মানুষের মনস্তত্ত্বের অনেকটাই জুড়ে আছে সবুজ প্রকৃতি আর বাগান। জীবনমান উন্নয়ন আর সময়ের প্রয়োজনে গ্রামীণ জীবনের পাশাপাশি পত্তন ঘটেছে নগর সভ্যতার। ইট-কংক্রিটের জীবনে অভ্যস্ত হলেও একজন শহুরে মানুষ কখনো সবুজ প্রকৃতির প্রতি তার ভালোবাসা ও সঙ্গ ত্যাগ করতে পারে না। এ কারণেই ইট-পাথরের মধ্যে বসবাস সত্ত্বেও নগরবাসীর চাই সবুজ বাগান। আগেকার মানুষের স্বপ্ন ছিল সবুজ বৃক্ষশোভিত দোতলা বাড়ির। কিন্তু বাস্তবতার নিরিখে জমির দুষ্প্রাপ্যতা আর উচ্চমূল্যের কারণে স্বপ্নের এ সংজ্ঞা বদলে গিয়ে স্থান পেয়েছে ফ্ল্যাটবাড়ি বা অ্যাপার্টমেন্ট কালচারে। যেখানে একটি বাগান পাওয়া দুঃস্বপ্ন হলেও মানুষের মধ্যে সবুজের সংস্পর্শে থাকার সহজাত প্রবৃত্তি কখনোই মুছে যায়নি। গ্রামের সবুজ প্রান্তরের আজও ঠাঁয় হয় ফ্ল্যাটবাড়ির ছাদে কিংবা বারান্দার এক কোণে। অথচ সবুজবান্ধব স্থাপত্য ডিজাইনের মাধ্যমেই যেকোনো ভবনকেই সাজানো যায় সবুজের সতেজ ছোঁয়ায়; এমন ডিজাইনের কারিগর ইউ-কিউব স্থাপত্য ফার্মের কর্ণধার স্থপতি আবু ইউসুফ স্বপন। তাঁর স্থাপত্য ডিজাইনে সবুজের ছোঁয়ায় ভবনটি হয়ে ওঠে জীবন্ত।

বাণিজ্যিক রাজধানী চট্টগ্রামের উন্মুক্ত স্থান দ্রুত কমে আসছে। চট্টগ্রাম উন্নয়ন কর্তৃপক্ষের স্ট্যান্ডার্ড ১৯৬১ অনুযায়ী, বন্দর নগরের জনসংখ্যা ছিল ৩ দশমিক ৩ মিলিয়ন (৩৩ লক্ষ), মোট এরিয়া ১০০ বর্গমাইল (২৬০ বর্গকিলোমিটার), মোট উন্মুক্ত স্থানের পরিমাণ ২০০ একর (০.৮০ বর্গকিলোমিটার), বিদ্যমান গড় উন্মুক্ত স্থানের পরিমাণ প্রতি ১০০০ জনে ০.০৬ একর এবং প্রয়োজনীয় গড় স্থানের পরিমাণ প্রতি ১০০০ জনে চার একর। কর্তৃপক্ষের দুর্বলতা আর ভূমিদস্যুদের দৌরাত্ম্যে বর্তমানে এ ঘাটতি আরও তীব্র আকার ধারণ করেছে। এ পরিস্থিতিতে ছাদ-বাগানের ব্যাপারে আগ্রহ বাড়ছে চট্টলাবাসীর। ছাদের ওপরে বাগান এখন আর শুধু মানুষের শখের মধ্যেই সীমাবদ্ধ নয়। বাণিজ্যিকভাবেও ছাদ-বাগানের ব্যবহার বেড়েছে। আবাসিক অ্যাপার্টমেন্ট বিল্ডিংয়ের কমিউনিটি স্পেস, উন্মুক্ত রেস্তোরাঁ, করপোরেট অফিসের অবকাশ যাপন কেন্দ্র, বহুতল ভবনের ছাদের ওয়াচ টাওয়ার, জগিং স্পেস ইত্যাদি প্রয়োজন মেটাতে ছাদের ব্যবহার ক্রমেই বেশ জনপ্রিয় হয়ে উঠছে। এসব জায়গার সঠিক ব্যবস্থাপনা ও ব্যবহার নিশ্চিত করতে; মানুষের মনে সবুজ প্রকৃতির খোরাক জোগাতে স্থপতিরা ভবন ডিজাইনে রাখছেন সবিশেষ ভূমিকা। বাংলাদেশ গার্মেন্টস ম্যানুফ্যাকচারার্স অ্যান্ড এক্সপোর্টার্স অ্যাসোসিয়েশন (বিজিএমইএ), চট্টগ্রাম, তাদের নতুন