করোনার লকডাউনের পুরো সময়ে বিশ্ববিদ্যালয়গুলো বন্ধ ছিল দীর্ঘদিন। কিন্তু কত দিনই-বা থেমে থাকবে শিক্ষাব্যবস্থা! তাই যাদের পক্ষে সম্ভব তারা শুরু করল অনলাইনে শিক্ষাদানের ব্যবস্থা। এশিয়া প্যাসিফিক বিশ্ববিদ্যালয় তাদের একটি। তত্ত¡গত পড়াশোনা অনলাইনে করা গেলেও ‘ভার্চুয়াল-স্টুডিও’ কেমন হতে পারে তা তখনো কারোই জানা ছিল না। যদিও আজকের লেখার প্রসঙ্গ সেটি নয় বরং এমনই এক কঠিন সময়ে অসাধারণ একটি থিসিস প্রকল্পের জানান দিতেই এই লেখা। তাবাসসুম সুলতানা সুসমি লকডাউনে নিরাপদে ছিলেন তাঁর জন্মস্থান কুষ্টিয়ায়। সেখানে বাবা, মা ও ছোট ভাইয়ের সঙ্গে সময়টা কাটাচ্ছিলেন তিনি। সবার জানা যে, থিসিস পর্যায়ে এসে একটি সত্যিকারের প্রস্তাবিত প্রকল্প নিয়ে সাধারণত কাজ হয়। একই সঙ্গে যেকোনো স্থাপত্য প্রকল্পের জন্য সাইট একটি গুরুত্বপূর্ণ ব্যাপার। কিন্তু এই মহামারিকালে কীভাবে সাইট ভিজিট করা যাবে? তাই বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ঠিক করা হলো শিক্ষার্থীরা যে যেখানে আছেন, সেখানেরই কোনো বিশেষ জায়গা ধরে বা প্রস্তাবিত প্রকল্প ধরে তাঁরা তাঁদের থিসিসের কাজ করতে পারেন।
শিক্ষার্থী সুসমি তখন ভাবলেন কুষ্টিয়ার ল্যান্ডমার্কগুলো আসলে কী কী? সেখানে আসে জগতি রেলওয়ে স্টেশন, টাগর লজ, মোহিনী মিল, লালন শাহের মাজার, রবীন্দ্রনাথের কুঠিবাড়ি, মীর মশাররফ হোসেন স্মৃতি জাদুঘর এবং কাঙ্গাল হরিনাথের বাড়ি। এই প্রতিটি জায়গা তাঁদের নিজ নিজ গুণে বিশেষ হলেও তা কুষ্টিয়া সদর ছাড়িয়ে কুমারখালীর বিশাল জায়গাজুড়ে অবস্থিত। এগুলো নিয়ে একযোগে কাজ করা নিঃসন্দেহে কঠিন। সুসমি তখন দেখলেন টেগর লজ, রবীন্দ্রনাথের কুঠিবাড়ি, মীর মশাররফ হোসেন স্মৃতি জাদুঘর ও কাঙ্গাল হরিনাথের জায়গাগুলো নিয়ে ইতিমধ্যে সরকারি ব্যবস্থাপনায় স্থাপনা নির্মিত হয়েছে এবং নিয়মিত সেগুলোর দেখভাল করা হচ্ছে। যদিও লালন শাহের মাজার, মোহিনী মিল এবং জগতি রেলওয়ে স্টেশন সরকারের অধীনেই আছে। কিন্তু সুসমির নজর কাড়ল এই তিনটি জায়গা, যেখানে তিনি বোধ করলেন নতুন পরিকল্পনার মধ্য দিয়ে জায়গাগুলোকে উন্নয়নের অনেক সুযোগ আছে। প্রকল্পটিতে একজন শিক্ষার্থীর গবেষণা মনোভাব, তাঁর সংবেদনশীলতা এবং পরিশেষে ডিজাইনে তাঁর চিন্তার প্রতিফলনগুলোকে বোঝাতেই এই লেখা। প্রথমে এই তিনটি সাইটের ঐতিহাসিক গুরুত্বগুলো সংক্ষেপে জানা যাক-
