বীর মুক্তিযোদ্ধা ড. মো. নূরুল আলম তালুকদারের জন্ম ১৯৫৪ সালের ১ জানুয়ারি, টাঙ্গাইলের ঘাটাইলে। বাবা আবুল হোসেন তালুকদার, মা নূরজাহান বেগম। অর্থনীতিতে স্নাতকোত্তর সম্পন্ন করে পিএইচডি করেন একই বিষয়ে। আশির দশকের শুরুতে কর্মজীবন শুরু বাংলাদেশ কৃষি ব্যাংকে প্রথম শ্রেণীর কর্মকর্তা হিসেবে। এরপর আনসার-ভিডিপি উন্নয়ন ব্যাংকের মহাব্যবস্থাপক, অগ্রণী ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালক (চলতি দায়িত্ব) হিসেবে দায়িত্ব পালন শেষে ব্যবস্থাপনা পরিচালক হিসেবে যোগ দেন বাংলাদেশ হাউস বিল্ডিং ফাইনান্স কর্পোরেশনে। অদ্যাবধি এ দায়িত্বেই রয়েছেন। কর্মসূত্রে পেশাগত প্রশিক্ষণ নিয়েছেন দেশ-বিদেশে। গুণী এ ব্যক্তিত্ব মুখোমুখি হয়েছিলেন বন্ধন-এ। জানিয়েছেন বাংলাদেশ হাউস বিল্ডিং ফাইনান্স কর্পোরেশনের (বিএইচবিএফসি) সাম্প্রতিক কর্মকান্ড ও আগামীর কর্মপরিকল্পনা সম্পর্কে। সাথে ছিলেন শামস আহমেদ
দেশের আবাসন সমস্যা সমাধানে বাংলাদেশ হাউস বিল্ডিং ফাইনান্স কর্পোরেশন (বিএইচবিএফসি)’র ভূমিকা কতটুকু?
আবাসন সমস্যা একটি ব্যাপক বিষয়। স্বল্পোন্নত ও অধিক জনসংখ্যার দেশ হিসেবে বাংলাদেশের অধিকাংশ মানুষের এটি সাধারণ সমস্যা। প্রাকৃতিক দুর্যোগপ্রবণ দেশ হিসেবে অনেকদিন ধরেই সমস্যাটি আমাদের নিত্যসঙ্গী। উপরন্তু স্বাধীনতার সময় হানাদার বাহিনীর বর্বর ধ্বংসযজ্ঞে এটি আরও প্রকট রূপ নেয়। দেশের গৃহায়ন সমস্যা সমাধানে সরকারি পর্যায়ে গৃহায়ন ও গণপূর্ত মন্ত্রণালয় এবং জাতীয় গৃহায়ন কর্তৃপক্ষের রয়েছে বিভিন্ন প্রকল্প। বাংলাদেশ হাউস বিল্ডিং ফাইনান্স কর্পোরেশন (বিএইচবিএফসি) গৃহায়নে ঋণ দানকারী একমাত্র রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠান। এই প্রতিষ্ঠানটি দেশের গৃহায়ন সমস্যা সমাধানে কাজ করছে। গৃহায়নে বিএইচবিএফসি সীমিত সামর্থ্যে ঋণ সহায়তা দিয়ে যে ভূমিকা রাখছে, তা নিতান্ত কম নয়। প্রতিষ্ঠানটি এ পর্যন্ত ১,৮৮,৬১০টি হাউজিং ইউনিট নির্মাণে ৪,৪৭৮.৬১ কোটি টাকার ঋণ সহায়তা দিয়েছে। বিএইচবিএফসি’র ঋণ সহায়তায় প্রায় ১৫ লক্ষ মানুষ মানসম্মত আবাসন সুবিধার আওতায় এসেছে। পর্যাপ্ত তহবিলের সংস্থান থাকলে আবাসন সমস্যা সমাধানে প্রতিষ্ঠানটি তাৎপর্যপূর্ণ ভূমিকা রাখতে পারবে।

নতুন আবাসন নির্মাণে সহজ শর্তে ঋণ পেতে কি কি করণীয়?
