পেশা যখন ইন্টেরিয়র ডিজাইন

নতুন নতুন স্থাপনা নির্মিত হচ্ছে প্রতিনিয়তই। আর এসব নবনির্মিত স্থাপনার ডিজাইন করছেন স্থপতিরা। স্থপতিদের অনেকেই এখন ইন্টেরিয়র ডিজাইন নিয়েও কাজ করছেন। তবে ইন্টেরিয়র ডিজাইন দেশের স্থপতিদের মূল কাজ নয়। যদিও তাঁরা ইন্টেরিয়র ডিজাইন চিন্তা করে ডিজাইন করেন, তবে ইন্টেরিয়র ডিজাইন মূলত একজন অন্দরসজ্জা স্থপতি বা ইন্টেরিয়র আর্কিটেক্টের কাজ। এই পেশায় প্রতিনিয়তই যুক্ত হচ্ছেন অসংখ্য ইন্টেরিয়র আর্কিটেক্ট। ইন্টেরিয়র ডিজাইন পেশার ভালো-মন্দের নানা দিক জানাচ্ছেন স্থপতি রাজীব চৌধুরী

ইন্টেরিয়র আর্কিটেকচার
ইন্টেরিয়র আর্কিটেকচার হলো আর্কিটেকচারের এমন একটা ক্ষুদ্র শাখা, যেখানে ইন্টেরিয়র ডিজাইন বিষয়ে বিশদভাবে শেখানো হয়। এই কোর্স মূলত ডিপ্লোমা আর্কিটেকচার সমমানের। তবে কোর্সটিতে বিশদভাবে আর্কিটেকচারের বিভিন্ন শাখা নিয়ে পড়ানো হয়, যেন একজন ইন্টেরিয়র আর্কিটেক্ট একটি ইন্টেরিয়র স্পেস সুন্দরভাবে ডিজাইন করতে পারে। ইন্টেরিয়র আর্কিটেকচার মূলত চার বছরের কোর্স। এই কোর্স করলে যে কেউ ইন্টেরিয়র ডিজাইনকে পেশা হিসেবে নিতে পারেন।

ইন্টেরিয়র আর্কিটেকচারের জন্য প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষা
ইন্টেরিয়র ডিজাইনার হওয়ার জন্য সত্যিকারের কোনো প্রাতিষ্ঠানিক পড়াশোনার প্রয়োজন হয় না। মানুষ যে সময় থেকে বিভিন্ন স্থানে নিজের বাসস্থান তৈরি করছে, সেখানে ইন্টেরিয়রও জড়িত। ৫০০ বছর আগেও যেখানে আর্কিটেকচার শব্দটার কোনো অস্তিত্ব ছিল না, সেখানে ৫০০০ বছর আগেকার স্থাপনা ও এর মধ্যকার অন্দরসজ্জা দেখে অবাক হয়ে যাই। এসব বিবেচনায় তো বলাই যায়, আসলেই স্থাপনার অন্দরসজ্জা বা ইন্টেরিয়র ডিজাইন করতে প্রয়োজন শুধু রুচিবোধের। এ ছাড়া আর বিশেষ কিছুর তেমন প্রয়োজন নেই। তবে বর্তমান বাজারে একজন ইন্টেরিয়র ডিজাইনার যিনি প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষায় শিক্ষিত, লোকে তাকে মূল্যায়ন করে বেশি। এ কারণে এখন ধীরে ধীরে ইন্টেরিয়র আর্কিটেক্টের চাহিদা তৈরি হচ্ছে।

ইন্টেরিয়রে ফুটে ওঠে শৈল্পিকতা

ক্যারিয়ার হিসেবে ইন্টেরিয়র ডিজাইন
ক্যারিয়ার হিসেবে ইন্টেরিয়র ডিজাইন বেশ চ্যালেঞ্জিং। এই চ্যালেঞ্জের বেশ কিছু কারণ আছে। আসুন একে একে এগুলো নিয়ে আলোচনা করি।

