কোন অঞ্চলের মানুষ কতটা সভ্য তা বোঝা যায় তাদের স্থাপত্য ও নির্মাণকৌশল থেকে। রোমান, গ্রিক, মায়ান, পার্সিয়ান, মিশরীয়, মেসোপটেমিয়া পৃথিবীর বিস্ময়কর সব প্রাচীন সভ্যতা। কিন্তু এসব সভ্যতাকে ছাপিয়ে আরেকটি সভ্যতা নিজের শ্রেষ্ঠত্বের দাবিদার। হবেই না বা কেন? এ ধরনের ঘন জঙ্গলঘেরা পর্বতে সভ্যতা নির্মাণ কি কম কথা, তাও আবার বিস্ময়কর স্থাপত্য নির্মাণকৌশল। কল্পনাকেও হার মানানো এ সভ্যতা যেমন আদিম, তেমনি বুনো। রহস্য-চাদর বিছানো এ সভ্যতার নাম বিশ্বখ্যাত ইনকা সভ্যতা। এখনো যে সভ্যতা নিয়ে মানুষের আগ্রহের কোনো কমতি নেই, যার স্থাপত্য, নির্মাণকৌশল, জীবণাচরণ নিয়ে আজও চলছে বিস্তর গবেষণা।
ইনকা সাম্রাজ্যের ইতিবৃত্ত
দক্ষিণ আমেরিকার উত্তর-দক্ষিণে ২,৫০০ মাইল বিস্তৃত আন্দিজ পর্বতমালা। পশ্চিমে প্রশান্ত মহাসাগর ও বিখ্যাত হ্রদ টিটিকাকা। সুবিশাল পর্বতমালা আর ঘন জঙ্গল গোটা অঞ্চলটিকে করেছে রহস্যময়। এ রহস্যকে আরও বাড়িয়ে তুলেছে ইনকা সভ্যতা। ঐতিহাসিকদের মতে, আমেরিকার অন্যান্য গোষ্ঠীর মতোই ইনকারা বেরিং প্রণালি পেরিয়ে এশিয়া মহাদেশ থেকে আমেরিকায় পদার্পণ করে। তারা ১১০০-১২০০ শতাব্দীতে আন্দিজ পর্বতমালার উচ্চভূমির কুজবেন নামক স্থানে বসতি গড়ে তোলে। এখানেই সূচিত হয় কুজকো রাজ্যের (কিংডম অব কুজকো)। কুজকোর অবস্থান পেরুর রাজধানী লিমা থেকে ৩৫৭ মাইল পূর্বে। জায়গার নামানুসারে এখানকার অধিবাসীদের বলা হতো কেচুয়া জাতি। এই রাজ্যটিই পরে হয়ে ওঠে পরাক্রমশালী ইনকা সাম্রাজ্য। জনসংখ্যা বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে বাড়তে থাকে এদের বসবাসের পরিধি। পেরু, বলিভিয়া, উত্তর আর্জেন্টিনা, চিলি ও ইকুয়েডর পর্যন্ত বিস্তৃত হয় রাজ্যটি। অন্যান্য নৃগোষ্ঠীর তুলনায় ইনকারা ছিল অত্যন্ত বুদ্ধিমান ও জ্ঞান-বিজ্ঞানে এগিয়ে। তারা বাইরের জগৎ থেকে আলাদা জীবনযাপন করত। ইনকাদের ছিল প্রচুর স্বর্ণভান্ডার। আর এই স্বর্ণই হয়েছিল ইনকাদের জন্য কাল। স্প্যানিশ দিগ্বিজয়ী ফ্রানসিসকো পিজারো ছিল ইনকা সভ্যতা ধ্বংসের মূল হোতা।
পিজারো ১৫০২ খ্রিষ্টাব্দে ওয়েস্ট ইন্ডিজের উদ্দেশে স্পেন ত্যাগ করে। এরপর ১৫০৯ সালে কলম্বিয়া অভিযানে অংশ নেয় আলোনসো দ্য ওদেজার অধীনে। এরপর পৌঁছান পানামায়। জানতে পারেন ইনকার স্বর্ণসমৃদ্ধ ভূখন্ডের কথা। ১৫২০ সালে দক্ষিণ আমেরিকার পশ্চিম উপকূলে পরপর দুটো অভিযান চালান। এ সময় তিনি ইনকাদের দেখতে পায়। তাদের শরীরে নানা সোনার অলংকার দেখে সোনাসমৃৃদ্ধির বিষয়টি নিশ্চিত হন। প্রথমবার তিনি জাহাজ ভর্তি করে সোনাদানা, লামা (একধরনের পশু) ও কিছু ইনকাকে বন্দী করে স্পেনে ফিরে আসেন। স্পেনের রাজা তখন পঞ্চম চার্লস। পিজারো রাজাকে সব খুলে বলেন এবং পেরু জয় করে সেখানকার শাসক হওয়ার অনুমতি চান। রাজা বিষয়টির গুরুত্ব বুঝতে পেরে অনুমতি দেন।

