সফলতা লাভে চাই সঠিক সময়ে সঠিক সিদ্ধান্ত

রোদ ঝলমল উজ্জ্বল দিন। নীল আকাশে ভাসছে সাদা মেঘের ভেলা। রাস্তার দু’পাশে থৈথৈ করছে বৃষ্টির পানি। কোথাও কোথাও ফুটে আছে রাশি রাশি শাপলা ফুল। জমে থাকা পানিতে স্পষ্ট দেখা যাচ্ছে আকাশের প্রতিচ্ছবি। কেউ জাল, কেউবা বড়শি দিয়ে মনের আনন্দে মাছ ধরে চলেছে। মুগ্ধ নয়নে দৃশ্যগুলো দেখতে দেখতে চলেছি প্রধান সড়ক ধরে। বন্ধনের নিয়মিত আয়োজন ‘সফল যারা কেমন তারা’ পর্বের সফল ব্যবসায়ীর খোঁজেই এবার পৌঁছালাম রংপুর জেলায়।

ঢাকা থেকে রংপুর আসার পরদিন আকিজ সিমেন্ট কোম্পানির আঞ্চলিক বিক্রয় কর্মকর্তা  মোঃ জহুরুল ইসলামকে সাথে নিয়ে রওনা দিলাম শহর থেকে ২৫-৩০ কিলোমিটার দূরে কাউনিয়া থানা অভিমুখে। কয়েক ঘণ্টার মধ্যে পৌঁছে গেলাম সেখানে। মেসার্স শফি ট্রেডিংয়ের স্বত্বাধিকারী বিশিষ্ট ব্যবসায়ী মোঃ শফিকুল আলম আমাদের স্বাগত জানালেন। লম্বাদেহী মানুষ তিনি। চোখেমুখে বুদ্ধিমত্তার ছাপও স্পষ্ট। কথা হলো ব্যবসায় সফলতা লাভ ও জীবনের নানা দিক সম্পর্কে।

তিনি ১৯৬৪ সালের ৫ অক্টোবর রংপুর জেলার কাউনিয়া থানার হরিশ্বর গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন। পিতা ডা. আজিজুল হক ও মা মোছাঃ মোমেনা খাতুন। তিনি শহীদ মোফাজ্জেল হোসেন দ্বিমুখী উচ্চ বিদ্যালয় থেকে এসএসসি এবং কাউনিয়া ডিগ্রি মহাবিদ্যালয় থেকে এইচএসসি পাস করেন। পরবর্তীতে একই কলেজ থেকে ডিগ্রি পাস করেন। তার বাবা ছিলেন এলাকার একজন জনপ্রিয় এলএমএফ ডাক্তার। শুধু তাই নয়, তিনি ১৯৬২ থেকে ১৯৯২ সাল পর্যন্ত কাউনিয়া থানার চেয়ারম্যান ছিলেন। ৯ ভাই-বোনের মধ্যে তিনি ৩য়। ১৯৮৬ সালের ঠিকাদারির মাধ্যমেই ব্যবসায়ের হাতে খড়ি। প্রাথমিক পর্যায়ে ছোট ছোট বিভিন্ন কাজ শুরু করেন। নিজ মেধা ও পরিশ্রমের বলেই ধীরে ধীরে ঠিকাদারিতে নিজের একটি শক্ত অবস্থান তৈরি করেন। এর পাশাপাশি কিছুদিন পরেই জড়িয়ে যান ট্রেড ব্যবসাতে। শুরু করেন পাটের ব্যবসা। রংপুর অঞ্চল পাটের জন্য বেশ বিখ্যাত। ফলে সেখানেও সফলতার দেখা পান। তবে যেহেতু ঠিকাদারি তার প্রধান ব্যবসা ছিল, তার সঙ্গে সঙ্গতি রাখতেই ২০০৯ সালে রড, সিমেন্ট ইত্যাদি নির্মাণ সামগ্রীর ব্যবসা করতে উদ্যোগী হন। তবে ঠিকাদারি করার খাতিরে নির্মাণ সামগ্রীর ব্যবসাতে এলেও সেখানে অন্য কারণও ছিল। তিস্তা নদীর ভাঙ্গন এলাকা বলে কাউনিয়া থানার উন্নয়নের গতিটাও ছিল কিছুটা মন্থর। সেখানে তেমন কোনো রড সিমেন্টের দোকান ছিল না। অবকাঠামো নির্মাণের প্রয়োজনে এসব সামগ্রী আনতে জেলা শহরে যেতে হতো। তা ছাড়া দেশের অন্যান্য এলাকার মতো এই থানাতেও ধীরে ধীরে উন্নয়নের ছোঁয়া লাগে। এই বিষয়টিকেই গভীরভাবে উপলব্ধি করেন শফিকুল আলম। ফলে তিনি সবার দোরগোড়ায় নির্মাণ পণ্য পৌঁছে দিতে সক্ষম হন। পাশাপাশি এ ব্যবসাতেও দেখা মেলে সফলতার।