বিএইচবিএফসি’র ঋণ পাওয়ার ক্ষেত্রে দেশের সব নাগরিকের জন্য শর্ত একই। প্রদেয় ঋণের টাকা নিয়মিত মাসিক কিস্তিতে আদায় হবে, এটা নিশ্চিত করতে কর্পোরেশন নির্মিতব্য বাড়িতে যথাযথ বিনিয়োগ নিশ্চিত করার শর্তে কোনরূপ আপোষ করে না। কর্পোরেশন থেকে ঋণ পেতে অবশ্য পালনীয় গুরুত্বপূর্ণ শর্ত হচ্ছে-
১. আবাসিক ভবন নির্মাণের জন্য বন্ধক প্রদেয় জমির নিষ্কন্টক মালিকানা প্রমাণ করা;
২. পৌরসভা বা নগর কর্তৃপক্ষ অনুমোদিত নকশা মোতাবেক নির্মাণ নিশ্চিত করা;
৩. নির্মিতব্য স্থাপনা থেকে ঋণের মাসিক কিস্তি পরিশোধ ও ভবন রক্ষনাবেক্ষনে প্রয়োজনীয় অর্থের সমপরিমাণ ভাড়া প্রাপ্তি নিশ্চিতকল্পে যথেষ্ট পরিমাণ স্পেস নির্মাণ সম্পন্ন করা এবং
৪. ফ্ল্যাট ঋণের ক্ষেত্রে মাসিক কিস্তি পরিশোধের জন্য পর্যাপ্ত আয়ের নিশ্চয়তা বিধান করা।
ব্যাংক ঋণ ও বিএইচবিএফসি ঋণের মধ্যে তুলনামূলক পার্থক্য কোথায়?
সম্প্রতি বিভিন্ন বেসরকারি ব্যাংক বাণিজ্যিকভিত্তিতে গৃহ নির্মাণে ঋণ প্রদান করছে। এসব ব্যাংক এ লক্ষ্যে ব্যক্তি ও প্রতিষ্ঠানকে ঋণ দিয়ে থাকে। অন্য দশটি লাভজনক খাতে ঋণ প্রদানের যে লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য এ ক্ষেত্রেও তা ভিন্ন কিছু নয়। প্রথমত: সাধারণ আমানতকারীদের নিকট থেকে সংগৃহীত তহবিল লাভজনকভাবে লগ্নী করায় ব্যাংক ঋণের সুদের হার অনেক বেশি। পক্ষান্তরে, কর্পোরেশন ঢাকা ও চট্টগ্রাম মেট্টো এলাকায় ১২ শতাংশ এবং এ দুটি মেট্রো এলাকার বাইরে সারাদেশে ১০ শতাংশ হারে সরল সুদে ঋণ দেয়।
দ্বিতীয়তঃ বাণিজ্যিক ব্যাংক এ খাতে ঋণ প্রদানের ক্ষেত্রে বাণিজ্যিক ও আবাসিক উভয় প্রকারের ইমারতকেই বিবেচনায় নিতে পারে। বিএইচবিএফসি শুধুমাত্র আবাসিক ভবন নির্মাণে ঋণ দেয়।
তৃতীয়তঃ ঋণের স্বল্প মেয়াদ এবং উচ্চহার সুদের কারণে তুলনামূলক অনুন্নত এলাকা এবং মফস্বলে ব্যাংকগুলোর পক্ষে ঋণ দেয়া সম্ভব হয় না।
চতুর্থতঃ লাভজনক কোন প্রকল্পে ব্যাংক উপযুক্ত জামানত বা গ্যারান্টির বিপরীতে বিপুল পরিমাণ অর্থের ঋণ ছাড় করতে পারে। কিন্তু বিএইচবিএফসি কোন অবস্থাতেই নির্ধারিত সর্বোচ্চ সিলিংয়ের অতিরিক্ত অর্থ ছাড় করতে পারে না।
পঞ্চমতঃ ব্যাংকের বিপুল অংকের ঋণযোগ্য তহবিল থাকায় উন্নত এলাকায় এ খাতে তাদের হাজার হাজার কোটি টাকার ঋণের সমারোহ ঘটে। পক্ষান্তরে, বিএইচবিএফসি’র সামর্থ্য ক্ষুদ্র হলেও ঋণ বিতরণের ক্ষেত্রে দেশের উন্নত ও উন্নয়নশীল সকল এলাকার মধ্যে তার সুষম বন্টন করে থাকে। বাস্তবে, উন্নত, স্বল্পোন্নত এবং অনুন্নত এলাকা নির্বিশেষে দেশের আবাসন অবকাঠামোর সুষম উন্নয়নে বিএইচবিএফসি’র মতো বিশেষায়িত আর্থিক প্রতিষ্ঠানের ঋণের বিকল্প এখনো তৈরি হয়নি।

