স্বাধীনচেতা এক স্থপতির গল্প

স্থাপত্য শুধু একটি ভবন ডিজাইন নয়। স্থাপত্য একটি নীরব শিল্প, যা প্রকৃতির সাথে মানুষের আত্মার বন্ধনকে দৃঢ় করে। এটা সঙ্গীতের মতো, অবচেতন মনকে আন্দোলিত করে। স্থাপত্যের আলৌকিক ক্ষমতা আছে যা একটি সমাজ বা দেশের অর্থনৈতিক ও সামাজিক পরিবর্তন করার প্রেরণা হতে পারে। স্থাপত্যকলা বিষয়টা এমন যাকে জীবন্ত মনে হবে। এর সাথে আপনার আত্মিক বন্ধন তৈরি হবে। আপনি তার সাথে কথা বলবেন, প্রতিটি অনুভুতি ভাগ করে নিবেন। আমরা বাড়িকে শুধু বাসগৃহ মনে করি। কিন্তু এটা তার চেয়েও বেশি কিছু। এটি একটি পরিবারের সবচেয়ে আপন জায়গা। প্রতিটি সদস্যের নিশ্চয়তা, ভাললাগা, অনুভ‚তি এবং বন্ধনের জায়গা। ভিন্ন ভিন্ন স্থাপত্যিক সৌন্দর্য দেখে আপনার বিশ্বাস, অনুভুতি ও ধারণা বদলাতে থাকবে। স্থাপত্য তখনই সফল হবে যখন তা আপনাকে স্বপ্নের অনুভুতি দেবে। কেন এত ভাল লাগছে তা শুধু অনুভব করতে পারবেন; কিন্তু মুখে বলতে পারবেন না। শুনছিলাম মন্ত্রমুগ্ধ হয়ে। কথাগুলো বলছিলেন এদেশের স্বনামধন্য একজন স্থপতি শেখ আহসান উল্লাহ মজুমদার। একজন মানুষের জীবন যে কতটা বর্ণিল হতে পারে সে গল্পটিই জানাব পাঠকদেরকে।

স্থপতি হিসেবে তার সুনাম দেশের গণ্ডি ছাড়িয়ে ছড়িয়ে পড়েছে বিশ্বময়। জন্ম ১৯৬৭ সালের ১০ জানুয়ারি ঢাকার আজিমপুরে। পিতার নাম শেখ আমান উল্লাহ মজুমদার ও মা হাজেরা খাতুন। ওয়ারী হাইস্কুল থেকে ১৯৮২ সালে এসএসসি এবং ১৯৮৪ সালে নটরডেম কলেজ থেকে এইচএসসি পাস করেন। এরপর বাংলাদেশ প্রকৌশল ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ে (বুয়েট) থেকে ১৯৯২ সালে ব্যাচেলর অব আর্কিটেক্ট পরীক্ষায় কৃতিত্বপূর্ণ ফলাফলের স্বীকৃতিস্বরূপ হাবিবুর রহমান স্কলারশিপ এবং ২০০০ সালে মাস্টার্স অব আর্কিটেক্ট এ একই কারণে আহসানুর রহমান গোল্ড মেডেল’ পান। ২০০০-০২ সালে টোকিও ইউনিভার্সিটি অব ফাইন আর্ট অ্যান্ড মিউজিক এ পোস্ট গ্রাজুয়েট ডিগ্রি লাভ করেন। সেখানে তিনি জাপান সরকারের ডক্টর অব আর্কিটেক্টার বিষয়ক স্কলারশিপ অর্জন করেন। দেশে ও বিদেশে বিভিন্ন প্রতিযোগিতায় অংশ নিয়ে শুধু পুরস্কারই পাননি, এদেশের ভাবমূর্তিকেও করেছেন উজ্জ্বল। বর্তমানে তিনি ইনিস্টিটিউট অব আর্কিটেক্টস বাংলাদেশের একজন সক্রিয় সদস্য এবং বাংলাদেশ প্রকৌশল ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ে (বুয়েট) স্থাপত্য বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক হিসেবে কর্মরত আছেন।

