শুরু কাহিনি
ক্যাপ্টেন নিমোর গল্প দিয়েই শুরু করা যাক। সময়টা ঊনবিংশ শতাব্দীর মধ্যভাগ। সামুদ্রিক ঝড়ে ডুবে যায় ‘লিনার’ নামের জাহাজটি। ধারণা করা হয়, এটা ছিল আটলান্টিক মহাসাগরের কোনো একটি জায়গা। জাহাজের চালক ও অনেক যাত্রীই লাইফবোটে চড়তে পারলেও কয়েকজন হতভাগ্য যাত্রী অথৈ সাগরে ডুবতে থাকে। ভাসতে থাকা নিশ্চল দেহগুলোকে অপরিচিত একদল উদ্ধারকারী ডুবন্ত এক সাবমেরিন নিয়ে আসে। সাবমেরিনটির নাম ‘নটিলাস’। এখান থেকে তাদের নিয়ে যাওয়া হয় ‘টেম্পলমির’ নামে ডুবন্ত এক শহরে। ডুবন্ত শহরটি আসলে ক্যাপ্টেন নিমোর নিভৃত গবেষণাগার। ক্যাপ্টেন নিমো তাদের তাঁর রহস্যময় ডুবন্ত শহর ঘুরিয়ে দেখান। শহরটি বিশাল আয়তনের; অদ্ভুত। বিপদাপন্ন যাত্রীদলের মধ্যে দুজন ছিলেন স্বর্ণ অনুসন্ধানকারী। তাঁরা অবাক হয়ে দেখছিলেন শহরের সবকিছু স্বর্ণ দিয়ে মোড়ানো।
ক্যাপ্টেন নিমোর এই গল্পের উৎস বৈজ্ঞানিক কল্পকাহিনির জনপ্রিয় লেখক জুলভার্নের অমর সৃষ্টি ‘টুয়েনটি থাউজেন্ড লিগ আন্ডার দ্য সি’। ১৮৭০ সালে লেখক জুলভার্ন ক্যাপ্টেন নিমোর যে ডুবন্ত ল্যাবরেটরির ছবি একেঁছিলেন, তা থেকেই কিন্তু সাগরের তলে বসবাসের ভাবনা কারও কারও মনে বাসা বাঁধতে শুরু করে। শুধু ক্যাপ্টেন নিমো কেন, ‘ইয়োলো সাবমেরিন’, ‘টাইটানিয়া’ ১৯৭১ সালের সাড়া জাগানো টিভি সিরিয়াল ‘সিটি বিনেথ দ্য সি’ এবং তারও পরের ‘দ্য আন্ডার সি ওয়ার্ল্ড অব জ্যাকুইস কস্টাউ’র মতো চিত্রনাট্য পানির নিচে বসবাসের স্বপ্ন দেখায় স্বপ্নচারী মানুষকে। পানির নিচে বাস একদা স্বপ্ন হলেও সত্যি সত্যি এ নিয়ে শুরু হয় গবেষণা।

স্বপ্নের পথচলা
সাগরের বিশাল জলরাশির ওপর ভাসতে ভাসতে সমুদ্রকে নিয়েও মানুষ স্বপ্ন দেখতে শুরু করে। লেখক জুলভার্নের মতে, সাগরই সবকিছু। পৃথিবীর ১০ ভাগের সাত ভাগজুড়ে রয়েছে বিশাল পানির জলধারা। এর প্রভাব হচ্ছে স্নিগ্ধ ও স্বাস্থ্যকর। এটা এমনই এক বিস্তীর্ণ উঠোন, যেখানে মানুষ কখনোই একঘেয়ে অনুভব করে না। সর্বত্রই রয়েছে বৈচিত্র্য। সমুদ্রই এখন পর্যন্ত সম্পূর্ণ প্রাকৃতিক ও অবিকৃত অবস্থায় রয়েছে। এটা আবেগ ও ভালোবাসার সীমানাহীন আবাস। তাই সাগরকে নিয়ে মানুষের স্বপ্ন ও কল্পনার শেষ নেই।