পিজারো ব্যাপক অস্ত্রসম্ভার নিয়ে ইনকা আক্রমণ করে এবং তৎকালীন শাসক আতাহুয়ালপাকে (Atahualpa) পরাজিত করে। রাজা নিজ জীবনের বিনিময়ে প্রচুর সোনা ও রুপা দেন। সম্পদ পেয়েও পিজারো রাজাকে খুন করে! কুজকোর সব দামি সামগ্রী লুট করে ইনকাদের দাসে পরিণত করে। সেখানে শুরু হয় স্প্যানিশ শাসন। ধীরে ধীরে স্প্যানিশরা তাদের ওপর জোরজুলুমসহ ইনকা সভ্যতার বড় বড় স্থাপত্য, মন্দির ও বাড়িঘর ধ্বংস করে দেয়। সভ্যতার নিদর্শনগুলো, যা মূল্যবান ধাতুতে গড়া ছিল তা তারা গলিয়ে ফেলে সোনা-রুপার লোভে।
১৫৩৫ খ্রিষ্টাব্দে লিমা নামে নতুন শহর প্রতিষ্ঠা করে পিজারো। সেখান থেকেই শাসন করে পেরু। বছর কয়েক বাদে নানা কারণে স্প্যনিশদের মধ্য শুরু হয় তীব্র বিরোধ ও অন্তর্দ্বন্দ্ব। এরই পরিণামে ১৫৪১ খ্রিষ্টাব্দে পিজারো ৬৬ বছর বয়সে লিমায় নিজ প্রাসাদে খুন হয়। তারপর ইনকা সভ্যতার স্মারক- সেই পাথর নগরগুলো দীর্ঘকাল লোকচক্ষুর অন্তরালে চলে যায়। সভ্যতাটি হারিয়ে যায় অরণ্যের গভীরে।
ইনকাদের স্থাপত্যকৌশল
ইনকা-রহস্যের প্রথমেই রয়েছে তাদের স্থাপত্য নির্মাণকৌশল। সুবিস্তৃত বিশাল পাহাড়ি এলাকায় ঘরবাড়ি, উপাসনালয়, প্রাসাদ, দুর্গ, শস্যগুদাম ও সড়ক নির্মাণ করেছিল তারা। অভিজাতদের বাসের স্থান ও বাড়িগুলো ছিল বড় এবং ভিন্ন প্রকৃতির। ‘আমাউতাস’ বা জ্ঞানী ব্যক্তিদের বাড়ি ছিল লাল দেয়ালের। ‘নুস্তাস’ বা রাজকন্যাদের ঘরগুলো ছিল ট্রপিজিয়াম আকৃতির। সাধারণ ইনকাদের বাড়িগুলো হতো ছোট। সবাই একসঙ্গে থাকত। এরা বাড়ি তৈরি করত পাথর ও মাটি ইট দিয়ে, তাতে মেশাত ঘাস-কাদা। কাদামাটি, খড়, ঘাস, বাঁশ, কাঠ ও ছনের চালা দিয়ে তৈরি করত বাড়ির ছাদ। দেয়ালে আলো-বাতাস প্রবেশের জন্য কিছু চৌকা ফোঁকর রাখা হতো। সবচেয়ে নান্দনিকভাবে নির্মাণ করা হতো এখানকার মন্দিরগুলোকে। এ ছাড়া মানুষ বলি দেওয়ার মন্দিরে করা হতো নানা রকম অলংকরণ। এই মন্দির অনেক ওপরে নির্মিত হওয়ায় ওঠার জন্য ইনকারা নির্মাণ করেছিল অগণিত সিঁড়ি।