জগতি রেলওয়ে স্টেশন
প্রায় দেড় শ বছরেরও আগে পূর্ব বাংলা রেলওয়ে অথরিটির তরফ থেকে প্রথম রেললাইন নির্মিত হয় বর্তমান পশ্চিমবঙ্গের শিয়ালদহ থেকে এখনকার কুষ্টিয়ার জগতিতে। অর্থাৎ বাংলাদেশের প্রথম রেলওয়ে স্টেশন হলো জগতি। নিঃসন্দেহে ঐতিহাসিকভাবে এই স্টেশনের গুরুত্ব আলাদা করে ব্যাখ্যার প্রয়োজন নেই। এই স্টেশন নির্মাণের ফলে তৎকালীন নদীয়ার সঙ্গে কলকাতার সংযোগ হওয়ায় এই এলাকার অর্থনৈতিক অবস্থার ব্যাপক উন্নতি ঘটতে থাকে।

মোহিনী মিল
রেলস্টেশন গড়ে ওঠার মধ্য দিয়ে কুষ্টিয়ায় শিল্পকারখানা গড়ে ওঠার বিষয়টিও তখন স্বাভাবিক ঘটনা হয়ে দাঁড়ায়। এবং নির্মিত হয় নানা ধরনের কলকারখানা, মোহিনী মিল এর মাঝে অন্যতম। গোটা বাংলায় তখন কেবল ১৩টি মিল ছিল, যার বেশির ভাগই সরকারের অধীনে কিন্তু ব্যক্তি উদ্যোগে এখানে নির্মিত হয় মোহিনী মিল। সচল অবস্থায় মোহিনী মিল সমগ্র এশিয়ার সর্ববৃহৎ কাপড়ের কলের স্বীকৃতিপ্রাপ্ত মিল। কুষ্টিয়ার অন্যতম বিখ্যাত ব্যক্তিত্ত¡ মোহিনী মোহন চক্রবর্তী ১৯০৮ সালে কুষ্টিয়া মোহিনী মিলস অ্যান্ড কোম্পানি লিমিটেড নামে এই কাপড়ের মিলটি প্রতিষ্ঠা করেন। সমসাময়িককালে অন্যান্য কাপড়ের মিলের তুলনায় এই মিলের উৎপাদিত পণ্য অনেক বেশি মানসম্পন্ন ছিল বলে কালক্রমে এটি দেশের অন্যতম সেরা কাপড়ের মিলে পরিণত হয়। মাত্র ৮টি তাঁত নিয়ে মিলটি উৎপাদন শুরু করে। পরবর্তীকালে মোহিনী মিল ব্যাপ্তি লাভ করে। এর শ্রমিক সংখ্যা প্রায় তিন হাজারে উন্নীত হয়। মোহিনী মিলের শাড়ি ও ধুতি বাংলায় জনপ্রিয়তা লাভ করে। টেক্সটাইল এই মিলটি ‘স্পিনিং’ এবং ‘উইভিং’-এর জন্য বিখ্যাত। মোহিনী মিলের মালিক মোহিনী বাবুর ব্যবসার পাশাপাশি সাংস্কৃতিক বোধ ছিল চাঙা। তিনি কেবল কলকারখানা নির্মাণে ক্ষান্ত ছিলেন না বরং কুষ্টিয়ার একমাত্র থিয়েটারও তাঁরই নির্মিত। সেখানে সারা বছর ধরে চলত নানা আয়োজন এবং বাৎসরিক একটি বিশাল আয়োজন হতো, যেখানে বাংলার নানা জায়গা থেকে স্বনামধন্য শিল্পীরা আসতেন নিজেদের দক্ষতা ও শিল্পমনকে তুলে ধরতে।
লালন শাহের মাজার
