রিকেন ইয়ামামোতোর জন্ম ১৯৪৫ সালে, চীনের বেইজিং শহরে। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের কিছুদিন পরেই তাঁর পরিবার জাপানে চলে আসে। ছোটবেলা থেকেই তিনি এমন এক বাড়িতে বেড়ে উঠেছেন, যেটা একই সঙ্গে প্রাইভেট এবং পাবলিক স্পেস নিয়ে কাজ করছিল। বাড়িটির একটি অংশে স্থপতি তাঁর পরিবারের সদস্যদের সঙ্গে থাকতেন। আর বাড়ির প্রথমাংশে ছিল তাঁর মায়ের একটি ফার্মেসি। জাপানি ঐতিহ্য ধারণকারী যে বাড়িগুলো আমরা দেখে থাকি, সে রকমই একটা বাড়ি ছিল এটি। স্থপতি সেই স্মৃতি রোমন্থন করে বলেন, ‘বাড়ির একদিক ছিল পরিবারের জন্য, আরেক দিক ছিল সমাজের জন্য। আর আমি বসে থাকতাম এই দুইয়ের মাঝে।’
ইয়ামামোতো তাঁর বাবা সম্পর্কে সামান্যই জানতেন। কারণ যখন তাঁর বয়স মাত্র পাঁচ বছর, তখন তিনি বাবাকে হারান। বাবা ইঞ্জিনিয়ার ছিলেন বলে সেটাকেই তিনি নিজের পেশা হিসেবে ভাবতে চেয়েছিলেন, পরে অবশ্য নিজের পথ নিজেই তৈরি করে স্থাপত্যবিদ্যাকে বেছে নেন। ১৭ বছর বয়সে তিনি প্রথম কোনো স্থাপনার দ্বারা তাড়িত হন। ‘খুব অন্ধকার হলেই আমি কাঠের টাওয়ারগুলো লক্ষ করতাম। দেখতাম সেখান থেকে চাদের আলো ঝরে পড়ছে। আমার মনে হয়, সেই প্রথম কোনো স্থাপনার সঙ্গে আমার একটা নিবিড় সম্পর্ক তৈরি হয়’, জাপানের প্রাচীন কোফুকুজি প্যাগোডাটি দেখে এই মন্তব্যটি করেন স্থপতি।
১৯৬৮ সালে নিহন বিশ্ববিদ্যালয় থেকে স্থাপত্যবিদ্যায় স্নাতক সম্পন্ন করেন রিকেন। টোকিও ইউনিভার্সিটি অব আর্টস থেকে মাস্টার্স অব আর্টস ইন আর্কিটেকচার ডিগ্রি অর্জন করেন। ১৯৭৩ সালে তিনি নিজের স্থাপত্য প্রতিষ্ঠান রিকেন ইয়ামামোতো অ্যান্ড ফিল্ড শপের কাজ শুরু করেন।

এ বছর স্থাপত্যবিদ্যার সব থেকে বড় পুরস্কার প্রিৎজকারে ভূষিত হন এই স্থপতি। বিশ্বনন্দিত স্থপতি ইয়ামামোতোর কাজগুলো বিশেষভাবে সবার নজর কেড়েছে। কারণ তাঁর প্রকল্পগুলোতে আছে সোশ্যাল অ্যাডভোকেসি এবং পাবিলক ও প্রাইভেট ক্ষেত্রে বিশেষ নজর। বৈষম্য আর বৈচিত্র্যের সীমানা ছাড়িয়ে তাঁর প্রকল্পগুলোতে সামাজিক ভারসাম্য জাহির হতে দেখা যায়। অর্থনীতি, রাজনীতি, ইনফ্রাস্ট্রাকচার এবং হাউজিং সিস্টেমে তাঁর কাজগুলো অনন্য। সামাজিক জীবনমানের উন্নতি সাধন, নাগরিক মানুষের নিজস্ব স্থান সুনিশ্চিত করা এই বিষয়গুলো তাঁর কাজে প্রাধান্য পায়। তিনি একটা সমাজকে ‘একটা জায়গা সবাই মিলে ব্যবহার করা’, এমন একটি ধারণা হিসেবে দেখতে চান। যেমন করে তিনি প্রত্যেকের প্রাইভেসির নিশ্চয়তা প্রদান করতে চান তেমনিভাবে প্রতিবেশীদের মাঝে কোনো সাক্ষাৎ হবে না এই ভাবনাটারও বিরুদ্ধে অবস্থান করেন। ফলে নানা সংস্কৃতি ইতিহাস এবং প্রজন্মের মাঝে সংবেদনশীল সেতুবন্ধন করার লক্ষ্যে তিনি আধুনিক ধারার স্থাপত্য ও নির্মাণপদ্ধতি প্রয়োগে সচেষ্ট থেকেছেন।