সোভিয়েত-মার্কিন স্নায়ুযুদ্ধকালীন সব বিষয়ে দুই পরাশক্তির একধরনের ছায়াযুদ্ধ চলত। বিজ্ঞান গবেষণায়ও পড়েছিল এর ছাপ। যে সময়টাতে চাঁদে অভিযানের ধুম পড়েছিল, সেই একই সময়ে পানির নিচে অভিযানও শুরু হয়ে যায় বেশ জোরেশোরে। ১৯৬০-এর দশকে ফ্রান্স পেট্রোকেমিক্যাল ইন্ডাস্ট্রির অর্থায়নে ‘কনশেলফ’ নামে শুরু হয় একটি সিরিজ প্রজেক্ট, যার উদ্দেশ্য ছিল পানির নিচে মানুষের বসবাসের সম্ভাব্যতা যাচাই এবং অনুক‚ল পরিবেশ তৈরি-বিষয়ক গবেষণা। প্রায় এক হাজার ফুট নিচে যাওয়ার ইচ্ছা থাকলেও ‘কনসেলফ-১’ এবং ‘কনসেলফ-২’ সর্বোচ্চ ১০০ ফুট পর্যন্ত পৌঁছাতে পারে। তবে ‘কনসেলফ-৩’ প্রায় ৩৩০ ফুট পানির গভীরে নেমে যায়। স্টার ফিশ, ফ্লাইং সসারের মতো নানা আকৃতির কেবিনে চড়ে ছয়জন অভিযাত্রী প্রায় তিন সপ্তাহ পানির নিচে কাটিয়ে আসে। ‘কনসেলফ-৩’ তার এই তিন সপ্তাহব্যাপী অভিযানে পানির তলে কাজ করার বিভিন্ন সমস্যা ও এসবের সম্ভাবনা চিহ্নিত করে। পানির নিচে বসবাসে অসামান্য সফলতার দৃষ্টান্ত সৃষ্টি করে। এর পরই শুরু হয় মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের অধ্যায়। নাসার কারিগরি সহযোগিতা ও নেভাল রিসার্স অফিসের উদ্যোগে ‘ইউএস নেভি সি ল্যাব’ এবং ‘টেকটাইট আন্ডারওয়াটার হ্যাবিট্যাট’ নামে দুটি প্রকল্প হাতে নেয়। সি ল্যাব খুব প্রাইমারি হলেও টেকটাইট প্রজেক্ট টানা ৫৩ দিন সমুদ্রের তলদেশে কাটিয়ে আসে। টেকটাইট-এর বড় সফল্য ছিল অভিযাত্রীরা একদম সাগরের তলদেশে স্থিরভাবে অবস্থান করতে সক্ষম হয়।

পানির তলের আবাসন নিয়ে বিভিন্ন গবেষণা বিশেষ করে জ্যাকের কনসেলফ সিরিজের বাস্তবায়নের পরে সমুদ্রতলের আবাসন নিয়ে অনেকেই গবেষণায় সক্রিয়ভাবে নেমে পড়ে। ১৯৬৬ সালের আগস্টে রাশিয়ার নবীন অভিযাত্রীদের ক্লাব ‘ইকথাইন্ডার’-এর পক্ষ থেকে ‘ইকথাইন্ডার-৬৬’ নামে অভিযানে একজন দুঃসাহসী তিন ঘণ্টা পানির নিচে কাটিয়ে কর্তৃপক্ষ ও বিজ্ঞানীদের মধ্যে বেশ সাড়া ফেলে।
তবে সব পরীক্ষাই যে সফল হয়েছে তা কিন্তু নয়। পৃিথবীব্যাপী এই গবেষণা ও প্রচেষ্টা চলছে। বাস্তবতা হচ্ছে পানির নিচে বসবাসের এই ধারণা এখন শুধু ফ্যাশন নয়, মানুষের প্রয়োজন কিংবা চাহিদায় পরিণত হয়েছে। মালদ্বীপে রাঙাল দ্বীপের কনরাড হোটেলে অত্যাধুনিক একটি রেস্টুরেন্ট রয়েছে, যারা পানির নিচের দৃশ্য উপভোগের জন্য আন্ডারওয়াটার রিসোর্ট নির্মাণের পরিকল্পনা চূড়ান্ত করেছে। তা ছাড়া পোল্যান্ডের ডিপ ওশান টেকনোলজি গ্রুপ দুবাই, সিঙ্গাপুরসহ বিভিন্ন ইউরোপিয়ান দেশে এ ধরনের স্থাপনা ডিজাইনের পরিকল্পনা করছে। তবে তার আগেই মানুষের