মেটারনিটি হাসপাতাল

ছেলেবেলা কেটেছে ঢাকার আজিমপুরে। বাল্যকাল থেকেই স্বাধীনচেতা। সেই ছোট্ট বয়সেই এখানে সেখানে ঘুরে বেড়ানো ছিল রীতিমত তার নেশা। সাধারণ মানুষের জীবনাচরণ, তাদের বিভিন্ন কাজ তাকে মন্ত্রমুগ্ধ করে রাখত। পায়ে হেটেই স্কুলে যাওয়া আসা করতেন। যেতে পথে বিভিন্ন পেশাজীবী মানুষের কাজ তার নজর কাড়ত। ইলেট্রিক মিস্ত্রি কিভাবে ঘড়ি ঠিক করে, সুতোর মিস্ত্রি কিভাবে কাঠের উপর নকশা করে, কামার কিভাবে ছুরি, কাচিসহ নানারকম লোহার জিনিস তৈরি করে, কিভাবে সাইকেল মেরামত করা হয় ইত্যাদি বিষয়গুলো গভীর বিস্ময় নিয়ে দেখতেন এবং বাসায় এসে এ সবের মিনিয়েচার বা প্রটোটাইপ ডিজাইন তৈরি করতেন। বন্ধুরা যখন দোকান থেকে কেনা খেলনা দিয়ে খেলত, তিনি তখন নিজের খেলনা নিজেই তৈরি করতেন। সে সময়ে পুরান ঢাকার দয়াগঞ্জে হিন্দু পাড়াতে মাটি দিয়ে প্রতিমা তৈরি হতো। খড়, মাটি, বাঁশ ইত্যাদি দিয়ে এত সুন্দর প্রতিমা গড়া যায় এটাও তার কাছে ছিল বিস্ময়ের। সেটা দেখে বাসায় এসে নিজেই চেষ্টা করতেন ছোট ছোট ভাস্কর্য গড়ার। স্কুলের পাশেই ছিল একটি পানের দোকান। দোকানি সেখানে আগত মানুষের ছবি আঁকতেন। অবাক বিস্ময় নিয়ে দেখতেন সাধারণ একটি পেন্সিল দিয়ে কিভাবে হুবহু মানুষের প্রতিকৃতি আঁকা যায়। এছাড়াও বিভিন্ন আর্টের দোকানে গ্রামীণ দৃশ্য, রিকশা পেইন্ট, সিনেমার ব্যানার তাকে বেশ আকর্ষণ করত। ক্লাসের বইগুলোতেও থাকত নানা ধরনের ছবি। এসব কিছু দেখেই ছবি আঁকতে শেখা। কিন্তু ছবি ছবি আঁকতে প্রয়োজন রঙ, তুলি, ক্যানভাসসহ নানান সরঞ্জাম। সেই উপকরণগুলো সংগ্রহের পথও বের করেন। স্কুলের সামনে ছিল কিছু স্টেশনারি দোকান। সেখানে বিভিন্ন অনুষ্ঠান উপলক্ষে হাতে তৈরি শুভেচ্ছা কার্ড বিক্রি হতো।

