মহিলাদের কারিগরি শিক্ষার পীঠস্থান ঢাকা মহিলা পলিটেকনিক ইনস্টিটিউট

রাজধানীর শেরেবাংলা নগরে প্রতিষ্ঠিত মহিলাদের প্রথম কারিগরি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান ঢাকা মহিলা পলিটেকনিক ইনস্টিটিউট। তৃতীয় বিশ্বের অধিক জনবহুল ও উন্নয়নশীল এ দেশের আর্থসামাজিক উন্নয়ন, কারিগরি শিক্ষার মাধ্যমে নারীদের কর্মসংস্থানের সুযোগ সৃষ্টির লক্ষ্যেই প্রতিষ্ঠা করা হয় এই ইনস্টিটিউটটির। জন্মলগ্ন থেকেই প্রতিষ্ঠানটি নারীদের আধুনিক কারিগরি শিক্ষায় শিক্ষিত করে দক্ষ জনশক্তি হিসেবে গড়ে তুলছে। প্রশিক্ষিত এসব নারী দেশের কারিগরি কর্মক্ষেত্রে রাখছেন অসামান্য অবদান।

প্রতিষ্ঠানের কথা
দেশের মোট জনসংখ্যার অর্ধেকই নারী। বিপুলসংখ্যক এই জনগোষ্ঠীকে প্রায়োগিক শিক্ষায় পারদর্শী করে তুলতে ১৯৮৫ সালে স্থাপিত হয় প্রতিষ্ঠানটি। স্বাধীনতা-উত্তর দেশের একমাত্র মহিলা কারিগরি প্রতিষ্ঠানের সূচনালগ্নে সুগম ছিল না এর পথচলা। আর্কিটেকটার এবং ইলেকট্রনিকস টেকনোলজি, এ দুটি বিষয়ে ৪০ জন শিক্ষার্থী ও কয়েকজন শিক্ষক নিয়ে শুরু হয় প্রতিষ্ঠানটির পথচলা। দীর্ঘ পথ চলতে চলতে প্রতিষ্ঠানটির শিক্ষা পরিসর ও শিক্ষক-শিক্ষার্থীর সংখ্যা ক্রমেই বেড়েছে। বর্তমানে প্রতিষ্ঠানটিতে ৫০ জনেরও বেশি প্রশিক্ষিত শিক্ষক, ২ হাজার শিক্ষার্থী এবং ৬০ জন অফিস সহকারী কর্মরত রয়েছেন। এখান থেকে প্রশিক্ষিত শিক্ষার্থীরা দেশ-বিদেশের বিভিন্ন কারিগরি অঙ্গনে রাখছেন অনন্য অবদান। স্বীকৃতিস্বরূপ ১৯৯৮ সালে সেরা প্রতিষ্ঠানের মর্যাদা পায় প্রতিষ্ঠানটি। এ ছাড়া ২০০৮ সালে এশিয়ান প্যাসিফিক আ্যক্রিডিটেশন অ্যান্ড সার্টিফিকেশন কমিশন সংক্ষেপে অ্যাপেক (APACC) সদস্য পদ লাভ করে।

লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য
দেশের নারীদের দক্ষ, যোগ্য হিসেবে গড়ে তুলে কর্মসংস্থানের সুযোগ দানে নারীর ক্ষমতায়ন ও দেশীয় আর্থসামাজিক উন্নয়ন অর্জন করা। এ ছাড়া আধুনিক প্রযুক্তি ব্যবহার, ল্যাব অন্যান্য সুবিধা প্রদান করে সুপ্রশিক্ষিত শিক্ষক দ্বারা শিক্ষার আদর্শ মান, সম্ভাবনা ও দক্ষতা নিশ্চিত করা।

