বাড়ির ভেতরেই পুকুর, পুকুরের ঘাটে গাছের তলায় বাঁধা একটি ডিঙি নৌকা। যেন কারও পারাপারের অপেক্ষায়। ইচ্ছা হলেই চালানো যাবে নৌকা। জানালা খুললেই জ্যামিতিক কনক্রিটের দেয়াল ছাপিয়ে সবুজ ঝোপঝাড়। সেখানে পাখির কলতান। ষড়ঋতুর বৈচিত্র্যময় এ দেশে বাড়ির কোথাও বৃষ্টির ঘর, ওপর থেকে অঝোর ধারায় বৃষ্টি পড়বে, মনের আনন্দে সে বৃষ্টিতে ভেজা যাবে। কোথাও বাতাসের ঘর, চারদিক থেকে বাতাস ঢুকবে। সারা বাড়িতে হাওয়া খেলে যাবে। বাড়ির কোথাও আবার গোস্বা (অভিমান) ঘর। পরিবারের কারও সঙ্গে ঝগড়া বা রাগ হলে অভিমান করে সে ঘরটিতে গিয়ে চুপটি করে বসে থাকা যাবে। জোছনাস্নাত রাতে চাঁদ দেখতে ছাদে বা বাইরে যেতে হবে না। লাইটগুলো বন্ধ করে দিলেই ভেসে উঠবে তারাভরা আকাশ, চাঁদের আলো ছড়িয়ে পড়বে ঘরময়। উথাল-পাথাল জোছনায় ভেসে যাবে ঘরের চারপাশ। বাড়িময় যেন প্রকৃতির এক অপূর্ব সৃষ্টিশৈলী খেলা করবে। আর এ সৃষ্টির স্র্র্রষ্টা স্থপতি রফিক আজম।
বাংলাদেশের স্থাপত্যচর্চাকে যিনি নিয়ে গেছেন অন্য উচ্চতায়। দেশের স্থাপত্যশিল্পীদের মধ্যে কর্মগুণে স্বনামে প্রতিষ্ঠিত। তাঁর স্থাপত্য আবহমান গ্রামবাংলা আর প্রকৃতির কথা বলে। তিনি তাঁর সৃষ্টিতে দেশীয় ঐতিহ্য, সংস্কৃতি, জলবায়ু, আলো-ছায়ার প্রহেলিকাময় জগৎকে ধারণ করেন। স্থাপত্য নকশা করেন মানুষের মনস্তত্ত্ব অনুভব করে। যে স্থাপত্য চেতনাকে জাগ্রত করে, মানুষকে নতুনভাবে বাঁচার প্রেরণা জোগায়, মানুষের বসবাসে দেয় সৃজনশীলতার আনন্দ। তাঁর স্থাপত্যকর্ম কৃষকের খালি গায়ের মতো রোদে, ঘামে, বাতাসে শুকোয়, আবার বৃষ্টিতেও ভেজে। কৃষকের মাথায় থাকা মাথালটি যেমন দেহকে ছায়াবৃত করে, এতে কিন্তু ওটাকে আর বোঝা মনে হয় না। তেমনি রফিক আজমের স্থাপত্যও হালকা ধাঁচের, যা বসুন্ধরার বুকে বোঝা হয়ে ওঠে না। ভবনটিও প্রাণীকূলের মতো শ্বাস-প্রশ্বাস নেয়, হয়ে ওঠে জীবন্ত, যা কোনোভাবেই জলবায়ু আর পরিবেশের সঙ্গে যুদ্ধ করে না; করে বন্ধুত্ব। তাঁর স্থাপত্যের সৌন্দর্যে যেকোনো মানুষ মুগ্ধ হতে বাধ্য। এখানকার বাগান, পাশে বসার জায়গা, পাখি, প্রজাপতি ও ভ্রমরের আগমন দেখলে মনটা নিজ থেকেই নেচে ওঠে আনন্দে। ভবনের কোথাও ত্রিভুজ বা বৃত্তাকার ফাঁকা অংশ দিয়ে মনের অজান্তেই চোখ চলে যাবে বইরে খোলা উন্মুক্ত আকাশে। সবখানেই মনে হয় যেন সবুজের প্রশান্তি।
ঐতিহ্যবাহী পুরান ঢাকার লালবাগের সন্তান গুণী এ স্থপতি। জন্ম ১৯৬৩ সালের ২৯ ডিসেম্বর উর্দু রোডে নানাবাড়িতে। বাবা মরহুম মোঃ আজম, মা আঙ্গুরী বেগম। বাবা ছিলেন একজন ব্যবসায়ী। পাঁচ ভাই, চার বোনের মধ্যে তিনি ষষ্ঠ। পড়ালেখার শুরু লালবাগের লিবার্র্টি স্কুলে। স্কুল না বলে এলাকার গরিব ছেলেমেয়েদের পাঠাগার বলাই শ্রেয়। স্কুলে যাওয়ার প্রবল আগ্রহ থাকলেও তাঁকে স্কুলে আনা-নেওয়ার তেমন কেউ র্ছিল না। বাধ্য হয়ে বাবাই তাঁকে পৌঁছে দিতেন স্কুলে। বুড়িগঙ্গার পাড়েই ছিল কেল্লার বাজার, বাবা বাজারে যেতেন, সঙ্গে করে নিয়ে যেতেন স্কুলে। আনা-নেওয়ার সুবিধার্থেই বাজারের পাশের স্কুলটিতে ভর্তি করা হয় তাঁকে। স্কুলের ছাত্ররা সবাই আসত খালি গায়ে। পোশাক পরাদের মধ্যে একমাত্র ছিলেন তিনিই। স্কুলে বসার বেঞ্চ ছিল না; মাস্টার মশায়ের বসার জন্য ছিল একটি মাত্র চেয়ার। ফলে পাটি পেতে বসেই ক্লাস করতে হতো। তৃতীয় শ্রেণীতে উঠে ভর্তি হন বকশিবাজারের নবকুমার ইনস্টিটিউটে। চলে এলেন নানুর বাসায়। সেখান থেকেই স্কুল করতেন। একদিন পত্রিকায় একটি বিজ্ঞাপন দেখেন। প্রতিযোগিতার ভিত্তিতে বাচ্চাদের আঁকা ছবি নিয়ে তৈরি করা হবে ক্যালেন্ডার (দিনপঞ্জিকা)। ‘দাদুর হাতে কলম ছিল ছুড়ে মেরেছে’ এ ধরনের কবিতার সঙ্গে মিল রেখে ছবি আঁকতে হবে। মনে ধরল তাঁর, খুবই ইচ্ছা হলো আঁকতে। আঁকলেনও। কিন্তু কোথায় জমা দেবেন তা নিয়ে পড়ে যান সমস্যায়। বাড়ির সবাই যার যার কাজে ব্যস্ত। ছবি নিয়ে কারও ভাবার সময় কোথায়? কী আর করা, জমা না দিয়ে নিজের কাছেই রেখে দিলেন। কিছুদিন পরেই এল নতুন বছর। এক আত্মীয়ের বাসায় বেড়াতে গিয়ে একটি দিনপঞ্জিকা দেখে