প্রতিটি স্থাপনাই পাথর নির্মিত। ইনকারা কখনোই চাকার ব্যবহার করেনি। তাই তারা কীভাবে এতসংখ্যক বিশাল আকৃতির পাথরখন্ড এক স্থান থেকে অন্য স্থানে, বিশেষ করে উঁচুতে নিয়ে গেছে সেটা এক রহস্য। তা ছাড়া কীভাবে সুবিশাল পাথর কেটে কেটে তা পরপর গেঁথেছে তা আরও রহস্যময়। মনে করা হয়, বিশাল আকৃতির পাথরখন্ডগুলো পাহাড়ের সমতল ঢাল দিয়ে ঠেলে ওপরে তুলতে তারা শত শত শ্রমিক ব্যবহার করেছিল। এখনো কিছু কিছু পাথরের গায়ে হাতলের মতো গাঁট রয়েছে, যা পাথরগুলোকে নির্দিষ্ট স্থানে বসানোর জন্য ব্যবহার করা হয়ে থাকতে পারে। পাথরখন্ডগুলো জায়গামতো স্থাপনের পর ইনকারা হয়তো হাতলগুলোকে ভেঙে সমান করে দিয়েছে। স্থাপনার দেয়ালের পাথর জোড়া দেওয়ার জন্য কোনো সিমেন্ট-জাতীয় পদার্থ বা চুন-সুরকির মিশ্রণ এখানে ব্যবহার করা হয়নি। স্থপতি, প্রকৌশলী এবং পাথরের কারিগররা তাদের সুনিপুণ দক্ষতায় পাথরের এসব স্থাপত্য নির্মাণ করেছেন। অ্যাশলার (Ashlar) নামক এই নির্মাণ কৌশলে ইনকারা ছিল খুবই দক্ষ। এই পদ্ধতিতে পাথরের খন্ড এমন নিখুঁতভাবে কাটা হতো যেন কোনো রকম সংযোগকারী মিশ্রণ ছাড়াই পাথরগুলো খাঁজে খাঁজে শক্তভাবে একটার ওপর আরেকটা বসে যায়। ইনকারা পাথরের এই নির্মাণপদ্ধতিতে পৃথিবীর সেরাদের সেরা ছিল। তাদের নির্মিত পাথরের দেয়ালগুলোর জোড় এতই নিপুণ যে একটা পাতলা ছুরির ফলাও সেগুলোর ভেতর দিয়ে প্রবেশ করানো যায় না। অনেক দূরের প্রাকৃতিক পানির উৎস থেকে নগরীতে স্বয়ংক্রিয়ভাবে পানি সরবরাহ করা প্রকৌশলীদের অসাধারণ বিজ্ঞানমনষ্কতার পরিচয় বহন করে। ইনকা সভ্যতার স্থাপত্য নমুনার অনেক কিছুই ধ্বংস হয়ে গেলেও সবচেয়ে ভালো অবস্থায় পাওয়া গেছে মাচুপিচু নগরীকে।

চাষাবাদ পদ্ধতি
আন্দিজ পর্বতমালার কুজবেনে বসতি স্থাপন করেই ইনকারা চাষাবাদের জন্য টেকসই আবাদ ভূমি প্রস্তুত করে। পাহাড়ি জঙ্গল কেটে উপত্যকা ও পাহাড়ের ঢাল উভয় স্থানেই তারা কৃষিকাজ শুরু করে। পাহাড়ের গায়ে ফসল ফলানোর চত্বরগুলো (terraces) এমনভাবে ধাপে ধাপে তৈরি, যা কোনোভাবেই ধসে পড়ত না। আশপাশের উঁচু পর্বতশৃঙ্গ থেকে তারা কৃষি সেচের ব্যবস্থা করে। ইনকাদের প্রধান খাদ্য ছিল আলু ও ভুট্টা। মানবসভ্যতায় আলু ইনকাদেরই অবদান। ভুট্টা পিষে চিচা নামক একধরনের পানীয় তৈরি করে খেত তারা। সাধারণদের শস্যের একাংশ রাখতে হতো সংরক্ষণের জন্য। সাম্রাজ্যজুড়ে ছিল স্টোরহাউস। ঐতিহাসিকদের মতে খাদ্যশস্য মজুতের কলাকৌশল রপ্ত করেছিল বলেই ইনকা সভ্যতা এত উন্নত স্তরে পৌঁছেছিল।
সড়ক অবকাঠামো
