রয়েল ক্রিসেন্ট হোটেল: জর্জিয়ান স্থাপত্যের অনুপম নিদর্শন

১৭২০ থেকে ১৮২০ সালের মধ্যে ইংরেজি ভাষাভাষী দেশগুলোতে যে স্থাপত্যকলা অনুসরণ করে দালানকোঠা ও অন্যান্য স্থাপনা নির্মিত হয়েছে, সেটাই জর্জিয়ান স্থাপত্য (Georgian architecture)। মূলত ব্রিটিশ সাম্রাজ্যের রাজা প্রথম জর্জ থেকে চতুর্থ জর্জের শাসনামলে নির্মাণ করা হয় এই স্থাপনাগুলো। ঊনবিংশ শতাব্দীতে আমেরিকায় এবং বিংশ শতাব্দীতে ইংল্যান্ডে আবারও জর্জিয়ান এই স্থাপত্য নতুনরূপে ফিরে আসে। একে ঔপনিবেশিক স্থাপত্য (Colonial Revival Architecture) বা নব্য জর্জিয়ান স্থাপত্য (Neo-Georgian architecture) বলা হয়। আর জর্জিয়ান এ স্থাপত্যের বৈশিষ্ট্যমণ্ডিত এক অনন্য নিদর্শন সগর্বে আজও তার অস্তিত্ব জানান দিচ্ছে; নাম যার রয়েল ক্রিসেন্ট হোটেল। অবস্থান ইংল্যান্ডে।

জর্জিয়ান স্থাপত্যের গোড়ার কথা

অষ্টাদশ শতাব্দীর বিলেতের অলংকারমূলক ও অতিরঞ্জিত স্থাপত্যকৌশল (Baroque) থেকে মুক্তি পেতে স্থপতিরা নতুন নতুন স্থাপত্য কৌশল খুঁজে ফিরছিলেন। যার সূচনা স্থপতি জেমস গিবসের কিছুটা ব্যতিক্রমধর্মী ডিজাইন কৌশলের মাধ্যমে। তাঁর ডিজাইনে জাঁকজমকপূর্ণ অলংকারের ছোঁয়া থাকলেও ছিল না অতিরঞ্জিত কিছু। তবে অলংকারিক স্থাপত্যকৌশল থেকে জর্জিয়ান স্থাপত্যেশৈলীর দিকে অগ্রযাত্রার পথিকৃৎ ছিলেন স্থপতি কলেন ক্যা¤পবেল এবং তাঁর সহযোদ্ধারা। যাঁদের মধ্যে ছিলেন উইলিয়াম কেন্ট, আইজ্যাক ওয়্যার এবং ভেনেসিয়ান গিয়াকামো লিওনির মতো বিখ্যাত স্থপতিরা। পরবর্তী সময়ে স্থপতি জন উড ও রবার্ট টেইলর জর্জিয়ান স্থাপত্যয় আনেন অভিনব এক মাত্রা।

হোটেল অভ্যন্তরস্থ জলাধার

জর্জিয়ান স্থাপত্যের উৎস

অষ্টাদশ শতাব্দীতে প্রাচীন ও বিশুদ্ধ স্থাপত্যকলাকে (Classic Architecture) পুনর্জীবন দানই ছিল জর্জিয়ান স্থাপত্যের দর্শন। বিশেষত এই স্থাপত্যশিল্পে প্রচণ্ড প্রভাব ছিল ইতালিয়ান স্থপতি আন্দ্রে পালাডিওর শিল্প দর্শনের, যাকে প্যালাডিয়ানিসম (Palladianism) বলা হয়। আন্দ্রে পালাডিওর স্থাপত্য ও নকশার মূলনীতি ছিল প্রাচীন রোমের স্থাপত্যশৈলী ও আনুপাতিক ধারার ডিজাইনে পুনর্জাগরণ ঘটানো। প্যালাডিয়ানিসমের মূলতত্ত্বই ছিল সাজসজ্জাধর্মী উপাদান (Decorative elements)-কে যথাসম্ভব কমিয়ে স্থাপনার মধ্যে আনুপাতিক শৃঙ্খলা আনয়ন। জর্জিয়ান স্থাপত্যের নকশা অনুসারে সেই সময়ে গ্রেট ব্রিটেনে নির্মিত হয়েছিল অনেক অবকাঠামো। এ সময়েরই অন্যতম স্থাপনা ইংল্যান্ডের রয়েল ক্রিসেন্ট হোটেল।

