ব্যবসার মূলধন পরিশ্রম

তিস্তা, ব্রহ্মপুত্র, করতোয়া, ঘাঘট, মানস ও বাঙ্গালী নদী বয়ে যাচ্ছে গাইবান্ধা জেলার ওপর দিয়ে। নদীবিধৌত এ জনপদটি যেমন এলাকাটিকে করেছে সমৃৃদ্ধ, তেমনি ভেঙেছে অনেকের ঘরবাড়ি, কৃষিজমি আর সংসার। ভাঙনের শিকার সর্বহারা এ মানুষগুলো তাই বাধ্য হয়েই নেমেছে কঠিন এক জীবন-সংগ্রামে। সর্বহারা এমনই এক পরিবারের সন্তান মো. মোকছেদুর রহমান (ভুট্টু)। জীবন সংগ্রামে জয়ী হয়ে আজ যিনি এলাকার সফল এক ব্যবসায়ী। গাইবান্ধা জেলার ভরতখালী উল্লাবাজারের মেসার্স সিহাব সজিব ট্রেডার্সের স্বত্বাধিকারী তিনি। আকিজ সিমেন্ট কোম্পানি লিমিটেডের আঞ্চলিক বিপণন কর্মকর্তা এ বি এম রাসেল মাহমুদের সহায়তায় সফল এ ব্যবসায়ীর সঙ্গে আলাপচারিতার পর ‘সফল যাঁরা কেমন তাঁরা’ পর্বে এবার রইল তাঁরই বর্ণাঢ্য জীবন সংগ্রামের আখ্যান।

ব্যবসায়ী ভুট্টুর জন্ম ১৯৭২ সালের ১৮ অক্টোবর, গাইবান্ধা জেলার সাঘাটা থানার গোপিন্দী গ্রামে। বাবা মরহুম আফসার আলী ও মা জামিলা খাতুন। চার ভাই ও এক বোনের মধ্যে সবার বড়। ১৯৮১ সালে নদীভাঙনে বাস্তুহারা হয়ে সপরিবারে গোপিন্দী ছেড়ে চলে আসেন ভরতখালী। বাবা ছিল কাঁচামালের ব্যবসা। সংসারেও ছিল সচ্ছলতা। কিন্তু সর্বনাশা নদী কেড়ে নিল সবকিছু। সহায় সম্বলহীন হয়ে বাবা বিক্রি শুরু করলেন আচার। কিন্তু তাতেও যায় না সংসারে অভাব। ভুট্টু স্কুলে পড়লেও সংসারের সচ্ছলতায় তাঁকেও নামতে হয় ব্যবসায়। বাবা তাঁকে তিন বয়াম আচার দিয়ে বসিয়ে দেন তাঁরই স্কুলের সামনে। পড়া ছেড়ে হয়ে গেলেন  আচার বিক্রেতা। এভাবে কয়েক দিন ব্যবসা করার পর হঠাৎ করেই বাবা প্যারালাইসিসে আক্রান্ত হওয়ায় শারীরিকভাবে অক্ষম হয়ে পড়েন। বড় ছেলে বলে সংসারের দায়িত্বটাও পড়ে তাঁর ওপর। বয়স তখন আর কত! ১০ বছর হবে; তৃতীয় শ্রেণীর ছাত্র। আচার বিক্রির টাকা দিয়েই চলতো ছয়-সাতজন মানুষের অন্ন সংস্থান। কিন্তু এভাবে চলল না বেশি দিন। আচারের পাশাপাশি শুরু করলেন বাদাম, বুট ইত্যাদি বিক্রিও। নিজে স্কুল ছাড়লেও বন্ধ হতে দিলেন না ভাইবোনদের পড়ালেখা; যাবতীয় খরচ তিনি নিজেই বহন করলেন। ক্রমেই বাড়তে লাগল সংসারের খরচ। তাই বাধ্য হয়েই ছাড়তে হল এ ব্যবসা। একটি সাইকেল ছিল নিজের। নষ্ট হলে নিজেই সারতেন। কাজটা যেহেতু ভালোই পারেন, তাই ভাবনায় এল বাজারে একটি সাইকেল মেরামতের দোকান দেবার। যেই ভাবা সেই কাজ। দোকান দিলেন উল্লাবাজারে। যে কাজ নিজে জানতেন না তা অন্য মেকানিকদের কাছ থেকে শিখতেন। কিছুদিনের মধ্যেই নিজে একজন দক্ষ সাইকেল মেকানিক বনে গেলেন। শুরু করেন সাইকেলের কিছু কিছু যন্ত্রাংশও বিক্রি। একপর্যায়ে রিকশা, ভ্যান ঝালাইয়ের জন্য কেনেন একটি ওয়েল্ডিং মেশিন। এই মেশিনটিই বদলে দেয় তাঁর ভাগ্য। ভ্যান-রিকশার ঝালাই কাজের পাশাপাশি বিভিন্ন লোহার আসবাব তৈরি ও বাড়ির দরজা-জানালার গ্রিলের কাজের অর্ডার পেতে শুরু করলেন। আস্তে আস্তে দোকানটিকে রীতিমত ওয়ার্কশপ বানিয়ে ফেললেন। গ্রিল, আলমারি, ড্রেসিং টেবিল তৈরি করতে লাগলেন। ক্রমেই বাড়তে লাগল তৈরীকৃত পণ্যের চাহিদা। তখন প্রয়োজন হলো প্রচুর স্টিলের। গ্রামীণ ব্যাংক থেকে ক্ষুদ্র ঋণ নিয়ে সরাসরি ঢাকার মহাজনদের সঙ্গে শুরু করলেন স্টিলশিটের ব্যবসা। বাকিও নিতেন তাঁদের কাছ থেকে। কেনাবেচা পর সময়মতো সে টাকা পরিশোধও করতেন। এভাবে মহাজনদের বিশ্বস্ততা অর্জন করেন। ফলে পণ্য পেতে আর কোনো সমস্যা রইলো না; চাইলেই লাখ লাখ টাকার পণ্য পেতেন। এভাবেই এগোতে থাকল ব্যবসার পরিসর। একসময় শুরু করলেন নির্মাণপণ্যের ব্যবসা। ক্রেতা চাহিদার পরিপ্রেক্ষিতে একে একে যোগ করেন ওয়ার্কশপ, ফার্নিচার, হার্ডওয়্যার, ইলেকট্রনিক্স, ইলেকট্রিক্যাল, স্যানিটারিসহ নানা ব্যবসা। 