চোখ আটকে যায়। এই তো ছন্দ মিলিয়ে আঁকা সেই ছবি। দেখে খুবই আফসোস হলো, ভাবলেন ক্যালেন্ডারের ছবি তো আমারও হতে পারত। সেই থেকে আবারও ছবি আঁকা শুরু করেন। আঁকতেন নিজে নিজেই। যা খুশি তা-ই আঁকেন। বোর্ড কেটে সুটকেস বানাতেন, খেলার ছলে তাতে আবার বই ভরে এ ঘর থেকে ও ঘরে যেতেন, সবাইকে দেখাতেন। নানুবাড়িতে ছোট কেউ ছিল না, তাই রাজত্ব ছিল তাঁরই। তিন বছর পর আবার লালবাগে ফিরে আজিমপুরের ওয়েস্টার্ন হাইস্কুলে সপ্তম শ্রেণীতে ভর্তি হলেন। একদিন তাঁর মেজো ভাইয়ের আর্ট কলেজে পড়ুয়া বন্ধু ফরহাদ বাসায় এলেন। তিনি আর্টিস্ট জেনে খুবই আনন্দিত হলেন।
ছেলেবেলার স্মৃতি জ্বলজ্বল করে উঠল। যেন মহামূল্যবান জিনিসটি পেয়েই গেছেন। ওনাকে ছবিগুলো দেখালেন। তিনি উৎসাহ দিলেন। একদিন তাঁর হাত ধরেই প্রথম আর্ট কলেজে পা রাখলেন। এমনকি চুপিচুপি প্রথম বর্ষের ক্লাসেও ঢুকে গেলেন। আবু তাহের বাবু, যিনি তাঁর পেইন্টিংসের গুরু, তিনি বলতেন, ‘এই ছেলে, তুমি ক্লাসে ঢুকেছ কেন, বাইরে যাও, স্যার আসবেন।’ বাধ্য হয়ে বাইরে আসতেন কিন্তু আবারও ঢুকতেন। আর্ট করা দেখতে খুব ভালো লাগত তাঁর, যেন এক অনাবিল আনন্দ, এক সুখের জগৎ। পরে তাঁর সঙ্গে বেশ ভাব হয়ে যায়। তিনিই মূলত প্রতিটি জিনিস ধরে ধরে শিখিয়েছেন। ওখানে ছোটদের একটি স্কুল ছিল। সেখানে আর্ট শেখানো হতো। তাঁর উৎসাহ দেখে বড় বোন ওখানে ভর্তি করিয়ে দিলেন। স্কুলে বিভিন্ন প্রতিযোগিতার জন্য চিঠি আসত। প্রতিযোগিতায় অংশ নেওয়া শুরু করলেন। কিন্তু কিছুতেই পাচ্ছিলেন না পুরস্কারের দেখা। তবুও হাল ছাড়লেন না। অবশেষে ১৯৭৫ সালে প্রথমবারের মতো একটি প্রতিযোগিতায় তৃতীয় স্থান লাভ করেন। সুসংবাদটি পেয়ে তো আকাশ থেকে পড়ার দশা। এমনিতেই লালবাগ থেকে প্রতিদিন হেঁটে আসতেন। স্যারের কাছ থেকে পুরস্কার নিয়ে সেই দিন আনন্দে রিকশায় উঠে পড়লেন, পকেটে অবশ্য টাকা ছিল না। এরপর শিশুদের জন্য শ্রেষ্ঠ পুরস্কার নেহরু গোল্ড মেডেল পেলেন, যেটা তাঁর জীবনে বড় স্বীকৃতি। শিশু সংগঠক রোকনুজ্জামান দাদাভাই সুখবরটি দেন কিন্তু কিছুতেই তাঁর বিশ্বাস হচ্ছিল না। পত্রিকায় নিজের নাম দেখে নিশ্চিত হলেন। এরপর আরও দুইবার পুরস্কার লাভ করেন। অষ্টম শ্রেণীতে পড়াকালীন নতুন কুঁড়ি শিশু প্রতিযোগিতায় প্রথম স্থান লাভ করেন। এ ছাড়া রাশিয়া, ভারত, কোরিয়াসহ দেশে-বিদেশে অসংখ্য পুরস্কারে ভূষিত হয়েছেন তিনি। স্কুলের ছোট পরিসরে একটি এক্সিবিশনও করেছিলেন। এভাবেই কাটতে থাকল দিন। এরপর ১৯৭৯ সালে এসএসসি পাস করেন। ভর্তি হন কবি নজরুল কলেজে। স্কুলের মজা আর কলেজ জীবনে পাননি। কারণ, কলেজ ছিল বেশ দূরে। খুব কমই যেতেন। বাবার কোর্ট-কাচারির সুবাদে তাঁর সঙ্গেই যেতেন। কোর্টে না গেলে তাঁরও যাওয়া লাগত না। তবে ছবি আঁকা চালিয়ে গেছেন তখনো। কিন্তু রং কেনার জন্য যে টাকা লাগত, তা তাঁর কাছে থাকত না আবার বাবার কাছেও টাকা চাইতে পারতেন না। চাইতে গেলে তিনি অনেক বকাঝকা করতেন। বলতেন, ‘তুই শুধু সিনেমার নায়ক-নায়িকাদের পোস্টার-ব্যানার আঁকতে পারবি, তোকে দিয়ে কিচ্ছু হবে না।’ কী আর করা! চলে যেতেন চারুকলার হলে। বড় ভাইদের কাছে রং চাইতেন। তাঁদেরই থাকত না, দেবেন কীভাবে? তাই তাঁদের ফেলানো টিউবগুলো কুড়িয়ে নিয়ে আসতেন। সেগুলোকে কেটে রং বের করতেন। লালবাগ কেল্লার মাঠ, চিপা গলি, পুরোনো বাড়িতে আড্ডা এসব করেই তাঁর দিন কাটতে থাকে। প্রতি সপ্তাহে দুই দিন চলে যেতেন গ্রামে ছবি আঁকতে। সেখানে শুনতেন পাখির গান, হারিয়ে যেতেন নৈস্বর্গিক এক জগতে। এ ছাড়া টিউশনিও করতেন। এভাবে ১৯৮১ সালে এইচএসসি পাস করেন।