মধ্যে প্রচারণা ও স্বপ্নের জন্ম দিয়েছে যেটি, সেটি আসলে ফিজির কাটাফিঙা আইল্যান্ডের পজেইডন আন্ডার সি রিসোর্ট। অনলাইনে এই রিসোর্টের যে প্রস্তাবিত ছবি দেওয়া হয়েছে তাতে দেখা যায়, স্বচ্ছ গ্লাসের তৈরি কক্ষের চারপাশে বর্ণিল সব শৈবাল ও মাছের দল ঘুরে বেড়াচ্ছে। এই ছবি যে কাউকে বাধ্য করবে এক রাত এখানে কাটানোর পরিকল্পনা করতে। এটা কঠিন হলেও প্রযুক্তির এই যুগে তা অসাধ্য নয় বলে মনে করেন এই রিসোর্টের ডিজাইনার এল ব্রুস জোনস।
পানির নিচে কেন
ঊনবিংশ শতকের মাঝামাঝি সময়ে পানির নিচে যাওয়ার প্রথম উদ্দেশ্য ছিল গবেষণার সম্প্রসারণ। সরকারি পৃষ্ঠপোষকতা কিংবা ব্যক্তিগত আগ্রহে যেসব অভিযান চলেছে, সেখানে তাদের আগ্রহের কেন্দ্রবিন্দু ছিল পানির মধ্যে বসেই পানিতে থাকা জীব ও প্রাণীদের নিয়ে গবেষণা করা। সমুদ্রতলের জানা-অজানা বিচিত্র সম্পদ ও সম্ভাবনাকে মানুষের প্রয়োজনে কোনোভাবে কাজে লাগানো যায় কি না তার একটা পথ বের করা। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধোত্তর পরাশক্তিগুলোর সঙ্গে তাদের প্রেস্টিজ ইস্যু যুক্ত হয়। বিজ্ঞানচর্চায় কে কত অগ্রগামী, তার একটা নীরব প্রতিযোগিতা থেকে এ ধরনের ব্যয়বহুল পরীক্ষা-নিরীক্ষা গতি পায়। ন্যাশনাল ওশানিক অ্যান্ড অ্যাটমোসফেরিক অ্যাডমিনিস্ট্রেশন ১৯৭৭ থেকে ১৯৮৭ সার পর্যন্ত বাহামা দ্বীপপুঞ্জে ১০০টি এবং ভার্জিন আইল্যান্ডে প্রায় ৮০টি ধারাবাহিক ‘হাইড্রোল্যাব’ অভিযান চালায়। হাইড্রোল্যাব জার্নালে এসব গবেষণার বিস্তারিত প্রকাশ পায়। জুলভার্ন যে পানির নিচের শহরের স্বপ্ন দেখিয়েছিলেন হাইড্রোল্যাব অভিযানের মাধ্যমে ওশ্যান ইঞ্জিনিয়ারিংয়ের সমসাময়িক বিজ্ঞানী ও শিক্ষানবিশরা সে স্বপ্নকে বাস্তবের কাছাকাছি পৌঁছে দেয়। এর পরেই মূলত নব্বইয়ের দশক থেকে পানির নিচে বসবাসের চিন্তার শুরু। পানির তলদেশ নিয়ে মূল্যবান সময় ও শ্রম ব্যয় করাতে আপত্তি আছে কারও কারও। পানির ও সমুদ্রতলের গবেষণা যেমন সময় ও শ্রম দাবি করে, তেমনি এখনো পর্যন্ত পানির নিচে বসবাস যথেষ্ট ব্যয়বহুল এবং একে একধরনের বিলাসী সাধ বা ইচ্ছে বলেই ধরা হয়। প্রায়ই প্রশ্ন ওঠে পানির নিচে বসবাস আসলেই মানুষের পক্ষে সম্ভব কি না কিংবা কৃত্রিম উপায়ে এ ধরনের বাসস্থান কতটুকু প্রয়োজনীয়।