বাজেট স্বল্পতা: আমাদের দেশের মানুষের ইন্টেরিয়র ডিজাইনের ক্ষেত্রে বাজেট স্বল্পতা একটি মূল কারণ, যার জন্য ইন্টেরিয়র সেক্টর বেশ চ্যালেঞ্জের সম্মুখীন হচ্ছে প্রতিনিয়ত। দেখা যায় একটি বাড়ি তৈরিতে ও এর ফিনিশিং ম্যাটেরিয়েলস কেনার জন্য প্রায় শতকরা ৯০ ভাগ টাকা খরচ হয়ে যায়। ইন্টেরিয়র ডিজাইনের জন্য তেমন অর্থ বরাদ্দ থাকে না। ফলে ইন্টেরিয়র ডিজাইনেও তেমন একটা প্রাধান্য দেওয়া হয় না। হলেও তখন ইন্টেরিয়র ডিজাইনারদের সাধারণ মানের মিস্ত্রি ও কনট্রাক্টরদের সঙ্গে বিভিন্ন জিনিসের রেট নিয়ে প্রতিযোগিতা করতে হয়। এতে ভালো ডিজাইন করেও অনেক ইন্টেরিয়র আর্কিটেক্ট তার কাক্সিক্ষত কাজটি করতে পারেন না। অথবা করতে পারলেও এর মান ঠিক রাখা সম্ভব হয় না।

ম্যাটেরিয়েল স্বল্পতা: বাজারে যেসব ম্যাটেরিয়েল পাওয়া যায়, ইন্টেরিয়র ডিজাইন মূলত সেসব ম্যাটেরিয়েল দিয়েই করতে হয়। ফলে এসব ক্ষেত্রে নতুন কিছু এক্সপেরিমেন্ট করা সম্ভব হয় না। গতানুগতিক কাজের বাইরে নতুন কিছু করতে চাইলে তখন প্রতিযোগিতায় টিকে থাকা সম্ভব হয় না।

ভালো ও মানসম্মত ম্যাটেরিয়েল স্বল্পতা: বাজারে যেসব ম্যাটেরিয়েল পাওয়া যায়, সেগুলো দিয়েই ডিজাইন ফুটিয়ে তুলতে হয় বিধায় আমাদের গতানুগতিক ডিজাইনের বাইরে যাওয়া সম্ভব হয় না। দেখা যায় যেসব এক্সক্লুসিভ ম্যাটেরিয়েল পাওয়া যায়, সেগুলো বেশ দামি বিধায় ক্লায়েন্টের বাজেট চিন্তা করে সেগুলো ব্যবহার অনেক ক্ষেত্রেই করা সম্ভব হয় না। এ জন্য আমাদের দেশের ইন্টেরিয়র ডিজাইনারদের বেশ চ্যালেঞ্জের সম্মুখীন হতে হয়।

রেস্টুরেন্টের নান্দনিক ইন্টেরিয়র

অধিক মুনাফালোভি কনট্রাক্টরদের দৌরাত্ম্য: কিছু কনট্রাক্টর আছে, যারা কাজ পাওয়ার জন্য এমন কোটেশন দেয় যে এগুলো দেখে ক্লায়েন্টের মনে হয় এই ইন্টেরিয়র সেক্টর বেশ সহজ। এই সহজ কাজটা করতে গিয়ে ওনারা শেষ পর্যন্ত নিজেরাই ক্ষতির সম্মুখীন হন। কিন্তু দিন শেষে একজন ইন্টেরিয়র আর্কিটেন্ট, যিনি নিজের মেধা খাটিয়ে ডিজাইনটি করেছেন, তিনি কাজটি করতে পারেন না। সামান্য কিছু টাকা বাঁচাতে গিয়ে মানহীন কাজ হয়, যা ইন্টেরিয়র সেক্টরের দুর্নাম ডেকে আনে।