শুরু হয় নতুন সংগ্রাম। জীবনের একমাত্র লক্ষ্য ছিল চিত্রশিল্পী হওয়া। বাবা কোনোভাবেই চাইতেন না। যেহেতু শিল্পীদের আয় খুব বেশি নয়, তাই কিছুতেই এ বিষয়ে পড়া যাবে না। এক বোন তাঁকে স্থাপত্যবিষয়ক ধারণা দেন। তিনি পরামর্শ দেন এটি ভালো সাবজেক্ট, ছবি আঁকতে দেন। বলেন, তুই ছবি আঁকতে পারবি, ভর্তি হয়ে যা। স্থপতি বা স্থাপত্যের সম্পূর্ণই ছিল অজানা। খোঁজ নিলেন। অনেক ভেবে ঠিক করলেন যেহেতু আর্ট কলেজে ভর্তি হতে পারবেন না, তাই এই সাবজেক্টটিতেই ভর্তি হন। তবে তা তো আর মুখের কথা না। এর জন্য নিতে হবে ট্রেনিং। বুয়েটের এক বড় ভাইয়ের সহায়তা নিলেন। অনেক ট্রেনিং দিলেন। ফুটবলার হওয়ারও ইচ্ছা ছিল। খেলাধুলাও ছেড়ে দিলেন, প্রচুর অধ্যবসায় শুরু করলেন। কিন্তু খেলা তো মন থেকে বাদ দিতে পারেন না। লালবাগের আমৃগোলায় ক্লাবে টেবিল টেনিস খেলতেন। একসময় নিজের বাড়িতেও একটি বোর্ড বানিয়ে নিলেন। তাঁর বোনের সঙ্গে খেলতেন। এভাবে ন্যাশনাল টিমেও চান্স পেয়ে গেলেন। তাঁর বোন তো ডাবলে চ্যাম্পিয়ান এবং এককভাবে রানারআপ হয়েছিলেন। অবশেষে চান্স পেলেন বুয়েটের স্থাপত্যে। ভর্তিও হলেন। কিন্তু এ কি! কোন জগতে তিনি প্রবেশ করলেন? এ তো শুধু ছবি আঁকা না, কঠিন কঠিন হিসাব। প্রথম প্রজেক্টেই ফেল। আর্কিটেকচার আর আর্ট এক নয়, সেটা তিনি হাড়ে হাড়ে টের পেলেন। কিছুতেই পেরে উঠছেন না। বারবার ফেল করেন, কালেভদ্রে পাস করলেও টেনেটুনে। প্রথম বর্ষে খুবই কষ্ট হয়েছে। এমনও হয়েছে সিঁড়িতে দাঁড়িয়ে কেঁদেছেন। তিনি বুঝেই উঠতে পারছিলেন না কী করবেন। যা-ই করেন তাতেই ফেল। সবাই তাঁকে উপহাস করত। ক্লাসের ছেলেমেয়েরা কেউ তাঁকে পাত্তা দিত না, সাহায্য করত না। পুরান ঢাকার ছেলে, স্থাপত্যে খরচ মেটাতে ক্লাসে আসতেন একটা পুরোনো বাইসাইকেল চালিয়ে। অন্য সবাই কেতাদুরস্ত, স্মার্ট। অনেকেই আসত গাড়িতে করে। ক্লাসের পেছনের বেঞ্চে বসা ছাত্র, তাই কেউ তাঁকে গ্রুপেও নিতে চাইত না। ভাবত, গ্রুপে কেন নেব ওকে, ও তো ডিজাইন পারে না। সব মিলিয়ে একটা অদ্ভুত হতাশা তৈরি হয়েছিল তখন। স্যারদের বকাঝকা খেতে খেতে কোনোভাবে প্রথম বর্ষ পার করে দ্বিতীয় বর্ষে উঠলেন। শুরু হলো নতুন সংগ্রাম। একজন ডিজাইনের শিক্ষক তিনি তো খাতাই দেখবেন না। তিনি তাঁকে বললেন, এই রকম ড্রয়িং তো দেখতে চাই না। কেন দেখবেন না জানতে চাইলে তিনি বললেন, কারণ, “You are below, below the failing grade.” এতটাই খারাপ ডিজাইন যে নম্বর দেওয়ার অবস্থা নেই। কিন্তু সেই শিক্ষকই একদিন তাঁর জন্য আগা খান অ্যাওয়ার্ডের জন্য সুপারিশ করেছেন। এমনও হয়েছে যে একজন শিক্ষক তাঁকে ডিজাইনে জিরো দিয়েছেন। কারণ জানতে চাইলে তিনি কোনো কথা বললেন না। তখন তিনি তাঁর পথ আগলে বলেন, আপনি যেতে পারবেন না। আপনি আমাকে দেখান, শুধু জিরো দেওয়াটাই আপনার দায়িত্ব না, আপনার দায়িত্ব একটা ছাত্র কীভাবে পাস করতে পারে, তার কী করণীয়; সেটাও শেখানো। এর জন্য তাঁর বিরুদ্ধে তদন্ত কমিটি হয়েছিল। আবার হয়তো অন্যদিন অন্য কোনো শিক্ষক বললেন, আমার মনে হয় তোমার অন্য কোনো প্রবলেম আছে। এমনকি তোমার পরিবারে কোনো মাথা খারাপের দোষ আছে নাকি? এ রকম কঠিন সময় পার করছিলেন তিনি। আর পেরে উঠছিলেন না। শিক্ষক যখন এ ধরনের আখ্যা দিলেন, তখন সিদ্ধান্ত নিলেন স্থাপত্যে আর পড়বেন না। মনে মনে বললেন, ‘আমি কিছু তো পারি। অথচ এখানে কিছু পারছি না সব সময় বকা খাচ্ছি, প্রায়ই ফেল গ্রেড পাচ্ছি, নয়তো টায় টায় ৪০/৪৫ পাচ্ছি।’ ছোটকাল থেকেই সুন্দর ছবি আঁকেন। ভালো আঁকেন বলে অনেক পুরস্কারও পেয়েছেন। তাহলে কেন এত হতাশ! চিত্রকলায় সৌন্দর্য থাকলে স্থাপত্যে কেন থাকবে না! কেন সিঁড়ি আর দরজা মাপতে গিয়ে কবিতা হারিয়ে ফেলব। বাবা যেহেতু বেঁচে নেই সেহেতু বাধারও কিছু নেই। এখন তিনি মুক্ত, স্বাধীন। চলে গেলেন আর্ট ইনস্টিটিউটে (চারুকলা)। সেখান থেকে ফরম সংগ্রহ করলেন। ফরম কিনে পূরণও করলেন।

