রিও প্রকৃতি যাকে সাজিয়েছে আপন স্নিগ্ধতায়; উজাড় করা অপার সৌন্দর্যে। যে সৌন্দর্যে বিমোহিত হয়ে পর্যটকেরা দলে দলে ভিড়ছে ব্রাজিলের বিখ্যাত শহর রিও টেকলস ফেভিলাস এ (Rio Tackles Favelas)। কয়েক দিন আগেও যা ছিল মূর্তিমান আতঙ্ক, প্রতি মুহূর্তেই যেখানে ঘটত ভয়ঙ্কর সব অপরাধ। নিজেদের মধ্যে মারামারি, মাদক ব্যবসা, খুন, ছিনতাই যেখানকার নিত্য অনুষঙ্গ, আর সে শহরেই কি না পর্যটকদের নির্ভীক পদচারণা। অবিশ্বাস্যই বটে! চাঁদের কলঙ্কের মতোই রিওর স্নিগ্ধ প্রকৃতির মাঝেই বিশাল বস্তি। বস্তির ঘিঞ্জি পরিবেশ আর কর্মহীনতা এখানকার বাসিন্দাদের দিন দিন করে তুলেছে অপরাধী। তবে রিও তাঁর অবাধ্য সন্তানদের এমনই সুবোধ করেছে যে তারা আজ শহরটির জন্য হুমকি তো নয়ই, বরং সমৃদ্ধির প্রতীক। ব্রাজিল সরকার পর্যটন উন্নয়নে রিওতে গড়ে তোলে বিশ্বের সবচেয়ে বড় কেব্ল কার সিস্টেম। যোগাযোগের সর্বাধুনিক ও আকর্ষণীয় এ মাধ্যমটি শুধু পর্যটনেই ভূমিকা রাখেনি, বদলে দিয়েছে রিওবাসীর আটপৌরে জীবনের রংকেও।

বিশ্ব অর্থনীতিতে ব্রাজিল বড় শক্তি। বিশ্বখ্যাত বন আমাজান, নদী, সমুদ্র, পাহাড়, জীববৈচিত্র্য, সংস্কৃতি, খেলাধুলা কী নেই ব্রাজিলে! দেশটির সরকার এই সম্পদগুলোকে কাজে লাগিয়ে কীভাবে পর্যটনশিল্পের তথা দেশের অর্থনৈতিক উন্নয়ন করা যায় সে পরিকল্পনাই ফাঁদছিল দীর্ঘদিন ধরে। ব্রাজিলের সর্বত্রই অনিন্দ্য প্রাকৃতিক সৌন্দর্য থাকলেও রিওর তুলনায় যা নগণ্যই। দেশটির পরিকল্পনাবিদেরা এ জনপদকে ঘিরেই পর্যটন জোন ও অবকাঠামো নির্মাণ উত্তম বলে রায় দেয়। কিন্তু যেখানে প্রতিদিন ঘুম ভাঙে গ্যাং ফাইটারদের গুলির শব্দে সেখানে পর্যটনকেন্দ্র গড়ে তোলা হলে আগত পর্যটকেরা পড়বে ভয়াবহ বিপদে, যা হবে দারুণ আতঙ্কের। কর্তৃপক্ষ উদ্যোগী হয় সমস্যাটি সমাধানে। অনুসন্ধানে জানা যায়, রিও টেকল্স ফেভিলাসের বিশাল বস্তিতে বাস করে প্রায় দেড় লাখ মানুষ। আদতে এই বৃহৎ জনগোষ্ঠীর জীবিকা নির্বাহের মতো নেই কোনো কর্মসংস্থান। তারা যে অন্যত্র গিয়ে কাজ করবে নেই সে উপায়ও। কারণ বস্তির পরিবেশ এতটাই ঘিঞ্জি, সেখানে পাকা সড়ক নির্মাণ একেবারেই অসম্ভব। সড়ক না থাকায় চলে না কোনো যানবাহনও, তাই পায়ে হাঁটা ছাড়া শহরে যাওয়ার অন্য কোনো উপায় নেই। আবার কাছের শহরে যেতে এতটাই সময় লাগে যে কাজ শেষে ফিরে আসাটাই কষ্টকর। তারপরও কেউ যদি যায় তবে সে পড়বে ছিনতাইকারীর কবলে নয়তো