অনিন্দ্যসুন্দর শালিমার গার্ডেন

মোগল সম্রাট শাহজাহানের অনন্য সৃষ্টি ‘তাজমহল’ অনুপম সৌন্দর্য ও নির্মাণশৈলীর কারণে আজও বিখ্যাত। সম্রাট যে শুধু তাজমহল নির্মাণেই তাঁর রুচি ও শিল্পবোধের পরিচয় দিয়েছেন, তা কিন্তু নয়। পাকিস্তানের লাহোরে সম্রাটের রুচি ও শিল্পসত্তার পরিচয় বহন করছে আরও একটি অনন্য স্থাপনা, নাম যার শালিমার গার্ডেন (Shalimar Garden)। তবে শৈল্পিক এ স্থাপনাটি শালামার গার্ডেন নামেও পরিচিত। এটি মোগল সাম্রাজের অভিনব স্থাপত্যিক কৌশলে নির্মিত দুর্গবিশেষ। গার্ডেনটি ষোড়শ-সপ্তদশ শতাব্দীর সংস্কৃতি ও শিল্পকলার অপূর্ব নিদর্শন। স্থাপনাকে ঘিরে রয়েছে উন্মুক্ত জলাধার, খোলা পরিসর ও বাগান, জলাধারের ভেতর দিয়ে নির্মিত সড়ক স্থাপত্যটিকে করেছে মহিমান্বিত।  

শালিমার গার্ডেনের জলাধার

শালিমার গার্ডেনের নির্মাণকাজ ১৬৪১ খ্রিষ্টাব্দে শুরু হয়ে পরের বছরই শেষ হয়। নির্মাণকাজের তদারকি ও তত্ত্বাবধানের দেখভালের দায়িত্ব সম্রাট শাহজাহান তাঁর বিশ্বস্ত সহযোগী খলিলুল্লাহ খানকে দেন। এটি নির্মাণে খলিলুল্লাহ খানকে সহযোগিতা করেন আলী মারদান ও মোল্লা আলাউল মাওলুক তানি। কেন এর নামকরণ শালিমার গার্ডেন, তার উপযুক্ত ব্যাখ্যা কোথাও নেই। তবে রাশিয়ান প্রাচ্যবিশারদ আন্না শুভরোভা তাঁর Lahore: Topophilia of Space and Place বইয়ে লিখেছেন, ‘এটি অবশ্যই কোনো আরবি বা পার্সিয়ান নাম। কারণস্বরূপ তিনি বলছেন, একজন মুসলিম সম্রাট তাঁর নিজ নির্মিত কোনো স্থাপনার নামকরণে কখনোই সংস্কৃত বা হিন্দু নাম ব্যবহার করবেন না।’ শালিমার গার্ডেনের অবস্থান পাকিস্তানের লাহোরের বাঘবানপুরার খুব কাছেই গ্রান্ড ট্রাঙ্ক সড়কে। এটি লাহোর থেকে প্রায় তিন কিলোমিটার উত্তরে।

নি‍র্মাণে শ্বেতপাথরের নান্দনিক ব্যবহার

শালিমার গার্ডেন বিখ্যাত এর দুর্বোধ্য কিন্তু নান্দনিক নকশার কারণে। এটি সমান্তরাল আয়তক্ষেত্র আকারের সুউচ্চ ইটের প্রাচীরে বেষ্টিত। গার্ডেনটি চার বাঘ (Char Bhagh) ধারণার ওপর ভিত্তি করে নির্মিত। এটি উত্তর থেকে দক্ষিণে ৬৫৮ মিটার এবং পূর্ব থেকে পশ্চিমে ২৫৮ মিটার বিস্তৃত। এটির সৌন্দর্য বহুগুণ বাড়িয়েছে এর তিন স্তরবিশিষ্ট ছাদ, যেগুলো একটি থেকে অপরটি চার থেকে পাঁচ মিটার উঁচুতে অবস্থিত এবং প্রতিটি আবার পৃথক নাম ও নামের ব্যাখ্যাসংবলিত। সবচেয়ে ওপরের ছাদের নাম ‘Farah Baksh’ অর্থাৎ ‘Bestower of Pleasure’, মাঝেরটির নাম ‘Faiz Baksh’ অর্থাৎ ‘Bestower of Goodness’ এবং নিচেরটির নাম ‘Hayat Baksh’ অর্থাৎ ‘Bestower of Life’। ছাদগুলোকে বিশেষত্ব প্রদান করেছে মার্বেল পাথরের তৈরি ৪১০টি ফোয়ারা। ওপরের ছাদটিতে আছে ১০৫টি, মাঝেরটিতে আছে ১৫২টি এবং নিচেরটিতে আছে ১৫৩টি ফোয়ারা; যার উপস্থিতি এনে দেয় অনাবিল প্রশান্তি। এখানে আরও আছে ছাউনি শাওয়ান ভাদুম (Sawan Bhadum), নাকারখানা (Naqar Khana), শয়নগৃহ (Khwabgah), রাজকীয় গোসলখানা (Hammam), দি আইয়্যান নামক বিশাল সভাকক্ষ, বিশ্রামঘর, সম্রাজ্ঞীর জন্য পৃথক শয়নকক্ষ, গ্রীষ্মকালীন বাগানের সৌন্দর্য উপভোগের জন্য Baradasies, জনসাধারণের সঙ্গে সম্রাটের সাক্ষাতের জন্য রাজসভা কক্ষ Diwan-e-khas-o-Aam এবং বাগানের দুই প্রান্তে দুটি সুদৃশ্য মিনার। বাগানকে সৌন্দর্য বাড়াতে এখানে আছে হরেক জাতের ফল, ফুল ও সৌন্দর্যবর্ধক বৃক্ষ। ফলের গাছের মধ্যে অন্যতম বাদাম, আপেল, খুবানি ফল, চেরিফল, গোকছা, আম, তুতফল, পিচফল, কুল এবং অম্ল ও মিষ্টি স্বাদের কমলা। ফুলের গাছগুলো এখানে এমনভাবে রোপিত যেন সব ঋতুতেই বাগানে থাকে ফুলের অবারিত সমারোহ। বিশেষ করে গ্রীষ্মকালে তো এখানে ফুলের মেলা বসে। বাগানের সৌন্দর্যবর্ধনের জন্য এখানে রোপণ করা হয়েছিল নানা জাতের ঝাউগাছ।