সে মুহূর্তে পাশে এসে দাঁড়ালেন তাঁরই সহপাঠী বন্ধু। তিনিও তাঁরই মতো ছাত্র। একদিন খুব জিদ করে ক্লাসে চিৎকার করে বলেছিলেন, ‘পাস করলে দেখিয়ে দেব আর্কিটেকচার কী জিনিস, আমরা কি কিছু বুঝি না? বললেই হলো এটা হবে না, ওটা হবে না।’ এত দূর এসে থেমে যাওয়া বা পরিবর্তন করা ঠিক হবে না। মাত্র দুই বছর কোনোভাবেই কেটে যাবে। তার মধ্যেও এক ধরনের প্রতিক্রিয়া হলো, জিদ করলেন; আমি কি পারি না! থার্ড ইয়ারে শুরু করলেন লাইব্রেরিতে যাওয়া, আগে কখনোই এত যেতেন না। বসে পড়তেন, কাজ দেখতেন। সেখানে দেখলেন পৃথিবীর অনেক মহান স্থপতি, শিল্পী, চলচ্চিত্রকার প্রকৃতি নিয়ে কাজ করেছেন। বিশ্বের বড় বড় স্থপতির কাজ সম্পর্কে জানলেন। নতুন আত্নবিশ্বাসের ফিরে পেলেন। তখন আরও জেদি হয়ে উঠলেন। তবে তিনি একবারও বদলে গেলেন না। পাখি, বাগান, উঠান এসবই তিনি বলতেন কিন্তু স্যারেরা বকা দিতেন। আগে যেমন বকা খেয়ে চুপসে যেতেন, তখন রীতিমতো তর্ক করতেন তাঁদের সঙ্গে। যুক্তি দিয়ে তাঁদের বোঝাতে চেষ্টা করতেন, কোন দেশে কোন স্থাপনা এই আদলে হয়েছে তা উদাহরণ দিয়ে বলতেন। স্যাররা তাঁকে বলতেন, বেশি বকবক করে। ভাবতেন ইয়ার্কি করছেন ক্লাসে। পঞ্চম বর্ষে রীতিমতো শিক্ষকদের সঙ্গে ঝগড়া করতেন। সে সময় শামসুল ওয়ারেস স্যারের সান্নিধ্য পান তিনি। এই প্রথম একজন শিক্ষকের ক্লাসে স্থাপত্যের আসল স্বাদ পান। তিনি তাঁর কাজকে সমর্থন দিতেন। তাঁর সঙ্গে গভীরভাবে স্থাপত্য নিয়ে আলোচনা করতেন। মনে মনে তাঁকেই প্রথম গুরু ও প্রিয় শিক্ষক বলে মেনে নেন। তখন মনে হলো স্থাপত্য আসলে কবিতা ও শিল্পের মতো। অবিশ্বাস্যভাবে বদলে গেল পুরো পরিস্থিতি। ক্লাসের সহপাঠীরা তাঁকেই তখন ডিজাইন দেখাত। কেউ কেউ তাঁকে মিরাকেল বলে অবিহিত করল। তারপরও ১৯৮৯ সালে টেনেটুনে সেকেন্ড ক্লাস নিয়ে ব্যাচেলর অব আর্কিটেক্ট পাস করেন।
রফিক আজম সত্যিকারের স্থাপত্য শিখেছেন তাঁর মায়ের কাছে। শুধু তা-ই নয়, প্রথম ডিজাইন করেছেন নিজেদের বাড়ি। তাঁদের বাড়িটি ছিল অনেক পুরোনো। বর্ষা এলে চুইয়ে চুইয়ে পানি পড়ত। বাবা একজন পরিচিত স্থপতিকে ডিজাইন করিয়েছিলেন, এমনকি এক কোণে একটি ঘরও বানিয়েছিলেন। কিন্তু ১৯৮৪ সালে তাঁর মৃত্যুর পর তা বন্ধ হয়ে যায়। এদিকে পরিবারের ভাইবোনেরা সবাই বড় হয়েছেন। বড় ভাই ও বোনের বিয়ে খুব তাড়াতাড়ি কিন্তু বাড়ির পরিসর ছোট। তাই সবাই সিদ্ধান্ত নিলেন আবারও বাড়ির কাজ শুরু করার। সেই স্থপতিকে দিয়েই আবার ডিজাইন করানো হলো। ডিজাইন দেখে তাঁর আম্মা বললেন, এটা কী ডিজাইন? কোনো উঠোন নেই! কোনো বাগান নেই! এ বাড়িতে কীভাবে থাকব? বাবার সঙ্গে বাড়ির অঙিনায় বাগান করা, চাঁদনি রাতে উঠোনে বসে গল্প করা, কোনো স্মৃতিই থাকবে না? এটা কেমন বাড়ি? আমি তোমার বাবাকে হারিয়েছি, তাই বলে তাঁর স্মৃতিকেও হারিয়ে ফেলব? এখানে তো আমি দম বন্ধ হয়ে মারা যাব। তিনি অনেকটা আহত হলেন। কিছুটা ধাক্কা খেলেন রফিক আজম নিজেও। উপলব্ধি করলেন অতীত স্মৃতি ও ঐতিহ্য ধ্বংস করে কোনো স্থাপনা করলে তা কখনো সুখকর হয় না। এটাই তাঁর প্রথম উপলব্ধি, স্থাপত্য একটি স্পেসের ডিজাইন, যা মানুষকে আশা জোগাবে, স্মৃতিকে ধরে রাখবে। এটা তাঁর বিশ্ববিদ্যালয় শেখাতে পারেনি। তিনি তাঁর মাকে কথা দেন, আমি নিজে তোমার জন্য ডিজাইনটি করব এবং তোমার স্মৃতি ফিরিয়ে দেব। তিনি বাড়িতে উঠোন করলেন, ঝুলন্ত বাগান করলেন। তবে কাজটি করা তাঁর জন্য সহজ ছিল না। কারণ, পুরান ঢাকার বাড়িগুলো এমনিতেই ছোট ছোট। খুব একটা খারাপ হয়নি ডিজাইনটা। অনেকেই এটাকে তাঁর স্থাপত্যের মধ্যে অন্যতম মনে করেন।

ছাত্রাবস্থাতেই রফিক আজম বিভিন্ন কাজের সঙ্গে সম্পৃক্ত হন। চতুর্থ বর্ষে পড়াকালীন একটি ইঞ্জিনিয়ারিং অ্যান্ড আর্কিটেকচারাল ফার্মে খণ্ডকালীন কাজ করেন প্রায় আড়াই বছর। বুয়েটের একটি প্রকল্পে পুরান ঢাকার ঐতিহাসিক স্থাপনা বিষয়ে গবেষণা সহযোগী হিসেবে প্রায় আড়াই বছর নিয়োজিত ছিলেন। পাস করেই চার বন্ধু মিলে গড়ে তোলেন স্থপতিক নামক একটি ফার্ম। ১৯৯০ সালে ঢাকা আন্তর্জাতিক বাণিজ্য মেলায় বেক্সিমকোর একটি প্যাভিলিয়ন সম্পূর্ণ কাচ দিয়ে ডিজাইন করেছিলেন। পুরস্কারও জুটে যায় তখন। এর পর করেন দৃক গ্যালারির দ্বিতীয় তলার পুনঃ ডিজাইন। গুলশানে এইচআরসি কোম্পানি লিমিটেডের মালিকের বাড়ি পুনরায় ডিজাইন ইত্যাদি কাজ করেন। একপর্যায়ে ১৯৯২ সালে বিবাহবন্ধনে আবদ্ধ হন তিনি। স্ত্রী ড. আফরোজা আক্তার। বর্তমানে তিনি ইউ ল্যাবে শিক্ষকতায় নিয়োজিত আছেন। কিন্তু যৌথ ফার্ম থেকে তেমন আয় হতো না। তাঁর স্ত্রী একটি এনজিওতে চাকরি করতেন এবং মোটামুটি ভালো সম্মানি পেতেন। ফলে সংসার চলে যাচ্ছিল। তারপরও সব