জৈব কংক্রিট ভবনে প্রাণের নতুন সঞ্চার

বিবর্তন শব্দটি আমাদের দৈনন্দিন জীবনের সঙ্গে ওতপ্রোতভাবে জড়িত। মানবসমাজের কাজকর্মে ও চিন্তাধারায়ও প্রতিনিয়ত পরিবর্তন লক্ষণীয়। আর এই বিবর্তনের ধারায় পূর্ণতা পায় তাদের চিরায়ত শৌখিনতা। আগের দিনে মানুষ শুধু মাথার ওপর একটা ছাদ তৈরি করেই সন্তুষ্ট থাকত, কিন্তু এখন চাই তার সৌন্দর্যবর্ধন, সেই সঙ্গে বিকশিত হয় তাদের চিন্তাধারা। যার ফলে উদ্ভব হয় নতুন নতুন সব বিস্ময়ের। ভবিষ্যতের কাঠামোর নকশা কেমন হবে তা আমাদের সৃজনশীলতার ওপর নির্ভর করে, আর এদের নির্মাণকৌশল ও ক্ষমতাও এর সঙ্গে জড়িত। প্রচলিত প্রথা থেকে সরে এসে কাঠামোর স্থায়িত্ব, নকশা তৈরির একটি অপরিহার্য অংশে পরিণত হয়েছে। নকশা তৈরিতে কাঠামোর স্থায়িত্ব উল্লেখযোগ্য ভূমিকা পালন করে।

আমাদের কি কখনো মনে হয়েছে, যে বাড়ির মধ্যে আমরা আছি তার চারপাশের দেয়াল জীবন্ত হতে পারে এবং শ্বাস-প্রশ্বাস নিতে পারে, এমনকি প্রতিনিয়ত পরিবর্তিত হতেও পারে? একটি নতুন ধরনের জৈব কংক্রিট তৈরি করা হয়েছে, যার পৃষ্ঠতল এমনভাবে তৈরি, যাতে এর ওপর রঞ্জক প্রাণী যেমন ক্ষুদ্র শ্যাওলা, শৈবাল, ছত্রাক, মস ইত্যাদি খুব সহজে জন্মাতে ও বাড়তে পারে। বার্সেলোনার ইউনিভার্সিট্যাট পলিটেকনিকা ডি ক্যাটালুনিয়া (Universitat Politècnica de Catalunya)-এর অ্যান্টোনিও আগুয়াডো (Antonio Aguado)-এর নেতৃত্বে একদল গবেষক এই নতুন একাধিক স্তরবিশিষ্ট কংক্রিট উদ্ভাবন করেছেন, যার পৃষ্ঠে উদ্ভিদ জন্মাতে ও বাড়তে পারে। উদ্ভিদ উৎপাদনের  মাধ্যম ও কাঠামোর নির্মাণ উপাদান ছাড়াও এই সিস্টেম পরিবেশে কার্বন ডাই-অক্সাইড (CO2)-এর মাত্রা কমাতে সাহায্য করে। সরাসরি বাতাসের গুণমান বৃদ্ধির পাশাপাশি উৎপন্ন গাছ তাপ সুরক্ষা এবং অন্তরণ প্রদান করে শক্তি খরচ কমাতে সহায়তা করে। ভবনের দেয়ালে উৎপন্ন প্রাণীর সৌর বিকিরণ শোষণ ক্ষমতা এবং এই কংক্রিট তাপকে ভবনে ঢুকতে বা বেরোতে দেয় না বলে ভবন এর ভেতরে তাপ পরিবাহিত স্বাভাবিক থাকে ও বসবাস আরামপ্রদ হয়।