পানির নিচে বসবাসের এই ধারণা এখন শুধু ফ্যাশন নয়, মানুষের প্রয়োজন কিংবা চাহিদার অবস্থানে এসে দাঁড়িয়েছে। বিশাল এ পৃথিবী জনসংখ্যার ভারে ভারাক্রান্ত। চাইলেও আর সম্প্রসারণ সম্ভব নয় এ সীমিত ভূখণ্ডের। আবার রাতারাতি মানুষের বৃদ্ধিকে রুদ্ধ করা যাবে না। সুতরাং বিকল্প বাসস্থান দরকার। তা হতে পারে মহাকাশে কিংবা মহাসমুদ্রে। মানুষ অসীম দূরত্ব পাড়ি দিয়ে মঙ্গলগ্রহে বসতি স্থাপন করতে চাইছে সে তুলনায় সমুদ্র আমাদের নিকট প্রতিবেশী। সিন্দাবাদের মতো সমুদ্রে ভেসে বেড়ানোর চেষ্টায় মানুষ সফলও হয়েছে স্রষ্টার অপার সৃষ্টিতে, নানাবিধ সম্পদে পরিপূর্ণ সমুদ্রের নিচে যাওয়ার চিন্তা করাটা কিন্তু দুঃসাহসের পর্যায়ে পড়ে।
সম্প্রতি বিনোদন ও পর্যটনশিল্পের ব্যাপক প্রসারে পানির নিচে আবাসনের গুরুত্ব বেড়েছে ব্যাপকভাবে। যোগাযোগব্যবস্থার উন্নতির সুবাদে মানুষ সহজেই এক দেশ থেকে আরেক দেশে ঘুরে বেড়াচ্ছে। বিভিন্ন জনপ্রিয় স্থানগুলো ব্যাপকসংকটে পড়ছে এদেরকে জায়গা দিতে। বিশেষ করে সমুদ্রসৈকতে ও গভীর বনাঞ্চলসহ বিভিন্ন প্রাকৃতিক সৌন্দর্যমণ্ডিত স্থানে বিভিন্ন স্থাপনা তৈরি করতে গিয়ে প্রাকৃতিক পরিবেশ নষ্ট হচ্ছে। এমতাবস্থায় বিকল্প একটি উপায় সমুদ্রতলের আবাসন।
বাধা যত
পানির নিচে বসবাসে মানুষ যতই স্বপ্ন দেখুক না কেন, এ স্বপ্নকে বাস্তবে পরিণত করা সহজ নয়। অনেক বাধা মোকাবিলা করেই সামনে এগোতে হবে। সবচেয়ে বড় বাধা মানুষের স্বাভাবিক শারীরবৃত্তীয় কর্মকাণ্ডের ব্যবস্থা নিশ্চিত করা। বেঁচে থাকার জন্য সার্বক্ষণিক শ্বাস-প্রশ্বাস অত্যাবশ্যকীয়। এ জন্য বিশুদ্ধ বাতাসের মুক্ত প্রবাহ নিশ্চিত করতে হবে। আর্দ্রতা ও তাপমাত্রার ব্যাপারেও ভাবতে হবে। কারণ, নির্দিষ্ট মাত্রার চেয়ে বেশি বা কম তাপমাত্রা অথবা আর্দ্রতা বসবাসকে অসম্ভব করে তোলে। এর পরেই বায়ুচাপ। পানির যতই গভীরে যাওয়া যাবে ভারী গ্যাসের কারণে ক্রমেই বায়ুর চাপ বাড়বে। সেই চাপের সঙ্গে তাকে একীভূত হতে হবে অথবা কৃত্রিমভাবে সেই একই মাত্রার বায়ুচাপ বজায় রাখতে হবে। সহনীয় প্রযুক্তিগত পরিবেশ নিশ্চিত করতে হলে আরও ভাবতে হবে খাবার পানি ও খাদ্য সরবরাহ নিয়ে। বর্জ্য পদার্থ, বিষাক্ত টক্সিন নির্গমন নিঃসরণ কীভাবে হবে তার সমাধানও থাকতে হবে।