খরচ মেটাতে তাঁকে হিমশিম খেতে হচ্ছিল। তাই চিন্তা করলেন নিজেই কিছু একটা করবেন। সেই ভাবনা থেকেই ১৯৯৫ সালেই প্রতিষ্ঠা করেন নিজের স্থাপত্য প্রতিষ্ঠান। নাম দিলেন সাতত্য। অর্থাৎ সর্বদা চলমান। মধুসূদন দত্তের ‘সতত হে নদ তুমি পড় মোর মনে’ এই কবিতার পঙ্ক্তি সতত থেকেই উদ্ভাবন করলেন নামটি। তাঁর স্ত্রী এই নামকরণে সহযোগিতা করেন। যেহেতু স্থাপত্য ও স্থাপতির কাজ সর্বদা চলমান, তাই এই নামকরণ করেন, যার মূলমন্ত্র ‘সবুজ সচেতন স্থাপত্য’। শুরুতেই বেশ অর্থকষ্টে পড়েন। তখন তাঁর আয়ের কোনো উৎসই ছিল না। স্ত্রীও বিদেশে উচ্চতর ডিগ্রি নেওয়ার জন্য গেছেন। কিছু পরিচিত ক্লায়েন্টের কাজ পেতেন, তাও মাঝে মাঝে। কিন্তু যে কাজই করেছেন খুব যত্ন নিয়ে করতেন। ভিন্ন বৈশিষ্ট্যের হওয়ার কারণে সবার নজর কাড়তে সক্ষম হন। ধীরে ধীরে ক্লায়েন্টও বাড়তে থাকে। বেড়েছে সেই পরিসর আর তা ছাড়িয়ে গেছে দেশের গণ্ডি পেরিয়ে বিশ্বব্যাপী।
২০০৪ সালে একটি স্বল্পমেয়াদি মাস্টার্স কোর্স করতে যান অস্ট্রেলিয়ায়। সেখানে পৃথিবীর বিখ্যাত স্থপতি গ্লেন মার্কাটের সান্নিধ্য পান তিনি। তাঁর কাছেই পেয়ে যান স্থাপত্যের প্রকৃত সংজ্ঞা। স্থপতি শুধু স্থাপত্যকে নিয়েই কথা বলবেন না, বলবেন পুরো প্রকৃতিকে নিয়ে। তাঁকে এটি নাড়া দেয়। তিনি তাঁর চেতনাকে ধারণ করেন। এরই পরিপ্রেক্ষিতে শুধু স্থাপত্যকে বুঝতে বিশ্বের বিভিন্ন দেশে ও বিশেষজ্ঞের কাছে করেছেন অসংখ্য ট্রেনিং। মানুষের আচরণের ধরন-বিষয়ক, কনস্ট্রাশন ম্যানেজমেন্টের ওপর, সিনেমা তৈরি, এডিটিং, আর্কিটেকচার ফটোগ্রাফি, শাস্ত্রীয় সংগীতবিষয়ক, বিশ্বসাহিত্য কেন্দ্রে এক বছরের বিশ্ব সাহিত্য পাঠচক্র, রবীন্দ্রনাথের ওপর এক বছরের কোর্স, জাপানে টপ লেভেল ম্যানেজমেন্ট ইত্যাদি। ঘুরেছেন এ দেশের প্রত্যন্ত গ্রামে, থেকেছেন কৃষকদের সঙ্গে। স্থাপত্যকে দেখেছেন কৃষকের চোখে, তাঁর অভিজ্ঞতার আলোকে। কারণ, একজন কৃষকই প্রকৃতি সম্পর্কে সবচেয়ে বেশি ভালো জানে। কখন বৃষ্টি আসবে, কোন দিক থেকে বাতাস হবে। তারা ফসল ফলায় প্রকৃতির ওপর নির্ভর করেই। আগে এ দেশে অসংখ্য সুন্দর সুন্দর খোলামেলা উঠানযুক্ত বাড়ি হতো। গ্রামের মানুষ প্রকৃতিকে খুব ভালোভাবে বুঝতে পারত। তখন প্রবাদ ছিল, ‘দক্ষিণ দুয়ারী উত্তম বাস, উত্তর দুয়ারী সর্বনাশ, পূবে হাঁস, পশ্চিমে বাঁশ।’ এই প্রবাদটির মধ্যে যে অর্থ রয়েছে- দক্ষিণামুখী বাড়ির মুখ, বাড়িতে জলাশয়, বাগান এই সবকিছু এ ধরনের প্রবাদ থেকেও তিনি শিখেছেন। রোদেরা কীভাবে খেলা করে, সূর্য কোন মাসে কোথা থেকে ওঠে, কোথায় অস্ত যায়। কোন মাসে কোন দিক দিয়ে বাতাস প্রবাহিত হয়। কোন গাছ লাগালে ভবনটির সঙ্গে খাপ খাবে। একটি মানুষের কখন কোন জায়গা পছন্দ হয়। এসবের নির্যাস নিয়েই ছোট্ট একটি স্থাপনা তৈরি করেন, যেখানে থাকে ভালো লাগার সবকিছু।

১৯৯৮ সালে আর্কিটেকচারের ওপর একক প্রদর্শনী করেছিলেন নিউইয়র্কে। ২০০০ সাল শেষ হয়ে যাচ্ছে, পৃথিবীর ইতিহাসে স্থাপত্য নিয়ে অনেক প্রদর্শনী হয়েছে কিন্তু বাংলাদেশের স্থাপত্য হাজার হাজার বছর ধরে এত সমৃৃদ্ধ থাকার পরও স্থপতিদের কেউ কোনো আন্তর্জাতিক প্রদর্শনীতে অংশ নেননি। যেহেতু তিনি স্থাপত্য করেন ও ছবি আঁকেন, তাই একটি প্রদর্শনী করার কথা ভাবেন। তাঁর দুজন বন্ধুর সহায়তায় পৃথিবীখ্যাত চেলসিয়া ভবনে প্রদর্শনী করেন। কিন্তু ওয়াটার কালারের দু-একটা কাজের প্রশংসা ছাড়া আহামরি কোনো সাড়া পাননি। তিনি চরম হতাশ হয়ে ফিরে এলেন। উপলব্ধি করলেন বুয়েট থেকে যা শিখেছেন তা দিয়ে মনের মাধুরী মিশিয়ে যা করছেন, তাতে হয়তো বা একটা জায়গা তৈরি হয়েছে। কিন্তু কাজের ক্ষেত্রে আরও আন্তরিক হতে হবে, নিজস্ব ঢংয়ে ভিন্ন কিছু করতে হবে। বিশ্বে দাঁড়াতে হলে নিজস্ব কিছু লাগে। কী করলে বাঙালিয়ানা আসবে তা নিয়েই চিন্তামগ্ন হলেন। আবার লাইব্রেরিতে যাওয়া শুরু করলেন। নিজেও অনেক বই কিনে অধ্যবসায় করলেন। তাঁর ভেতর নতুন চেতনাবোধের জাগ্রত হলো। বুঝলেন, আমাদের আছে অফুরন্ত সম্পদ। প্রায় ২০০ বছর ধরে ব্রিটিশরা শিখিয়েছে আমরা