লালন শাহের মাজারের পাশেই রয়েছে কালীগঙ্গা নদী। এই নদীতে করেই ভেসে এসেছিলেন লালন শাহ এমনই কথা প্রচলিত আছে। এবং এই নদীর কিনারেই তাঁর আধ্যাত্মিক সাধনার আখড়া জমে। এখানে মীর মশাররফ হোসেন এবং কাঙ্গাল হরিনাথও আসতেন বলে জানা যায়। শোনা যায় রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের সঙ্গে লালন শাহের সাক্ষাৎও হয়েছিল। লালন শাহ দেহ রাখার পর মোহিনী মিলের কমিটির সদস্যরা জায়গাটি রক্ষণাবেক্ষণের দায়িত্ব নেন এবং বাৎসরিক উৎসবগুলো মোহিনী মিলের স্কুল আঙিনায় পালনের সুযোগও করে দেন।
পরিকল্পনা ও ডিজাইন-ভাবনা
স্থপতি সুসমি ডিজাইনের সুবিধার জন্য চারটি জোন বা অঞ্চলে প্রকল্পটিকে ভাগ করে নেন। সেগুলো হচ্ছে-
- জোন এ- জগতি রেলওয়ে স্টেশন
- জোন বি- মোহিনী মিল
- জোন সি- মোহিনী মিল ও
- জোন ডি- লালন শাহের মাজার।
এবার এই তিন সাইটের মানোয়ন্ননের সম্ভাবনাগুলো জানা যাক-
জগতি রেলওয়ে স্টেশন: বাংলাদেশের প্রথম স্টেশন হিসেবে জগতি স্টেশনের গুরুত্ব শীর্ষে। এই স্টেশনে এখনো দুবেলা ট্রেন আসে। তবে এর ভবন বহু পুরোনো এবং ভগ্ন দশায় আছে। এই জায়গাটিকে ঘিরে একটি জাদুঘর করার প্রস্তাব রাখেন সুসমি, যাতে এই জায়গাটি পর্যটকদের জন্য আকর্ষণীয় একটা তথ্যবহুল স্থানে পরিণত হতে পারে। পাশাপাশি মূল ভবনটি সংরক্ষণের প্রস্তাবও রাখা হয়।
মোহিনী মিল: বর্তমানে যেন বেদখল না হয়ে যায়, তাই এই জায়গাটিকে দেখে রাখার জন্য একজন প্রশাসনিক কর্মকর্তা এবং ৭-৮ জন গার্ড আছেন। তবে কুষ্টিয়া শহরের নগর পরিকল্পনা অনুযায়ী এই এলাকাটি আবাসিক এলাকায় মধ্যে পড়ায় এই জায়গাটিকে আর মিল হিসেবে নতুন করে ব্যবহার করা যাবে না। উইভিং অ্যান্ড স্পিনিংয়ের জন্য দুটি বড় বিভাগ মিলের প্রায় চল্লিশ শতাংশ জায়গা নিয়ে নিয়েছে। স্থপতি সুসমি জায়গাটিকে সংরক্ষণের পাশাপাশি একটি সাংস্কৃতিক প্রাঙ্গণ হিসেবে সচল করার প্রস্তাব রাখেন।

লালন শাহের মাজার: লালন শাহের মাজারটি ১৯৬৩ সালে কাঠামোগতভাবে নির্মিত হয়। তখন পাকিস্তান সরকার লালনকে পীর-আউলিয়া ঘরানার ভেবে দিল্লির বিখ্যাত সুফি নিজাম উদ্দিন আউলিয়ার মাজারের অনুরূপ ছোট আকারের মাজার কাঠামোটি এখানে স্থাপন করেন। ফলে লালনের ভাবধারা থেকে এই স্থাপনা নির্মিত হয়নি তা হলফ করে বলা যায়। পরবর্তী সময়ে বাংলাদেশ সরকার মাজার প্রাঙ্গণে লালন একাডেমি ভবন নির্মাণ করে এবং উৎসবে বেশি মানুষের জায়গার জোগান দিতে কালীগঙ্গা নদীর একটা বিরাট অংশ ভরাট করা হয়। স্থপতি সুসমি তাঁর গবেষণা এবং দীর্ঘকাল কুষ্টিয়ায় থেকে বুঝেছেন যে লালনের ভাবধারা বিচ্যুত মাজার কাঠামোর এই