যেহেতু ডিজাইন করে কাজ করতে পছন্দ করতেন, সে কারণে দোকানিকে কার্ডগুলো বানিয়ে দেয়ার প্রস্তাব দিলেন। নয়াবাজার থেকে পুরাতন কাগজ কিনে কার্ড তৈরি করতেন। দামে বেশ সস্তা ছিল বলে তা দিয়ে অনেক কার্ড তৈরি করা যেত। একটা কার্ডে লাভ হত ৫০ পয়সা বা কিছু কমবেশি। এভাবেই আয়ের শুরু। মাস শেষে এতে ৭-১০ টাকা মুনাফা থাকত। তবে তখনকার সময়ে স্কুলে পড়া একটি ছেলের কাছে এটা ছিল অনেক টাকা। সেই টাকা দিয়েই কিনতেন রঙ। রঙ কিনলেও ভালমানের তুলি পাওয়াটা সহজ ব্যাপার ছিল না। তাই তুলি বানাতে বাধ্য হয়ে সেলুন থেকে মানুষের নরম চুল সংগ্রহ করতেন। বিপত্তির কিন্তু এখানেই শেষ নয়। সেটা লাঠির সাথে আটকাতে কন্ডেস মিল্কের কৌটা কেটে ভালভাবে র‍্যাপিং করে দিতেন। মোটামুটি তুলির মতো কাজ ভালই চলে যেত। সেই রঙ তুলি দিয়ে ছবি আঁকিয়ে পেয়েছেন বেশ কিছু জাতীয় ও আন্তজার্তিক পুরস্কার। পরবর্তীতে কাঠ কেটে বিভিন্ন ধরনের ছবির ফ্রেম তৈরি করতেন। মজার ব্যাপার হলো কিছুদিন আগে তিনি গিয়েছিলেন আমেরিকাতে। সেখানে একটি হবিলবির দোকানে তিনি দেখেন তার সেই ছোট বেলায় করা বিভিন্ন ডিজাইনের ফ্রেমের আদলের ফ্রেম সেখানে বিক্রি হচ্ছে। একজন স্কুলপড়–য়া ছেলের পক্ষে নিজের শখগুলো মেটানো সহজ কোনো ব্যাপার নয়, তা ঠিকই বুঝেছিলেন তিনি। প্রয়োজনগুলো মেটাতেই এ ধরনের বিভিন কর্মকাণ্ড করতেন। এছাড়াও বিভিন্ন প্রতিযোগিতায় অংশ নিয়ে জিতে নিতেন নানা পুরস্কারের পাশাপাশি প্রাইজ বন্ড, যার প্রাইজ মানি ছিল বেশ ভালই। তবে শুধু দেশেই নয় আন্তর্জাতিক প্রতিযোগিতায়ও অংশ নিতেন। ১৯৭৯ ইউনেস্কো এজুকেইশন লীগ ইন জাপান কর্র্র্তৃক আয়োজিত প্রতিযোগিতায় তার দুটি ছবি অংশ নেয়। একটি পায় স্বর্ণ ও অপরটি রৌপ্য পদক। এরপর কোরিয়া, ফ্রান্সসহ বিভিন্ন দেশের নানা প্রতিযোগিতায় অংশ নিয়েছেন। ১৯৭৮ সালে নয়াদিলি­তে আয়োজিত শংকর আন্তর্জাতিক শিশু প্রতিযোগিতাতে জওহরলাল নেহেরু মেমোরিয়াল গোল্ড মেডেল পান। ১৯৭৯ সালেও তিনি একই প্রতিযোগিতায় ২য়, পরের বছরও ২য় এবং দুই বছর পর, পর পর দুবার রৌপ্য পদক অধিকার করেন। ১৯৮০ সালে ইংল্যান্ডে আয়োজিত কমনওয়েলথ এক্সিবিউশনে সার্টিফিকেট অব মেরিট ইন ইয়াং আর্টিস্ট লাভ করেন। ১৯৮২-৮৩ সালে জাপানে আয়োজিত ১২ ও ১৩তম আন্তর্জাতিক শিশু প্রতিযোগিতাতে তাম্র পদক লাভ করেন।