এতসব ব্যবসায় নিজেকে জড়ালেও সব ব্যবসার প্রতিই ছিল তাঁর সমান মমত্ব। কোনো ব্যবসাকেই তিনি ছোট মনে করতেন না। প্রতিটি ব্যবসায়ই দিতেন সমান মেধা ও শ্রম। তাই কখনোই তাকে লোকসানের মুখে পড়তে হয়নি। ব্যবসার প্রসারে এলাকাবাসীর সঙ্গে রয়েছে তাঁর দারুন সুসম্পর্ক। কোম্পানিগুলোও তাঁর ব্যবসায়িক কৌশলে সন্তুষ্ট। ভালো পন্য বিক্রির স্বীকৃতিস্বরূপ তাই বিভিন্ন সময়ে পেয়েছেন টিভি, মোবাইল, ডিভিডি, মাইক্রোওভেন, নগদ টাকাসহ নানা উপহার। আকিজ সিমেন্ট কোম্পানির দেওয়া নির্দিষ্টসংখ্যক পণ্য বিক্রির সুবাদে কোম্পানির পক্ষ থেকে এবার যাচ্ছেন থাইল্যান্ড ও নেপাল ভ্রমণে। তা ছাড়া একসময়ে তিন বয়াম আচার নিয়ে শুরু করা ব্যবসাটির প্রসার ঘটিয়ে বাজারে করেছেন ছয়টি শোরুম ও একটি ওয়ার্কশপ। এসব ব্যবসায় তাঁর প্রতিষ্ঠানে কাজ করছে প্রায় ৪০ জন কর্মচারী ও শ্রমিক। 

সপরিবারে ব্যবসায়ী মো. মোকছেদুর রহমান (ভুট্টু)

সফল এ ব্যবসায়ী বিয়ে করেছেন ১৯৯৩ সালে। স্ত্রী সালমা বেগম। সংসারে তাঁদের দুই মেয়ে ও যমজ ছেলে। বড় মেয়ে মুসলিমা আক্তার উর্মি, ছোট মেয়ে তাসলিমা আক্তার রুম্পা। দুজনই অষ্টম শ্রেণীতে পড়ছে। যমজ ছেলে সিহাব ও সজিব পড়ে পঞ্চম শ্রেণীতে। ছোটবেলা থেকেই কাঁধে সংসারের বোঝা, তাই কাজের মধ্যেই কেটেছে তাঁর জীবনের বেশির ভাগ সময়। তবুও আচার বিক্রির ফাঁকে ফাঁকে খেলতেন স্কুলের বন্ধুদের সঙ্গে। যতটা সম্ভব ভাইবোনদের লেখাপড়া শিখিয়েছেন। তাদের স্বাবলম্বী হতে সাহায্য করেছেন। প্রত্যেককেই বাড়ি করে দিয়েছেন। নিজেও কিছু জমি কিনেছেন। এলাকার দরিদ্র অনেককেই ভ্যান কিনে দিয়েছেন।  গাইবান্ধা স্টিল ইঞ্জিনিয়ারিং ওয়ার্কশপের একজন সম্মানিত সদস্য। জড়িত আছেন ভরতখালী মসজিদ কমিটির সঙ্গেও। জীবনের সবচেয়ে বড় প্রাপ্তি ও আনন্দ ভাইবোনদের মানুষ করতে পারায়।

শৈশব আর কৈশোরে কীভাবে সংসার চালিয়েছিলেন তা ভাবলে আজও শিউরে ওঠেন; চোখ বেয়ে নামে অবিরল অশ্রুধারা। দু’মুঠো ভাতের জন্য মানুষকে কতোই না পরিশ্রম করতে হয়! পিছনে ফেলে এসেছেন কষ্টময় অতীত। সামনে স্বপ্নময় ভবিষ্য। সবসময় স্বপ্ন দেখতেন বড় কিছু করবেন। এই স্বপ্নই তাঁকে পৌঁছে দিয়েছে সাফল্যের দোড়গোড়ায়। ব্যবসার আসল মূলধনই পরিশ্রম; অর্থ নয়। সৎভাবে বাঁচাই বড় কথা; কে কোন ব্যবসা করল সেটা বড় নয়। এখন তাঁর ইচ্ছা এলাকায় মিনি গার্মেন্টস দেওয়ায়। এ স্বপ্নও যে স্বাপ্নিক এ মানুষটি পূরণ করতে পারবেন এ কথা হলফ করেই বলা যায়। 

মাহফুজ ফারুক

প্রকাশকাল: বন্ধন ৪৯ তম সংখ্যা, মে ২০১৪

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Scroll to Top