বিষয়টি নিয়ে কাজ করার সুযোগ আছে এবং যে নদীতে ভেসে লালন এসেছিলেন বলে কথিত আছে, সেই নদীকে মর্যাদা দিয়ে তার যেটুকু অংশ ভরাট করা হয়েছে, আবার সেটুকু উন্মুক্ত করে দেওয়া উচিত বলেই তিনি ভেবেছেন। এমন দুটি সাহসী সিদ্ধান্ত সুসমি নিতে পেরেছেন তাঁর গবেষণার বলে, তা বিশেষভাবে উল্লেখ করার দাবি রাখে। বাউল স¤প্রদায় যেন মাজারের মূল প্রাঙ্গণে থাকতে পারেন, সেই ব্যবস্থা নিশ্চিত করতে লালন একডেমি ও মেলার স্থানান্তরের ব্যাপারটিও সুসমি ভেবেছেন। ভাবের আন্দোলনে যুক্ত মানুষের আখড়া হোক এই প্রাঙ্গণ এটিই তাঁর ডিজাইনের উদ্দেশ্য।
ডিজাইন সিদ্ধান্তগুলো যেমন হবে
জগতি রেলওয়ে স্টেশন: যেহেতু স্টেশনের ভবনটা বেশ পুরোনো এবং এখনো স্টেশন হিসেবে সচল তাই গোটা ভবনটিকেই মিউজিয়ামের একটা উপাদান হিসেবে ভাবেন স্থপতি। ডিজাইনের থ্রি-ডি ছবিতে দেখা যাবে আধুনিক স্থাপনার মিউজিয়ামটি সুন্দরভাবে ধারণ করেছে পুরোনো ভবনটিকে। একটা চিকন লম্বাটে জায়গাজুড়ে ডিজাইন করেছেন তিনি, যাতে আশপাশের সবুজ এবং জলাশয়কে নতুন স্থাপনা যেন নষ্ট না করে। পাশাপাশি দৃশ্যগত স্বচ্ছতাকেও এখানে ভাবা হয়েছে। বাংলাদেশের প্রথম রেলস্টেশনের মিউজিয়ামে এসে যদি একটা সত্যিকারের স্টেশনেই চলে এলাম এরকম একটা অভিজ্ঞতা পাওয়া যায়, তাহলে যাঁরা আসবেন, তাঁদের অনুভূতি পূর্ণতা পাবে বলে স্থপতি ভেবেছেন। বাংলাদেশে রেলওয়ে মিউজিয়াম একটি আছে চট্টগ্রামে। কিন্তু জগতি স্টেশনের ঐতিহাসিক মূল্য বিবেচনায় এখানে একটা মিউজিয়াম নির্দ্বিধায় হতে পারে বলে স্থপতি চিন্তা করেছেন। নতুন স্থাপনার ম্যাটেরিয়াল এবং নির্মাণ পদ্ধতির মাঝে চিরায়ত স্টেশনের অভিজ্ঞতার নস্টালজিয়াগুলোর দেখা মেলে।
মোহিনী মিল: মোহিনী মিলের মাঝে স্থপতি তৎকালীন মাস্টারপ্ল্যান খুঁজে পেয়েছেন। স্থপতি সেটিকে মিলের প্রবেশমুখে রেখেছেন স্মৃতিচিহ্ন হিসেবে। এ ছাড়া প্রবেশমুখে পুরোনো ভবনগুলোকেই দৃশ্যগতভাবে প্রাধান্য রাখা হয়েছে। মাঝখানে একটা কোর্টইয়ার্ডে মোহিনী বাবুর নিজের ব্যবহৃত গাড়ি ও সেই সময়ের মিলের একটি গাড়ি পাওয়া যায়, এ দুটোকেও ডিসপ্লে আকারে সবার দেখার জন্য এখানে রাখা হয়েছে। সংরক্ষণের পাশাপাশি এই জায়গাটিকে সাংস্কৃতিক অঙ্গন হিসেবে স্থপতি পুনরায় চিন্তা করে সাজিয়েছেন, যাতে এলাকাটি সচল থাকে। এই অঙ্গনের একটা অংশের ছাদ তুলে দিয়ে স্থপতি জায়গাটির নস্টালজিয়া আরও বাড়িয়ে তুলেছেন, তাতে যেন মনে হয় খোলস চলে গিয়েছে কিন্তু সারবস্তু ঠিকই রয়ে গেছে। ঠিক যেমন করে মোহিনী মিল এখন আর সচল নেই কিন্তু তার তরঙ্গ প্রবাহ সময়ের মধ্য দিয়ে আমাদের এখনো সমৃদ্ধ করে চলেছে আর সেটি আমাদের সন্দেহাতীতভাবে ধারণ করা প্রয়োজন।