শালিমার গার্ডেনের একাংশ

শালিমার গার্ডেন ১৯৮১ সালে ‘ওয়াটার গার্ডেন’ নামে সর্বপ্রথম ইউনেসকো ওয়ার্ড হেরিটেজ সাইটের তালিকাভুক্ত হয়। কারণ, এটি মোগল সাম্রাজের অভিনব শিল্পকলা এবং ষোড়শ ও সপ্তদশ শতাব্দীর সংস্কৃতির ধারক ও বাহক। মোগল স্থাপনাগুলো মূলত তৎকালীন ইসলামি, পার্সিয়ান, হিন্দু এবং  মোঙ্গলিয়ান (যার তৎকালীন হিন্দুস্তানের একটি বড় অংশকে কয়েক শতাব্দী ধরে শাসন করেছিল) সংস্কৃতি এবং শিল্পসত্তার পরিচয় বহন করে। অযত্ন এবং অবহেলায় শালিমার গার্ডেন তার স্থাপনার স্থায়িত্ব ও সৌন্দর্য হারাতে শুরু করলে ২০০০ সালে এটিকে বিপজ্জনক স্থাপনা আখ্যা দেয় ইউনেসকো, ওয়ার্ড হেরিটেজ স্থাপনার তালিকা থেকে বাদ দেওয়া হয় একে। যদিও তখনকার পাকিস্তান সরকার এটিকে তালিকা থেকে বাদ না দিয়ে বরং সংস্কার ও পরিচালনার জন্য ইউনেসকোকে অনুরোধ জানায়।

শালিমার গার্ডেনটি মূলত অভিজাত জাইলদার (Zaildar) পরিবারের (যারা বাঘবানপুরার আরাইন (Arain Mian) পরিবার নামে পরবর্তী সময়ে পরিচিতি পায়) জায়গায় নির্মাণ করা হয়েছিল। ইশাকপুরা নামের এই স্থানটি রাজকীয় প্রকৌশলীরা এই প্রকল্পের জন্য নির্বাচন করার কারণ এর অবস্থান এবং ভূমির উপযুক্ততা। যার পরিপ্রেক্ষিতে রাজকীয় প্রকৌশলীরা তৎকালীন জাইলদার পরিবারের প্রধান মুহাম্মদ ইউসুফকে এই জায়গাটি সম্রাট শাহজাহানকে উপঢৌকনস্বরূপ প্রদানে চাপ দেয় এবং এর বিনিময়ে রাজকীয় মিয়ান উপাধিতে জাইলদার পরিবারকে অনুমতি প্রদানের প্রতিশ্রুতি দেওয়া হয়, যা পরে প্রতিশ্রুতি মোতাবেক বাস্তবায়িত হয়। জাইলদার পরিবার ৩৫০ বছরেরও বেশি সময় ধরে এর গর্বিত রক্ষণাবেক্ষক ছিল কিন্তু ১৯৬২ সালে জেনারেল আইয়ুব খান শালিমার গার্ডেনকে জাতীয়করণ করেন। কারণ, আরিয়ান মিয়ান পরিবারের সদস্যরা জেনারেল আইয়ুব খানের মার্শাল ল-র বিরোধিতা করেছিল। এর আগ পর্যন্ত এখানে প্রতিবছর মেলা চিরাগহান (Mela Chiraghan) উৎসব হতো।

ব‍র্ণিল ফুলবাগানে ঘেরা শালিমার গার্ডেন

এককথায় মোগল ঐতিহ্যের অনুপম নির্দশন এই শালিমার গার্ডেন, যা এখনো পর্যটকদের অন্যতম পর্যটকপ্রিয় স্থান। লাহোরের আরও একটি মোগল নিদর্শন লাহোর কোর্ট শালিমার গার্ডেন থেকে মাত্র সাত কিলোমিটার দূরে। তাই একসঙ্গে দুটি স্থাপনা দেখতে দেশ-বিদেশ থেকে এখানে ছুটে আসেন পর্যটকেরা।  

আশিক মাহমুদ

[email protected]

প্রকাশকাল: বন্ধন ৪৮ তম সংখ্যা, এপ্রিল ২০১৪

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Scroll to Top