১৯৮১ সালে জাতীয় শিশু প্রতিযোগিতায় ভাস্কর্যে স্বর্ণ পদক, জল রঙ ও পেন্সিল স্কেসে স্বর্ণপদক পান। ১৯৮০ সালে শহীদ মতিউর শিশু প্রতিযোগিতায় বিশেষ পুরস্কার, জাতীয় শিশু প্রতিযোগিতায় জল রঙ ও পেন্সিল স্কেসে যথাক্রমে  রৌপ্যপদক ও স্বর্ণপদক লাভ করেন। ১৯৭৮ সালে জাতীয় চিত্রাঙ্কন প্রতিযোগিতায় প্রথম এবং বিটিভির নতুন কুঁড়ি প্রতিযোগিতায় ২য় স্থান লাভ করেন। এসবের সুবাদেই বিভিন্ন দেশের ছেলেমেয়েদের সাথে মেশার সুযোগ হয়। তবে তার মনে হয়েছে আমাদের দেশের ছেলেমেয়েরা তাদের তুলনায় অনেক বেশি মেধাসম্পন্ন। এখনো মনে হয় এদেশটি সকল সম্ভাবনার দেশ। কলেজ বা বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়াকালীন নিত্যনতুন উদ্যোগ গ্রহণ করেছেন।  ছাত্র পড়াতেন, বিভিন্ন দ্রব্য তৈরি করে দোকানে দিতেন। এভাবেই আয়টা তার ভালই হতো। তিনি যখন বুয়েটের ছাত্র তখন বাংলাদেশে রিয়েল এস্টেট ডেভেলপমেন্ট ব্যবসা যাত্রা শুরু করে। এ সময়টা তারা বিভিন্ন স্থাপত্যের প্রেজেন্টেশন ড্রইং সিঙ্গাপুর, থাইল্যান্ডসহ প্রভৃতি দেশ থেকে করে আনতেন। তিনি কিছু প্রতিষ্ঠানকে সমমানের এমন সব কাজ অর্ধেক মূল্যে করে দেয়ার প্রস্তাব দেন। সাড়াও পান ভালো। নতুন উদ্যমে কাজ শুরু করেন। বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানকে প্রতি মাসে প্রায় ১০টি কাজ করে দিতেন। এছাড়াও বাংলাদেশ টেলিভিশনে স্মরণীয় নামে একটি অনুষ্ঠান করতেন। এসব কাজের মাধ্যমেই চেষ্টা করতেন অর্থ সংগ্রহের। এ অর্থ দিয়েই বিভিন্ন দেশে ভ্রমণ, সেমিনার ইত্যাদি করতেন। তবে এসবে পড়াশুনার কোন ক্ষতি যে হয়নি তা তার ঈর্ষণীয় ক্যারিয়ারেই বোঝা যায়। জাপানে স্কলারশিপ নিয়ে গিয়েছিলেন যার বিষয় ছিল মাল্টিমিডিয়া সিস্টেম ডেভেলপমেন্ট’ কিন্তু এটা তার ইন্টারেস্টের বিষয় ছিল না। তবুও সেখানে তিনি প্রথম স্থান অধিকার করেছিলেন। এছাড়াও তিনি স্কাউটিং, রেডক্রস, কচিকাচার মেলা ইত্যাদি নানা সামাজিক ও সেবামূলক সংস্থার সাথে ছোটবেলা থেকেই জড়িত ছিলেন।