ফকির, আমরা গরিব, আমাদের কিছু নেই, যার পুরোটাই মিথ্যা। আসলে আমাদের যা আছে, ওদের তা নেই। এই যে পানি, যেটাকে আমরা সমস্যা বলি, এ রকম পানি কার আছে? কিন্তু আমরা মনে করি, বন্যা একটা সমস্যা। কিন্তু তিনি দেখলেন পানি বা বন্যা না হলে এত ফসল ফলত না। পানি আছে বলেই শস্য উৎপাদন হয়, কোটি কোটি মানুষ বেঁচে থাকতে পারছে। এই চেতনাবোধই হয়ে ওঠে তাঁর ঘুরে দাঁড়ানোর মূলমন্ত্র। তিনি খুঁজে পেলেন দেশের ঐশ্বর্য ভান্ডার। বিদেশি ঘরানার স্থাপনা তৈরি করলেও তাতে মেখে দিলেন বাঙালিপনা। সুইমিংপুলের বদলে করলেন পুকুর। পুকুরে দিলেন ঘাট, ঘাটে দিলেন নৌকা। ফলে এগুলোই হয়ে উঠল আকর্ষণীয়। খুঁজে পেলেন লালনকে। ভবনকে করলেন দেহ খাঁচা। খাঁচার ভেতর পাখি আনতে যা যা করতে হয় করলেন। প্রকৃতির সঙ্গে স্থাপনাকে বাতচিত করালেন। গ্রামের পুকুর, বাড়ির উঠান, পুরান ঢাকার শৈলী এসবের মাধ্যমে শহর ও গ্রাম কখন যে মিলেমিশে একাকার হয়ে গেল তার স্থাপত্যে। জানালা দিয়ে আসা সকালের রোদ ফিতা, কম্পাস দিয়ে মাপতেন। মাসের পর মাস মেপে দেখেছেন সূর্য এক জায়গায় ওঠে না। কেন শীতকালে এক রকম, গ্রীষ্মকালে অন্য রকম; আবার এ দেশে থেকে অন্য দেশে কেন আলাদাÑ এসব রহস্যের সমাধান করেন তিনি। প্রকৃতিতে বাতাসের খেলার রহস্য বের করেন। তিনি উপলব্ধি করেন একজন স্থপতি শুধু স্থাপত্য ডিজাইন করেন না, করেন মানুষের মনস্তত্ত্ব। শিল্পকলার যত মাধ্যম আছে- চিত্রকলা, সঙ্গীত, সিনেমা, নাটকÑ এর সবকিছুরই অস্তিত্ব রয়েছে কিন্তু তার বাস্তব স্পর্শ পাওয়া যায় না। শুধু পারে স্থাপত্য, যা বাস্তবতার পাশাপাশি মানুষের অনুভূতির জগৎকেও নাড়াতে পারে। স্থপতি শুধু ভবনের ডিজাইন করেন না, জীবনেরও ডিজাইন করেন। তাই তো স্থাপত্যকে বলা হয় ‘মাদার অব অল আর্টস’।
প্রকৃতির সঙ্গে মানুষের অকৃত্রিম সম্পর্ক, এই বাস্তবতাকে স্থপতি রফিক আজম গভীরভাবে উপলব্ধি করেন। প্রকৃতির সংস্পর্শে থাকতে চাওয়া তাঁর আদিম ও অকৃত্রিম প্রবৃত্তি। তাই তো তিনি চান তাঁর ঘরটি বড় হোক, সুন্দর একটি বারান্দা থাক; যেন দক্ষিণা বাতাস আসে। বড় বাসা বড় আশা, ছোট বাসা, ছোট আশা, ছোট বাসায় এক চিলতে রোদ আসবে, বড় বাসায় বেশি এমনটি হয় না। কারণ, নিজের বাড়িটিকে ঘিরে সবারই একই রকম আশা। প্রতিটি মানুষেরই চাওয়ার মধ্যে সৌন্দর্য আছে। সেগুলোকে তিনি না করেন না কিন্তু তিনি তাঁদের বলেন, আপনি যে এগুলো চাইলেন, আমি এর সবই দিচ্ছি, আমাকে কিছুটা জায়গা দেন, যেখানে আমি বাগান করব, বৃষ্টিতে আপনি ভিজতে পারবেন, সরাসরি বাতাস ঘরে ঢুকবে, জলাশয় দেব, গাছ দেব, তাহলে কেউ না বলবেন না! বাড়ির রুম বা খুপরি ছাড়াও এগুলোর স্বপ্ন দেখান ক্লায়েন্টকে। যে স্বপ্ন স্থপতিরা ক্লায়েন্টকে দেখাতে পারেন না। মানুষ এত অযৌক্তিক না, তাঁকে যদি বুঝিয়ে বলা হয় তাহলে তিনি তা করতে আগ্রহী হন। তখন তিনি তো নিশ্চয়ই নেবেন। আমি একটা বাগান পেলাম, গাছ দেখতে পারলাম জানালা দিয়ে অথবা পানির ফোয়ারা, তখন ওগুলো রাখতে চাই। তাঁর বোধটাকে একটু জাগিয়ে দেওয়া এই। একটা স্বপ্ন শুরু হয়ে যায়। আমাকে একটু জায়গা দেন আমি বাগান করে দিই, কেউ না করেন না। পরিবেশের জন্য ক্ষতিকর ক্লায়েন্ট এমন কোনো আবদার তিনি কিছুতেই রাখেন না।

বাংলাদেশে কনক্রিটের জনপ্রিয়তা তাঁর হাত ধরেই শুরু হয়েছে। তাঁর স্থাপত্যে কনক্রিটের অধিক ব্যবহার লক্ষণীয়। প্রয়োজনে ইটের ব্যবহারও করেন। কারণ, এর জন্য বাড়তি কোনো প্লাস্টার করার প্রয়োজন হয় না। স্থাপনার জন্য এটা খুবই শক্ত, নিরেট একটি নির্মাণ উপাদান। অন্য কোনো উপাদান এত স্থায়ী হয় না। বাংলাদেশের মতো দেশে এটা খুবই কার্যকরী। কারণ, আমাদের জলবায়ুতে ময়েশ্চার অনেক বেশি। আর্দ্রতা বেড়ে গেলে ও ময়েশ্চার কমে গেলে এখানে ব্যাকটেরিয়া উৎপন্ন হয়। বাড়ির বাইরে রং করলে তা জলবায়ুর সঙ্গে খাপ খাওয়াতে পারে না। স্থাপনার বিম ও কলাম খোলা রাখেন, যাতে ভবনের ত্রিমাত্রিক রূপ বাইরে থেকেও দেখা যায়। স্থাপনার ক্ষেত্রে তিনি চেষ্টা করেন যত সম্ভব হালকা ধাঁচের করা যায়। এ জন্য কনক্রিটকেও নমনীয় করে ব্যবহার করেছেন, পুরুত্ব আস্তে আস্তে কমিয়ে এনেছেন, কখনো কখনো ছাদের কার্ণিশে কনক্রিটের পরিবর্তে কাচ ব্যবহার করেছেন। ভারী ছাদের বদলে এর আবরণ পাতলা করায় ভবনটি দেখতে লাগে পাখির ডানার মতো। ভবনকে করে তোলেন একটি গাছের আদলে। গাছ যেমন নিচ থেকে মোটা হতে হতে সরু হয়ে যায়। ঠিক তেমন। ওপরে পাতাগুলো ফিনফিন করে।