দুই পক্ষের গোলাগুলির মধ্যে পড়ে ঘটবে প্রাণ সংশয়। কাজ না থাকায় তরুণ প্রজন্ম ক্রমেই জড়িয়ে পড়ে মাদক ব্যবসা আর চোরাকারবারিতে। ক্ষিপ্র ও হিংস্রতা যেন তাদের স্বভাবজাত। মাদক ব্যবসায়ীরা এতটাই শক্তিশালী যে তাঁদের দমনে ব্যর্থ পুলিশও। শেষে মোতায়েন করা হয় সেনাবাহিনী। কিন্তু এভাবে কত দিন? এদের কাজে লাগানোর পূর্বশর্ত জীবনমান ও জীবিকার উন্নয়ন। যার প্রধান শর্ত উন্নত যোগাযোগব্যবস্থা। কেন্দ্রীয় মিউনিসিপ্যাল গভর্নমেন্ট ফেভিলাসের বিশাল জনগোষ্ঠীকে উন্নত নাগরিকসুবিধা দিতে উদ্যোগী হয়। উপায় হিসেবে বেছে নেয় যোগাযোগব্যবস্থা ও অবকাঠামো নির্মাণকে। যেহেতু রিও পাহাড়ি এলাকা, তাই এমন যোগাযোগব্যবস্থা গড়ে তুলতে হবে, যাতে এখানকার অধিবাসীরা খুব সহজেই আসা-যাওয়া করতে পারে এ শহর থেকে অন্য শহরে। দেশটির বাঘা বাঘা প্রকৌশলীর ওপর দেওয়া হয় এ গুরুদায়িত্ব। গবেষণা শেষে রিওর বৈশিষ্ট্য অনুযায়ী কেব্ল কার নির্মাণই উপযোগী বলে মত দেন বিশেষজ্ঞরা। যেমন ভাবনা তেমন কাজ। অপেক্ষা শুধু নির্মাণ শেষের।

২০১১ সালে শুরু হয় কেব্ল কার স্থাপনের বিশাল নির্মাণযজ্ঞ। প্রকল্পটি ব্রাজিল একলারেটেড গ্রোথ প্রোগ্রামের অধীনে সম্পূর্ণ রাষ্ট্রীয় একটি উদ্যোগ। বিখ্যাত স্থপতি জর্জ মারিও জারগুই এই কেব্ল কারের ডিজাইনার। এ ধরনের কেবল সিস্টেম কারের স্থানীয় নাম টেলিফেরিকো (Teleferico)। এটা এমনভাবে ডিজাইন করা, যাতে লক্ষাধিক মানুষের যাতায়াত চাহিদা মেটানো যায় সহজেই। লালরঙা কেব্ল কারের প্রতিটিতে রয়েছে আটটি করে আসন। কিছুক্ষণ পরপর কারগুলো নির্দিষ্ট স্টেশন অর্থাৎ রিওর সেন্তিটাউন থেকে ছেড়ে যায়। সবগুলো টেরিফেরিকো মিলে দিনে অন্তত ৩০ হাজার যাত্রী পরিবহন করে। আর এ জন্য এই যানগুলোকে পাড়ি দিতে হয় ১৫ কিলোমিটার বা নয় মাইল ঝুলন্ত পথ। এর নির্দিষ্ট দূরত্বে রয়েছে ছয়টি স্টপেজ। স্টেশনগুলো স্থাপন করা হয়েছে ছয়টি উঁচু পাহাড়ের চূড়ায় যেখানে এক স্টপেজ থেকে আরেক স্টপেজে হেঁটে যেতে সময় লাগে ঘণ্টারও বেশি, কেব্ল কারে, যা অতিক্রম করা যায় মাত্র ২০ মিনিটে। প্রতিদিন সকাল ছয়টা থেকে রাত নয়টা পর্যন্ত চলে এই টেলিফেরিকো। স্থানীয় বাসিন্দারা বিনা পয়সায় দিনে একবার এ কারে যাওয়া-আসা করতে পারে। তবে এর বেশি হলে ট্রিপপ্রতি গুনতে হয় এক ব্রাজিলিয়ান রিয়াল (Brazilian Real) বা ৪০ সেন্ট। অবশ্য পর্যটকদের গুনতে হয় বাড়তি অর্থ। তবে