উইক এ্যান্ড হাউজ, সাভার

স্থাপত্যকে তিনি দেখেন একজন শিল্পীর সৃষ্টকর্ম হিসেবে। স্থপতির কাজ কি? তার কাজ কি শুধু বিল্ডিং ডিজাইন করা? তিনি তা মনে করেন না। স্থপতিরা সমাজ তথা দেশ উন্নয়নের শিল্পী। একজন আর্কিটেক্ট একটি জাতির ভবিষ্যতকে ডিজাইন করে। ভবিষ্যত প্রজন্মের চাহিদানুযায়ী ভবনের নকশা করে। স্থাপত্য সৌন্দর্যের সঙ্গা আলাদা। স্থাপত্য ইন্দ্রিয় দিয়ে অনুভব করতে হয়। এর শব্দ, ঘ্রাণ, স্পর্শ  মানুষের মনকে আন্দোলিত করে। আমাদের দেশে বেশিরভাগ বাড়ির মেঝে থেকে ছাদের উচ্চতা ১০-১২ ফুট। কিন্তু এদেশের মানুষের গড় উচ্চতা ৫-৬ ফুট। সেক্ষেত্রে এতো উচ্চতার কোনো প্রয়োজন তিনি দেখেন না। এতে সম্পদের অপচয় হয় বলে তিনি মনে করেন। তিনি যখন কোন স্পেস ডিজাইন করেন, তখন সূর্যের আলো, প্রাকৃতিক বাতাস ইত্যাদি কাজে লাগাতে চেষ্টা করেন। ২০০৯ সালে তিনি আফ্রিকার দেশগুলোর জন্যে ফাইট ফর চিলড্রেন আয়োজিত ডিজাইন ফর দি চিলড্রেন নামক একটি আন্তর্জাতিক প্রতিযোগিতায় ১ম স্থান লাভ করেন, যেখানে বিশ্বের প্রায় ৩০০টি প্রতিষ্ঠান ও ১৫২ জন খ্যাতনামা স্থপতি অংশগ্রহণ করেন। যেখানে প্রথম ২৫ জন বিজয়ীর মধ্যে এশিয়া মহাদেশের আর কোনো দেশের বিজয়ী ছিল না। এটি ছিল বেশ চ্যালেঞ্জিং। এটা যেন দীর্ঘস্থায়ী ও তাদের ব্যয়ভার মেটানোর ক্ষমতা থাকে পাশাপাশি তাদের সংস্কৃতির সাথে খাপ খায় এই বিষয়গুলোকে প্রাধান্য দিতে হয়েছিল। তিনি মাটি, কাঠ ও টিনের তৈরি বিশেষ ধরনের খোলামেলা ভবনের ডিজাইন করেছিলেন। যেখানে বাতাস ও আলোর সর্বোচ্চ ব্যবহার সম্ভব ছিল। তাছাড়া তা ছিল একেবারেই কম খরচে। এ ধরনের অ্যাওয়ার্ড বাংলাদেশে এটাই প্রথম। ১৯৯৯ সালে মাল্টিমিডিয়া সিস্টেম ডেভেলপমেন্ট কোর্সের স্বীকৃতিস্বরূপ জাপান সরকার এবং সেন্টার ফর ইন্টারন্যাশনাল কো-অপেরেশন ফর কম্পিউটারাইজেশন অ্যাওয়ার্ড প্রাপ্ত হন। ২০০৯ সালে আর্ক এশিয়া এলাকার স্থাপত্যিক মডেল প্রদর্শন করে প্রশংসামূলক আর্ক এশিয়া অ্যাওয়ার্ড ফর আর্কিটেক্টার-২০০৯-১০ লাভ করেন। এছাড়াও এ বছরেই ওপেন আর্কিটেক্টার চ্যালেঞ্জ: ক্লাশরুম শীর্ষক প্রতিযোগিতায় বিশ্বের এক হাজার প্রতিযোগীর মধ্যে প্রথম ৫২ জনের ফাইনালিস্ট হওয়ার গৌরব অর্জন করেন। ২০০৮ সালে জে কে সিমেন্ট এবং দি ইন্ডিয়ান ইনস্টিটিউট অব আর্কিটেক্ট, (ইন্ডিয়া) কর্তৃক আয়োজিত ১৮তম আর্কিটেক্ট অব দি ইয়ার অ্যাওয়ার্ড লাভ করেন।