‘আমার জন্য একটা স্পেসকে চেনার অর্থ হলো গোটা কমিউনিটিকে চিনতে পারা’, ইয়ামামোতো বলেন। তিনি জাপানিজ ও গ্রিক স্থাপনার ঐতিহ্য দ্বারা দারুণভাবে প্রভাবিত। পাঁচ দশকের দীর্ঘ স্থাপত্যচর্চার এ জীবনে তিনি আবাসিক ভবন থেকে শুরু করে পাবলিক হাউজিং, স্কুল, ইউনিভার্সিটি, সিভিক স্পেস, নগর পরিকল্পনা ইত্যাদি নানা প্রকল্প করেছেন যেগুলো মূলত ছড়িয়ে আছে জাপান, চীন, কোরিয়া ও সুইজারল্যান্ডে। ইয়ামামোতো হলেন ৫৩তম প্রিৎজকার পুরস্কার জেতা একজন স্থপতি। এবং জাপান থেকে তিনি নবম স্থপতি, যিনি এই সর্বোচ্চ সম্মানে ভ‚ষিত হলেন।
স্থপতি রিকেন ইয়ামামোতোর সাত প্রকল্প
ইয়ামাকাওয়া ভিলা, জাপান, ১৯৭৭
মসে ঢাকা চালাওয়ালা ছাদের নিচে আশ্রয়ের নামই হলো ইয়ামাকাওয়া ভিলা। একটা সরুও ঢালু আকারের গ্রীষ্মকালীন বাড়ি এটি। এই বাড়িটি নাগানোর উডোল্যান্ডে অবস্থিত। স্থপতির একদম শুরুর দিকের কাজ এই ভিলা। একটা উন্মুক্ত টেরাস আছে এই বাড়িতে। সেই সঙ্গে দেখা যায় বাড়ির ঘরগুলো বেরিয়ে আসে সরাসরি ভূপ্রকৃতির মাঝে। কিছু ঘুমানোর ঘর আর রান্নাঘর আছে ভিলার পুরো ভলিউমটার মাঝে। ইয়ামামোতো এই ভিলা প্রসঙ্গে বলেন, ‘জঙ্গলের মাঝখানে বেশ কয়েকটি ঘর যারা একে অপরের থেকে বিচ্ছিন্ন এবং একটি একক ছাদ সেগুলোকে ঢেকে রাখে।’

ফিউচার ইউনিভার্সিটি অব হাকোডাতে, জাপান, ২০২০
ইয়ামামোতো যখন এই ইউনিভার্সিটি ডিজাইন করেন তখন ভেতরের স্পেসের স্বচ্ছতা বৃদ্ধি করতে বেশির ভাগ জায়গায় তিনি গ্লাস ব্যবহার করেন। এই ইউনিভার্সিটি ইনফরমেশন সায়েন্সের জন্য উৎসর্গিত। এই বিল্ডিংয়ে দেখা যায় গ্লাস লাইন ধরে করা ক্লাসরুম, রিসার্চের ঘর, একটা অডিটরিয়াম এবং একটা লাইব্রেরি, যার সবই দৃশ্যত সংযুক্ত। এর ফলে একজন ব্যবহারকারী এই ইউনিভার্সিটির একটা বিশাল স্ট্রাকচার ও এর স্কেল সম্বন্ধে জাগ্রত হতে পারেন। এই ক্লাসরুমগুলো আবার একটা কমন উন্মুক্ত স্পেসের সঙ্গে যুক্ত অর্থাৎ আমাদের উঠোন যেমন হয়ে থাকে।
ইয়োকোসুকা মিউজিয়াম অব আর্ট, জাপান, ২০০৬