রয়েল ক্রিসেন্ট হোটেল   

জর্জিয়ান স্থাপত্যের নকশা অনুযায়ী নির্মিত রয়েল ক্রিসেন্ট হোটেলের অবস্থান ইংল্যান্ডের বাথ শহরে। স্থাপনাটির স্থপতি জন উড। এটি নির্মাণে সময় লেগেছিল প্রায় ছয় বছর (১৭৬৭-১৭৭৪)। মূলত ৩০টি দালান পরপর অর্ধচন্দ্রাকৃতির আকারে স্থাপন করায় এর নামের সঙ্গে যুক্ত হয়েছে ক্রিসেন্ট। হোটেলটিকে ইংল্যান্ডে জর্জিয়ান স্থাপত্যের সর্বোত্তম দৃষ্টান্ত বিবেচনায় এটিকে গ্রেড আই (Grade I)-ভুক্ত স্থাপনার মর্যাদায় অভিষিক্ত করা হয়। গ্রেড আইপ্রাপ্ত স্থাপনায় যথাযথ কর্তৃপক্ষের অনুমতি ব্যতীত এমন কোনো পরিবর্তন বা পরিবর্ধন করা যাবে না, যাতে স্থাপনাটির ঐতিহাসিক গুরুত্বের কোনোরূপ ব্যত্যয় ঘটে। যদিও নিয়ম মেনে কালের পরিক্রমায় রয়েল ক্রিসেন্টের অভ্যন্তরীণ কিছু সংস্কার করা হয়েছে, কিন্তু অট্টালিকার বাইরে সম্মুখভাগে বসানো পাথরের স্থাপত্যশৈলী (Stone façade) আজও তেমনি আছে, যা ছিল ২৫০ বছর আগে।