অর্থটা খুব বেশি নয়, মাত্র আড়াই ডলার। যাত্রীদের সহযোগিতা ও সেবাদানের জন্য লালরঙা কেবিনে থাকেন নীল পোশাকধারী সহায়তাকারী। এ ছাড়া এই কেব্ল কার সিস্টেমের নিরাপত্তা নিশ্চিত ও যান্ত্রিক ত্রুটি নিরসনে সর্বদা নিয়োজিত রয়েছে একদল নিরাপত্তাকর্মী ও দক্ষ টেকনিশিয়ান। ঝুলন্ত কার ও তারগুলো নিয়মিত পর্যবেক্ষণ করেন তাঁরা। ফলে এই ঝুলন্ত যাতায়াতব্যবস্থাটি এখনো পর্যন্ত দুর্ঘটনা ও ঝুঁকিমুক্ত জনপ্রিয় যোগাযোগ মাধ্যম।

ব্রাজিলের প্রকৌশলীরা এই কেব্ল কার সিস্টেমের সফলতা নিয়ে গর্ব করতেই পারে। কিন্তু এর নির্মাণপ্রক্রিয়া কিন্তু সহজ ছিল না। দেশটির প্রকৌশলীদের জন্য এটি ছিল প্রথম ও বড় কোনো ঝুলন্ত যোগাযোগ প্রকল্প। এখানকার অদ্ভুতুড়ে আবহাওয়া, মানে এই মুষলধারে বৃষ্টি আবার এই প্রখর রৌদ্র। তাপমাত্রা কখনো সহনীয় কখনো বা ৪০ ডিগ্রিরও ওপরে। তবে পাহাড়ি এলাকায় বন্যা ও হড়কা বান (Flash Flood) উপেক্ষা করে কাজ চালিয়ে যাওয়াটাই কঠিন। যদিও প্রকৌশলীরা এসব মোকাবিলা করে নির্মাণে অভ্যস্ত ও দক্ষ, তবুও ছিল পারিপার্শ্বিক সমস্যাও। এখানকার বাড়িগুলো এতটাই গায়ে গায়ে লাগানো যে প্রকৌশলীদের রীতিমতো কসরত করতে হয়েছিল। বাড়িগুলোর কাঠামো দুর্বল হওয়ায় চিলেকোঠার ওপর দিয়ে কেব্ল তার টানতে হয়েছিল খুব সতর্কতার সঙ্গে, যা দৈর্ঘ্যে ছিল প্রায় ৩০ মিটারের ওপরে। স্টেশন তৈরি, থাম নির্মাণ, কেবল স্থাপন ও তার ভারবাহী ক্ষমতা নিশ্চিতকরণের মতো চ্যালেঞ্জিং কাজগুলো বেশ সফলভাবেই সম্পন্ন করেছিলেন তাঁরা। আর এভাবেই একটি যুগোপযোগী নির্মাণের মাধ্যমে বদলে দিয়েছিলেন বঞ্চিত এক জনপদের অর্থনীতি ও জীবনমানের চিরচেনা দৃশ্যপট।

তবে সমালোচনাকারীরা প্রকল্পটির নির্মাণব্যয় নিয়ে প্রশ্ন তুলতে ছাড়েনি। কারণ প্রকল্পটির বাস্তবায়নে ১১০ মিলিয়ন মার্কিন ডলার ব্যয় হয়েছে, যার জোগান এসেছে দেশটির ডেভেলপমেন্ট ফান্ড থেকে। এর জন্য অনেক খাতই বঞ্চিত হয়েছিল উন্নয়ন থেকে। তবে সমালোচনাকারীদের মুখ খুব দ্রুতই বন্ধ হয়ে যায় যখন প্রকল্পটি অভাবনীয় সাফল্যের মুখ দেখে। বিশেষ করে রিওর অধিবাসীরা অপরাধ ছেড়ে যখন নিজ নিজ কাজে ব্যস্ত হয়ে পড়ে, যা দেশটির জাতীয় অর্থনীতিতে রাখছে উল্লেখযোগ্য অবদান। ব্যবস্থাটি আমূল বদলে দিয়েছে এ অঞ্চলের শিক্ষা, স্বাস্থ্যসহ মানব উন্নয়নের সূচককেই। রোগীদের উন্নত সেবা প্রদানে দ্রুততার সঙ্গে হাসপাতালে নেওয়া যেমন সহজ হয়েছে, তেমনি বস্তিবাসীর জীবনমান উন্নয়নে চলছে নানা কর্মমুখী প্রশিক্ষণ। তবে এসব ছাপিয়ে জনপদটি এখন অনেকটাই সন্ত্রাস ও মাদকমুক্ত। বড় সুসংবাদ রিও এখন বিশ্বখ্যাত অন্যতম পর্যটন নগর।
