নগরায়ণের এই যুগে আবাসনশিল্পের ঘটেছে ব্যাপক উন্নয়ন; গড়ে উঠছে অসংখ্য বহুতল ভবন। মজবুত ভবন নির্মাণের জন্য মাটির বেশ গভীরে স্থাপন করতে হয় ফাউন্ডেশন। সে কারণেই করা হয় মাটি খনন। ফলে আশপাশের ভবন হয়ে পড়ে ঝুঁকিপূর্ণ। আবার অনেক পুরোনো স্থাপনা রয়েছে, যেগুলো সময়ের ব্যবধানে হয়ে উঠেছে ঝুঁকিপূর্ণ! যা যেকোনো সময়ই ভেঙে পড়তে পারে। নিরাপত্তার স্বার্থে প্রয়োজন তা ভেঙে নতুন ভবন করা অথবা রেট্রোফিটিংয়ের মাধ্যমে স্থায়িত্ব বাড়ানো। কিন্তু তাৎক্ষণিকভাবে যদি তা করা না যায় তাহলে সাময়িকভাবে ঝুঁকিপূর্ণ কাঠামোকে অস্থায়ীভাবে সাপোর্ট দেওয়া গেলে রক্ষা করা সম্ভব স্থাপনাটি; রোধ করা যাবে জীবনহানি ও এর পার্শ্বস্থ অন্যান্য স্থাপনা। সে লক্ষ্যেই সাময়িকভাবে বিপদগ্রস্ত কাঠামোকে সাপোর্ট দেবার জন্য যে অস্থায়ী কাঠামো নির্মাণ করা হয়, তাকেই শোরিং বলে। অন্য কথায় কোনো কাঠামোর বুনিয়াদের বা ভিত্তির মাটি কাটার সময় নিকটবর্তী কাঠামো ধসে যাওয়ার আশঙ্কাকে প্রতিরোধ করার জন্য অথবা নিকটবর্তী কোনো কাঠামো অপসারণের সময় অথবা কোনো ত্রুটিপূর্ণ বুনিয়াদের মেরামতের সময় কাঠামোকে নিরাপদে রাখার জন্য অস্থায়ীভাবে যে কাঠামো নির্মাণ করা হয়, তাকে শোরিং বলে। এর ব্যবহার বর্তমানে অনেক ক্ষেত্রে (যেমন : বেজমেন্টের ফাউন্ডেশন খননের জন্য) স্থায়ীভাবে আরসিসি শোর পাইল শোরিংয়ের কাজে দিন দিন বাড়ছে।
শোরিংয়ের ব্যবহার
নিম্নোক্ত অবস্থায় বা উদ্দেশ্যে শোরিং ব্যবহার করা হয়-
- সাধারণত বেইজমেন্টের ফাউন্ডেশনের খননের আগে পার্শ্ববর্তী কাঠামোর নিরাপত্তার প্রয়োজনে
- ত্রুটিপূর্ণ গাঁথুনি বা দুর্বল ভিত্তির জন্য কোনো কারণে দেয়ালের বাইরের দিকে স্ফীত হেলে পড়ার আশঙ্কা থাকলে
- ভিত্তির অসম বসনের জন্য দেয়ালে ফাটল দেখা দিলে এবং ফাটল মেরামতের প্রয়োজন হলে
- পার্শ্ববর্তী কাঠামো অপসারণের প্রয়োজন হলে
- দেয়ালের মধ্যে ফোকর নির্মাণ বা ফোকর বৃদ্ধির প্রয়োজন হলে ইত্যাদি।

শোরিংয়ের প্রকারভেদ
- হেলানো শোর (Raking or Inclined Shores)
- আনুভূমিক শোর (Flying or Horizontal Shores)
- উলম্ব শোর (Dead or Vertical Shores)
হেলানো শোর
কাঠামোর যে অংশ ভেঙে পড়ার আশঙ্কা দেখা দেয়, তা প্রতিরোধ করার জন্য তীর্যকভাবে কাঠের বা স্টিলের যে ঠেস দেওয়া হয়, তাকে হেলানো শোর বলে।
হেলানো শোর উপাংশসমূহ। যথা-
- রেকার (Raker)
- ওয়াল প্লেট (Wall Plate)
- নিডল (Needle)
- ক্লিট (Cleat)
- ব্রেসিং (Bracing)
- সোল প্লেট (Sole Plate)