নির্মাণাধীন অফিসের ইন্টেরিয়র ও ছাদ-বাগানের ডিজাইনের জন্য উপদেষ্টা ফার্ম ইউ কিউব (U3)-এর দ্বারস্থ হয়। ইউ-কিউবের কর্ণধার স্থপতি আবু ইউসুফ স্বপন বিজিএমইএ অফিসের ইন্টেরিয়র ডিজাইন ও তৎসংলগ্ন উন্মুক্ত বাগানের ডিজাইনকে একে অপরের পরিপূরক হিসেবে ব্যবহারকারীদের উপযুক্ত করে একটি থিম নিয়ে কাজ করেন। তিনি অফিস ও বাগানকে একক স্পেস হিসেবে বিবেচনা করেন এবং স্পেস ভাগ করেন ইনডোর, সেমি-আউটডোর ও আউটডোরে, যাতে ইনডোর থেকে আউটডোরের যাত্রাপথে মাঝখানের সেমি-আউটডোর স্পেস রাখার বা প্রস্তুতিমূলক স্থান হিসেবে কাজ করে। বিজিএমইএ মূলত ব্যবসায়ী ও গার্মেন্টস মালিকদের স্বার্থসংশ্লিষ্ট সংগঠন। এই সংগঠনের কার্যালয়ের দাপ্তরিক কার্যক্রম শুরু হয় বিকেলে, চলে সন্ধ্যা পেরিয়ে রাতের প্রথমাংশ অবধি। কারণ, সংগঠনের সদস্যরা দিনের বেলা তাঁদের নিজ নিজ কর্মস্থলে ব্যস্ত থাকেন। তাই স্থপতি আবু ইউসুফ স্বপন বিজিএমইএ অফিসের জন্য একটি আউটডোর নাইট লাইফ এনভায়রনমেন্ট তৈরির পরিকল্পনা করেন। এতে ব্যবহারকারী সদস্যরা দিন-রাত মিলিয়ে এক মিশ্র উপভোগ্য কর্মচঞ্চল পরিবেশ পেতে পারেন।

ভাবনা অনুযায়ী ডিজাইন। স্থপতি ইউসুফ কেন্দ্রীয়ভাবে একটি সবুজ লন ডিজাইন করেন, যার চারপাশ ঘিরে রয়েছে সুপরিসর পায়ে চলা পথ। পুরো ছাদ-বাগানটি তিন হাজার ২৩০ বর্গফুট জায়গাজুড়ে অবস্থিত, যার পরিধি নিবিড় সবুজ বেষ্টনীতে আবদ্ধ। এই নিরবচ্ছিন্ন সবুজ বেষ্টনীতে স্থান পেয়েছে ৬০ প্রজাতির ছোট, বড় ও মাঝারি আকৃতির গাছপালা। বাগানের উত্তর পাশে ধূমপায়ীদের জন্য নির্ধারিত স্থান। সেখানে রোপণ করা হয়েছে সুগন্ধি ফুলের গাছ ও থাই পাতা এবং হাতের নাগালেই রাখা হয়েছে ছাইদানি। পরিবেশদূষণ রোধে সব জায়গায় রয়েছে রিসাইকেল বিন। যেহেতু বর্ষায় বৃষ্টির পানি ছাদে জমলে ক্ষতি হয়, তাই ছাদ-বাগানের পানি নিষ্কাশনে নেওয়া হয়েছে বিশেষ ব্যবস্থা। রাতের পরিবেশকে আকর্ষণীয় করার জন্য ব্যবস্থা রয়েছে পর্যাপ্ত আলোর। আলোর পাশাপাশি রয়েছে সারাউন্ড মিউজিক সিস্টেম, যা দর্শনের সঙ্গে যোগ করেছে শ্রুতিমধুর এক আনন্দঘন পরিবেশ। বিজিএমইএর ছাদ-বাগান বাস্তবায়নের অংশীদার হিসেবে এলকোভ (Alcove) নামক একটি ইন্টেরিয়র ফার্মের রয়েছে সহযোগী ভূমিকা।
ল্যান্ডস্কেপ ডিজাইনের একটি গুরুত্বপূর্ণ থিম সূর্যাস্ত পর্যবেক্ষণ। স্থপতি এখানে পশ্চিমাকাশের মনোরম প্রাকৃতিক দৃশ্যকে সবুজ সাইকাস বৃক্ষের সারির মাধ্যমে ফ্রেমবন্দীর পরিকল্পনা করেন। পূর্বপ্রান্তের পায়ে চলা পথের পাশে এ জন্য তিনি ডিজাইন করেন একটি রেল বেঞ্চ, যার বৈশিষ্ট্য এটি একটি রেল ট্র্যাকের ওপর উত্তর-দক্ষিণে স্থানান্তর করা যায়। সূর্যাস্ত পর্যবেক্ষণকারী যাতে তাঁর মনের মতো অবস্থানে বসতে পারেন, এর জন্যই এ ব্যবস্থা।