১৯৯৩ সালে বিল্ডিং ফিনিশিং ফোরাম, জাপান কর্তৃক আয়োজিত টোকিও MACHIAI স্পেস ডিজাইনে ৩য়, BUFF ইন্টারন্যাশনাল আর্কিটেক্টারাল ডিজাইন কম্পিটিশন এ ৩য় পুরষ্কার লাভ করেন। ১৯৮৯ সালে মিমার (MIMAR) আর্কিটেকচার ইন ডেভেলপমেন্ট, ফ্রান্স কর্তৃক আয়োজিত মিমার ইন্টারন্যাশনাল ডিজাইন কম্পিটিশন VI, বিজয়ী হন। এছাড়াও একই বছরে বাংলাদেশ ইনস্টিটিউট অব আর্কিটেক্টস কর্তৃক আয়োজিত প্রশংসা এ্যাওয়ার্ড এ্যাকুয়া পেইন্ট অ্যান্ড আইসিই টুডে ইন্টেরিয়র ডিজাইন অ্যাওয়ার্ড লাভ করেন। ২০০৭ সালেও একই প্রতিষ্ঠান থেকে বার্জার অ্যাওয়ার্ড ফর এ্যাকসেলেন্স ইন আর্কিটেক্টার পুরস্কার পান। ২০১০ সালে হোলসিম বাংলাদেশ কর্তৃক আয়োজিত হোলসিম গ্রীন বুইল্ট বাংলাদেশ গ্রীন আর্কিটেক্টারের জন্য ১ম পুরস্কার লাভ করেন। ২০১১ সালে বুয়েটের বর্ধিত ভবন ডিজাইনে বিজয়ী হন। সাভারে একটি স্পেস ডিজাইন করেছেন যেখানে প্রকৃতি পেয়েছে তার নিজ ঠিকানা। সেখানে এমন ইকো-ফ্রেন্ডলি পরিবেশ সৃষ্টি করা হয়েছে যেখানে রয়েছে পাখির কলকাকলি, প্রজাপতির অবাধ বিচরণ, সবুজের নীরব মুগ্ধতা। কাজটির স্বীকৃতিস্বরূপ তা আর্ক এশিয়া অ্যাওয়ার্ড লাভ করে। এছাড়াও বিভিন্ন ডিজাইন তিনি করেছেন যেগুলো পেয়েছে কোনো না কোনো স্বীকৃতি।

সান গ্লোরিয়া, ধানমন্ডি

বর্তমানে তিনি ছোট ছোট ছেলেমেয়েদের নিয়ে কাজ করছেন। এর মধ্যে রয়েছে চিল্ড্রেন সেন্টার, স্কুল প্রভৃতি। স্কুলটির নাম স্বপ্ননগর স্কুল। চট্রগ্রামের পাহাড়ি এলাকার স্কুলটিকে স্বপ্নের মত করেই গড়ে তোলা হচ্ছে। গ্রামটিতে প্রায় ৪০-৫০টি পরিবার আছে; কিন্তু কোন স্কুল নেই। তাদের কোনো সম্পদ নেই, বলা যায় প্রায় নিঃস্ব। গ্রামটি কিভাবে নিজেদের আর্থসামাজিক উন্নয়ন করতে পারে, পরবর্তী প্রজš§কে সহায়তা করতে পারে, কিভাবে ওরা স্বপ্ন দেখবে, সর্বোপরি কিভাবে তাদের ভাগ্যের চাকা ঘুরাতে পারবে তাই স্কুলটিতে শেখানো হবে। অবশ্য শিশুদের নিয়ে কাজ করার পেছনে তার উদ্দেশ্যও আছে। তিনি মনে করেন, এদেশের মানুষ খুব মেধাবী; কিন্তু তারা তাদের মেধাকে কাজে লাগাতে পারছে না। যে দেশে মাটিতে বীজ ফেলে রাখলে ফসল জন্মে,  যে দেশে রয়েছে মানবসম্পদসহ নানারকম সম্পদ, সে দেশের মানুষ গরিব থাকার কোনো কারণই নেই। এদেশে জানার সুযোগ আছে। মানুষ এখানে বিনামূল্যে শিক্ষা নেয়, যা বিশ্বের অনেক দেশে কল্পনাও করা যায় না। এখানে সবাই সবাইকে শেখাতে চাই। তবে সবচেয়ে বড় কারণ বাংলাদেশে সত্যিকারের নেতা আসছে। সে শুধু রাজনৈতিক নেতা নয় বরং সব ক্ষেত্রেই। যে নেতা মানুষকে স্বপ্ন দেখাবে, যার সুদুরপ্রসারী পরিকল্পনা থাকবে, যে প্রজন্মকে সামনে এগিয়ে নিয়ে যেতে সাহায্য করবে এদেশে প্রয়োজন সেই নেতা। এদেশের মুক্তির জন্য প্রয়োজন বলিষ্ঠ নেতৃত্ব। তাই তিনি শিশুদের নিয়ে কাজ করছেন যারা ভবিষ্যতের সুনাগরিক হবে এবং এ জাতিকে বিশ্বের দরবারে মাথা উঁচু করে দাঁড়াতে সাহায্য করবে। বাংলাদেশের মানুষ খুবই দয়ালু, সহযোগী, অতিথি পরায়ন। কুমিল্লার ময়নামতির লাইমাই পাহাড় সংলগ্ন একটি গ্রামে ছবি আঁকতে গিয়েছিলেন। ছবি আঁকতে আঁকতে সকাল গড়িয়ে বিকেল হয়ে যায়। তিনি ক্ষুধার্ত বুঝতে পেরে গ্রামটির একটি হতদরিদ্র পরিবার তাকে খাওয়ার জন্য তাদের বাড়িতে নিয়ে যায়। অনিচ্ছা সত্ত্বেও সেখানে যেতে হয়। তারা তার জন্য মুরগি জবাই করে মাংস, পোলাও ইত্যাদির আয়োজন করেছিল। তারা তাকে চেনে না, জীবনে প্রথম দেখেছিল। তাদের আতিথেয়তায় তিনি মুগ্ধ। কিন্তু এত আয়োজন করার সামর্থ্য আসলে তাদের ছিল না। হয়ত জাবাইকৃত ওই মুরগিটি তাদের ডিম দিত। আর কখনো হয়ত দেখাও হবে না। শুধু তাই নয় পথে যেতে যেন ক্ষুধায় কষ্ট না হয় সেজন্য কিছু পিঠাও তৈরি করে দিয়েছিল। তার জন্য যে ত্যাগ স্বীকার তারা করেছে, মনে হয় অন্য কোন দেশের মানুষ হলে এটা করত না। একটি উদাহরণ থেকেই তিনি মনে করেন কেন এদেশের মানুষ গরিব থাকবে। একজন আরেক জনকে যদি সহযোগিতা করা যায় তাহলে দেশটা এমনিতেই উন্নত হবে।