চাহিদা অনুযায়ী ঋণ প্রদানে বিএইচবিএফসি’র সীমাবদ্ধতা আছে কি? থাকলেও তা কতটুকু ?
চাহিদা অনুযায়ী ঋণ প্রদানে বিএইচবিএফসি’র সীমাবদ্ধতার বিষয়টি বর্তমানে অতি প্রাসঙ্গিক এবং গুরুত্বপূর্ণ। এখন কর্পোরেশনে প্রতিবছর কয়েক হাজার কোটি টাকার ঋণের চাহিদা রয়েছে। ২০১৩ সালের প্রথম ছয় মাসে দেশের কয়েকটি গুরুত্বপূর্ণ জেলায় নতুন আঞ্চলিক অফিস চালুর ফলে এ চাহিদা আরো বেড়েছে। সরকারের সুষ্ঠু অর্থনৈতিক ব্যবস্থাপনার ফলে বিশ্বব্যাপী অর্থনৈতিক মন্দা সত্ত্বেও দেশের মানুষের আয়-উপার্জন বেড়েছে। সার্বিকভাবে মানুষের জীবনমান এবং ক্রয় সামর্থ্যরে উন্নয়নের ফলে স্বাস্থ্য ও মানসম্মত আবাসস্থলের চাহিদাটা উত্তরোত্তর বেড়েছে। এর ফলে বিএইচবিএফসি’র ঋণের চাহিদা বর্তমানে আগের যে কোন সময়ের চেয়ে অনেক বেশি। পক্ষান্তরে, কর্পোরেশনের অনুমোদিত ও পরিশোধিত মূলধনের পরিমাণ আদৌ বাড়েনি। প্রতিষ্ঠানটির অনুমোদিত ও পরিশোধিত মূলধন মাত্র ১১০ কোটি টাকা। বিগত দশ বছরে সরকারি ঋণ বা আমানতের পরিমাণ ৩৩৫.২১ কোটি টাকা মাত্র। কর্পোরেশনের অনুমোদিত ও পরিশোধিত মূলধন বৃদ্ধির লক্ষ্যে কর্পোরেশনের P.O-7 এ সংশোধনী আনার জন্য একটি প্রস্তাব অর্থ মন্ত্রণালয়ের বিবেচনাধীন। গত ৬ মে মন্ত্রণালয়ে অনুষ্ঠিত সভায় P.O-7 সংশোধন সংক্রান্ত বিষয়ে কর্পোরেশনের পক্ষ থেকে সরকারের সব ধরনের প্রশ্নের জবাব দেয়া হয়েছে। প্রসঙ্গত, প্রতিষ্ঠানটি যাতে তহবিলের দিক দিয়ে স্বাবলম্বী হতে পারে সে লক্ষ্যে সীমিত মাত্রায় আমানত গ্রহণের প্রস্তাবও দেয়া হয়েছিল।
সম্প্রতি তিন বছরে কর্পোরেশনের বার্ষিক আদায়যোগ্য অর্থ গড়ে ৫৪১.৯১ কোটি টাকা। এ সময়ে আদায় লক্ষ্যমাত্রার বিপরীতে বার্ষিক গড়ে ৪২৮.০৫ কোটি টাকা আদায় হয়েছে। গত ৩ বছরে আদায়ে লক্ষ্যমাত্রা অর্জনের হার ৭৮.৯৯ শতাংশ। কিন্তু সকল খরচ-খরচা বাদ দিয়ে এ পরিমাণ অর্থ হতে বছরে গড়ে ৩৫০-৪০০ কোটি টাকার বেশি ঋণ দেয়া সম্ভব হয় না। কয়েক হাজার কোটি টাকার চাহিদার বিপরীতে তিন-চারশ কোটি টাকার ঋণ জনগনের চাহিদা ও প্রত্যাশা পূরণ করতে পারছে না।
দেশের সাধারণ মানুষের জন্য পর্যাপ্ত গৃহ ঋণের সংস্থান করতে বিএইচবিএফসি কি ধরনের পদক্ষেপ নিচ্ছে?