উলম্ব বাগান

গবেষণায় জৈব কংক্রিট

নতুন আবিষ্কৃত এই জৈব স্তর, যার ওপর উদ্ভিদ বিস্তার লাভ করে তা আসলে কংক্রিট। এতে একপ্রকার সিমেন্ট স্তর আছে, যা উদ্ভিদ বিস্তারে সহায়ক বিশেষ করে মস ও শ্যাওলা-জাতীয় উদ্ভিদ। সাধারণত, কংক্রিটের পিএইচ (pH) অনেক বেশি থাকে। আদর্শ অবস্থায় কংক্রিটের পি.এইচ ৯-এর চেয়ে কম থাকে। কিন্তু প্রচলিত পোর্টল্যান্ড সিমেন্টের পি.এইচ ১২ বা ১৩, যা গ্রহণযোগ্য পর্যায়ে আনতে কিছু বিশেষ পদক্ষেপ গ্রহণ করা প্রয়োজন। গবেষকদের মতে, এটা উদ্ভিদের জন্য মোটেও আদর্শ অবস্থা নয়। ইউপিসি (UPC: Universitat Politècnica de Catalunya)-এর কাঠামোগত প্রযুক্তি বিভাগ এক প্রকার কংক্রিট উন্নয়ন ও পেটেন্ট করেছেন, যাতে এর পৃষ্ঠতলে স্বাভাবিক ও দ্রুত রঞ্জক প্রাণীরা বিস্তার লাভ করতে পারে। নতুন এই কংক্রিট দ্বারা তৈরি ভবন, অন্যান্য ভবন হতে বিশেষ করে ভূমধ্য জলবায়ু অঞ্চলে পরিবেশগত, তাপগত ও নান্দনিক সুবিধা দিয়ে থাকে।

এই জাতীয় কংক্রিট নিয়ে গবেষণাকালে গবেষকেরা দুই ধরনের সিমেন্টভিত্তিক উপাদানের ওপর গুরুত্বারোপ করেছেন। প্রথমটি হলো, প্রচলিত কার্বোনেটেড কংক্রিট (পোর্টল্যান্ড সিমেন্টভিত্তিক), এটি এমন এক উপাদান, যা পি.এইচ ৮-এর কাছাকাছি অর্জনে সক্ষম। দ্বিতীয় উপাদানটি তৈরি করা হয় ম্যাগনেসিয়াম ফসফেট সিমেন্ট (Magnesium Phosphate Cement, MPC), একটি জলবাহী পিণ্ডীভূত উপাদান, যা কিঞ্চিৎ অম্লীয় slightly acidic) ফলে পি.এইচ কমাতে অতিরিক্ত কোনো ব্যবস্থা গ্রহণের প্রয়োজন পড়ে না। মস অনেক কম পি.এইচ যেমন ৫-এও বেঁচে থাকতে পারে। কিন্তু বেশির ভাগ উদ্ভিদ এত কম পি.এইচে টিকতে পারে না, যা প্রতিদ্বন্দিতাকে অনেকাংশে কমিয়ে দেয় এবং সঙ্গে মসের উপনিবেশ স্থাপন নিশ্চিত করে। এই পন্থা গবেষকদের মনে নতুন ধারণার উদ্ভব ঘটায় এবং তাঁরা পরিবর্তনশীল পি.এইচযুক্ত কংক্রিট তৈরিতে উজ্জীবিত হন, যা বহুবিধ মস, ছত্রাক, শৈবালের বৃদ্ধি নিশ্চিত করতে সক্ষম।

দ্রুত সেটিং (Setting) বৈশিষ্ট্যের ওপর ভিত্তি করে ম্যাগনেসিয়াম ফসফেট সিমেন্ট মেরামতের উপাদান হিসেবে অতীতে ব্যবহার করা হতো। এটি জৈব সিমেন্ট হিসেবে চিকিৎসাবিজ্ঞানে ও দন্ত চিকিৎসায় ব্যবহৃত হতো, যা বলে দেয় এর কোনো পরিবেশগত বিরূপ প্রতিক্রিয়া নেই।

এই গবেষণার মুখ্য উদ্দেশ্য হচ্ছে ক্ষুদ্র প্রাণীর (microorganism) স্বাভাবিক উপনিবেশ স্থাপন প্রক্রিয়া ত্বরান্বিত করা, যাতে ভবনের পৃষ্ঠদেশ এক বছরের মধ্যে আকর্ষণীয় রূপ লাভ করে। এ ছাড়া আরেকটি লক্ষ্য হলো এই আকর্ষণীয় আবরণ, যাতে সময়ের সঙ্গে পরিবর্তিত হয় এবং বছরের বিভিন্ন সময়ে বিভিন্ন রং ও রূপে ভবনকে সাজিয়ে তোলে। এই জাতীয় উপাদান অন্যান্য ধরনের ক্ষতিকারক উদ্ভিদের আবির্ভাব বা অন্তত তাদের মূল হতে স্থাপত্যকে রক্ষা করে।