সুবিশাল পাহাড়ি উপত্যকাজুড়ে ছিল ইনকা সাম্রাজ্য যেখানে সে সময়ে কোনো সড়কের কথা চিন্তাও করা যায় না। অবিশ্বাস্য মনে হলেও বিভিন্ন শহরগুলোর সঙ্গে যোগাযোগ রাখতে এবং ফসল আনা-নেওয়া করতে ইনকারা নির্মাণ করেছিল বিস্ময়কর সড়ক। এটা ‘ইনকা ট্রেইল’ নামে পরিচিত। তাদের নির্মাণকৌশলও ছিল অভাবনীয়। দুর্গম সব পাহাড়ি উপত্যকা ও গিরির মধ্যে দিয়ে তারা এই ট্রেইল নির্মাণ করেছিল। কোথাও উচ্চতা ছিল প্রায় ১৬ হাজার ফুট ওপরে। সামরিক ও বেসামরিক উভয় শ্রেণির লোকই চলাচল করত। আর চলত লামা ক্যারাভান। সাধারণ লোকের সে পথে চলতে হলে ইনকা সম্রাটের অনুমতি লাগত। পথের মাঝে ছিল সেতু। সেতুতে টোলব্যবস্থা ছিল। এখন এসবের ধ্বংসাবশেষ দেখা যায়।
জীবনাচরণ ও পোশাক
ইনকাদের ছিল সুসংগঠিত কেন্দ্রীয় সরকার। সম্রাটই শ্রেষ্ঠ ইনকা। সম্রাটগণ বিয়ে করতেন আপন বোনকে। পুত্রগণের মধ্যে উত্তরাধিকারী নির্বাচিত করতেন। সাধারণত বড় ছেলেই সম্রাট হতো। সম্রাটের অধীনে অভিজাতদেরও কাউন্সিল ছিল। তারা সাম্রাজ্য পরিচালনায় সাহায্য করত। সাধারণদের কর দিতে হতো। কর ব্যবস্থা ছিল কঠোর। পুরুষেরা কাজ করত সৈন্য বিভাগে বা খনিতে। মেয়েদের নির্দিষ্ট পরিমাণে কাপড় বুনতে হতো।
ইনকারা অত্যন্ত সামাজিক জীবনযাপন করত। যৌথ পরিবার প্রথা প্রচলিত ছিল। তারা পোশাক তৈরি করত লামার উল দিয়ে। সুতি কাপড়ও পরত। অভিজাত ব্যক্তিরা পোশাকের সঙ্গে সোনা-রুপার অলংকার পরত। মেয়েরা ‘মানতাস’ নামক একধরনের ভারী চাদরে দিয়ে শরীর আবৃত করত। সব পোশাকই ছিল সেলাইহীন। পুরুষেরা নিম্নাঙ্গে লম্বা সুতির পোশাক পরত ধুতির মতো করে। সবাই লামার চামড়ায় তৈরি একধরনের চপ্পল ব্যবহার করত। ইনকাদের ছিল প্রচুর স্বর্ণভান্ডার। তারা রোমান্টিকও ছিল বটে! তারা বিশ্বাস করত রুপা হলো চাঁদের কান্না আর স্বর্ণ সূর্যের ঘাম।
ধর্মবিশ্বাস
ইনকারা জ্ঞান-বিজ্ঞানে অনেক এগিয়ে থাকলেও ধর্মভিত্তিক কুসংস্কারের শেষ ছিল না। তারা বহুদেবতায় বিশ্বাসী ছিল। ভিরাকোকা তাদের প্রধান দেবতা ও স্রষ্টা। আর ইনতি সূর্যদেব। ইনকাদের বলা হয় ‘সূর্যের সন্তান।’ ইনকা শব্দটি এসেছে এই ইন্তি শব্দ থেকেই। তারা সূর্যপূজক বলেই উঁচু পাহাড়ে পাথরের বেদি তৈরি করত। এর ওপরে সূর্যদেবতার প্রতীকী মূর্তি রাখা হতো। মন্দিরের দায়িত্বে থাকতেন একজন প্রধান পুরোহিত এবং তাঁর কিছু সহযোগী পুরোহিত। এই মন্দিরকে বলা হতো ইনতিহুয়াটানা।