ইন্টেরিয়র ডিজাইন সম্পর্কে ক্লায়েন্টের পরিষ্কার ধারণা না থাকা: একজন ক্লায়েন্ট যিনি ইন্টেরিয়র ডিজাইন মানেই কেবিনেট তৈরি বোঝেন, তিনি আসলে ইন্টেরিয়র ডিজাইন ব্যাপারটাই বোঝেন না। তিনি ভাবেন কয়েকটা বোর্ড দিয়ে কেবিনেট তৈরি করলেই ইন্টেরিয়র ডিজাইন করা হয়ে যায়। আর এভাবেই তিনি কাজের মানের ক্ষতি করেন। অনেক সময় দেখা যায়, একজন ইন্টেরিয়র আর্কিটেক্ট বা ডিজাইনারের কাছ থেকে ডিজাইন নিয়ে তিনি বেশ কয়েকজনের কাছ থেকে দাম যাচাই করে একটা প্রজেক্টে কয়েকজন কন্ট্রাক্টরকে কাজ দেন। যার দাম যেটায় কম, সেটা তাকে দিয়েই করতে দেন। ফলে কাজের মান খারাপ হয়। তিনি নিজেও বুঝতে পারেন না যে আখেরে তিনি নিজের টাকার নয়-ছয় করেছেন। আবার অনেক ক্লায়েন্ট তো দেখে দেখে কম রেট দেওয়া কাজগুলো করিয়ে নেন। এভাবে ইন্টেরিয়র ডিজাইন মাঠে মারা যান। একজন ফার্নিচার ডিজাইনার ও ইন্টেরিয়র ডিজাইনার যে আলাদা, এই শিক্ষাটা যেসব ক্লায়েন্টের মধ্যে থাকে না, তাদের জন্যই এই ইন্টেরিয়র সেক্টর প্রতিনিয়ত ক্ষতির সম্মুখীন হচ্ছে।

ডিজাইনার যখন কনট্রাক্টর: একজন ইন্টেরিয়র আর্কিটেক্ট যখন নিজেই পুরো কাজটির দায়িত্ব নেন, তখনই বাধে গন্ডগোল। ইন্টেরিয়র ডিজাইনারকে তখন টাকা বাঁচাতে মানহীন পণ্যের দিকে ঝুঁকতে হয়। আর এভাবে একজন ইন্টেরিয়র ডিজাইনারকে লোভ পেয়ে বসে। তিনি নিজের ডিজাইনকে ঠিক রাখেন বটে, কিন্তু মানহীন ম্যাটেরিয়েল দিয়ে নিজের কাজের মান কমিয়ে নিজের ক্ষতি করে বসেন। এ জন্য একজন ডিজাইনার যখন কনসালট্যান্সি বাদ দিয়ে নিজেই কনট্রাক্টর হয়ে যান, তখন কাজের মানের ক্ষতি বই লাভ কিছু হয় না।

ইন্টেরিয়র ডিজাইনারকে আসলে কী করতে হবে?
একজন ইন্টেরিয়র ডিজাইনারকে সঠিক পথ খুঁজে বের করতে হবে। ইন্টেরিয়র ডিজাইনারকে কখনোই একজন কনট্রাক্টর হলে চলবে না। তিনি যে একজন ডিজাইনার সেটা ওনার মনে রাখতে হবে। আর এ জন্য কাজ করাতে হবে একজন কাজ জানা কনট্রাক্টরকে দিয়ে, যিনি কাজের মান ধরে রাখবেন। এ ক্ষেত্রে কাজের মান ঠিক রাখতে ইন্টেরিয়র ডিজাইনার সর্বোচ্চ মান যাচাই করতে পারেন কিন্তু তিনি কোনো ম্যাটেরিয়েল নিজে কিনবেন না। যা কেনার সব ক্লায়েন্ট কিনবেন। আর এভাবেই সঠিক ইন্টেরিয়র ডিজাইন প্র্যাকটিস চালু হতে পারে।