এই শোরের তীর্যক অংশকে রেকার বলে। এর এক প্রান্ত মাটি এবং অন্য প্রান্ত যে দালানকে রক্ষা করতে হবে তার সঙ্গে আটকাতে হয়। দেয়ালের সঙ্গে ওয়াল প্লেট দিয়ে নিডল দ্বারা রেকারে আটকানো হয়। নিডলের ওপরে ক্লিট ব্যবহার করতে হয়। যেন ওয়ালপ্লেট দেয়াল থেকে সরে যেতে না পারে। বহুতলবিশিষ্ট দালানের ক্ষেত্রে প্রতি তলায় একটি করে রেকারের দরকার হয়। ওপরের রেকারকে রাইজার শোর বলে। রেকারগুলোকে একসঙ্গে আয়রন হুপ দ্বারা বাঁধা হয় এবং শোর প্লেটের ওপর বসানো হয়। যাতে মাটিতে বসে যেতে না পারে। ওপরের প্রতিটি রেকারকে ব্রেইস দ্বারা আটকানো হয়।

হেলানো বা রেকিং শোর নির্মাণে লক্ষণীয় বিষয়সমূহ
- রেকারগুলোকে সাধারণত ৪৫-৭৫০ কোণে বসানো প্রয়োজন।
- উঁচু দালানের ক্ষেত্রে রাইডার রেকার ব্যবহার করে রেকারের দৈর্ঘ্য কমানো যেতে পারে।
- রেকারগুলোকে কিছু দূর পরপর ব্রেইস দ্বারা আটকানো হয়।
- ওয়ালের পার্শ্বচাপের পরিমাণের ওপর নির্ভর করে রেকারের আকার নির্ধারণ করতে হয়।
- রেকার এবং ওয়ালের সেন্টার লাইন, ফ্লোর লেভেলে মেলাতে হবে।
- উঁচু ওয়ালের ক্ষেত্রে ওয়ালের দৈর্ঘ্য বরাবর ৩ থেকে ৪.৫ মিটার পরপর শোরিং করতে হয়।
- সমস্ত রেকার প্রান্ত এবং বহিঃস্থ প্রান্তে ক্লিট বসানোর জন্য প্রয়োজনীয় স্থানের ওপর সোল প্লেটের আকার নির্ভর করে।প্লেট মাটির অভ্যন্তরে হেলানোভাবে বসানো হয়।
- সোল প্লেটের ওপর ওয়েজ ব্যবহার করা যাবে না।
ফ্লাইং বা আনুভূমিক শোর
যখন কোনো দালানের বুনিয়াদে ত্রুটি দেখা দেয় কিংবা বুনিয়াদকে শক্ত করার প্রয়োজন দেখা দেয়, তখন ওই দালানের বুনিয়াদের জন্য মাটি খননের ফলে পার্শ্ববর্তী দালানগুলো বসে যেতে পারে। এ রকম বসে যাওয়া প্রতিরোধের জন্য ফ্লাইং শোর ব্যবহার করা হয়। ওয়ালপ্লেট, নিডল, ক্লিট, আনুভূমিক শোর পিছ এবং ফোল্ডিং ওয়েজ সমন্বয়ে ফ্লাইং শোর গঠিত। প্রথমে ওয়ালপ্লেটকে নিডল দিয়ে দেয়ালে আটকানো হয়। তারপর ওয়ালপ্লেটের মাঝামাঝি আড়াআড়ি আনুভূমিক বিম ব্যবহার করা হয়। স্ট্রিটগুলো আনুভূমিক বিম এবং ওয়ালপ্লেটের সঙ্গে আটকাতে হয়। স্ট্রেইনিং পিছকে ওয়েজ দ্বারা বিমের ওপর বসাতে হয়, যেন স্ট্রিটগুলো সরে যেতে না পারে।
ফ্লাইং শোর নির্মাণে যা যা লক্ষণীয়
- দুটি ভবনের ফ্লোর লেভেলে ফ্লাই শোর এবং স্ট্রিটের সেন্টার লাইনগুলো মিলিত হবে। ভবনদ্বয়ের ফ্লোর লেভেল আলাদা হলে আনুভূমিক শোরটি সমান শক্তিসম্পন্ন দুটি ফ্লোরের মধ্য বরাবর অথবা দুর্বল মেঝে বরাবর বসাতে হবে।
- স্ট্রিটগুলো ৪৫০ কোণে বসাতে হবে এবং কোনো অবস্থাতেই ৬০০ কোণের বেশি হবে না।
- দুটি ওয়ালের মধ্যবর্তী দূরত্ব ৯ মিটার পর্যন্ত হলে সিঙ্গেল শোর এবং বেশি হলে ডাবল শোর ব্যবহার করা যেতে পারে।
- ৩-৪.৫ মিটার পরপর ফ্লাই শোর বসাতে হবে। দুই শোরের মধ্যবর্তী আনুভূমিক ব্রেইস প্রদান করতে হবে।
