পুরান ঢাকার ঐতিহ্য সংরক্ষণ

পুরান ঢাকা একসময় সুপরিকল্পিত, সুন্দর ও ছিমছাম এক নগর ছিল। কিন্তু মুঘল শাসনের পতনের পর থেকে পুরান ঢাকার ভাগ্যে নেমে আসে বিপর্যয়। ব্রিটিশ শাসকরা এ শহরের কিয়দংশের দেখভাল করলেও এখনকার প্রশাসনের অবহেলায় পুরান ঢাকা ধীরে ধীরে হারাতে বসেছে তার আদি শ্রী ও ঐতিহ্য।

পুরান ঢাকার পুরনো রূপ

ইতিহাস বলে, ৭০০ থেকে ১২০০ খ্রিস্টাব্দের মধ্যে ঢাকা অঞ্চলটি নগর হিসেবে গড়ে ওঠে। পুরান ঢাকার প্রশাসনিক কাঠামোতে রয়েছে ৮টি মেট্রোপলিটন থানা। থানাগুলো হলো- হাজারীবাগ, লালবাগ, চকবাজার, বংশাল, ঢাকা সদর বা কোতোয়ালি, সূত্রাপুর, ওয়ারী ও গেন্ডারিয়া। থানাগুলো ঢাকা দক্ষিণ সিটি কর্পোরেশনের অন্তর্ভুক্ত। পুরান ঢাকার পশ্চিমে মোহাম্মদপুর, উত্তরে ধানমন্ডি, নিউমার্কেট, শাহবাগ, রমনা, মতিঝিল ও সবুজবাগ, পূর্বে যাত্রাবাড়ী ও শ্যামপুর এবং দক্ষিণে কামরাঙ্গীরচর থানা ও কেরানীগঞ্জের অবস্থান।

ঐতিহ্যবাহী স্থাপনা এখন

মহানগরীর গুরুত্বপূর্ণ ৯৩টি স্থাপনা ও ৪টি ঐতিহ্যবাহী ভবন রয়েছে পুরান ঢাকায়। এর মধ্যে ফরাশগঞ্জ অঞ্চলের ঋষিকেশ দাস, রেবতী মোহন দাস, বিকে দাস ও ফরাশগঞ্জ রোড, শাঁখারীবাজার এলাকার শাঁখারীবাজার, তাঁতীবাজার ও পন্নীটোলা, সূত্রাপুরের প্যারিদাস রোড ও হেমন্ত দাস রোড এবং রমনা অঞ্চলের বেইলী রোড, মিন্টো রোড এবং হেয়ার রোডের স্থাপনাগুলো গুরুত্বপূর্ণ। সংরক্ষণের অভাবে অনেক স্থাপনাই ধ্বংসের দ্বারপ্রান্তে। আবার অনেক স্থাপনা দখল করে নিয়েছে প্রভাবশালীরা।

এগুলোর মধ্যে ঐতিহ্যবাহী রূপলাল হাউস এখন রয়েছে শ্যামবাজার কৃষিপণ্য আড়ত মালিক সমিতির ব্যবসায়ীদের আওতায়। মসলার গুদাম বানিয়ে নষ্ট করা হচ্ছে এ পুরাকীর্তিকে। রাধাকৃষ্ণ মন্দিরটি দীর্ঘদিন ধরে তালা বন্ধ করে রাখা। ঐতিহাসিক স্থাপনা লালকুঠি বা নর্থব্রুক হল ভবন ব্যবহৃত হচ্ছে ঢাকা সিটি কর্পোরেশনের আওতাধীন কমিউনিটি সেন্টার হিসেবে। শঙ্খনিধি নাচঘর ও ভজহরি লজ ভেঙে সেখানে স্কুুল ভবন নির্মাণ করা হয়েছে। সূত্রাপুর জমিদারবাড়ি প্রত্নতত্ত্ব অধিদপ্তরের ঐতিহাসিক নিদর্শনের তালিকায় থাকলেও বাস্তবে সেখানে বসবাস করছেন ফায়ার সার্ভিস অ্যান্ড সিভিল ডিফেন্সের কর্মকর্তা ও স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের কর্মচারীরা। 

পুরান ঢাকার ঐতিহ্যবাহী স্থাপনাগুলোর একটি তালিকা করেছে আর্কিওলজিক্যাল বিভাগ। ১৯৯৯ সালে এ এলাকার ১১টা ভবনকে এই তালিকার অন্তর্ভুক্ত করা হয়। অর্কিওলোজিক্যাল বিভাগের দায়িত্ব শুধু তালিকাভুক্ত করা নয়, পাশাপাশি এগুলো সংরক্ষণ করাও। 