একটি জৈব কংক্রিটের পৃষ্ঠদেশ

তিন স্তরবিশিষ্ট উপাদান

জৈব কংক্রিট অর্জনের লক্ষ্যে পি.এইচ বাদে অন্যান্য বিষয়, যা এর জৈব ধারণক্ষমতাকে প্রভাবিত করে যেমন ভেদনক্ষমতা ও পৃষ্ঠ বন্ধুরতা, পরিবর্তন করা হয়। প্রাপ্ত ফলাফল হচ্ছে একটি প্যানেল আকারের একাধিক স্তরবিশিষ্ট উপাদান, যাতে একটি স্ট্রাকচারাল স্তর ছাড়াও তিনটি অতিরিক্ত স্তর রয়েছে: প্রথম হচ্ছে একটি পানিরোধী স্তর, যা স্ট্রাকচারাল স্তরের ঠিক ওপরে অবস্থিত এবং পানির অনুপ্রবেশ জাতীয় ক্ষয় হতে কাঠামোকে রক্ষা করে।

দ্বিতীয় স্তর হচ্ছে একটি জৈব স্তর, যা উপনিবেশ স্থাপনেও পানি ধরে রাখতে সহায়তা করে। এটি অভ্যন্তরীণ ক্ষুদ্র কাঠামো হিসেবে কাজ করে, যা আর্দ্রতা ধরে রাখতে ও বের করে দিতে সহায়তা করে। যেহেতু এর আর্দ্রতা ধরে রাখার ক্ষমতা আছে, তাই এটি জৈব প্রাণীর বিস্তারে বিশেষ ভূমিকা রাখে।

শেষ স্তর হলো বিচ্ছিন্ন প্রলেপ দেওয়া স্তর, যা বিপরীত পানিরোধকের কাজ করে। অর্থাৎ এই স্তর পানি প্রবেশ নিশ্চিত ও বের হয়ে যাওয়া রোধ করে, যা জৈব বৃদ্ধিতে সহায়তা করে।

কার্বন ডাই-অক্সাইড হ্রাসকরণ

জৈব কংক্রিট কাঠামো তৈরির এটি নতুন উপাদান, যার আছে নানাবিধ প্রয়োগ। এটির আবার পরিবেশগত, তাপগত ও নান্দনিক উপকারিতাও আছে। পরিবেশগত দিক থেকে চিন্তা করলে খুব সহজেই উপলব্ধি করা যায় যে এই জৈব আবরণ বাতাসের কার্বন ডাই-অক্সাইড শোষণ ও এর পরিমাণ হ্রাস করে এবং অক্সিজেন বৃদ্ধি করে। একই সঙ্গে এর সৌর বিকিরণ শোষণের ক্ষমতা আছে, যা কাঠামোর অভ্যন্তরীণ তাপ পরিবাহিত নিয়ন্ত্রণ করে ও তাপমাত্রা সহনীয় পর্যায়ে রাখে। যার ফলে ঘরের আবহাওয়া থাকে শীতে উষ্ণ ও গ্রীষ্মে শীতল।

স্থাপত্যের সৌন্দর্যবর্ধন ও সংস্কার

জৈব কংক্রিট শুধু তাপের অন্তরক ও নিয়ন্ত্রক হিসেবেই নয় সৌন্দর্যবর্ধক হিসেবেও ব্যবহৃত হয়। কাঠামোকে সাজিয়ে তোলার জন্য জৈব কংক্রিট ব্যবহার করে বৈচিত্র্যময় রঙিন নকশা তৈরি করা সম্ভব। এটি এমনভাবে তৈরি করা হয়েছে, যাতে উপনিবেশ স্থাপনের মাধ্যমে সম্পূর্ণ কাঠামো বা কাঠামোর শুধু একটি নির্দিষ্ট স্থানকে নতুন সাজে সাজানো যায়। এর উদ্দেশ্য হলো একটি সবুজাভ বর্ণের পাতলা জৈব ফিল্মের আচ্ছাদন তৈরি করা, যা জীবন্ত রং হিসেবে কাজ করবে। এর ফলে ভবনের বাহ্যিক সৌন্দর্য বেড়ে যায় বহুগুণ। একে বাগানের মধ্যে অবস্থিত বাড়ির সাজসজ্জায়ও ব্যবহার করা যায়, যা কি না কাঠামোকে সহজেই চারপাশের পরিবেশের সঙ্গে খাপ খাইয়ে নিতে সক্ষম।