বর্তমানে কিছু ভিন্নধর্মী কাজ করছেন তিনি। নতুন আইনে যে ভবন তৈরির নিয়ম চালু হয়েছে, সেগুলোকে ধারণ করে ভবন ডিজাইন। যেগুলো শহরের ল্যান্ডস্কেপের অংশ হয়ে যায়। এখনকার ভবনগুলোর শুধু সামনের অংশই দেখা যায় খুব সুন্দর কিন্তু তার পেছনে কী আছে তা দেখা যায় না। আপনি তাকাচ্ছেন, চোখ চলে যাচ্ছে বহুদূর। আপনার ভেতরেও জাগছে কৌত‚হল। আপনি ভেতরটাও দেখতে আগ্রহী হয়ে উঠছেন। তিনি এমনভাবে ভবন ডিজাইন করছেন, যা শুধু ভবনের সামনের অংশকেই প্রদর্শন করবে না বরং পেছনের সৌন্দর্যকেও। পেছনে দেখা যাবে সবুজ বনানী, সবুজ ঘাসের লন। ওপর থেকে বা কোনাকুনিও দেখা যাবে। শহরটাকে তখন ঘিঞ্জি মনে না হয়ে ফাঁকা ফাঁকা মনে হবে। ভবনগুলো ছবির মতো দেখাবে। চোখ আটকে যাবে না, চলে যাবে বহুদূর। তখন ভবনটি হবে শহরের সৌন্দর্যবর্ধনের অংশ। তখন এটিকে একটি ভবন মনে না হয়ে মনে হবে প্রকৃতি ও সমাজের অংশ। ভবনটিকে শহরের সবার মনে হবে, যেন রাস্তার কোনো গাছ। জলাশয় দেখা যাবে, যেখানে কোনো দেয়াল থাকবে না। তখন সৃষ্টি হবে এক নতুন গতি। শহরের জীবনধারার পরিবর্তন আনতে চান।
তিনি বিশ্বের বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ে স্থাপত্য বিষয়ে ভিজিটিং ফ্যাকাল্টির দায়িত্বরত আছেন। এসব বিশ্ববিদ্যালয়ের মধ্যে রয়েছে, দ্য ন্যশনাল ইউনির্ভাসিটি অব সিঙ্গাপুর এবং এনইডি ইউনির্ভাসিটি অব পাকিস্তান, দেশে এশিয়া প্যাসিফিক ইউনির্ভাসিটি, ব্র্যাক ইউনির্ভাসিটি, নর্থসাউথ, আহসানউল্লাহ ইউনির্ভাসিটি, প্রভৃতি। ছাত্র রফিক আজম টেনেটুনে পাস হলেও শিক্ষক হিসেবে যথার্থই। কলকাতার যাদবপুরে, পাকিস্তানে তাঁর নামে রফিক আজম ট্রাভেল স্কলারশিপ দেওয়া। সেখানে কথা বলেন বাংলাদেশকে নিয়ে, বাংলার ঋতু, পানি, প্রকৃতিকে নিয়ে। বাংলাদেশের সমস্যাকে সমস্যা মনে করেন না, দেখেন প্রকৃতির অংশ। পাশাপাশি বাংলাদেশের মহান ব্যক্তিত্ব যাঁরা আছেন- লালন, জীবনানন্দ দাস, জগদীশ চন্দ্র বসুর জীবন দর্শন তুলে ধরেন। তাঁদের দর্শনের সঙ্গে ভবনের সম্পর্ক তুলে ধরেন। বলেন, এ দেশের হাজার বছরের বাড়িঘরের কথা, যেগুলো সম্পূর্ণই পরিবেশবান্ধব। যেগুলো তৈরি করতে স্থাপত্যের মোটা মোটা বই পড়তে হয় না, জটিল অংক কষতে হয় না, আধুনিক প্রযুক্তি বা যন্ত্রপাতির প্রয়োজন হয় না। আজকে যেখানে গ্রিন বিল্ডিং তৈরিতে সবাই ব্যস্ত।
তিনি দেশে-বিদেশে অনেক গুরুত্বপূর্ণ স্থাপনার নকশা করেন। তাঁর নকশা করা কাজের মধ্যে রয়েছে মালয়েশিয়ায় বেশকিছু গুরুত্বপূর্ণ ভবন, পাকিস্তানে বাংলাদেশ দূতাবাস ভবন, ঢাকায় সিক্স সিজন ভবন, শূন্যতায় উন্মুক্ততা। তাঁরই একটি স্থাপত্য মালেশিয়ায় তৈরি হচ্ছে, যা দেশটির ইতিহাসে প্রথম কোনো স্থাপত্য, যেটা রেটিং পেয়েছে প্লাটিনাম, সর্বোচ্চ স্বীকৃতি। মালয়েশিয়ার একটি আইকন ভবন হতে যাচ্ছে। খুব শিগগিরই এর কাজ শেষ হবে। গুলশান-২-এ ডিজাইন করেছেন ‘শূন্যতায় উন্মত্ততা’। এস এ রেসিডেন্স। দেশে-বিদেশে বেশকিছু স্থাপনা করলেও একসময় রফিক আজমের উপলব্ধি হয় গ্রামেও স্থাপনা করা উচিত। এ জন্য ছোট পরিসরে চাঁদপুর, সাভার, জয়দেবপুরসহ কিছু কিছু স্থাপনা করেছেন। তবে এখনো মনের মতো কাজ করতে পারেননি। তাই পরবর্তী কাজটিকেই উল্লেখযোগ্য করে গড়তে চান।

রফিক আজম এরই মধ্যে অনেক আন্তর্জাতিক পুরস্কার পেয়েছেন, বিশ্বব্যাপী তরুণ স্থপতিদের জন্য শ্রেষ্ঠ এবং সবচেয়ে বড় পুরস্কার
২০১২ : উইনার অব এমিরাতস গ্লাস লিডিং ইউরোপিয়ান আর্কিটেক্টস’ ফোরাম (এলইএএফ) অ্যাওয়ার্ড
২০১২ : উইনার অব ওয়ার্ল্ড আর্কিটেক্টারাল কমিউনিটি অ্যাওয়ার্ড, ১১তম সাইকেল
২০১২ : দি সাউথ এশিয়ান ‘আর্কিটেক্ট অব দি ইয়ার’ অ্যাওয়ার্ড ২০১১