একাডেমিক ভবন

অবস্থান ও অবকাঠামো
ঢাকার শেরেবাংলা নগরের আগারগাঁওয়ে তালতলা বাসস্ট্যান্ডের পাশে ৪ দশমিক ৩ একর জায়গাজুড়ে এ প্রতিষ্ঠানটির অবস্থান। এ পলিটেকনিকে রয়েছে একটি প্রশাসনিক ও একটি অ্যাকাডেমিক ভবন। উভয় ভবনেই শিক্ষাকার্যক্রম সম্পন্ন হয়। এ ছাড়া রয়েছে গবেষণাগার, ওয়ার্কশপ, কনফারেন্স রুম, পাঠাগার, নামাজের ঘর। সোনালি বাংলা, শ্যামলী বাংলা ও রূপসী বাংলা নামে তিনটি আবাসিক হল রয়েছে। হলের মোট সিটসংখ্যা ৪৫০, যা প্রতিষ্ঠানটির মোট শিক্ষার্থীর তুলনায় সীমিত। প্রতিটি হলেই রয়েছে যথাযথ তত্ত¡াবধায়ন ও নিরপত্তাব্যবস্থা। প্রতিষ্ঠানটিতে একটি সমৃদ্ধ পাঠাগার রয়েছে, যেটির সংগ্রহে রয়েছে বিভিন্ন ধরনের সাময়িকী, জার্নাল, ম্যাগাজিন এবং দুর্লভ সব বই। ক্যাম্পাসে রয়েছে একটি সুসজ্জিত ক্যানটিন, যেখানে হালকা খাবারের পাশাপাশি স্টেশনারি ও প্রসাধনী সামগ্রী পাওয়া যায়। ক্যাম্পাসে আরও রয়েছে অতিথি অভ্যর্থনা কক্ষ, অধ্যক্ষের বাংলো, স্টাফদের আবাসিক ভবন, মসজিদ এবং মেয়েদের নামাজের ঘর। শহীদ মিনার, একুশে চত্বর, খেলার দুটি মাঠ, সবুজ গাছপালা ও ফুলের বাগান প্রতিষ্ঠানটির সৌন্দর্য বাড়িয়েছে বহুগুণে। পুরো ক্যাম্পাসটি সিসি টিভি ক্যামেরা দ্বারা নিয়ন্ত্রিত।

ভর্তির যোগ্যতা
ঢাকা মহিলা পলিটেকনিকট ইনস্টিটিউটে পড়তে হলে ভর্তি পরীক্ষায় অংশ নিতে হয়। এ জন্য শিক্ষার্থীকে এসএসসি/সমমানের পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হতে হবে এবং GPA-2.50-এর ওপরে থাকতে হবে।

শিক্ষা কার্যক্রমের নিয়মাবলি
ঢাকা মহিলা পলিটেকনিকট ইনস্টিটিউটে মোট আসন ৬০০। প্রতিটি বিভাগের টেকনোলজি ৬০টি সিটের সমন্বয়ে গঠিত। চার বছর মেয়াদি শিক্ষা কার্যক্রম আট সেমিস্টার অর্থাৎ প্রতি সেমিস্টার ছয় মাসের হিসেবে পরিচালিত হয়। এ কোর্সগুলোকে দুটি শিফটে শিক্ষাদান করা হয়। প্রথম শিফট শুরু সকাল ৮টায় এবং দ্বিতীয় শিফট ১১টা ১৫ মিনিটে শুরু হয়। প্রতিটি সেমিস্টারে ১৬ সপ্তাহ শ্রেণি কার্যক্রমে উপস্থিত থাকা বাধ্যতামূলক। বোর্ডের চূড়ান্ত পরীক্ষায় অংশগ্রহণে শতকরা ৮০ ভাগ উপস্থিতি নিশ্চিত করতে হয়। প্রথম থেকে তৃতীয় সেমিস্টার পর্যন্ত ফলাফল প্রকাশ করে বাংলাদেশ কারিগরি শিক্ষা বোর্ড (বিটিইবি)। পরীক্ষাগুলো প্রায়োগিক ক্লাসের গুরুত্ব দেয়। ফলে অষ্টম সেমিস্টারের শিক্ষার্থীদের ইন্ডাস্ট্রিয়াল ট্রেনিংয়ের জন্য বিভিন্ন ইন্ডাস্ট্রিতে পাঠানো হয়। শ্রেণিকক্ষে শিক্ষার্থীকে অবশ্যই নির্ধারিত ইউনিফর্ম পরতে হয়। এখানকার ডিপ্লোমা কোর্সের বিষয়সমূহ হচ্ছে-

আর্কিটেকচার টেকনোলজি (Architecture Technology)
ইলেকট্রনিকস টেকনোলজি (Electronics Technology)
কম্পিউটার টেকনোলজি (Computer Technology)
ইলেকট্রো-মেডিকেল টেকনোলজি (Electro-medical Technology)
ইনস্ট্রুমেনটেশন অ্যান্ড প্রসেস কন্ট্রোল টেকনোলজি (Instrumentation & Process Control Technology)