প্রায় দুই বছর ধরে মিউজিয়ামের সঙ্গে জড়িত নানা কাজের মানুষের সঙ্গে আলাপের মধ্য দিয়ে এই প্রকল্পের ডিজাইন কাজ শুরু হয়। যদিও এই গোষ্ঠীর মাঝে মিউজিয়াম কিউরেটরদের প্রাধান্য বেশি। উত্তরমুখে আছে সমুদ্র এবং চারদিকে পাহাড়ের মাঝে একটা উপত্যকায় এই মিউজিয়ামটির সাইট। ইয়োকোসুকার খুব টিপিক্যাল এক ভূখন্ড এটি। মিউজিয়ামের একটা বিশাল অংশকে তাই মাটির নিচে নিয়ে যাওয়া হয়েছে যেন তা ল্যান্ডস্কেপের সঙ্গে মিশে গিয়েছে বলে মনে হয়। একটা পাখির বাসার মতো ভেতরের স্পেসগুলোকে চিন্তা করা হয়েছে। মিউজিয়ামের কিনার ঘেঁষে নানা সার্ভিস যেমন রেস্তোরাঁ, কর্মশালার ঘর ইত্যাদি রাখা হয়েছে। মাঝখানের অংশটি হলো মিউজিয়ামের সংবেদনশীল বস্তুগুলো প্রদর্শনী ও সংগ্রহের জায়গা। এভাবে ডিজাইন করার ফলে সাগরধারে পরিবেশসংক্রান্ত যে জটিলতাগুলো তৈরি হয়, সেটির সমাধানও হয়ে যায়। দুই স্তরের ছাদ ও দেয়ালের একদিকে গ্লাস প্লেট আর অন্যদিকে আয়রন বোর্ড দেওয়া হয়েছে। এভাবে করে একদিকে প্রদর্শনী এবং আরেক দিকে সংগ্রহশালা সাজানো হয়েছে। এই দুই স্তরের দেয়াল ঘিরে দর্শকেরা যখন আসতে থাকেন, তখন তাঁরা কেবল প্রদর্শনীর বিষয়বস্তু নয়, শিল্পকলাকে ঘিরে নানা আয়োজন সম্পর্কেও জানতে পারেন।

ফুসা সিটি হল, জাপান, ২০০৮
টোকিও থেকে ৫০ কিলোমিটার দূরে এক জনবহুল এলাকায় ফুসা সিটি হল অবস্থিত। তামা নদী থেকে একটু একটু করে ঢাল বেয়ে ওপরে উঠতে থাকে এই প্রকল্পের সাইট। সিটি হলের যে ভূস্তর এটাকে বলা হয় ‘ফোরাম’। এই জায়গাটি উন্মুক্ত এবং নাগরিকেরা তা ব্যবহার করেন। একটা বিশাল অবিচ্ছিন্ন ছাদের নিচেই তাঁরা জড়ো হন। এবং দুই পাশ দিয়ে দুইটা টাওয়ার ওঠানো হয়েছে। এই বিশাল ছাদের ওপরের অংশটাও একটা বড় সবুজ পাবলিক স্পেস হিসেবে ব্যবহƒত হয়। প্রাত্যহিক প্রয়োজনে অথবা নানা ইভেন্টস এবং অ্যাকটিভিটির জন্য তাঁরা এই জায়গাটা ব্যবহার করে থাকেন। এই অংশটির জন্য বিল্ডিংয়ের এনার্জি সেভ হয় এবং আশপাশের যে মনোরম পরিবেশ, সেটির সঙ্গে সংগতিপূর্ণ থাকে। এই দুই টাওয়ারে আছে মেইন অফিস, যা সিটি হলকে একটা আইকনিক ইমেজ প্রদান করে। অফিসগুলোকে সর্বোচ্চ মান প্রদান করা ছিল মূল ভাবনা। নির্মাণের দিক থেকে ভাবনাটা ছিল এর স্ট্রাকচারকে বিল্ডিংয়ের বাহ্যিক দিকে রাখা এবং কাজের জায়গাগুলোতে যেন স্ট্রাকচারগুলো না আসে, সেটি নিশ্চিত করা।
প্যাঙ্গিও হাউজিং, দক্ষিণ কোরিয়া, ২০১০