- শোরিংয়ের বিভিন্ন মেম্বারের আকার নির্ধারণে নিরাপদ সহগের মান বেশি ধরতে হবে। কারণ প্রকৃত লোড নির্ধারণ করা ১০০% সম্ভব নয়।
- পুরোনো ভবন অপসারণের জন্য ব্যবহৃত ফ্লাইং শোর নতুন ভবন না হওয়া পর্যন্ত রাখতে হয়।
ভার্টিক্যাল বা ডেড শোর
যখন কোনো দালানের বুনিয়াদে ত্রুটি দেখা দেয় অথবা বুনিয়াদকে শক্ত করার প্রয়োজন হয় অথবা দেয়ালে কোনো দরজা-জানালা বা কোনো ওপেনিং করার প্রয়োজন হয়, তখন ডেড শোর ব্যবহার করা হয়। ডেড শোর (ভার্টিক্যাল মেম্বার) এবং নিডল (আনুভূমিক মেম্বার) সমন্বয়ে এ শোর গঠিত। নিডল ওয়ালের নোডকে ডেড শোরে স্থানান্তর করে। ভার্টিক্যাল বা ডেড শো যে কারনে ব্যবহৃত হয়-
- দেয়ালের ত্রুটিমুক্ত নিম্ন অংশকে পুনর্নির্মাণের জন্য
- বর্তমান ভিত্তিকে আরও গভীরে বসানোর জন্য অথবা পুনর্নির্মাণের জন্য
- বর্তমান দেয়ালের নিম্ন প্রান্তে বৃহদাকার ফোকর নির্মাণ করার জন্য। দরজা-জানালা বা কোনো ওপেনিং দিয়ে কাঠ বা স্টিলের নিডল প্রবেশ করাতে হবে। নিডলের দুই প্রান্তে খাড়া পোস্ট দ্বারা সাপোর্ট প্রদান করতে হবে। খাড়া পোস্ট বা ডেড শোরগুলো দেয়াল থেকে একটু দূরে বসাতে হবে, যাতে মেরামত কাজ বাধাপ্রাপ্ত না হয়। সোল প্লেট ও ফোল্ডিং ওজে ডেড শোলের নিচে ব্যবহার করতে হবে।
ভার্টিক্যাল বা ডেড শোর নির্মাণে লক্ষণীয় বিবেচ্য
- ডেড শোর এবং প্রস্থচ্ছেদী আকার লোড স্থানান্তরের জন্য পর্যাপ্ত হতে হবে
- ১-২ মিটার পরপর নিডলগুলো স্থাপন করতে হবে। প্রতি ফোকরের জন্য কমপক্ষে তিনটি নিডল ব্যবহার করতে হবে
- নিডলগুলোতে ব্রেসিং সংযোজন করতে হবে
- বহিঃস্থ দেয়ালের ফোকর করতে হলে বহিঃস্থ ডেড শোরটি অন্তঃস্থ ডেড শোর অপেক্ষা বড় করতে হবে
- সোল প্লেটের ওপর ডেড শোরগুলো স্থাপন করতে হবে। ডেড শোর এবং সোল প্লেটের মধ্যে ফোল্ডিং ওয়েজ লাগাতে হবে
- অন্তঃস্থ পার্শ্ব থেকে ফ্লোরকে প্রয়োজনীয় সাপোর্ট দিতে হবে
- বহিঃস্থ দেয়াল দুর্বল হলে ডেড শোর ছাড়াও রেকিং শোর ব্যবহার করতে হবে
- নতুন কাজ পর্যাপ্ত শক্তিসম্পন্ন না হলে শোরগুলো অপসারণ করা উচিত নয়। তবে কোনো অবস্থাতেই সাত দিনের আগে অপসারণ করা যাবে না
- ভার্টিক্যাল শোর অপসারণের জন্য দুই দিন পরপর অলটারনেটভাবে নিডল, স্ট্রেটিং, অন্তঃফ্লোর স্ট্রেটিং এবং রেকিং অপসারণ করা উচিত।
শোর ব্যবহারের সুবিধা ও অসুবিধাসমূহ
রেকিং বা হেলানো শোর
সুবিধা
- বহুতলাবিশিষ্ট দালানের ক্ষেত্রে এই শোর সুবিধাজনক।
- ফোল্ডিং ওয়েজ ব্যবহার করে রাইডার রেকারের দৈর্ঘ্য হ্রাস করা যায়।
- প্রতি তলায় রেকার ব্যবহার করার কারণে টপ রেকারের হেলানো কোনো সীমার মধ্যে অর্থাৎ ৭০০-এর মধ্যে থাকে।