ইনকারা নরবলি দিত। বিশেষ করে ‘কাপাকচা’ নামের বিশেষ অনুষ্ঠানে শিশুদের বলি দেওয়া হতো। আগ্নেয়গিরিকে কিংবা দেবদেবীকে শিশু উৎসর্গ করা তাদের একটি বর্বরতম দিক। উৎসর্গের আগে শিশুদের মোটাতাজা করা হতো। এরপর সেখানে তাদের শ্বাসরোধে হত্যা করা হতো অথবা আগুনের উত্তাপে মৃত্যুর জন্য রেখে আসা হতো। এ সময় তাদের ওষুধ দিয়ে মাতাল করে আগুনের মুখে ঠেলে দেওয়া হতো। নির্মমতার সেই প্রমাণ মিলেছে। লুলাইলাকো নামের একটি আগ্নেয়গিরির চূড়ায় সংরক্ষিত ৫০০ বছরের পুরোনো মমির চুল পরীক্ষার মাধ্যমে বিস্তারিত জানা যায়। সেখানে ‘লুলাইলাকোর কুমারী’ নামে পরিচিত ১৫ বছর বয়সী এক বালিকা এবং ‘লুলাইলাকোর বালক’ নামে সাত বছর বয়সী এক বালকের দেহাবশেষ পাওয়া গেছে। উত্তর-পশ্চিম আর্জেন্টিনায় চিলির সীমান্তবর্তী লুলাইলাকো পাহাড়ে এসব মমি আবিষ্কার হয় ১৯৯৯ সালে। প্রতিটি দেহই সূক্ষ্মভাবে সংরক্ষিত ছিল। সাল্টার নিকটবর্তী একটি শহরে অবস্থিত ‘হাই মাউন্টেইন আর্কিওলজিক্যাল মিউজিয়াম’-এ রাখা হয়েছে মমিগুলোকে। শুধু আদিম বিশ্বাসের জন্যই বলি দেওয়া হতো তা ঠিক নয়। ইনকারা ছিল সাম্রাজ্যবাদী। সম্ভবত দুর্গম এলাকায় ভয় ও সামাজিক নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠার ক্ষেত্রে কৃষিজীবীদের সন্তানদের প্রতি এ নির্মম আচরণ দমিয়ে রাখার কৌশল হিসেবে কাজ করত।
রহস্যে ঘেরা মাচুপিচু
মাচুপিচু ইনকাদের সবচেয়ে বিস্ময় নগর। একে সূর্যনগরী নামেও ডাকা হয়। মাচুপিচুর অনেক রহস্য উদ্ঘাটন করা সম্ভব হলেও বেশির ভাগেরই কোনো কূলকিনারা হয়নি। মাচুপিচু অর্থ প্রাচীন পর্বত। অধিকাংশ সময় নগরীটি মেঘের আড়ালে ঢাকা থাকে বলে একে মেঘনগর বলে। এমনকি বিমান থেকেও দেখা যায় না। পেরুর কুসকো থেকে ৫০ মাইল উত্তর-পশ্চিমে আন্দিজ পর্বতমালার দুটি সুউচ্চ শৃঙ্গের মধ্যবর্তী সরু উপত্যকায় এর অবস্থান। শহরটি সমুদ্রপৃষ্ঠ থেকে প্রায় ৭,৮৭৫ ফুট উঁচুতে অবস্থিত। এত উঁচুতে কীভাবে তারা একটা আস্ত শহর তৈরি করল তা বেশ রহস্যময়। এর দখলে রয়েছে প্রায় ৩২ হাজার ৫০০ একর পাহাড়ি এলাকা।
ইনকাদের অন্যান্য শহর স্প্যানিশদের আক্রমণে ধ্বংস হলেও মেঘে ঢাকা মাচুপিচু তারা খুঁজে পায়নি। ফলে রক্ষা পায় শহরটি, থেকে যায় অধরা ও অক্ষত। হয়তো ইনকাদের অস্তিত্বকে জানান দিতেই এই দুর্গ নগরী অক্ষত রয়ে গিয়েছিল। কারণ পিজারো ভিলকা বাম্বার মন্দির থেকে শুরু করে সম্পূর্ণ পাথুরে নগরী ধ্বংস করে ফেলেছিল। তারা বেছে বেছে স্থানীয় লোকদের সব ধর্মীয় তীর্থস্থানকে ধ্বংস করে।