পুরান ঢাকার বাসিন্দারা তাদের নিজস্ব ঐতিহ্য শতবর্ষ ধরে বহন করে আসছে। এটাকে সংরক্ষণ করা দরকার। নষ্ট হতে দেওয়া ঠিক নয়। পুরান ঢাকার অনেক কিছুই হারিয়ে গেছে কালের বিবর্তনে। বিলীন হয়েছে সনাতন ঐতিহ্য। এখনও যা আছে সেটা সংরক্ষণে নিতে হবে বড় ধরনের উদ্যোগ। 

সম্ভাবনায়/ সম্ভাবনাময় পুরান ঢাকা

পুরান ঢাকা তার আদি রূপ ও ঐতিহ্য হারাতে বসেছে। একে কাজে লাগিয়ে একটি পরিকল্পিত ও দর্শনীয় স্থানে পরিণত করতে হবে। এখানে নির্মাণ করা যেতে পারে সুন্দর সব রেস্টুরেন্ট। বিনোদন ও পর্যটন কেন্দ্র, কটেজ। ভারত ও চীন এ রকম করেছে। ঐতিহ্যবাহী স্থাপনাকে তারা সংরক্ষণ করে তা থেকে আয় করছে। প্রচুর পর্যটক সংস্কারকৃত স্থাপনা দেখতে ভিড় জমাচ্ছে। এজন্য সরকার ও বেসরকারি উদ্যোক্তাদের সমন্বিত উদ্যোগের প্রয়োজন।

পুরান ঢাকায় যে পুরনো ভবন রয়েছে সেগুলোকে সংস্কার করে একটি পরিকল্পিত পর্যটন কেন্দ্র হিসেবে গড়ে তোলা সম্ভব আর তার জন্য যেটা দরকার তা হলো সকলের সদিচ্ছা। অন্য কিছুর প্রয়োজন নেই।

আমরা লেখার মাঝে আজ দেখাব পুরান ঢাকার একটি পুরনো ভবনকে সংস্কার করলে কেমন দেখাবে এমন বেশ কিছু বাড়ির চিত্র।

সব কিছু ঠিক আছে এবং ঠিকই থাকবে। শুধু একটু সংস্কার করতে হবে। এটাকে সংস্কার করলে এই স্থান থেকে অনেক সুন্দর সুন্দর ভবনের নকশা বেরিয়ে আসবে।

তারুণ্যের ভাবনায় পুরান ঢাকা

পুরান ঢাকাকে নতুন রূপ দিতে কাজ করছে এ সময়ের তারুণ্য। বিশেষ করে স্থাপত্য নিয়ে যাদের পড়াশোনা। নিজেদের প্রয়োজনে পুরান ঢাকা নিয়ে নানা ধরনের প্রজেক্ট করে থাকে ওরা। ছাত্র অবস্থায় অনেকে এগুলো প্রজেক্ট পেপার হিসেবে থিসিসে জমা দিয়ে থাকে। পুরান ঢাকা নিয়ে নানা রকম গবেষণা হয়েছে এবং হচ্ছে। এছাড়াও পুরান ঢাকা নিয়ে স্থাপত্য বিভাগের পাশাপাশি ভাবছে নগর পরিকল্পনা বিভাগের শিক্ষার্থীরাও।

স্থাপত্য শিক্ষার্থীদের মাঝে পুরান ঢাকা নিয়ে সচেতনতা ক্রমেই বাড়ছে।

এ ব্যাপারে জানতে চাইলে বুয়েটের প্রাক্তন শিক্ষার্থী স্থপতি তাইমুর ইসলাম জানান, পুরান ঢাকা নিয়ে এখন অনেক কাজ হচ্ছে। সেমিনার, সিম্পোজিয়াম হচ্ছে। পুরান ঢাকা নিয়ে আমাদের বিশেষ মহলের এলার্জি রয়েছে। এটা নিয়ে তারা নানামুখী মন্তব্য করেন। এ মানসিকতা থেকে বেরিয়ে আসতে হবে।

চলছে সংস্কার ও সংরক্ষণ

পুরান ঢাকার ঐতিহ্য সংরক্ষণের জন্য কাজ করছে কয়েকটি প্রতিষ্ঠান। এ নিয়ে কোর্টে মামলাও হয়েছে। সরকার কিছু সংস্কার কাজ করেছে বিভিন্ন বেসরকারি প্রতিষ্ঠানের সহায়তায়। এ জায়গার বাসিন্দাদের জমির মালিকানা নিয়ে রয়েছে জটিলতা। এমন সব জটিলতাকে পাশ কাটিয়ে যদি এর উন্নয়নকে সত্যিকারের অর্থে কাজে লাগানো যায় তবে এলাকাটি ঢাকার পাশের একটি লাভজনক পর্যটন কেন্দ্র হিসেবে গড়ে উঠবে। স্থানীয় লোকদেরকে বোঝাতে হবে তাদের একটি বড় সম্পদ রয়েছে। এটা বোঝাতে পারলে এ কাজে ওদের সহায়তার ঘাটতি থাকবে না।