পর্যাপ্ত ঋণের সংস্থান করতে বিএইচবিএফসি কর্তৃপক্ষ সবসময়ই শতভাগ আন্তরিক। তবে, তহবিল স্বল্পতার অচলায়তন ভেঙ্গে প্রতিষ্ঠানটি কোনমতেই বেরিয়ে আসতে পারছে না। দীর্ঘ ৬২ বছরের অভিজ্ঞতা, দক্ষ ও যোগ্য জনবলসহ সব কিছু ঠিক থাকলেও শুধুমাত্র তহবিল স্বল্পতার কারণে প্রতিষ্ঠানটির পরিসর কাংখিত মাত্রায় বড় হতে পারছে না। আজ পর্যন্ত প্রতিষ্ঠানটির জোনাল ও রিজিওনাল অফিসের সংখ্যা মাত্র ২৯টি। দেশের প্রতিটি জেলায় বিএইচবিএফসি’র অন্তত একটি করে অফিস থাকা উচিত। কর্পোরেশনে আমার কার্যকাল প্রায় ৩ বছর পূর্ণ হতে চললো। এ সময়ে প্রতিষ্ঠানটির সার্বিক উন্নয়নে ব্যাপক কাজ হয়েছে। জাতীয় বাজেটের বার্ষিক উন্নয়ন কর্মসূচির আওতায় প্রতি বছর বিএইচবিএফসি’র জন্য পর্যাপ্ত অর্থের সংস্থান রাখা, প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ের গৃহায়ন সংক্রান্ত বিশেষ তহবিল এবং বাংলাদেশ ব্যাংকের গৃহায়ন তহবিল থেকে অর্থ পাওয়ার জন্য প্রচেষ্টা অব্যাহত আছে। ২০১৪-২০১৫ অর্থবছরে বার্ষিক উন্নয়ন কর্মসূচিতে (এডিপি) ‘কর্পোরেশনের পল্লী গৃহায়ন প্রকল্প’ শীর্ষক একটি প্রস্তাব প্রাথমিক পর্যায়ে একটি বরাদ্দহীন অননুমোদিত প্রস্তাব হিসেবে অন্তর্ভুক্ত হয়েছে।
বাংলাদেশের মতো ঘনবসতিপূর্ণ দেশে আরো অধিক সংখ্যক মানুষকে আবাসন সেবার আওতায় আনতে আর কি কি করা যেতে পারে?