সাইটের এলাকাটিকে ধরে ধরে ডিজাইন করে সাইটের উন্নয়ন করেছেন স্থপতি ছবিগুলো দেখলে বেশ বোঝা যায়। যেহেতু বিশাল সাইটটি দুইটি অংশে ভাগ করা তাই ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র জায়গা ধরে কাজগুলো করা হয়েছে। মোহিনী লজ- যেখানে মোহিনী বাবু থাকতেন সেটাকে সংরক্ষণ করে নিচতলায় একটা রেস্তোরাঁর কথা ভেবেছেন স্থপতি। মোহিনী মিলেই যেহেতু প্রথম এই এলাকার থিয়েটার বানানো হয়েছিল, তাই সেটা পুনরায় প্রাণ ফিরিয়ে আনতে চাইলেন স্থপতি। অফিসার্স কোয়ার্টারসহ অন্যগুলো রেনোভেট করে পুনরায় ব্যবহারোপযোগী করা যাবে, পাশাপাশি একটা এক্সপেরিমেন্টাল থিয়েটারও এখানে প্রস্তাব করা হয়েছে। পূর্বের ধারানুযায়ী লালন একাডেমি এবং মেলা উপলক্ষে বর্তমানে লালন মাজার প্রাঙ্গণের জমির চেয়েও বেশি জমি মোহিনী মিলের একটি অংশে করার সংবেদনশীল এক প্রস্তাব রাখেন স্থপতি।
লালন শাহের মাজার: লালন সাঁইয়ের আখড়াবাড়ি হিসেবে নামকরণ করেছেন স্থপতি এই জায়গাটিকে। একই সঙ্গে লালনভক্ত বাউলদের জন্য এই জায়গাটিকে উৎসর্গ করতে চেয়েছেন তিনি। ভেক বা ভিখা অনুষ্ঠানের মাধ্যমে লালনভক্তরা দীক্ষা নিয়ে থাকে। এটি এই মাজারের একটু গুরুত্বপূর্ণ আয়োজন এ ছাড়া বছরে দুটি গুরুত্বপূর্ণ দিন- দোল পূর্ণিমা এবং লালনের তিরোধান দিবস এখানে ঘটা করে পালিত হয়। লালন একাডেমি যে কাজগুলো করছেন লালনকে নিয়ে তা ঠিক এই এলাকাতেই করার দরকার আছে কি না তা নিয়ে প্রশ্ন জাগে স্থপতির মনে। কারণ এই বিশাল ভবন এলাকার যে জায়গা দখল করে আছে তা মূলত সাধুদের দখলে থাকার কথা। যেহেতু কিছুটা দূরে থাকলেও লালন একাডেমির কাজে কোনো সমস্যা হবে না, তাই স্থপতি লালন একাডেমিকে এই এলাকা থেকে সরিয়ে প্রস্তাব করেন মোহিনী মিলের একটি অংশে, যা মাজার নিকটস্থ। যেহেতু পূর্বে মিলের এই অংশে লালন সাঁইকে কেন্দ্র করে অনেক লোকের জমায়েত হতো, ফলে ব্যাপারটা সংগতিপূর্ণ হয়। তা ছাড়া নদীটা দখল করে যে জায়গা করা হয়েছে, সেটাকেও আগের হালে ফিরিয়ে আনা জরুরি প্রাণ ও