স্থাপত্য তৈরিতে এই উপাদান উলম্ব বাগানের নতুন ধারণার উদ্ভব ঘটায়, যা কেবল নতুন কাঠামো তৈরির ক্ষেত্রেই নয়, পুরোনো স্থাপত্য সংস্কারেও উল্লেখযোগ্য ভূমিকা রাখে। বর্তমানে ব্যবহৃত উদ্ভিদের আবরণের সঙ্গে তুলনা করলে এই নতুন উপাদান শুধু কারুকার্যপূর্ণ আবরণই নয়, সঙ্গে সময় সাপেক্ষে পরিবর্তনও এনে দেয়, যার সবই হয় স্থাপত্যের নিজস্ব পৃষ্ঠে; এর জন্য আলাদা কোনো জটিল কাঠামোর দরকার হয় না, একই সঙ্গে স্থাপত্যের নির্দিষ্ট কোনো অংশ চিহ্নিত করে শুধু ওই স্থানে জৈব বিস্তার প্রয়োগ করা সম্ভব।

বর্তমানে গাছের আবরণ দিয়ে সৌন্দর্যবর্ধনের যে পন্থা অবলম্বন করা হয়, তাতে গাছ কোনো পাত্রে রেখে ঝুলিয়ে দেওয়া হয় বা কোনো জটিল কাঠামো গঠন করে তার সহায়তায় আবরণ তৈরি করা হয়, যা হয়তো বা দেখতে অনেক সুন্দর কিন্তু এখানে ব্যবহৃত অতিরিক্ত কাঠামো স্থাপত্যের ওপর একটা অতিরিক্ত ভরের সৃষ্টি করে, যা কোনো কোনো ক্ষেত্রে গ্রহণযোগ্য হয়ে ওঠে না। কিন্তু আধুনিক এই জৈব কংক্রিটের ব্যবহার কোনো অতিরিক্ত ভর প্রয়োগ ছাড়াই দালানকোঠার সৌন্দর্য বাড়িয়ে তোলে বহুগুণ আর সঙ্গে নিজের মনের মতো নকশা তৈরি করাও এখন আর কঠিন কিছু নয়।

সিঁড়ির দেয়ালে জৈব আবরণ

পরিশেষ

যাঁরা বাড়ির বাহ্যিকরূপ নিয়ে চিন্তিত, তাঁদের জন্য জৈব কংক্রিট যেন স্বপ্নপূরণের নতুন এক হাতিয়ার। জৈব কংক্রিট নানা ধরন ও রঙে ব্যবহার করা সম্ভব, এবং এর রং ঋতুভেদে পরিবর্তিত হয়, যা স্থাপত্যকে দেয় এক জাদুকরী পরিবর্তনশীল চেহারা। এই উপাদান শুধু  নতুন কাঠামোর জন্যই নয়, পুরোনো স্থাপত্যের সংস্কারেও বিশেষভাবে ব্যবহার করা যায়। কারণ, এতে লাগে না কোনো জটিল কাঠামোর ব্যবহার। শুধু তা-ই নয়, এটি ভবনের যেকোনো অংশে ব্যবহার করা যায়। আর এর ব্যবহার শুধু সৌন্দর্যবর্ধনেই সীমাবদ্ধ নয়, এটি বাড়ির ভেতরের পরিবেশকে করে তোলে বসবাসের জন্য আরামপ্রদ আর একই সঙ্গে বাহ্যিক পরিবেশকে রক্ষা করে দূষণ থেকে। যদিও এই বিস্ময়কর উপাদানটি এখনো গবেষণা পর্যায়ে রয়েছে। ইতিমধ্যেই এই কংক্রিটের পেটেন্ট করা হয়েছে, ফলে খুব শিগগিরই আমরা আমাদের মধ্যে জীবন্ত বাড়ির অস্তিত্ব আশা করতে পারি।

তথ্যসূত্র : ইন্টারনেট

মো. নূর বাসিত জামান 

লেকচারার, পুরকৌশল বিভাগ

ইউনিভার্সিটি অব ইনফরমেশন টেকনোলজি অ্যান্ড সায়েন্সেস।

প্রকাশকাল: বন্ধন ৪০ তম সংখ্যা, আগস্ট ২০১৩

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Scroll to Top