অভ্যন্তরীণ কারুকা‍র্য ও হোটেলের বিলাশবহুল কক্ষ

রয়েল ক্রিসেন্টের নকশা ও নির্মাণশৈলী

রয়েল ক্রিসেন্টের গোটা ভিত্তিটাই (Foundation) নির্মিত মসৃণ বর্গাকৃতির বড় বড় পাথর দিয়ে, পদ্ধতিকে স্থাপত্যবিদ্যার পরিভাষায় বলা হয় রাস্টিকেসন (Rustication)। ভিত্তির ওপরেই স্থপতি জন উড বিশালাকৃতির কলামের সাহায্যে পাথরের স্থাপত্যশৈলীটি নির্মাণ করেন। পুরো রয়েল ক্রিসেন্টে রয়েছে মোট ১১৪টি বৃত্তাকার কলাম। প্রতিটি কলামের ব্যাস ৩০ ইঞ্চি, লম্বায় যা ৪৭ ফুট পর্যন্ত। একদম মাঝখানের অট্টালিকাটি, যেটি রয়েল ক্রিসেন্ট হোটেলের মূল অংশ, সেটি এক জোড়া জোড় কলামের ওপর দাঁড়িয়ে। রয়েল ক্রিসেন্টের পাথরের স্থাপত্যশৈলীযুক্ত সম্মুখভাগ নির্মাণের পর অনেকের কাছে এর বিভিন্ন অংশ বিক্রি করা হয়। বিক্রির পর মালিকেরা এর সামনের অংশ ঠিক রেখে, পেছনে নিজস্ব স্থপতি দিয়ে বিভিন্ন ডিজাইনের স্থাপনা তৈরি করে। আর তাই রয়েল ক্রিসেন্টের সামনের অংশের পুরো কাঠামোটা সুন্দরভাবে সুষম ও প্রতিসম (Symmetrical) হলেও, পেছনের বিভিন্ন অংশের স্থাপনাগুলোর ডিজাইন, আকার ও উচ্চতায় রয়েছে ভিন্নতা। রয়েল ক্রিসেন্টের সামনেই আছে একটি পরিখা, যা হা-হা (Ha-ha) নামে পরিচিত। এটি বিশেষভাবে তৈরি প্রাকৃতিক পরিখা বিশেষ (Recessed landscape), যার ভেতরের দেয়াল খাড়া ও নিরেট পাথরের তৈরি এবং বাইরের দিক ঢালু এবং ঘাসে আবৃত (Turfed)। এটি করার মূল উদ্দেশ্য দর্শনার্থীরা যাতে চারপাশ থেকে রয়েল ক্রিসেন্টকে দেখতে পেলেও অনুপ্রবেশ করতে না পারে। অনাকাক্সিক্ষত অনুপ্রবেশকারী ঠেকানোর জন্য প্রথম দিকে পরিখাটি গভীর থাকলেও পরে তা ভরাট করে বর্তমান অবস্থায় ফিরিয়ে আনা হয়। রয়েল ক্রিসেন্টের অদূরে অবস্থিত বিখ্যাত রয়েল ভিক্টোরিয়া পার্ক থেকে স্থাপনাটিকে ভালোভাবে দেখা যায়, এ জন্যই মূলত এটি করা। ২০১১ সালে এর চারদিক নিরাপত্তা রেলিং দিয়ে ঘিরে ফেলা হয়। 

রয়েল ক্রিসেন্ট হোটেলের একাংশ

এ সময়ের রয়েল ক্রিসেন্ট হোটেল

আধুনিক ইংল্যান্ডের অন্যতম আকর্ষণীয় ও দৃষ্টিনন্দন স্থাপনা এই রয়েল ক্রিসেন্ট হোটেল। শুধু এর অভিজাত ও আরামপ্রদ রুম ও স্যুটগুলোর জন্যই নয়, রয়েল ক্রিসেন্ট হোটেল বিখ্যাত এর অতুলনীয় ¯পা সার্ভিস ও খাবার রেস্তোরাঁগুলোর (Restaurants) জন্য, যার মেন্যুতে রয়েছে জিভে জল আনা সব খাবার। হোটেলের রুমগুলো থেকে বাইরে তাকালে দেখা যায় এর চারপাশ ঘিরে থাকা অনিন্দ্যসুন্দর সবুজ বাগান ও মনোরম জর্জিয়ান স্থাপত্যশিল্পের নিদর্শনসমূহ। রয়েল ক্রিসেন্ট হোটেলের আরেকটি আকর্ষণীয় দিক হচ্ছে এটি আদৌতে জর্জিয়ান আমলের মিউজিয়াম, যাতে সংরক্ষিত আছে সে আমলের অনেক প্রাচীন শিল্প নিদর্শন। জর্জিয়ান আমলের এক রাজকীয় ও অনিন্দ্যসুন্দর স্থাপনা এই রয়েল ক্রিসেন্ট হোটেল। প্রায় ২৫০ বছর ধরে ইতিহাসের সাক্ষ্য বহন করে চলা এই রয়েল ক্রিসেন্ট হোটেল আরও যুগ যুগ ধরে ভ্রমণপিপাসু মানুষের কাছে এক অপূর্ব সুন্দর নিদর্শন হিসেবে বিবেচিত হবে- এ কথা হলফ করেই বলা যায়।

আবু আহমেদ সুফিয়ান

তথ্যসূত্র : ইন্টারনেট

প্রকাশকাল: বন্ধন ৪৭ তম সংখ্যা, মা‍র্চ ২০১৪

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Scroll to Top