কোরিয়া ন্যাশনাল করপোরেশন একটি স্থাপত্যের প্রতিযোগিতার আহ্বান জানায় ২০০৬ সালে। যেখানে বলা হয়, সৃষ্টিশীল পরিবেশবান্ধব লো-রাইজ মাল্টি ফ্যামিলি হাউজিং প্রকল্প তারা চাচ্ছে তাদের নতুন শহর প্যাঙ্গিওর জন্য। স্থপতি ইয়ামামোতে দুই ধরনের ডিজাইন প্রস্তাব দেন। একটি থাকে এমন যে সব ইউনিট আলাদা আলাদা বসানো। আরেকটি হলো সবাই একটা কমন ডেক শেয়ার করে। এই সাইটে মোট ৯টা আলাদা অঞ্চল ছিল। প্রতি অঞ্চলে ৯-১৩টি আবাসিক ভবনের জন্য ইউনিট ঠিক করা ছিল, যেগুলো তিন-চারতলা হবে। কমিউনাল ডেকটা ভাবা হয়েছিল দ্বিতীয় স্তরে। হাউজিংয়ের এই স্বচ্ছ স্তরটিকে বলা হয় ‘শিখি’। শিখি অর্থ একটা সুবিশাল উঠোন, যা ড্রয়িং রুম, হোম অফিস, এটলিয়ার এবং আরও নানা কাজে ব্যবহার করা যাবে। এই আলাদা আলাদা অঞ্চলকে কমন ডেকটি একটা সুযোগ দেয় যেন তারা আশপাশের পরিবেশের সঙ্গে খাপ খাইয়ে সে অনুযায়ী নিজেদের একটা চরিত্র দাঁড় করাতে পারে।

তিনজিয়ান লাইব্রেরি, চায়না, ২০২১
ছয় মিলিয়ন বই আছে এই লাইব্রেরিতে। ৫৫ হাজার বর্গমিটার এলাকার ওপরে এই লাইব্রেরিটি নির্মিত। ইয়ামামোতো বলেন এই বিশাল জায়গা জাপানের মতো জায়গায় চিন্তা করলে খাটবে না। এই লাইব্রেরির অন্যতম আকর্ষণীয় বিষয়টি হলো অনেক ক্রিসক্রস স্তর আছে। আরও আছে একটা সুবিশাল হল, যেটি লাইব্রেরিতে প্রবেশের পরপর দেখা যায় এবং ভবনের দুই প্রান্ত থেকেই এই হলে প্রবেশ করা যায়। একটা পাথরের লুভ্যর স্তর ভবনের দেয়ালে লক্ষ করা যায়, যা এর পরের স্তরে থাকা গ্লাসের আবরণকে ধূলিঝড় থেকে রক্ষা করে।
নাগোয়া জোকেই ইউনিভার্সিটি, জাপান, ২০২২
একটি আর্ট স্কুল যেটি নাগোয়ায় স্থানান্তরিত হয়েছে, সেই ইউনিভার্সিটিটাই হলো স্থপতির খুব সাম্প্রতিক কাজগুলোর একটি। একদম ওপরের তলায় একটা বিরাট উন্মুক্ত স্পেস ডিজাইন করা হয়েছে, যা প্রায় ৮৮ বর্গমিটারের। নানা বিষয়ে অধ্যয়নরত শিক্ষার্থীরা এই স্পেসটিকে তাদের নিজেদের মতো করে স্টুডিও হিসেবে ব্যবহার করতে পারবে। এর নিচে যত ফ্লোর আছে, সেখানে লাইব্রেরি, গ্যালারি স্পেস, ক্যাফে ইত্যাদি নানা আয়োজন আছে। ভবনের দেয়ালে ব্যবহার করা হয়েছে জালি, ফলে দিনের বেলায় আসে পর্যাপ্ত আলো এবং রাতে করে জ্বলজ্বল।

সামাজিক সম্পর্ক, এই বিষয়টা রিকেন ইয়ামামোতোর সব কাজেই প্রকাশ পায় বলিষ্ঠভাবে। এবং এই সমাজে কেবল সব স্তরের মানুষ নয়, প্রকৃতিকেও তিনি শামিল করেছেন সমান মর্যাদায়। খুব সম্ভবত তত্ত্বীয় বিষয়টিকে তাঁর কাজের মধ্য দিয়ে খুব সহজ ও সাধারণভাবে প্রকাশ হতে দেখা যায় বলেই আজ তা এত সমাদৃত। বর্তমান সময়ে স্থাপত্যচর্চায় সামগ্রিক বোধের যে অভাব আমরা বোধ করি, তা রিকেন ইমায়ামোতোর কাজগুলো দেখা ও বোঝার মধ্য দিয়ে পূর্ণতা পাওয়ার সম্ভাবনা আছে।
– সুপ্রভা জুঁই
স্থপতি ও লেখক
প্রকাশকাল: বন্ধন ১৬৮ তম সংখ্যা, আগস্ট ২০২৪