প্রতিবেশের স্বার্থে। কারণ সাঁইজিকে ঘিরে যে আয়োজন, তার সঙ্গে এই নদী ভরাট করা জায়গাটির বিশেষ কাজ নেই এবং নদী ভরাট সাঁইজির ভাবের সঙ্গে যায় কি না, সেটিও প্রশ্নের আওতায় পড়ে। লালন-মেলা বা উৎসবের গান এই আয়োজনগুলো মাজারসংলগ্ন হতেই হবে এমন তো নয়। বাউলরা বরং আখড়াবাড়ির কাছে থাকলেন এবং মেলার অংশটা দূরে থাকল। যাঁরা ঘুরতে আসেন, তাঁরা মেলা উদযাপন করে মাজার ঘুরে চলে যেতে পারবেন।

মাজার প্রাঙ্গণে বাউলদের অস্থায়ী থাকার জায়গা হলো মূলত এখানকার মূল বিষয়। বছরে উৎসবভিত্তিক এবং দৈনন্দিন অধিবাস, সেবা গ্রহণ (আহার গ্রহণ), পুণ্য স্নান ইত্যাদি কর্মগুলো হয়, ফলে স্থপতি সে অনুযায়ী তার ডিজাইনগুলো ভেবে করেছেন। কিন্তু যতটা পারা যায় এই জায়গায় কম স্থাপনা করার প্রয়াস থেকেছে তাঁর। কারণ, লালন সাঁইয়ের সময়েও এখানে বিশেষ কিছু ছিল না। ফলে সেই সময়ের ভাবটি বজায় রাখাটাই ছিল স্থপতির মূল প্রয়াস। মাজার স্থাপনটা যেহেতু লালনকে ভেবে নির্মিত হয়নি, তাই স্থপতি পুনরায় ডিজাইন করেন ধ্যানের জন্য আদর্শ একটি পরিবেশ হিসেবে। গ্রামীণ বা আঞ্চলিক ম্যাটেরিয়াল দিয়ে খুঁটি নির্মাণ করেন এবং সাদা রঙের কাপড়কে তিনি ব্যবহার করেন ছাদ হিসেবে, যেহেতু সাদা রং লালনভক্তদের জন্য বিশেষ ইঙ্গিত বহন করে। লালন সাঁই যেহেতু সব মানুষকে সমান করে দেখতে চেয়েছেন, তাই মাজার চত্বরটিতে সাঁইজির মাজারের জন্য আলাদা পাটাতন করে তাঁকে আমাদের কাছ থেকে আলাদা না করে এখানে তাঁর আরও ভক্তদের দেহাবশেষ রাখা আছে এবং সেই ভূপৃষ্ঠতলেই লালন সাঁইয়ের দেহকে রাখার কথা ভেবেছেন তিনি। যদিও গুরুবাদী ঘরানায় গুরুকে আর সবার থেকে কিছুটা উঁচুতে রেখে হোক বা নিতান্ত তাঁর বসার জায়গায় একটা গামছা পেতে হলেও বিশেষায়িত করার চল আছে, যাতে অহমের নত হওয়ার চর্চা হয় কিন্তু স্থপতি সুসমির চিন্তাটির মাঝেও একটি সর্বজনীন মাজার দৃষ্টিভঙ্গিকে ভিন্নভাবে দেখার সুযোগ আছে।
শিক্ষার্থী সুসমির থিসিসের জুরিবোর্ডে ছিলেন স্থপতি এহসান খান। স্বপ্নের মতো করে জুরির পরদিনই এহসান খানের দপ্তরে কাজ জুটে যায় সুসমির, তাঁর এই অনবদ্য চিন্তাশীলতা ও কর্মদক্ষতার জন্য। শিক্ষার্থী থেকে রাতারাতি স্থপতি বনে যাওয়ার এই যাত্রাটি নিঃসন্দেহে খুব রোমাঞ্চকর!
– স্থপতি সুপ্রভা জুঁই
স্থপতি ও লেখক
প্রকাশকাল: বন্ধন ১৪৫ তম সংখ্যা, সেপ্টেম্বর ২০২২