শহীদ মিনার

বিষয়-বৃত্তান্ত
বর্তমান বিশ্বে উপরিউক্ত বিষয়সমূহের চাহিদা ব্যাপক। প্রতিটি টেকনোলজিরই রয়েছে স্বতন্ত্র বৈশিষ্ট্য ও কর্মক্ষেত্রে অনায়াসে প্রবেশের সুযোগ। বিষয় বৈচিত্র্য ও কর্মসুবিধার মধ্যে যা রয়েছে-

আর্কিটেকচার টেকনোলজি
এ টেকনোলজির অন্তর্ভুক্ত ইন্টেরিয়র ডিজাইন, মডার্ন আকিটেকচার, ডিজাইন স্ট্রাকচার, বিল্ডিং অ্যান্ড ফিনিশ ম্যাটারিয়ালস ও আর্কিটেকচার প্রজেক্ট। এ বিভাগে দক্ষ শিক্ষার্থীর শিক্ষা শেষে স্থাপত্য ফার্ম, ডেভেলপার কোম্পানি, ইন্টেরিয়র ডিজাইন ফার্মসহ বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানে কাজের সুযোগ রয়েছে।

ইলেকট্রনিক টেকনোলজি
ইলেকট্রনিক টেকনোলজি অন্যতম গুরুত্বপূর্র্ণ বিভাগ। এ বিভাগের বিষয়সমূহ হলো মাইক্রোকন্ট্রোলার অ্যান্ড ইমবেডেড সিস্টেম, কম্পিউটার কন্ট্রোল অ্যান্ড রোবোটিকস, ইন্ডাস্ট্রিয়াল কন্ট্রোল অ্যান্ড পিএলসি, মাইক্রোওয়েভ রাডার অ্যান্ড নেভিগেশন এইডস, কমিউনিকেশন ইঞ্জিনিয়ারিং। অধ্যায়ন শেষে টেলি-কমিউনিকেশন সেক্টর, ইলেকট্রনিক মিডিয়া ও ইলেকট্রনিকস ইন্ডাস্ট্রিতে রয়েছে কাজের সুযোগ।

কম্পিউটার টেকনোলজি
বর্তমান সময়ে বিষয়টি অত্যন্ত জনপ্রিয়। এতে অন্তর্ভুক্ত আছে জাভা অ্যাপ্লিকেশন, সিস্টেম অ্যানালাইসিস ডিজাইন অ্যান্ড ডেভেলপমেন্ট, মাল্টিমিডিয়া অ্যান্ড গ্রাফিক্স, আর্টিফিসিয়াল ইন্টিলিজেন্স, কম্পিউটার সায়েন্স প্রজেক্ট। সফটওয়্যার ফার্ম, আইটি ফার্মস, কম্পিউটার হার্ডওয়ার ইন্ডাস্ট্রি প্রভৃতি।

রোভার স্কাউট দল, ইলেকট্রো মেডিকেল ল্যাব ক্লাস, সফটওয়ার ল্যাব ক্লাস ও এটমিক এনার্জি কেন্দ্র পরিদর্শন (উপরে বা থেকে)

ইলেকট্রো মেডিকেল টেকনোলজি
এ টেকনোলজির অন্তর্ভুক্ত হসপিটাল ল্যাবরেটরি ইকুইপমেন্টস, রোবটিস অ্যান্ড কন্ট্রোল, নিউক্লিয়ার মেডিকেল ইনস্ট্রুমেন্ট, আইসিইউ অ্যান্ড সিসিইউ ইকুপমেন্ট। কর্মক্ষেত্রে সুযোগ রয়েছে হসপিটাল ডায়াগনস্টিক সেন্টার, মেডিকেল ইকুইপমেন্ট কোম্পানিতে কাজের।