দ্বিতীয় বাধা নিরাপত্তা। পানির জগৎ জানা-অজানা নানা বিচিত্র প্রাণীর সমাহারে সমৃদ্ধ। ক্ষুদ্রাতিক্ষুদ্র থেকে বিশালায়তন ও নিরীহ প্রাণী থেকে মারাত্মক বিষাক্ত অণুজীব ঘুরে বেড়ায় পানির সীমাহীন জগতে। বিশালাকৃতির প্রাণীর আক্রমণ ও বিভিন্ন সামুদ্রিক বিপর্যয় যেমন- ভূমিকম্প, সমুদ্রতলের আগ্নেয়গিরির অগ্ন্যুৎপাত ইত্যাদি বিবেচনায় পানি তলের স্ট্রাকচার বিষয়ে ভাবতে হবে। এ ছাড়া পানিবাহিত ছত্রাক, ভাইরাস, ব্যাকটেরিয়াঘটিত রোগসহ জৈববৈজ্ঞানিক ইস্যুগুলো আরও নিবিড় গবেষণার দাবি রাখে।

আর্থিক ও মনোজাগতিক বিষয় তো আছেই। সম্পূর্ণ কৃত্রিম একটি ব্যবস্থাপনায় বাস করা অবশ্যই স্বাভাবিকের চেয়ে ব্যয়বহুল। পানির নিচে থাকা মানে মানুষের স্বাভাবিক সমাজ ও নগরজীবন থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে অন্ধকার এক জগতে বাস করা। পানির উপরিভাগের সঙ্গে যোগাযোগ, প্রতিনিয়ত আসা-যাওয়া, কিংবা স্থায়ীভাবে থাকতে হলে বিনোদন, শিক্ষা, ইত্যাদি প্রয়োজন পূরণ কীভাবে হবে তার সমাধান না হওয়া পর্যন্ত মানুষ কোনোভাবেই পানিতে আবাস গড়তে আগ্রহী হবে না।
এগিয়ে যাওয়ার প্রত্যয়
বাধা যতই থাকুক প্রচেষ্টার কমতি নেই এতটুকু। প্রযুক্তির উৎকর্ষতার যুগে কোনো বাধাই অপ্রতিরোধ্য নয়। একটা সময় ছিল পানির নিচে যাওয়ার সংগ্রাম। সে প্রচেষ্টায় মানুষ সফল হয়েছে। এখন চলছে কীভাবে স্থায়ীভাবে সমুদ্রে বাস করা যায় তার গবেষণা। অব্যাহত প্রচেষ্টার ফসল হিসেবে নতুন নতুন ধারণা মাথায় আসছে। ফিল পাউলির ডিজাইন আইডিয়াটা তেমনই। তিনি বিগত ২০ বছর ধরে পানির নিচে শহর তৈরির স্বপ্ন দেখছেন। শেষ পর্যন্ত কেমন হবে সেই আবাস তার বাস্তবভিত্তিক ছবিও তৈরি করতে সক্ষম হয়েছেন। তিনি তাঁর প্রজেক্টের নাম দিয়েছেন সাব-বায়োস্ফেয়ার ২। এটা আয়তনে বায়োডোম স্ট্রাকচারের প্রায় আটটির সমান এবং প্রস্থে এক হাজার ১০৫ ফুট। বায়োস্ফেয়ার-২-তে একটি বড় স্পেয়ার বা বায়োডোমকে কে ঘিরে কয়েকটি ছোট ছোট বায়োডোম থাকবে। বড়টি হবে বিভিন্ন সাপোর্টের জন্য আর ছোটগুলো ব্যবহৃত হবে বসবাসের জন্য। এর মধ্যে দর্শনার্থীদের অবজারভেশনের জন্য রাখা হবে কয়েকটিকে। প্রতিটি ডুয়েলিং পডে আলাদা আলাদা ইকো সিস্টেম তৈরি করা হবে। বাতাস প্রবাহ ও এমনকি খাদ্যের জন্য বাইরের ওপর নির্ভরশীল হতে হবে না। পাউলির স্বপ্নের সিটিতে প্রাথমিকভাবে ১০০ জনের থাকার ব্যবস্থা হবে। তবে তার আশা পর্র্যায়ক্রমে সীমাবদ্ধতা নিয়ে কাজ করে একে বড় আকারে হাউসিং পার্কে পরিণত করা সম্ভব।