ইন্টেরিয়র ডিজাইনের নান্দনিকতায় ছিমছাম অন্দর

প্রফেশন হিসেবে ইন্টেরিয়র ডিজাইন
প্রফেশন হিসেবে ইন্টেরিয়র ডিজাইন নেওয়ার আগে ভাবতে হবে অনেক কিছু। এই পেশায় ক্লায়েন্টের পেমেন্ট দেওয়ার কোনো গ্যারান্টি নেই। অনেক ক্ষেত্রেই ক্লায়েন্ট শেষ ধাপের পেমেন্ট না দেওয়ার চেষ্টা করেন, যেটা থেকে রেহাই পেতে ডিজাইনারকে অনেক রকম কসরত করতে হয়। অনেকেই আগেই পেমেন্ট নিয়ে কাজ করেন। এটা বেশ ভালো পরিকল্পনা। যদিও এটা অনেক সময় কাজ দেয় না। অনেক ক্লায়েন্ট ডিজাইন অনলাইনে চেয়ে থাকেন। সেটা দিলেই তিনি ডিজাইন নিয়ে যোগাযোগ বন্ধ করে দেন। এসব ক্ষেত্রে বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে এই টাকা আদায় করার কোনো বৈধ উপায় নেই। এ জন্যে ইন্টেরিয়র আর্কিটেকচার পেশায় এসে অনেকেই বিরক্ত হয়ে এই পেশা ত্যাগ করেন। দিন শেষে টাকা যেখানে একজন ডিজাইনারের বেঁচে থাকার মূল উপজীব্য, সেখানে সত্যিই এসব অনভিপ্রেত ঘটনা ঘটতে দেখা প্রতিদিনকার ব্যাপার। এ জন্য প্রফেশনাল হতে হবে। আগেই ডিজাইন ফি নিয়ে নিলে অনেকেই ফ্রিতে ডিজাইন পাওয়ার চিন্তা করবে না। অনেকেই আছে যাঁরা টাকা ছাড়া ডিজাইন দেন না বলে শোনা যায়। আসলে তাঁরাই সত্যিকারের বুদ্ধিমান, যিনি নিজের ডিজাইনকে মূল্যবান করতে পেরেছেন।

বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে ইন্টেরিয়র ডিজাইন বেশ শ্রমসাধ্য ও চ্যালেঞ্জিং হলেও এই খাতে প্রতিবছর লাখো-কোটি টাকা বিনিয়োগ হচ্ছে। দেশ-বিদেশ থেকে হাজার কোটি টাকার পণ্য আমদানি হচ্ছে। তৈরি হচ্ছে শ্রমবাজার। কাঠমিস্ত্রি থেকে শুরু করে লেকারমিস্ত্রি অথবা রংমিস্ত্রিদের কর্মসংস্থানের ব্যবস্থা হচ্ছে। নিত্যনতুন শ্রমবাজার, যেটার মাধ্যমে দেশের অনেক কর্মহীন শ্রমশক্তির কাজের সংস্থান হচ্ছে। এই সেক্টরের মাধ্যমে স্বাবলম্বী হচ্ছে লাখ লাখ শ্রমিক এবং তাদের লাখ লাখ পরিবার। তাই এই পেশা দেশের বাজারে এই মুহূর্তে ট্রেন্ডিং। আমাদের দেশের প্রেক্ষাপটে একটু কঠিন হলেও আশা করা যায় দিন দিন এই পেশায় আরও স্বচ্ছতা আসবে। আসবে শ্রমের সঠিক মূল্যায়ন এবং অর্থের নিশ্চয়তা। এই হোক আগামীর বাংলাদেশের সব ইন্টেরিয়র ডিজাইনারদের কামনা।

প্রকাশকাল: বন্ধন ১৬৫ তম সংখ্যা, মে ২০২৪

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Scroll to Top