দক্ষিণ-পূর্ব কোণে রয়েছে একটি দুই স্তরবিশিষ্ট মনোরম জলাধার ও ফোয়ারা। এটি নির্মাণের উদ্দেশ্য, গরমকালে ছাদ-বাগান ব্যবহারকারীদের জন্য আরামদায়ক পরিবেশ সৃষ্টি করা। ফোয়ারার জলীয় বাষ্প কণা দক্ষিণ-পূর্বের প্রবাহিত বাতাসের সঙ্গে পুরো ছাদ-বাগানজুড়ে প্যাসিভ কুলিংয়ের মাধ্যম শীতল ও আরামদায়ক হবে এমনটাই উদ্দেশ্য। একটি সাবমার্সিবল পাম্পের সাহায্যে রিসাইকেল পদ্ধতিতে একই পরিমাণ পানিকে ব্যবহার করার ব্যবস্থা করা হয়েছে, যা অপচয়রোধী ও টেকসই। ফোয়ারাটিতে রয়েছে লাইটিংয়ের সুব্যবস্থা, যা রাতের পরিবেশকে করে তোলে আরও আকর্ষণীয় ও মনোরম। ছাদ-বাগানের দক্ষিণ ও উত্তর পাশে স্টেজ পারফরমেন্সের জন্য রয়েছে পর্যাপ্ত খোলা জায়গা।

ল্যান্ডস্কেপিংয়ের উপাদান হিসেবে বিভিন্ন প্রজাতির শোভাবর্ধনকারী গাছপালা ব্যবহার করা হয়েছে। এর মধ্যে রয়েছে গ্রাউন্ড কাভার, গুল্ম, লতা ও কাঁঠাল-জাতীয় গাছ। বিভিন্ন ধরনের গাছের সমাহার এই ছাদ-বাগানটিকে ছোট পরিসরের এক বৃক্ষ জাদুঘরে পরিণত করেছে। ব্যবহৃত গ্রাউন্ড কাভারগুলোর মধ্যে রয়েছে বিলাস দুর্বা, বারমুডা ঘাস, মুম্বা ঘাস, বিদ্যা পাতা, থাই ঘাস, ঝালর ফার্ন, তরারী ফার্ন, থোপা ফার্ন। গুল্ম-জাতীয় এবং ফুলগাছের মধ্যে ব্যবহৃত হয়েছে নয়নতারা, দীপ্তি, লালসালু, রক্তগাদা, কসমস, মোরগঝুঁটি, খাটো টগর, কাঁটা মেহেদি, পাথরকুচি, নীলরানী, অগাস্টিন ঘাস, ফার্নপাতা, পলিসিয়াম, বিচিত্র জাপানি ঘাস, চায়না বাঁশ, নলিনা, রক্তপাতা, গন্ধরাজ, লতাবট। মাঝারি ও ছায়াবান্ধব উদ্ভিদের মধ্যে ব্যবহৃত হয়েছে জিববট, ড্রামিনা, লালপাড় ড্রামিনা, চিকনপাতা ড্রামিনা, ক্লোরোফাইটাম ক্যালাথিয়া, জামিয়া, লেডি পাম, এরিকা পাম, বড় উদ্ভিদের মধ্যে ব্যবহৃত হয়েছে নিম, সোনালি বাঁশ, ঘটি বাঁশ, বামন বাঁশ, কৃষ্ণচূড়া, রাধাচূড়া ইত্যাদি। এ ছাড়া আরবি লতাসহ তিন ধরনের লতা-জাতীয় গাছ রোপণ করা হয়েছে। আগ্রহী বৃক্ষপ্রেমিকদের জন্য এই ছাদ-বাগানটি হতে পারে দর্শনীয় এক স্থান।