পানির নিচের অন্ধকার জগৎ থাকার জন্য কেমন তা নিয়ে কল্পনার শেষ নেই। এই কৌত‚হল মেটানোর ব্যবস্থা করে দিয়েছে দ্বীপরাষ্ট্র মালদ্বীপের ওয়াটার ডিসকাস হোটেল। মালদ্বীপের অর্থনীতির প্রধান চালিকাশক্তি হচ্ছে পর্যটনশিল্প। পর্যটকদের আকৃষ্ট করার জন্য তারা সমুদ্রের গভীরে একটি আন্ডারওয়াটার হোটেল করার জন্য পোল্যান্ডভিত্তিক ডিপ ওশ্যান টেকনোলজি গ্রুপের সঙ্গে চুক্তিবদ্ধ হয়েছে। মালদ্বীপের কুরেদিভার আইল্যান্ডে এটি স্থাপিত হবে। ওয়াটার ডিসকাস হোটেলের মূল থিম ছুটির দিন শুধু রিসোর্টে বসে থাকার জন্য নয় বরং একই সঙ্গে প্রকৃতির সঙ্গে নিজেকে মেলে ধরার। তারা এখানে এমন একটি নাটকীয় পরিবেশ দিতে চাইছে, যেখানে রঙিন মাছ, বর্ণিল শৈবাল, সমুদ্রতলের নাম না-জানা ভাসমান প্রাণীকুল, কোরাল, স্টারফিশ, সিহর্স ঘুরে বেড়াবে। একটি স্বচ্ছ কাচের গোলকের মধ্যে আপনিও তাদের সঙ্গে ঘুরে বেড়াবেন। একান্ত আলাপে মেতে উঠবেন নিজের মতো করে।

ওয়াটার ডিসকাস হোটেল প্রকৃতপক্ষে পানির নিচের ও পানির ওপরের দুটি আলাদা চরিত্রের সমন্বয়ে গড়ে উঠেছে। হোটেলের বাহ্যিক কাঠামো দেখেও মনে হবে দুটি ডিস্কের সমন্বয়। এর একটি পানির নিচে এবং অপরটি পানির ওপরে। দুটি ডিস্ক একে অপরের সঙ্গে সংযুক্ত হয়েছে পাঁচটি পায়ার সাহায্যে। একটা লিফট কোরের মধ্য দিয়ে সিঁড়ি ও লিফটে দর্শনার্থীদের ওঠানামার সুযোগ দেবে। আন্ডারওয়াটার ডিস্কের মধ্যে মোট ২১টি কক্ষ থাকবে, যা পানির উপরিতল থেকে প্রায় ৩০ ফুট নিচে থাকবে। মাঝে কেন্দ্রে থাকবে বিশালাকৃতির খোলা জায়গা, যেটা বিভিন্ন ধরনের কমিউনিটি প্রোগ্রাম ও বিনোদনের জন্য ব্যবহৃত হবে। স্বচ্ছ কাচঘেরা প্রতিটি রুম মনে হবে যেন সরাসরি প্রবাল প্রাচীর দিয়ে ঘেরা।
ডিস্ক আকৃতির একটি মডিউল প্রায় দুই হাজার বর্গমিটার জায়গা নিয়ে গড়ে উঠছে। প্রয়োজনমতো মডিউল নির্মাণ করে রিসোর্টের বর্ধিতকরণ করা যাবে। পানির মধ্যে ভাসমান অথবা লম্বা পায়ের সাহায্যে তলদেশে সংযুক্ত থাকা দুই রকম সুবিধা নিয়েই এর মডিউলগুলো তৈরি হয়েছে। যেকোনো প্রতিক‚ল পরিবেশে প্রয়োজন হলে সরিয়ে নেওয়া যাবে। থাকার পরিবেশ যেন একঘেয়ে বিরক্তিকর না হয় বরং সব ধরনের বৈচিত্র্য থাকে, সে কথা মাথায় রেখেই ওয়াটার ডিসকাস হোটেলের পানির ওপরের এবং পানির নিচের দুটি আলাদা চরিত্রের সমন্বয় করা হয়েছে।