ডিজাইন ফর দি চিলড্রেন, আফ্রিকা

স্থাপত্য ডিজাইনের পাশাপাশি প্রায় ২০ বছর যাবত তিনি শিক্ষকতা পেশায় নিয়োজিত আছেন নান্দনিক তার সব স্থাপত্য, নান্দনিক তার প্রতিটি শিল্পকর্ম। এসব কাজ তিনি করতে সক্ষম হয়েছেন এদেশের সাধারণ মানুষের সাথে মিশতে পেরে। ছেলেবেলা থেকে ভিন্নধর্মী কাজ করার প্রয়াস থেকেই এত সাফল্য পাওয়া সম্ভব হয়েছে। তবে এ কাজে তাকে যিনি প্রেরণা যুগিয়েছেন তিনি তার মা। ছেলেবেলা থেকেই তার সব কিছু মায়ের সাথে শেয়ার করতেন, তিনি তাকে প্রেরণা ও সমর্থন দিতেন। কিন্তু অত্যন্ত দুঃখজনক ব্যাপার তিনি এই কাজগুলোর অনেকটাই দেখে যেতে পারেননি। কিছু মানুষের স্থাপত্য তার প্রেরণার উৎস হয়ে রয়েছে। এদের মধ্যে দাদা বাস্ত, কেঞ্জিয় কুমা, কাতায়ামা, কাজুতোষ, বশিউল হক প্রমুখ। এতকিছুর পরও নিজের স্বপ্নের স্থাপত্য নকশাটি এখনো করতে পারেননি। যে স্থাপত্য মানুষের বোধকে জাগাতে পারবে, তাদেরকে শক্তি দেবে, তাদের কথা, তাদের ভবিষ্যতের কথা বলবে এমন কাজই তিনি করে যেতে চান।

মাহফুজ ফারুক

প্রকাশকাল: বন্ধন ২৬ তম সংখ্যা, জুন ২০১২

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Scroll to Top