- মেইন রোডের সন্নিকটে অবস্থিত বহুতলাবিশিষ্ট দালানে এই শোর সহজে ব্যবহার করা যায়।

অসুবিধা
- দালানের বা কাঠামোর পাশে অধিক জায়গার প্রয়োজন।
- এই শোরিং দক্ষ মিস্ত্রিও বা কার্পেন্টার দ্বারা করতে হয়।
আনুভূমিক বা ফ্লাইং শোর
সুবিধা
- বুনিয়াদের ত্রুটি দেখা দিলে বা বুনিয়াদ শক্ত করার প্রয়োজন হলে এই শোর সুবিধাজনক।
- ত্রুটিপূর্ণ কাঠামোর পাশের কাঠামোগুলোকে মুক্ত রাখে।
অসুবিধা
- প্রকৃত লোড নির্ধারণ করা দুঃসাধ্য বিধায় বিভিন্ন মেম্বারের আকার অনেক বেশি ধরতে হয়।
- পুরোনো ভবন অপসারণের জন্য ফ্লাইং শোরকে নতুন ভবন না হওয়া পর্যন্ত রাখতে হয়।
উলম্ব বা ডেড শোর
সুবিধা
- বুনিয়াদে ত্রুটি দেখা দিলে অথবা বুনিয়াদকে শক্ত করার প্রয়োজন হলে এই শোর সুবিধাজনক।
- পুরোনো দেয়ালে দরজা বা জানালা অথবা যেকোনো ওপেনিং করার প্রয়োজন হলে এটি দারুন কার্যকর।
অসুবিধা
নতুন কাজ পর্যাপ্ত শক্তি অর্জন না করা পর্যন্ত শোরগুলো রাখতে হয়।
প্রয়োজনীয় নিরাপত্তাব্যবস্থা

শোরিং কাজ চলাকালে নিম্নবর্নিত নিরাপত্তাব্যবস্থা নেওয়া উচিত-
- যে দালানে শোরিংয়ের কাজ করতে হবে, সেই দালানের লোকজন এবং আসবাবপত্র অন্যত্র সরিয়ে নিতে হবে।
- দালানটি শোরিংয়ের জন্য উপযুক্ত কি না এবং তা নির্মাণকালে পার্শ্ববর্তী কাঠামোর ওপর কোনো প্রভাব পড়বে কি না তা যাচাই করে দেখতে হবে।
- আগত লোডের সঠিক হিসাব করা সম্ভব নয় বলে সর্বদা বেশি মাত্রায় সেফটি নিতে হবে।
- কাঠামোর চারদিকে সতর্কতা সাইনবোর্ড অথবা ফ্লাগ মার্কের মাধ্যমে জনসাধারণকে সচেতন এবং বিপদমুক্ত নির্দিষ্ট দূরত্বে রাখতে হবে।
- ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের তথা সংশ্লিষ্ট প্রকৌশলী বা বিশেষজ্ঞের সঙ্গে পরামর্শক্রমে কাজ শুরু করতে হবে।
- কাজ শুরুর আগে অবশ্যই সেফটি নেট দিয়ে নির্মাণ এলাকা ঘিরে নিতে হবে।
- শোরিংয়ের কাজ বিল্ডিংয়ের ওপরের দিক থেকে শুরু করতে হবে।
- পর্যাপ্ত পরিমাণে দক্ষ জনবল নিয়োগ করতে হবে এবং নিরাপত্তা সরঞ্জাম ব্যবহার করতে হবে।
- জনসচেতনতা সৃষ্টির জন্য প্রজেক্টে মাইকিংয়ের ব্যবস্থা রাখতে হবে।
- কাজ চলাকালীন বিপদ সম্পর্কে আঘাতজনিত ক্ষয়ক্ষতি সম্পর্কে এবং দায়িত্ব ও কর্তব্য সম্পর্কে শ্রমিকদের আগেই নিরাপত্তা প্রশিক্ষণ দিতে হবে।
- ফাস্ট এইড বক্স থাকতে হবে এবং যেকোনো দুর্ঘটনার জন্য প্রস্তুত থাকতে হবে। ইনজুরি মারাত্মক হলে দুর্ঘটনাকবলিত ব্যক্তিকে নিকটস্থ হাসপাতালে বা নিকটবর্তী ক্লিনিকে স্থানান্তর করতে হবে।
প্রকৌশলী সুবীর কুমার সাহা
প্রকাশকাল: বন্ধন ৪১ তম সংখ্যা, সেপ্টেম্বর ২০১৩