একই রকম পরিকল্পনা নিয়েছে দুবাইয়ের হাইড্রোপোলিশ আন্ডারওয়াটার হোটেল। এই হোটেলের তিনটি অংশ থাকবে। এক অংশ স্থলভাগে থাকবে ল্যান্ডপোস্টে, যেখানে প্রথমে দর্শনার্থীরা একত্র হবে। দ্বিতীয় অংশ হচ্ছে কানেকশন সাবওয়ে, যা কিনা সবাইকে সেন্টার পজিশনে নিয়ে আসবে। আর স্যুট এরিয়া হচ্ছে মূল হোটেল। প্রায় ২২০টি স্যুট নিয়ে এই অংশের মোট আয়তন ২৬০ হেক্টর, যা আয়তনে লন্ডনের হাইড্রো পার্ককে ছাড়িয়ে যাবে।
পানির নিচে বসবাসের যে সমস্যাগুলো ছিল, সেগুলো উত্তরণের উপায়ও বিজ্ঞানীরা বের করেছেন। পানির নিচের প্রধান সমস্যা অক্সিজেন। সাবমেরিন যে কৌশলে অক্সিজেন সরবরাহ করে সেই একই কৌশলে গভীর সমুদ্রে অক্সিজেন সরবরাহ করা সম্ভব। উদ্বৃত্ত ও বিষাক্ত গ্যাস নির্গমনের জন্য শৈবাল ব্যবহার করে গবেষণায় বেশ ভালো ফল পাওয়া যাচ্ছে। শৈবাল বেড়ে উঠছে এক বিশেষ ধরনের ভাসমান ব্যাগে এবং এটা কার্বন ডাই-অক্সাইড বের হওয়ার ফিল্টার হিসেবে বিশেষ ভূমিকা রাখছে। একই সঙ্গে বায়োফুয়েল ও বিশেষ ধরনের খাবার তৈরিতে ব্যবহৃত হচ্ছে। সমুদ্রে সৃষ্ট জলতরঙ্গ থেকে বিদ্যুৎ তৈরির পদ্ধতিও এখন স্বীকৃত।
সব মিলিয়ে বলা যায় পানির নিচে বাস করার চিন্তা এখন আর অবাস্তব নয়। তুরস্কেও সমুদ্রসৈকতে সম্প্র্রতি চালু হয়েছে এমন এক হোটেল। যদিও এটি পানির খুব অল্প গভীরে, তবুও পানির নিচে বাণিজ্যিকভাবে বসবাসের পরিবেশ তৈরিতে সীমিত আকারে সফলও হয়েছে।
আমার সীমানা, আমার স্বপ্ন
নদীমাতৃক জনবহুল এ দেশ। বিপুল জনসংখ্যা ও দারিদ্র্যের ভারে ভারাক্রান্ত জনপদে সমস্যার অন্ত নেই। এত ছোট একটি ভূখণ্ডে এত বেশি মানুষের বসবাস বড় রকমের সমস্যা হয়ে দাঁড়িয়েছে। বাংলাদেশের জন্য একটি বিকল্প আবাসনব্যবস্থার প্রয়োজন খুব বেশি। নদীর বুকে ভেসে থাকার অভ্যাস আমাদের পুরোনো। তবে সময়ের প্রয়োজনে আন্ডারওয়াটার লিভিং হতে পারে একটি চমৎকার ধারণা। সব ক্ষেত্রে না হোক যেসব ক্ষেত্রে স্বল্পমেয়াদি সময় কাটানোর দরকার হয়, সেসব ক্ষেত্রে এভাবে আবাসনের ব্যবস্থা করা যায়। আন্ডারওয়াটার লিভিং বলতে আমরা যদি পানির মধ্যে ডুবে থাকা বোঝাতে চাই তাহলে তা নিঃসন্দেহে ভীতিকর, কষ্টদায়ক ও অসম্ভব ব্যাপার। কিন্তু আধুনিক প্রযুক্তি, মানুষের উদ্ভাবনী চিন্তা, নতুন নির্মাণকৌশল আন্ডারওয়াটার লিভিংকে বরং আকর্ষণীয় ও লোভনীয় করে তুলেছে। আমাদের দেশের প্রেক্ষাপটে আন্ডারওয়াটার লিভিং একটি প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ হতে পারে পর্যটনশিল্পের জন্য। কক্সবাজার ও কুয়াকাটা সমুদ্রসৈকত বিশ্বব্যাপী পরিচিত দুটি জনপ্রিয় পর্যটন স্পট। ছোট