে। আজকের প্রজন্ম এটি নিয়ে অনেক সচেতন। দুর্বল দিক হচ্ছে, যে আইন রয়েছে তার বাস্তবায়ন না হওয়া। আর এর জন্য দায়ী রাজনৈতিক নেতৃত্ব। তাদের মাঝে এই আইন বাস্তবায়নের জন্য কোনো ধরনের কার্যকর পদক্ষেপ লক্ষ করা যায় না। এখানে রাজনৈতিক ব্যক্তিত্বের সদিচ্ছার অভাবের কারণে এটি বাস্তবায়নে সমস্যার সৃষ্টি হচ্ছে। মাত্র ৮৭টি ট্যানারি মালিকের স্বার্থের জন্য জলাঞ্জলি দেওয়া হয়েছে বুড়িগঙ্গাকে। এর মধ্য দিয়ে বোঝা যায়, সরকার রাষ্ট্রপরিচালনার জন্য জনগণের কাছে যে প্রতিশ্রুতি দিয়েছিল তা তারা পালন করছে না। আমাদের বন বা বন্যপ্রাণী সংরক্ষণ আইনের ১৬টি ধারায় পরিবর্তন আনতে হবে। বন ব্যবস্থাপনায় বনবাসীকে সম্পৃক্ত করতে হবে। নদী ব্যবস্থাপনার কথা বললেও সরকার ছাড় দিচ্ছে নদী ব্যবস্থাপনার দিকেও।
এখন ঢাকা শহরকে বিশ্বের দ্বিতীয় দূষিততম মেগাসিটি বলা হচ্ছে। এর অন্যতম কারণ আমাদের ভ্রান্ত উন্নয়ন কৌশল। আমরা উন্নয়নের জন্য যে মডেল বেছে নিয়েছি তা টেকসই নয়। টেকসই উন্নয়ন হচ্ছে এমন একটি মডেল যাতে বর্তমান প্রজন্মের পাশাপাশি ভবিষ্যৎ প্রজন্মকেও উপকৃত করা যায়। আমাদের বেছে নেওয়া মডেলটির ফলে আমাদের খেলার মাঠ চলে গেছে। পার্ক চলে গেছে। আমাদের রাস্তাঘাটে জ্যাম বেড়ে গেছে ভয়ানকভাবে। বায়ুদূষণ মাত্রা ছাড়িয়েছে। শব্দদূষণ হচ্ছে ব্যাপক। অর্থাৎ আমাদের মডেলটি উন্নয়নের গতিকে আরো শ্লথ করে দিয়েছে। আমাদের কৈশোরে মনে আছে, বনানী থেকে মগবাজারে স্কুলে যেতাম দশ মিনিটে। এখন হরতালের দিন ছাড়া অন্য কোনো সময় এত দ্রুত বনানী থেকে মগবাজারে যাওয়ার প্রশ্নই ওঠে না। আসলে এই মডেলটা যে কাজ করেনি সেটাই এর প্রমাণ।
বেলার বর্তমান সময়ের কাজ বলুন?
বেলা এখন বেশি যে কাজটি করছে সেটি হলো তৃণমূল পর্যায়ে পরিবেশ বিপর্যয়ের হাত থেকে দেশকে রক্ষার জন্য প্রয়োজনীয় আইনি সহায়তা দেওয়া। এ কাজটি করে যাচ্ছে নিষ্ঠার সাথে।
বাংলাদেশের পরিবেশ নিয়ে আপনার ভাবনার কথাটা জানতে চাই?
আমার কথা বলি, পরিবেশ আইনের নামে অত্যাচার হচ্ছে গরিবের উপরই। আর যারা আসলে পরিবেশ আইন লঙ্ঘন করছে তারা দিব্যি আছে। তাদের কোনো সমস্যা নেই। পরিবেশ-শাসন ব্যবস্থাটা খুব বেশি নাজুক হয়ে পড়েছে বলেই আজ দেশের এই অবস্থা। রাজনৈতিক দলগুলোরও সেই অর্থে কোনো কমিটমেন্ট নেই। যদি থাকত, তা হলে হাজারীবাগের ট্যানারি সরাতে এত সময় লাগত না। জাহাজ-ভাঙা শিল্পের ব্যাপারে বিধি দিয়েও একে নিয়ন্ত্রণ করতে সময় নষ্ট করা হতো না। পাহাড়ে এত প্রাণহানি হতো না। চারদিকে আবাসন কোম্পানিগুলোর যে অত্যাচার চলছে তা বন্ধ হতো। সত্যিকার অর্থে আমাদের প্রশাসন কোথায় যেন আটকে আছে।
বৃষ্টির পানির ব্যবহার দেশের ভয়াবহ পানি সঙ্কট মোকাবেলায় সহায়ক। বাসা-বাড়ি পর্যায়ে বৃষ্টির পানির নিরবচ্ছিন্ন সরবরাহ নিশ্চিতকরণ, ভূগর্ভস্থ পানি রিচার্জসহ আনুষঙ্গিক প্রয়োজনে বৃষ্টির পানি সংরক্ষণ এখন সময়ের দাবি। সময়ের আলোচিত এ অনুষঙ্গটি নিয়ে বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের (বুয়েট) পুরকৌশল বিভাগের অধ্যাপক ড. মফিজুর রহমানের সাথে আলাপচারিতার পর লিখেছেন মেহেদী হাসান
প্রকাশকাল: বন্ধন ২৮ তম সংখ্যা, আগস্ট ২০১২