ঘনবসতিপূর্ণ দেশ বলতে বিদ্যমান জনসংখ্যার জন্য মাথাপিছু বাস ও চাষযোগ্য জমির স্বল্পতাকে বুঝায়। ঘনবসতিপূর্ণ দেশে ভারসাম্যপূর্ণ পরিবেশের জন্য পর্যাপ্ত বনাঞ্চল, উন্মুক্ত স্থান, জলাধার, নদ-নদী, খাল-বিলও থাকে না। ১৬ কোটি মানুষের বাসযোগ্য পরিবেশের জন্য কাম্য অবস্থা বজায় রেখে পর্যাপ্ত আবাসিক ভূমি এবং নিকট ভবিষ্যতের খাদ্য নিরাপত্তার জন্য যথেষ্ট পরিমাণ কৃষি জমি আমাদের নেই। এ অবস্থার মধ্যেও বিভিন্ন উন্নয়ন প্রকল্প বাস্তবায়ন, শিল্পায়ন ও ক্রমবর্ধমান জনসংখ্যার বাসস্থানের সুবিধাদানের জন্য প্রতি বছর অন্তত ১ শতাংশ হারে কৃষি জমি হ্রাস পাচ্ছে। পরিনাম বিবেচনায় এ বাস্তবতা ভবিষ্যতের জন্য অত্যন্ত ভয়ঙ্কর। এ বাস্তবতায় ভূমি-সাশ্রয়ী উর্ধ্বমুখী আবাসন ব্যবস্থা গড়ে তোলার কোন বিকল্প নেই। শহর, মফস্বল এবং গ্রামাঞ্চল নির্বিশেষে সারাদেশে দিগন্তপ্রসারী আবাসন ব্যবস্থার বদলে উর্ধ্বমুখী অবকাঠামো তৈরী করা প্রয়োজন। গোষ্ঠি ও পেশাজীবী বিবেচনায় বিভিন্ন শ্রেণীভিত্তিক মানুষের জন্য উপযুক্ত নাগরিক সুবিধা সম্বলিত বহুতল কমিউনিটি আবাসন ব্যবস্থা গড়ে তুলতে সরকারী ব্যবস্থাপনার পাশাপাশি বেসরকারী উদ্যোগ ত্বরান্বিত করতে হবে।

বাংলাদেশে আবাসন খাতে ঋণ দানকারী সরকারী-বেসরকারী সংস্থার অবস্থা কি? ঋণ দানে এগুলো কি যথেষ্ঠ?
আবাসন বা বাসস্থান মানুষের অন্যতম মৌলিক চাহিদা। খাদ্য আর বস্ত্রের পরেই এর অবস্থান। ব্যক্তি ও সরকারের ক্ষুদ্র প্রচেষ্টাতেই খাদ্য ও বস্ত্রের ব্যবস্থা সহজেই করা সম্ভব। কিন্তু বাসস্থানের ব্যবস্থা করতে প্রয়োজন বৃহৎ সামর্থ্যরে। বিশ্বব্যাপী এর প্রকৃতি ও বাস্তবতা একই। তবে, দুর্যোগপ্রবণ অঞ্চল বিধায় বাংলাদেশের আবাসন খাতের উন্নয়নে প্রাতিষ্ঠানিক পৃষ্ঠপোষকতা ও আর্থিক সহায়তা অনেক বেশী জরুরি। দেশের স্বল্পোন্নত অর্থনৈতিক অবস্থার বাস্তবতা স্বীকার করে নিয়েও এ খাতে সরকারি-বেসরকারি সংস্থার উদাসীনতার বিষয়টি হতাশার সাথে উল্লেখ করতে হয়। বাস্তবে, আবাসন খাতে ঋণ দানকারী সরকারি-বেসরকারি সংস্থাসমূহের ভূমিকা যথেষ্ঠ নয়। রাষ্ট্রমালিকানাধীন বিশেষায়িত প্রতিষ্ঠান হিসেবে একমাত্র বিএইচবিএফসি-ই গৃহায়ন খাতে ঋণ প্রদান করে থাকে যার আর্থিক সামর্থ্যরে বিষয়টি আগেই উল্লেখ করেছি। বেসরকারী কিছু ব্যাংক এবং এনজিও-ও গৃহায়ন খাতে ঋণ প্রদান করছে যাদের যাত্রা শুরু হয়েছিল গত শতাব্দীর ৯০ এর দশকে। এসব ব্যাংক এবং এনজিও’র গৃহ ঋণের মূল বৈশিষ্ট্য হচ্ছে- ব্যাংকের ঋণ শহরকেন্দ্রিক এবং এনজিও’র মফস্বল ও গ্রাম কেন্দ্রিক। তবে, উভয় প্রতিষ্ঠানের