মাচুপিচুর অদ্ভুত স্থাপত্যশৈলীর সবগুলোই পাথরের তৈরি মজবুত কাঠামোর ওপর দাঁড়ানো। পাহাড়ের এক পাশ চূড়া থেকে একেবারে খাড়াভাবে ৬০০ মিটার নিচে উরুবাম্বা নদীর পাদদেশে গিয়ে মিশেছে। অন্যদিকে হুয়ানা পিচু নামের আরেকটি পর্বত খাড়া উঠে গেছে আরও কয়েক হাজার ফুট উঁচুতে। সুতরাং দুই দিক দিয়েই শহরটি প্রাকৃতিকভাবেই বেশ নিরাপদ ছিল। এ কারণে শহরটিকে ইনকাদের প্রাচীন দুর্গনগরী নামেও ডাকা হয়। শহরের মাঝে রয়েছে উঁচু-নিচু বিভাজন। এর উঁচু অংশে রয়েছে মন্দিরগুলো, নিচু অংশে রয়েছে গুদামঘর। প্রশস্ত বর্গাকৃতির কেন্দ্রে একই সমতলে অবস্থিত প্রায় ২০০টি ভবন। এতে আরও রয়েছে বিভিন্ন ‘কাঞ্চা’, যেগুলো আসলে কতগুলো ভবনের সমস্তি এবং এগুলো দাঁড়িয়ে রয়েছে পাহাড়ের ঢালের সঙ্গে সামঞ্জস্য রেখে। এখানেই রয়েছে বিখ্যাত ‘টোরিয়ন’, বিশালাকৃতির একটি টাওয়ার যা ব্যবহৃত হতো মানমন্দির হিসেবে। আরও রয়েছে ইনকা সভ্যতার তিন অমূল্য রত্ন ‘ইন্তিহুয়াতানা’, ‘সূর্যমন্দির’ এবং ‘তিন জানালার কক্ষ’। স্থানীয় উপাখ্যান অনুসারে কোনো অনুভূতি সম্পন্ন মানুষ যদি এই পাথরে তার কপাল ঘসে তাহলে আধ্যাত্মিক জগৎ দেখতে পাবে। ইন্তিহুয়াতানা পাথর দক্ষিণ আমেরিকার পূজিত পবিত্র পাথরগুলোর একটি। স্প্যানিশরা ২০ শতকের আগে এই পাথরটি খুঁজে পায়নি; ফলে এটি ইনকাদের অন্যান্য পবিত্র পাথরের মতো ধ্বংস হওয়ার হাত থেকে বেঁচে যায়। এই পাথরগুলো এমনভাবে স্থাপন করা হয়, যাতে শীতকালে এগুলো সরাসরি সূর্যের দিকে নির্দেশ করে। একে ‘সূর্যের আঁকা বিন্দু’ও বলা হয়, কেননা উপকথা অনুসারে এটি সূর্যকে তার জায়গায় আটকে রাখার উদ্দেশ্যে নির্মিত। ২১ মার্চ ও ২১ সেপ্টেম্বর, বছরে এই দুইবার দিনের মাঝামাঝি সময়ে সূর্য ইন্তিহুয়াতানা পাথরের একেবারে ওপরে থাকে; ফলে এর কোনো ছায়া তৈরি হয় না। প্রকৃতপক্ষে পাথরটি একটি সূর্যঘড়ি।
আবিষ্কার
কয়েক শ বছর জনমানবহীন থাকায় ঘন জঙ্গলে ঢেকে যায় শহরটি। পার্শ্ববর্তী কিছু আদিবাসী এর অস্তিত্ব জানলেও অভিশপ্ত নগর বলে তারা সেখানে যেত না। তবে অনেক গুপ্তধন সন্ধানী ও ঐতিহ্য অন্বেষণকারী এমন একটি সভ্যতার কথা জানত। স্প্যানিশরা মনে করত ইনকাদের একটি পরিত্যক্ত শহর আছে, যা সোনায় মোড়া। নাম ‘এল ডোরাডো’। সেখানে ঘরবাড়ি, তৈজসপত্র, মন্দির, মন্দিরের ভেতরের মূর্তি সবকিছুই নাকি সোনা দিয়ে তৈরি! রূপকথার গল্পের মতো শোনালেও এই মিথের হাতছানিতেই বহুদিন ধরে অনেক দুঃসাহসী অভিযান চালিয়েছে পেরুর দুর্ভেদ্য অরণ্যে। তবে আজ পর্যন্ত কেউই খুঁজে পায়নি তাদের ধনসম্পদ। ভূতত্ত্ববিদ ও স্বর্ণসন্ধানীরাও ব্যর্থ হয়েছেন। এল ডোরাডোর রহস্যে কেউ আবার যোগ করেছে ভিনগ্রহি তত্ত্বও। গ্রহটির প্রাণীরা নাকি জীবনধারণের জন্য সোনার ওপর নির্ভরশীল ছিল এবং তারাই স্বর্ণভান্ডার সরিয়ে ফেলেছে!