ঐতিহ্য সংরক্ষণের উদ্যোগ 

পুরান ঢাকার ঐতিহ্য ও আদি রূপ সংরক্ষণের জন্য নিজ উদ্যোগে কাজ করছেন স্থপতি তাইমুর ইসলাম। গড়ে তুলেছেন একটি প্রতিষ্ঠান। এই প্রতিষ্ঠানটি মূলত পুরান ঢাকা সংস্কারের কাজ করছে। ২০০৯ সাল থেকে পুরান ঢাকার ওয়ার্ডে ওয়ার্ডে গিয়ে তিনি তৈরি করেছেন পুরান ঢাকার বিস্তারিত ম্যাপ। খুঁজেছেন কোথায় কোথায় রয়েছে ঐতিহ্যবাহী স্থাপনা। এগুলোকে উপস্থাপন করেছেন সরকারের দায়িত্বশীল ব্যক্তিদের কাছে। বিভিন্ন ম্যাপ ও এর সংরক্ষণের জন্য প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ নিতে দিয়েছেন প্রস্তাবনা। 

ঝুঁকিতে থাকা ভবনগুলো

রাজউক ইতোমধ্যে এখানকার হেলে ও ভেঙে পড়া কয়েকটি ঝুঁকিপূর্ণ ভবন অপসারণের সিদ্ধান্ত নিয়েছে। জাতীয় স্বার্থে প্রয়োজনে বৃহত্তর অভিযান পরিচালনা করতে তারা বদ্ধপরিকর। বুয়েটের পুরকৌশল বিভাগের প্রধান অধ্যাপক ড. মেহেদি আহমেদ আনসারী বলেন, এই মুহূর্তে ভেঙে ফেলার জন্য ডিসিসির তালিকাভুক্ত ভবনগুলোর গায়ে বট-পাকুড়ের শেকড় গজিয়েছে। অত্যধিক বৃষ্টি বা মাঝারি মানের ভূমিকম্প হলেই এসব ভবনের টিকে থাকা মুশকিল হয়ে পড়বে। কাজেই অপসারণের কোনো বিকল্প নেই। তার মতে, ইউএনডিপির সহায়তায় কমপ্রিহেনসিভ ডিজাস্টার ম্যানেজমেন্ট প্রজেক্টের আওতায় একটি জরিপ চালানো হয়। এতে দেখা যায়, ঢাকা শহরের ৭২ হাজার ভবন নীতিমালা অনুসরণ করে তৈরি হয়নি। তবে সবচেয়ে বেশি ঝুঁকির মধ্যে রয়েছে পুরান ঢাকার ভবনগুলো।

অতঃপর পুরান ঢাকা

রাজধানী শহর ঢাকাকে বাসযোগ্য করে তুলতে বদলে ফেলতে হবে এর পরিকাঠামো। রাজধানীকে বাসযোগ্য করার স্বার্থে এর কোনো বিকল্প নেই। বাসযোগ্য করতে হলে এই শহরের পুরনো ভবন ভাঙতে হবে। আবাসন ব্যবসায়ীদের মতে, এখানে বহুতল ভবন নির্মাণ করতে হবে। স্থানীয়রা তাদের বাপ-দাদার সম্পদ রক্ষা করতে চায়। অনেক ভবনের উপর রয়েছে সরকারি নিষেধাজ্ঞা। আর পুরান ঢাকা নিয়ে যারা গবেষণা করছেন তারা বলছেন, ঐতিহ্যবাহী জায়গাগুলোকে সংস্কার করে ভারত বা চীনের মতো হেরিটেজ এলাকা হিসেবে গড়ে তোলার সুযোগ রয়েছে।

এ সংকট সমাধানে এখন প্রয়োজন ভবিষ্যতের কথা চিন্তা করে বাস্তব অবস্থার প্রেক্ষিতে সরকারের পক্ষ থেকে দ্রুত সিদ্ধান্তে আসা। তবেই হেরিটেজ এলাকা হিসেবে পাওয়া যাবে পুরান ঢাকার ঐতিহ্যকে।

পুরনো সবকিছুই কেন যেন ছেড়ে যেতে ইচ্ছে করে না। বরং ইচ্ছে করে বার বার পুরনোকে আঁকড়ে ধরতে। আর তাই পুরান ঢাকাবাসী চায় পুরান ঢাকা ফিরে পাক তার সোনালি ঐতিহ্য, সগৌরবে জানান দিক তার শৌর্যবীর্য। 

আনিস রহমান

প্রকাশকাল: বন্ধন ৩২ তম সংখ্যা, ডিসেম্বর ২০১২

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Scroll to Top