সুদের হার অত্যন্ত চড়া। এছাড়া, বেসরকারি পর্যায়ে গড়ে ওঠা ল্যান্ড ডেভেলপার অ্যান্ড বিল্ডার্স প্রতিষ্ঠানগুলোও রয়েছে। এসব সংস্থা মূলত বিভিন্ন ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠান থেকে ঋণ নিয়ে এ খাতে অবদান রাখছে। এছাড়া, সরকারি-বেসরকারি কিছু প্রতিষ্ঠান রয়েছে যারা তাদের নিজ কর্মকর্তা-কর্মচারীদের গৃহ নির্মাণে অগ্রিম (HB Advance) অর্থ দিয়ে থাকে। তবে, প্রতিবছর লক্ষ লক্ষ গৃহ ইউনিট বা বাড়ি নির্মাণে সৃষ্ট ঋণ-চাহিদার তুলনায় এসব প্রতিষ্ঠানের ঋণের যোগান অত্যন্ত অপ্রতুল এবং অধিকাংশ ক্ষেত্রে যা খুব ব্যয়বহুল।
সরকারি ঋণ নিয়ে আরো বেশিসংখ্যক মানুষ যাতে বাসগৃহ নির্মাণ করতে পারে, এটা নিশ্চিত করতে সরকারের কাছে আপনাদের প্রস্তাবিত সুপারিশ ও প্রস্তাবসমূহ কি অবস্থায় রয়েছে?
বাংলাদেশ হাউস বিল্ডিং ফাইনান্স কর্পোরেশনের অনুমোদিত ও পরিশোধিত মূলধন বৃদ্ধি এবং ঋণযোগ্য তহবিল বৃদ্ধির জন্য সরকারের বার্ষিক উন্নয়ন কর্মসূচি (এডিপি) থেকে অর্থ প্রদান, বাংলাদেশ ব্যাংকে রি-ফাইনান্স স্কিম থেকে অর্থ প্রদান এবং বিশ্বব্যাংক বা এ জাতীয় প্রতিষ্ঠান থেকে আর্থিক সুবিধার ব্যবস্থা করে দেয়ার জন্য সরকারের কাছে প্রস্তাব রয়েছে। পরিশোধিত মূলধন বৃদ্ধির বিষয়টি মন্ত্রণালয়ের বিবেচনাধীন। এখন এ প্রতিষ্ঠানে তহবিল বৃদ্ধির নানামুখী প্রচেষ্টা চালানো হচ্ছে যা বর্তমানে অব্যাহত আছে।
আবাসন খাতের উন্নয়নে বিএইচবিএফসি’র উল্লেখযোগ্য অর্জন সম্পর্কে কিছু বলুন?
গৃহ নির্মাণে ঋণ সহায়তার জন্য সবার আগে বিএইচবিএফসি-তে যেতে হবে, জনগণের মধ্যে এমন আস্থার জায়গা তৈরি করতে পারাটাই বিএইচবিএফসি’র সবচে বড় অর্জন। স্বল্প সুদ, ঋণ পরিশোধের দীর্ঘ মেয়াদ, শুধুমাত্র আসল অংকের (Principal Amount) উপর সরল সুদের সহজ হিসাব ব্যবস্থা, ইমরাত নির্মাণকালীন কিস্তি শুরু না হওয়া ইত্যাদি নানাবিধ সুবিধা এবং উন্নত সেবার মান কর্পোরেশনের প্রতি মানুষের এ আস্থা তৈরি করেছে। ১৯৫২ সাল থেকে অদ্যাবধি লক্ষ লক্ষ মানুষের জন্য স্বাস্থ্য ও মানসম্মত আবাসস্থল নির্মাণে ঋণ সহায়তা প্রদান এবং বাংলাদেশের নির্মাণ শিল্পের পথপ্রদর্শক হয়ে জাতীয় অর্থনৈতিক কর্মকান্ডে নিয়মিত অবদান রাখতে পারাটাও উল্লেখযোগ্য অর্জন। এছাড়া, সরকারি কোষাগারে নিয়মিত উল্লেখযোগ্য হারে রাজস্ব প্রদানকারী লাভজনক সরকারি আর্থিক প্রতিষ্ঠানের গৌরব অর্জন করতে পারাটাও কম গৌরবের নয়।

বিএইচবিএফসি’র বর্তমান কর্মকান্ড এবং ভবিষ্যৎ পরিকল্পনা সম্পর্কে জানতে চাই?