ইনকাদের শেষ রাজধানী ভিলকা বাম্বার খোঁজে ইয়েল বিশ্ববিদ্যালয়ের ইতিহাসের শিক্ষক হায়রাম বিংগহাম (HYPERLINK “http:// www.google.co.uk/url?sa=t&rct=j&q=&esrc=s&frm=1&source=web&cd=1&cad=rja&uact=8&ved =0ahUKE wiypZW97ezMAhUEro8KHVBMC-cQFggjMAA&url=http%3A%2F%2Fpeabody. yale.edu%2Fcollections% 2Farchives% 2Fbiography%2Fhiram-bingham-iii&usg=AFQjCNFoOj Zqj61AcLN4COw8cPpCUJ7Vzg&bvm= bv.122448493,d.c2I” Hiram Bingham) অনুসন্ধানের একপর্যায়ে মাচুপিচু নগরী খুুঁজে পান ১৯১১ সালে। ১৯০৯ সালে প্রথম অভিযান করে ব্যর্থ হন। তবে দমে না গিয়ে আবার ইতিহাস ঘেঁটে শুরু করেন দ্বিতীয় অভিযান। পথে দেখা হয় কিছু রেড ইন্ডিয়ানের সঙ্গে। তাদের সহযোগিতায় উরুবাম্বা থেকে দুই হাজার ফুট ওপরে এক প্রাচীন শহরের ধ্বংসাবশেষ খুঁজে পান। তবে এ শহরই যে ভিলকাবাম্বা, সেটার অবশ্য প্রমাণ নেই। ইন্ডিয়ানদের কাছে জানতে পান জায়গাটির নাম ‘মাচুপিচু’ যার অর্থ, ‘পুরোনো শীর্ষ’।
আবিষ্কারের পর মাচুপিচু নিয়ে বিশ্বে ব্যাপক তোলপাড় পড়ে যায়। শুরু হয় ব্যাপক গবেষণা। বছরের পর বছর ধরে চালানো গবেষণায় অনেক তথ্য উদ্ঘাটিত হলেও ইনকাদের হারিয়ে যাওয়ার সঠিক কারণ এখনো অজানা রয়ে গেছে। কারণ ইনকাদের কোনো লিখন পদ্ধতি বা লিখিত দলিলাদি পাওয়া যায়নি। ১৯৮৩ সালে ইউনেসকো বিশ্ব ঐতিহ্যবাহী স্থান হিসেবে ঘোষণা করে মাচুপিচুকে। ২০০৭ সালে ‘নিউ ওপেন ওয়ার্ল্ড করপোরেশন’ প্রতিযোগিতায় বিশ্বের সাতটি নতুন বিস্ময়ের একটি নির্বাচিত হয় এ সভ্যতা।
শেষের আগে
ইনকা সভ্যতার রহস্যজাল উন্মোচনে বাকি রয়েছে অনেকটাই। সভ্যতার অধিকাংশই ধ্বংস হয়ে গেলেও একমাত্র মাচুপিচু অনেকটাই সগৌরবে টিকে আছে। বিস্ময়কর এ নগরী দেখার জন্য পর্যটকদের ভিড় লেগেই থাকে। ঐতিহাসিক নিদর্শন চুরি, পর্যটকদের অতিরিক্ত ভিড় ইত্যাদি কারণে এর অস্তিত্ব বিপন্ন হওয়ার আশঙ্কা দেখা দিলে তা রক্ষার্থে নেওয়া হয় নানা পদক্ষেপ। পাশাপাশি ধ্বংসপ্রায় ভবনগুলোকে সংস্কারপ্রক্রিয়া চলছে। আরেক দিকে ইনকা-রহস্যের জাল ছিড়তে অনুসন্ধানীরা কিন্তু থেমে নেই, তা সে স্বর্ণসন্ধানীই হোক বা ঐতিহ্যসন্ধানী।
মারুফ আহমেদ
প্রকাশকাল: বন্ধন ৭৪ তম সংখ্যা, জুন ২০১৬