তবে যত সহজে ব্যবসায়ের সফলতার কথা বললাম তত সহজে তা আসেনি। পেছনে রয়েছে কিছু ঘটনা। শূন্য থেকে শুরু করেছিলেন তিনি। পড়াশোনা শেষ করার পর স্থানীয় একটি স্কুলে শরীরচর্চার শিক্ষক হিসেবে যোগ দেন। তার সম্মানী ছিল মাত্র ৪৩৫ টাকা। সম্মানী দেওয়া হতো ৩ মাস পর পর। তাও আবার পেতে পেতে যথারীতি ৬ মাস। ফলে ব্যবসা করার উদ্যোগ নেন। ৩ মাস চাকরি করার পর বেতনের টাকা দিয়ে একটি সাইকেল কেনেন। তার মা তাকে ব্যবসা করার জন্য ১০ হাজার টাকা দেন। সে টাকা দিয়েই শুরু হয় তার ব্যবসায়িক জীবন। বাবার যে কম ছিল তা নয়। কিন্তু তার দৃঢ় সঙ্কল্প ছিল নিজে কিছু করার। এভাবেই ব্যবসাতে আসা। তবে পরবর্তীতে স্থানীয় একটি কলেজে শরীরচর্চার শিক্ষক হিসেবে প্রায় ১০ বছর চাকরি করেন। ১৯৯২ সালে তিনি বিবাহবন্ধনে আবদ্ধ হন। বর্তমানে তার ১ ছেলে ও ১ মেয়ে। ছেলে সাবাব আবতাহি আবেশ ৯ম শ্রেণী ও মেয়ে সারিকা সুলতানা রীতিমা ৩য় শ্রেণীতে পড়ছে।

সপরিবারে ব্যবসায়ী মোঃ শফিকুল আলম

খেলাধুলা তার কাছে সবচেয়ে প্রিয়। সবচেয়ে পছন্দের খেলা ফুটবল। প্রাথমিক বিদ্যালয় থেকেই অংশ নেন আন্ত: স্কুল ফুটবলে। স্থানীয় সোনালি অতীত ক্লাবে খেলতেন এবং এখনও তার সদস্য হিসেবে আছেন। মূলত তিনি ছিলেন গোলরক্ষক। শুধু দেশেই নয়, দেশের বাইরেও খেলেছেন। পার্শ্ববর্তী দেশ ভারতের আমন্ত্রণে প্রাক্তন খেলোয়াড়দের সমন্বয়ে চ্যারিটি ম্যাচে অংশ নিতে গিয়েছেন দার্জিলিং, জলপাইগুড়ি, শিলিগুড়ি, গয়ারকাটাসহ বেশ কিছু স্থানে। বিভিন্ন সময় গ্রæপ অ্যাওয়ার্ডও পেয়েছেন। পাশাপাশি ভলিবলও খেলতেন। একসময়ে থিয়েটার করতেন। বর্তমানে তিনি মহল্লার একটি জামে মসজিদের সভাপতি। স্থানীয় ঈদগাহ ও কবরস্থানের সাধারণ সম্পাদক। উপজেলাভিত্তিক ঠিকাদার সমিতির সাধারণ সম্পাদক। এ ছাড়াও তিনি কাউনিয়া থানা জাতীয়তাবাদী ছাত্রদলের প্রতিষ্ঠাতা সভাপতি ছিলেন। বর্তমানে উপজেলা জাতীয়তাবাদী দলের সাধারণ সম্পাদক হিসেবে দায়িত্বরত। পাশাপাশি বিভিন্ন সামাজিক সংগঠনের সাথেও তিনি জড়িত। বর্তমানে এলজিইডি ও পানি উন্নয়ন বোর্ডের একজন ঠিকাদার হিসেবে ব্রিজ, কালভার্ট, রাস্তাঘাট ইত্যাদি উন্নয়ন কাজ করে যাচ্ছেন। এলাকার বেশকিছু যুবক প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে তার ব্যবসার সাথে জড়িত। 

ব্যবসায়ে সফলতা লাভের কিছু দিকনির্দেশনা দিলেন সফল এই ব্যবসায়ী। বললেন, প্রতিদিনের কাজ প্রতিদিন করতে হবে। সৎ ও নিষ্ঠার সাথে ব্যবসা করা এবং সঠিক সময়ে সঠিক সিদ্ধান্ত নেওয়ার ব্যাপারেও তাগিদ দেন। প্রতিশ্রুতি দিয়ে প্রতিশ্রুতি রক্ষাও সফলতা লাভের মূল মন্ত্র হতে পারে বলে তার অভিমত। তিনি মনে করেন, অধিক মুনাফাই ব্যবসায়ের মূল লক্ষ্য হওয়া উচিত নয়। তাতে জনগণের সেবার বিষয়ও থাকতে হবে।

নিজ চেষ্টা, পরিশ্রম এবং তার মায়ের উৎসাহ ও প্রেরণাতেই আজকের এই অবস্থানে আসতে পেরেছেন তিনি। ফুটবল খেলায় দাড়াঁতেন গোলপোস্টের সামনে। শুধু খেলাতেই নয়, ব্যক্তিগত জীবনেও তার অর্জিত সম্পদকে কিভাবে রক্ষা এবং তার সঠিক ব্যবহার করতে হয় তা ভালোভাবেই আয়ত্ত করতে পেরেছেন সফল এই মানুষটি।

প্রকাশকাল: বন্ধন ২৮ তম সংখ্যা, আগস্ট ২০১২

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Scroll to Top