তহবিল স্বল্পতার কারণে বিএইচবিএফসি’র ঋণ কার্যক্রমে মন্থরতা থাকলেও নিয়মিত আদায় কার্যক্রম পরিচালনার মাধ্যমে অর্থ সংগ্রহকরণ এবং আদায়কৃত অর্থ থেকে ইতোপূর্বে মঞ্জুরীকৃত ঋণ বিতরণের কার্যক্রম জোরদারভাবে পরিচালিত হচ্ছে। ঋণ আদায় প্রক্রিয়ায় আদালতে বিচারাধীন মামলাসমূহ নিষ্পত্তি এবং বিশেষতঃ শ্রেণীকৃত ঋণের হার শূন্যতে নামিয়ে আনার লক্ষ্যে সর্বাত্মক কার্যক্রম পরিচালিত হচ্ছে। কর্পোরেশনের সাম্প্রতিক সময়ের অর্জন বিশ্লেষণ করলে দেখা যায়, বিগত তিন বছরে প্রতিষ্ঠানটি ঢাকা ও চট্টগ্রাম মেট্রো এলাকার বাহিরে ঋণ বিতরণ অনেকাংশে বাড়িয়েছে। বড় বড় শহরের বাইরে অর্থাৎ জেলা ও উপজেলা শহর এবং উন্নত গ্রোথ-সেন্টারে অধিক হারে ঋণ প্রদানে আমাদের পরিকল্পনা ও সদিচ্ছার বাস্তব প্রমাণ এটি। তহবিল প্রাপ্তি সাপেক্ষে মফস্বল এলাকা এবং গ্রামে গৃহঋণ ব্যাপক মাত্রায় বৃদ্ধির পরিকল্পনা আমাদের রয়েছে।
বিএইচবিএফসি’র কাছ থেকে সাধারণ জনগণ কি ধরনের সেবা পাচ্ছে?
বিএইচবিএফসি গৃহ নির্মাণে সরকারি পর্যায়ে ঋণ প্রদানের একমাত্র বিশেষায়িত প্রতিষ্ঠান। গৃহ নির্মাণে ঋণ প্রদান এবং তা আদায়ের মাধ্যমে পুনঃপুন তা বিনিয়োগ করাই এর এখতিয়ারাধীন কাজ। বিদ্যমান এ কর্মকান্ড পরিচালনার ক্ষেত্রে কর্পোরেশন উন্নতমানের সেবা প্রদান করছে। সেবার মান আরো উন্নত করার ক্ষেত্রেও আমরা শতভাগ আন্তরিক। দেশের গৃহায়ন ব্যবস্থার উন্নয়নে সরকার নতুন কোনও কর্মসূচি ও প্রকল্প এবং নিজস্ব তহবিল গঠনে নতুন কোন দায়িত্ব প্রদান করলে কর্পোরেশন তা নিষ্ঠার সাথে পালনে সচেষ্ঠ।
বন্ধনকে সময় দেওয়ায় আপনাকে অনেক ধন্যবাদ।
বন্ধনকেও ধন্যবাদ।
প্রকাশকাল: বন্ধন ৫১ তম সংখ্যা, জুলাই ২০১৪