২০০৯ : উইনার, সিটিস্কেপ আর্কিটেক্টার অ্যাওয়ার্ড ফর দি ‘প্রজেক্ট এস এ রেসিডেন্স’, ঢাকা।
২০০৯ : উননার, পঞ্চম সাইকেল, ওয়ার্ল্ড আর্কিটেক্টারাল কমিউনিটি অ্যাওয়ার্ড
২০০৯ : উননার, ১ম সাইকেল, ওয়ার্ল্ড আর্কিটেক্টারাল কমিউনিটি অ্যাওয়ার্ড
২০০৭ : দি ২০০৭ কেনেথ এফ. ব্রাউন, এশিয়া প্যাসিফিক কালচার অ্যান্ড আর্কিটেকচার ডিজাইন অ্যাওয়ার্ড, ইউএসএ
২০০৭ : এআর এমার্জিং আর্কিটেকচার অ্যাওয়ার্ড, লন্ডন
১৯৯৯ : ইয়াং আর্কিটেকচার’স অ্যাওয়ার্ড ইন সাউথ এশিয়ান আর্কিটেকচার অ্যাওয়ার্ড
১৯৯৬ : আইএবি ডিজাইন অ্যাওয়ার্ড
১৯৯১ : উইনার, মিমার ইন্টারন্যাশনাল ডিজাইন প্রতিযোগিতা- ঠওও, লন্ডন
এ ছাড়া তিনি এখনো পর্যন্ত মোট ৩৫টি আন্তর্জাতিক পুরস্কার অর্জন করেন। ২০০৪ ও ২০০৭ সালে আগা খান স্থাপত্য পুরস্কারের চ‚ড়ান্ত পর্বে মনোনয়ন পেয়েছিলেন। বাংলাদেশের ভেতরও বেশ কটি নামী পুরস্কার তাঁর হাতে এসেছে। বিশ্বের সবচেয়ে পুরোনো ও প্রভাবশালী আর্কিটেকচার জার্নাল দি আর্কিটেকচার রিভিউয়ে রফিক আজমকে নিয়ে প্রতিবেদন ছাপা হয়, যা একটি বিরল ঘটনা। প্রায় দেড় শ বছরের পুরোনো আরবান ল্যান্ড ইনস্টিটিউট রিসার্চ ম্যাগাজিন ২০০৮ সালের নভেম্বর-ডিসেম্বর সংখ্যায় বিশ্বের যে ১০ জন স্থপতিকে প্রতিশ্রুতিশীল স্থপতি বলে উল্লেখ করা হয়, সেখানে স্থপতি রফিক আজম ছিলেন এক নম্বরে। এ ছাড়া বিশ্বের অসখ্য সাময়িক ও দৈনিকে তাঁকে নিয়ে প্রতিবেদন ছাপা হয়।
ছোটবেলা থেকেই খেলাপাগল ছিলেন রফিক আজম। দুর্দান্ত ফুটবল খেলতেন। স্কুল ও কলেজ টিমে খেলেছেন। বুয়েটের হল টিমেও খেলেছেন। পরপর তিনবার তাঁর ফুটবল টিম চ্যাম্পিয়ন হয়েছিল। মুক্তিযোদ্ধা ফুটবল দলের দলনেতা জাকারিয়া পিন্টু ছিলেন তাঁর কোচ। তাঁর কাছেই ফুটবল খেলা শিখেছেন। খুবই সখ্য ছিল তাঁর সঙ্গে। এ ছাড়া আজাদ পত্রিকায় গ্রাফিক্স ডিজাইন করতেন। দাদা ভাইয়ের কিশোর বাংলা পত্রিকায়ও যুক্ত ছিলেন। পত্রিকাটির বেশ কিছু সংখ্যার কাভার ডিজাইন করেছেন। ঈদসংখ্যায় বাংলাদেশের প্রথম ছড়ার সঙ্গে ছবির প্রথা তিনিই চালু করেন। স্থাপত্য পেশার পাশাপাশি চিত্রাঙ্কন এবং ফটোগ্রাফিতেও সমান পারদর্শী। দেশে এবং বিদেশে তাঁর একাধিক প্রদর্শনী হয়েছে এবং তিনি একাধিকবার চিত্রশিল্পী হিসেবে বাংলাদেশ, ভারত, রাশিয়ায় পুরস্কৃত হয়েছেন। এ ছাড়াও বেশ কিছু জাতীয় ও আন্তর্জাতিক স্থাপত্য প্রতিযোগিতার সম্মানিত জুরির দায়িত্ব পালন করেছেন। বর্তমানে তিনি ইনস্টিটউট অব আর্কিটেক্টস বাংলাদেশ (আইএবি) ও এরটিএসের একজন সম্মানিত সদস্য। তিনি সাতত্য আর্কিটেকচার ফর গ্রিন লিভিং প্রতিষ্ঠানটির প্রিন্সিপাল আর্কিটেক্ট ও স্বত্বাধিকারী।

তাঁর স্থাপত্যে বিশ্বের খ্যাতনামা স্থপতিদের চেতনাকে ধারণা করেন। তাঁর আদর্শের নাম স্থপতি গেøন মার্কাট। এ ছাড়া জেফরি বাওয়ার কাজেও অনুপ্রাণিত হন। দেশীয় স্থপতিদের মধ্যে মাজহারুল ইসলাম, উত্তম কুমার সাহা, বশিরুল হক, শামসুল ওয়ারেসসহ তরুণ অনেক স্থপতির কাজও ভালো লাগে তাঁর। তাঁর এক ছেলে আরাফ দায়াদ আজম। খুবই সাধারণ জীবনযাপন করেন তিনি। ডাল-ভাতই তাঁর ভালো লাগে। অবসরে বই পড়েন, মাকে ও পরিবারের অন্য সদস্যদের সঙ্গে দেখা করতে যান। আজকের এই অবস্থান এবং এখনো স্থাপত্য করতে পারার জন্য পরিবার, মা, স্ত্রী, সহকর্মী, ক্লায়েন্টসহ সবার কাছেই তিনি কৃতজ্ঞ।
মানুষের যে আকাঙ্খা, যে স্পেস বা পরিসর ধারণ করতে পারে এবং তা আরও প্রসারিত করতে পারে, সেটাই স্থাপত্য। পরিসরটি আপনাকে শক্তি, আশা জোগাবে, স্বপ্ন দেখাবে, সেটাই স্থাপত্য। তরুণ প্রজন্মের মধ্যে রয়েছে ব্যাপক স্পৃহা। নিজের অনুভ‚তিকে সবার মধ্যে ছড়িয়ে দিতে চান। তারা বিশ্বজয় করতে চায়, সেই স্বপ্ন বাস্তবায়নে তাদের পাশে থাকতে চান। তিনি চান আর্কাইভ বা জাদুঘর তৈরি করতে। ছোট কোনো ইনস্টিটিউশন তৈরি করতে, যেখানে সমাজ ও পরিবেশ নিয়ে কাজ হবে, আড্ডা হবে। তারই প্রস্তুতি নিচ্ছেন। ঢাকাকে তিলোত্তমা নগরে পরিণত করতে চান। মানবতাপূর্ণ একটি সমাজ গড়ারই স্বপ্ন দেখেন তিনি।
মাহফুজ ফারুক
প্রকাশকাল: বন্ধন ৩৬ তম সংখ্যা, এপ্রিল ২০১৩