মানবজাতির উদ্ভাবন শক্তির ক্ষমতা অসীম, যা বিশ্বকে পাল্টে দিতে পারে অবিশ্বাস্য দ্রুততায়। একটি কেব্ল কার কীভাবে একটি জনপদের জীবনমান পরিবর্তন করে তা রিও টেকল্সকে না দেখলে বিশ্বাস করা কঠিন। আগে যেখানে মানুষের ঘুম ভাঙত গুলির শব্দে আর এখন ঘুমানো যায় দুয়ার খুলে। আধুনিকতম এই যোগাযোগ মাধ্যমটি এনেছে নতুন এক সভ্যতা। রিও-এর বাসিন্দাদের করেছে সভ্য। তবে আগে যারা রিওর ভয়ঙ্কর পরিস্থিতি দেখেনি, তারা বুঝতে পারবে না কেন শহরটি ছিল এত বিপদসংকুল। মাদকের স্বর্গরাজ্যে এখন সৌন্দর্যপিপাসু পর্যটকের আনাগোনা। প্রচুরসংখ্যক পর্যটক আসায় এর সুফল পাচ্ছে স্থানীয় বাসিন্দারা। তাদের জন্য এখানে গড়ে উঠেছে হোটেল, মোটেল, বিনোদন কেন্দ্র, শপিংমলসহ নানা স্থাপনা। বিশ্বের অন্যতম পর্যটকপ্রিয় স্থানটি উন্নত হওয়ার বেড়েছে এখানকার জমির দামও। আয়তনে তিনগুণ বেড়েছে শহরটির পরিসর। ফলে বস্তির পরিবেশও বদলেছে। নির্মিত হয়েছে আধুনিক সব স্থাপনা আর ঘরবাড়ি। পর্যটন স্পটে পরিণত হয়েছে রিও। আগের প্রজন্মের কাছে যা ছিল অকল্পনীয়। বদলে যাওয়া এ রিও যাতায়াতকে করেছে সহজ ও নিরাপদ। কবির ভাষায়, নগণ্যকে করেছে মহান।

রিওর সেন্তিটাউন যেন হাজার বছরের বন্দিদশা থেকে মুক্তি পেয়ে মেলেছে ডানা। তবে নিজে না উড়ে উড়িয়েছে মানবসভ্যতাকে। সদ্য সমাপ্ত ফুটবল বিশ্বকাপ উপভোগে আগত দর্শনার্থীদেরও শূন্যে ভাসার আনন্দে ভাসিয়েছে রিওর টেলিফেরিকো। দর্শনার্থীরা ঝুলন্ত এই কারে চড়েই পাখির চোখে দেখেছে রিওর অকৃত্রিম সৌন্দর্য। যোগাযোগের ঝুলন্ত এই মাধ্যমটি তার উপযোগিতার কারণে ক্রমেই হয়ে উঠছে জনপ্রিয়। বিশ্বে যখন নিঃশেষ হয়ে আসছে জ্বালানি তখন এই প্রযুক্তি দেখাচ্ছে সম্ভাবনার হাতছানি। এত দিন পাহাড়-পর্বত-বৃক্ষ কেটে নির্মিত সড়ক পরিবেশকে কেবল হুমকির মুখেই ফেলেছে। অথচ পরিবেশের কোনো ক্ষতি না করেই ঝুলন্ত এই যোগাযোগ মাধ্যমটি প্রকৃতির সঙ্গে গড়েছে দারুণ সহাবস্থান। ঝুলন্ত কারের এ প্রযুক্তিটি যোগাযোগের জটিল অঙ্ক কষা বিশেষজ্ঞদের বুঝিয়েছে ভূপৃষ্ঠ যতই অমসৃণ হোক, শূন্যময় অবারিত দিগন্ত ঠিক ততটাই মসৃণ।
মারুফ আহমেদ
প্রকাশকাল: বন্ধন ৫৩ তম সংখ্যা, সেপ্টেম্বর ২০১৪