বাগানের আউটডোর ফার্নিচার, বিশেষ করে বেঞ্চগুলোর যেন এক-একটি ভাস্কর্য। বিশেষভাবে তৈরি করা এই রেল-বেঞ্চটির বসার স্থানটি কিছুটা উত্তলভাবে ডিজাইন করা, যাতে সেখানে বসে সূর্যাস্ত উপভোগ করা যাবে কিন্তু শুয়ে থাকা যাবে না। পশ্চিম পাশের কাঠের বেঞ্চটি মানুষের শরীরের মাপকে প্রাধান্য দিয়ে ডিজাইন করা। উত্তর পাশের স্থায়ী বেঞ্চটি মিরর পলিশ টাইলস দিয়ে তৈরি করা, যা মাঝখানের সবুজ লনের সঙ্গে ধূমপানের স্থানকে আলাদা করতে সাহায্য করেছে। উন্মুক্ত ছায়াবিহীন স্থানে ব্যবহৃত বেঞ্চগুলোতে কাঠের ব্যবহার দেখা যায়, যা তাপ অপরিবাহী হওয়ায় আরামদায়ক। অন্যদিকে কংক্রিটের বেঞ্চগুলোকে স্থাপন করা হয়েছে ছায়াঘেরা স্থানে। দক্ষিণ-পশ্চিম এবং উত্তর-পূর্ব প্রান্তে মিলবে বাঁশঝাড়ের নিবিড় ছায়া। পশ্চিমের সাইকাসগুলো বেশ বড়সড়, কান্ডগুলো লম্বা হয়ে বেড়ে গিয়ে ঝাকড়া হয়ে পাতা মেলেছে, যার ফলে পূর্ব প্রান্ত থেকে সহজেই এগুলোর ফাঁক দিয়ে সন্ধ্যার সূর্যাস্তকে উপভোগ করা যায়। একই সঙ্গে সংলগ্ন পায়ে চলা পথটি থাকে ছায়াঘেরা। সব মিলিয়ে এই ছাদ-বাগানটি যেন ৪০ ফুট উঁচুতে অবস্থিত একুশ শতকের এক শূন্য উদ্যান। রাতের আয়োজনকে উপভোগ্য করার জন্য ব্যবহৃত হয়েছে পর্যাপ্ত আলো। এই ছাদ-বাগানে রীতিমতো মিউজিক শো অথবা বুফে ডিনার আয়োজন করা সম্ভব।

ইউ কিউব (U3) বৃত্তান্ত
স্থাপত্যবিষয়ক উপদেষ্টা প্রতিষ্ঠান ইউ কিউবের শুরুটা ২০০৯ সালে স্থপতি ও এর কর্ণধার আবু ইউসুফ স্বপনের হাত ধরে। স্থপতি ইউসুফ বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয় (বুয়েট) থেকে ২০০৩ সালে স্থাপত্যে স্নাতক সম্পন্ন করার পর কিছুদিন জড়িত ছিলেন কনসালটেন্সিতে। এরপর ২০০৫ সালে উচ্চশিক্ষার উদ্দেশ্য জার্মানিতে পাড়ি জমান। সেখানে পড়াশোনা শেষে বেশ কিছুদিন আর্কিটেকচারাল কনসালটেন্ট ও ল্যান্ডস্কেপ আর্কিটেকচারের ওপর বাস্তব অভিজ্ঞতা অর্জন করেন। এরপর ২০০৮ সালে চলে যান সিঙ্গাপুর। বছর খানেক সিঙ্গাপুরে কাজ করার পর তিনি দেশে ফিরে আসেন এবং নিজ শহর চট্টগ্রামের স্থাপত্য শিক্ষা প্রসারে আগ্রহী হন। বছর তিনেকের অক্লান্ত পরিশ্রমের পর তিনি চট্টগ্রাম শহরের কেন্দ্রস্থলে প্রিমিয়ার বিশ্ববিদ্যালয়ের অধীনে স্থাপত্য বিভাগ চালু করেন। শিক্ষকতার পাশাপাশি তিনি তাঁর কনসালটেন্সি ফার্ম U3-এর প্রসার ঘটান। ফার্মটি আর্কিটেকচারাল কনসালটেন্সির পাশাপাশি গ্রাফিক্স ডিজাইন, হেরিটেজ কনজারভেশন আর ল্যান্ডস্কেপিংয়ের কাজ করেন। এরপর স্থপতি আবু ইউসুফ বেশ কয়েকটি ছাদ-বাগান নির্মাণ ও ডিজাইন করেন, যার মধ্যে জামালখান এলাকার মিনহাজ কমপ্লেক্সের সর্বোচ্চ তলার ওপরের ছাদ-বাগানটি উল্লেখযোগ্য। স্থপতি ইউসুফ মনে করেন, আধুনিক নগরজীবনের সবুজহীনতার বিপরীতে ছাদ-বাগান এক পরম স্বস্তির কারণ।
মারুফ আহমেদ
marufahmed11@gmail.com
প্রকাশকাল: বন্ধন ৫১ তম সংখ্যা, জুলাই ২০১৪