ইনস্ট্রুমেনটেশন অ্যান্ড প্রসেস কন্ট্রোল টেকনোলজি
ইন্ডাস্ট্রিয়াল অটোমেশন অ্যান্ড রোবোটিকস, ইলেকট্রনিকস টেস্ট ইকুইপমেন্ট, ইলেকট্রনিকস ইকুইপমেন্ট, মেইনটেইনস টেকনিক, মেডিকেল ইনস্ট্রুমেন্টশন অ্যান্ড প্রসেস কন্ট্রোল এ বিভাগের পঠিত বিষয়। ইনস্ট্রুমেনটেশন ইন্ডাস্ট্রি, ইন্ডাস্ট্রিয়াল কন্ট্রোল, অটোমেশন ইন্ডাস্ট্রিতে রয়েছে কাজের সুযোগ।

বৃত্তিমূলক ব্যবস্থা
শিক্ষার্থীদের শিক্ষা কার্যক্রম সুষ্ঠুভাবে সম্পন্ন করার লক্ষ্যে প্রতি সেমিস্টারে ৬৫ শতাংশ শিক্ষার্থী সরকার থেকে পাচ্ছে প্রায় ৯০৫ টাকা উপবৃত্তি। এ ছাড়া বিশ্ব ব্যাংকের সহায়তায় STEP শিক্ষার্থী প্রতি ৪ হাজর ৮০০ টাকা প্রদান করে। দরিদ্র শিক্ষার্থীদেরও প্রতিষ্ঠানের পক্ষ থেকে সহায়তা করা হয়। তাদের ফরম পূরণের সময় দরিদ্র তহবিল থেকে ৪০০ টাকা ভর্তুকি দেওয়া হয়।

সহশিক্ষা কার্যক্রম
বাংলাদেশ কারিগরি শিক্ষা বোর্ডের অধীনে প্রতিষ্ঠানটিতে রয়েছে কতিপয় সহশিক্ষা কার্যক্রম। এ কার্যক্রমের মধ্যে রচনা প্রতিযোগিতা, বাংলা ও ইংরেজি বিতর্ক প্রতিযোগিতা, আন্তবিভাগীয় ক্রিকেট/ফুটবল/ব্যাডমিন্টন/ভলিবল প্রতিযোগিতা, নানা ধরনের সাংস্কৃতিক এবং সাহিত্য-বিষয়ক আকর্ষণীয় প্রতিযোগিতা। এ ছাড়া নানা আঙ্গিকে রয়েছে বাংলা নববর্ষ বা চৈত্রসংক্রান্তি উৎসব, আর্ন্তজাতিক মাতৃভাষা দিবস, শহীদ দিবস, শিশু দিবস, বিজয় দিবস ও স্বাধীনতা দিবস উদ্যাপিত হয়। বিজয় ও স্বাধীনতা দিবস উপলক্ষে প্রামাণ্যচিত্র দেখানো হয়ে থাকে। এ ছাড়া নবীনবরণ ও বিদায়ী ছাত্রীদের বিদায় অনুষ্ঠানের আয়োজন করা হয়। জ্ঞান বৃদ্ধি সহায়ক হিসেবে প্রতিবছর শিক্ষাসফরের ব্যবস্থা করা হয়। এ ছাড়া এখানে রয়েছে রোভার স্কাউট দল।

ক্যাফেটরিয়া, প্রধান প্রবেশ পথ ও পাঠাগার (উপরে বা থেকে)

ডিপ্লোমা ডিগ্রি অর্জনের পর বিএসসি করার সুযোগ রয়েছে দেশের সরকারি প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ে। এ ছাড়া রয়েছে দেশ-বিদেশে বৃত্তিমূলক শিক্ষা ও কাজের সুযোগ। প্রতিষ্ঠানটিতে রয়েছে Job Placement Cell, যেটির মাধ্যমে বিভিন্ন সংস্থার সঙ্গে নিয়মিতভাবে যোগাযোগ রাখা হয়। নতুন বিষয়ের আরও আটটি টেকনোলজি আসছে, যাতে পড়ার সুযোগ হবে আরও ৪০০ শিক্ষার্থীর।

যোগাযোগ: আগারগাঁও, শেরেবাংলা নগর, ঢাকা-১২০৭
ফোন: +৮৮০-০২-৯১১৪০১৩
ই-মেইল: HYPERLINK “mailto:[email protected][email protected]
ওয়েবসাইট: HYPERLINK “http://www.dmpi.gov.bd” www.dmpi.gov.bd

প্রকাশকাল: বন্ধন ৭৪ তম সংখ্যা, জুন ২০১৬

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Scroll to Top