হলেও পর্যটনে বাংলাদেশের বৈদেশিক আয়ের একটা উৎস এখন কক্সবাজার ও কুয়াকাটা। এ ছাড়া আছে বিশ্বের বৃহত্তম ম্যানগ্রোভ বন সুন্দরবন। বিভিন্ন উৎসবে ও ছুটির দিনে মানুষ ভিড় করে এ সব জায়গায়। আগ্রহী পর্যটকদের থাকার জায়গা দেওয়া বড় সমস্যা। বাড়তি মানুষের চাপ সামলানোর জন্য সমুদ্রসৈকতে একের পর এক বহুতল হোটেল, মোটেল, রিসোর্ট তৈরি হচ্ছে। নষ্ট হচ্ছে নির্মল পরিবেশ ও প্রাকৃতিক সৌন্দর্য। ইট-পাথর কংক্রিটের জঙ্গল তৈরি করতে গিয়ে নির্বিচারে উজাড় হচ্ছে গাছপালা, উঁচু-নিচু পাহাড়ি ভূমি, বিরল জীববৈচিত্র্য। প্রকৃতির ভারসাম্য নষ্ট হয়ে প্রকৃতি হয়ে পড়ছে সৌন্দর্যহীন।

আন্ডারওয়াটার লিভিং হতে পারে এর একটি চমৎকার বিকল্প। সমুদ্রসৈকতে যে বিশাল আকৃতির ভবনগুলো গড়ে উঠছে, এর একটা অংশ পানির নিচে চলে যেতে পারে। বিশাল প্রাকৃতিক বনকে ক্ষতিগ্রস্ত না করে অদূরে জলাশয়ের নিচে থাকার ব্যবস্থা করা যেতে পারে। সাধারভাবে দেখা যায় দর্শনার্থীরা সারা দিন ঘোরাফেরা ও ভ্রমণে ব্যস্ত থাকে। রাতের ঘুমানো কিংবা বিশেষ প্রয়োজন ছাড়া হোটেলে ফেরার তেমন কোনো তাড়া থাকে না। এসব দর্শনার্থীরা আন্ডারওয়াটার রিসোর্টে সময় কাটাতে কোনো আপত্তিই করবে না। বরং নতুন একধরনের অভিজ্ঞতা তারা আগ্রহের সঙ্গে লুফে নেবে। পাশের দেশ মালদ্বীপে এ রকম একাধিক আন্ডারওয়াটার রিসোর্ট তৈরির কাজ চলছে।
বর্তমানে বিশ্বব্যাপী যেসব আন্ডারওয়াটার রিসোর্টের ডিজাইন হচ্ছে, সেগুলো সাধারণত পানির ওপরে এবং নিচে দুটি অংশের সমন্বয়ে হচ্ছে। থাকার ব্যবস্থা হয় পানির নিচের অংশে ভাসমান অবস্থায়। ওপরের অংশ অন্য যেকোনো হোটেলের মতোই স্বাভাবিক এবং সবার জন্য খোলা। সব ধরনের সামাজিক ও বিনোদনমূলক অনুষ্ঠানের ব্যবস্থা, বৃহদাকার পার্ক, খেলার মাঠ, মসজিদ, বাজার, মুক্তমঞ্চ এমনকি হেলিপ্যাডও পরিকল্পনায় রয়েছে।
এমন সুযোগ-সুবিধা আজ হোক কাল হোক আমাদের দেশের মানুষও পানির নিচে উপভোগ করতে আগ্রহী। প্রযুক্তি দিনে দিনে আরও সহজতর হবে। আন্ডারওয়াটার লিভিং আপাতত একটু ব্যয়বহুল মনে হলেও বিজ্ঞানী ও প্রকৌশলীরা বলছেন খুব তাড়তিাড়িই তা মানুষের হাতের নাগালে চলে আসবে। পানির নিচে রীতিমতো জনবহুল কলোনি তৈরি হতেও বেশি দেরি নেই। আর এমনিভাবেই পানির নিচে ভিন্ন এক আবাসের স্বপ্ন দেখছে স্বপ্নভুক আগামীর মানুষেরা।
স্থপতি খালিদ মাহমুদ
প্রকাশকাল: বন্ধন ৫৪ তম সংখ্যা, অক্টোবর ২০১৪